একলা চলো রে by আতাউর রহমান
আমার আদি বাড়ি নোয়াখালীতে জেনে বন্ধু-বান্ধবরা ঠাট্টা করে বলে, নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধী যখন গিয়েছিলেন তখন নোয়াখাইল্লারা গান্ধীজীর ছাগল জবাই করে খেয়ে ফেলেছিলেন। নোয়াখাইল্লারা নাকি সবই পারে। আমি এই ধরনের উক্তিতে নিছক ঠাট্টার উপাদান ছাড়া আর কিছুই পাই না।
একটি বই সম্পর্কে পড়তে গিয়ে এই কথাগুলো মনে হলো। বইটির শিরোনাম ‘নোয়াখালীর দুর্যোগের দিনে’, লেখিকা অশোকা গুপ্ত। এই ভদ্রমহিলা তেমন বড়সড় লেখিকা নন। স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ আমলের অন্যতম দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, আইসিএস অফিসার। চট্টগ্রামে তিনি জেলা জজ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। অশোকা গুপ্ত ছিলেন অল ইন্ডিয়া উইমেন্স কনফারেন্সের একজন সক্রিয় কর্মী। আমি নোয়াখালীর জয়াগে অবস্থিত গান্ধী আশ্রমে গিয়েছি। এখনও সেখানে গান্ধীজীর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এখনও চরকা চলে, সুতা বুনানো হয়। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে অহিংসার সামান্য রেশ হলেও সেখানে পাওয়া যায়। নোয়াখালীতে হিন্দু-মুসলমানদের প্রলয়ঙ্করী দাঙ্গা থামাতে গান্ধী নোয়াখালীতে গিয়েছিলেন। ডাইরেক্ট অ্যাকশনের স্লোগানের জিগিরে ১৯৪৬-এর ১৪ আগস্ট কলকাতার হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা শুরু হয়। কলকাতা শহর রক্তস্নাত হয়েছিল এবং বেশ কিছুদিন প্রশাসন নিশ্চল হয়ে পড়ে ছিল। এই হত্যালীলা ভারতের মধ্যে ছিল নজিরবিহীন। আমার বাবা তখন কলকাতায় চাকরি করতেন। এই হত্যাযজ্ঞের সময় আমি ও আমার মা নোয়াখালীতে নানার বাড়িতে অবস্থান করছিলাম। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, আমার বাবা বেঁচে নেই। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়েছেন। হঠাত্ তিনি এক গভীর রাতে আবির্ভূত হলেন আমার নানার বাড়িতে। পরনে হাফপ্যান্ট ও হাফশার্ট এবং তার বেঁচে আসার কাহিনী আমাদের শোনালেন। সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনী। এক হিন্দু পরিবার তাকে বাঁচিয়েছিল। আসলে পৃথিবীতে দু’রকমের মানুষ হয়। ভালো ও খারাপ, এক্ষেত্রে জাতি-ধর্মের প্রশ্ন অবান্তর। দাঙ্গা এক অর্থে যুদ্ধের চেয়ে ভয়ঙ্কর। যুদ্ধে গুলি খেয়ে লোক মারা যায়, আর দাঙ্গায় মানুষ মানুষের হাতের ছুরি বা ঠাণ্ডা মাথা আততায়ীর তরবারির আঘাতে নিহত হয়। গান্ধীর নোয়াখালীর দিনপঞ্জি সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। গান্ধীকে তখন উল্কার মতো ছুটতে হয়েছিল নোয়াখালী ও বিহারের দাঙ্গা-হাঙ্গামা থামানোর কাজে; কিন্তু নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যূপকাষ্ঠে তিনি স্বয়ং বলি হলেন। দেশ বিভাগের পরে গান্ধী বড় একা হয়ে পড়েছিলেন। তার একাকিত্বের বর্ণনা পাওয়া যায় লেরি কলিনস ও ডমিনিক লেপিয়ারের ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইয়ে। গান্ধী নোয়াখালীতে চার মাস ছিলেন। অশোকা গুপ্তের ‘নোয়াখালীর দুর্যোগের দিনে’ বইতে লেখিকার বেশকিছু নিজস্ব মতামত পাওয়া যায়। তিনি আমাদের জানাচ্ছেন, দেশ বিভাজনের মতো ঘটনা অত্যন্ত মর্মন্তুদ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, ফলে বহু মানুষ বাস্তুহারা হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। বাইবেলের ‘এক্সোডাস’ থেকে নিয়ে সব ‘এক্সোডাস’ই মানুষের জীবনে দুঃখ বয়ে আনে। অশোকা গুপ্ত গান্ধীকে নিয়ে অনেক সরস গল্পের অবতারণা করেছেন তার বইয়ে। এলাহাবাদের জগদীশ-স্বামী নোয়াখালীতে তার সঙ্গে কর্মরত ছিলেন। একদিন গান্ধী অশোকা গুপ্ত’র কাছে জানতে চান—স্বামী কোথায়। অশোকা গুপ্ত মনে করেছিলেন গান্ধী তার পতি বা স্বামীর কথা জানতে চাচ্ছেন এবং তিনি তার স্বামী সম্পর্কে জবাব দেন। তখন গান্ধী তাকে বলেছিলেন, ত্রাণকার্যে এসেও যদি কারও মন ঘরে পড়ে থাকে, তাহলে তার ঘরেই ফিরে যাওয়া উচিত। গান্ধী ছাগলের বহর নিয়ে চলাফেরা করতেন। তার সঙ্গে দুটি দুগ্ধবতী মা-ছাগল ও চারটি ছানা ছিল। এদের দেখাশোনা অশোকা গুপ্তকে করতে হতো। একজন আইসিএস জজের স্ত্রীর জন্য এ ছিল এক কৃচ্ছ্রসাধন। গান্ধীজী নেহরু, বল্লভ ভাই প্যাটেল, মাওলানা আজাদের ওপর তার নিজস্ব অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেন অথচ উনি কংগ্রেসের কোনো পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন না। তাহলে তিনি কি রাজনীতির মানুষ, সন্ন্যাসী অথবা সমাজের ত্রাণকর্তা? উনি অনেক অদ্ভুত কথা বলেছেন। একদল মানুষকে তিনি হরিজন বলে চিহ্নিত করেছেন। অযোধ্যার অধিপতি রামকে তিনি পতিতপাবন বলতেন, কাশী আর কাবাকে এক চোখে দেখতেন, ঈশ্বর আর আল্লাহকে এক বলতেন। সবার সত্মতি চাইতেন। তিনি দেশ বিভাজন চাননি কিন্তু তার শিষ্যরা এ ব্যাপারে তার কথা শোনেননি। ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’ বইয়ে পড়েছিলাম গান্ধীর প্রিয় গান ছিল—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’ এই গান কণ্ঠে ধারণ করে তিনি নোয়াখালীতে দাঙ্গার সময়ে একহাতে হারিকেন লণ্ঠন অন্য হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের আরও কয়েকটি গান গান্ধীর প্রিয় ছিল। জাতির পিতা গান্ধী, একশ’, পাঁচশ’ এবং হাজার টাকার নোটে ছাপা হয়ে বসে আছেন অথচ অন্তরে এই নিঃসঙ্গ মানুষটিই সম্ভবত ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে ট্র্যাজিক চরিত্র। আমার ধারণায় বেশিরভাগ বড় মানুষই ব্যক্তিগত জীবনে ট্র্যাজিক হয়ে থাকেন।
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
লেখক : অভিনেতা ও নাট্যনির্দেশক
No comments