নির্ভরশীলতা নয়, চাই সহযোগিতা by ফারুক চৌধুরী
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তাঁর এই সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে, তা বিশ্লেষণ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও প্রবীণ কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফর নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে আরও এক ধাপ কাছে নিয়ে এল। দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা নিবিড়তর করতে, নিয়মিত অংশীদারি সংলাপ অনুষ্ঠিত করার যে সমঝোতাপত্র সই হয়েছে, তা যদি সঠিক প্রস্তুতি অন্তে, সঠিক পর্যায়ে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে তা সহযোগিতার একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক আলোচনায় আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া, যেমন মার্কিন বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, বিশেষায়িত মার্কিন উন্নয়ন তহবিল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এবং বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত যে খুনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে, তাকে ফিরিয়ে আনতেও তা সহায়ক হবে। এই নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে দুই দেশের ভেতর যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, তা নিরসনও সহজসাধ্য হবে।
এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে একজন গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাগত অতিথি হিসেবে হিলারি ক্লিনটনকে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুণগত মানের ওপর মন্তব্য করতে হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিতে হয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়া এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার কথাগুলো তুলে ধরতে হয়েছে। আশা এই যে ইলিয়াস আলীকে যারা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে গুম করেছে, জনাব আলীকে মুক্ত করে তাদের সঠিক রূপ উন্মোচন করতে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এবং তাতে সফল হবে। রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়নের জন্য এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তা নিতান্তই মূল্যবান। হত্যা ও গুমের রাজনীতির অবসান ঘটাতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আগামী সাধারণ নির্বাচন যাতে মুক্ত, স্বাধীন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অংশীদারিতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেটি যে কেবল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন বলেই নয়, দেশের জনগণও সেই ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। টেকসই গণতন্ত্রই উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে পারে, যে কথা হিলারি ক্লিনটন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। অন্যথায় এই সফর কোনো স্থায়ী সুফলই বয়ে আনবে না।
২০০৫ সালে তাঁর কন্যা চেলসিসহ বাংলাদেশ সফর যে তাঁর মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়েও একটি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, তা হিলারি ক্লিনটন এই সফরকালে উল্লেখ করেছেন। এই সফরে যে তিনি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তা সেই আগ্রহেরই পরিচায়ক। একই সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নাগরিক সমাজ ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
হিলারি ক্লিনটন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগামীর রাজনীতিতে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অবশ্যই রইবে। অতএব, তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর বর্তমান বংলাদেশ সফরের সার্থকতা যদি আমরা আমাদের অর্জনের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি, তা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচকই হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে গত বছরেই আমরা যুরক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় করেছি এবং সেই দেশ থেকে আমদানি করেছি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এই বিনিয়োগকে অনেক গুণ বাড়াতে পারে। আর সেজন্য প্রয়োজন অব্যাহত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ করে তাঁর কলকাতা সফর যদি সহায়ক হয়, তাহলে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাব। আশা করি, ৭ মে, ২০১২ থেকে দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে যৌথ কমিশন বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, তার ওপর এই সফরটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা অবশ্যই একজোট। তবে সেই প্রক্রিয়ায় আমরা যেন আমাদের নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার স্বাধীনতার ওপর কোনোভাবে আঘাত হানতে না দিই। এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যথাযথ শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতি যেন কখনো যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশনির্ভর না হয়, কেবল অন্য দেশের স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ উন্নয়নে যেন আমাদের দেশের রাজনীতি ব্যবহূত না হয়। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে তার পরিণাম বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে নিয়মিত বার্ষিক আলোচনায় আমরা আমাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া, যেমন মার্কিন বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, বিশেষায়িত মার্কিন উন্নয়ন তহবিল মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি এবং বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ বৃদ্ধি সম্বন্ধে প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে সক্ষম হব। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত যে খুনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে, তাকে ফিরিয়ে আনতেও তা সহায়ক হবে। এই নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে দুই দেশের ভেতর যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, তা নিরসনও সহজসাধ্য হবে।
এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যে একজন গুরুত্বপূর্ণ অভ্যাগত অতিথি হিসেবে হিলারি ক্লিনটনকে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গুণগত মানের ওপর মন্তব্য করতে হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপের তাগিদ দিতে হয়েছে, রাজনৈতিক অঙ্গনে শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের নিহত হওয়া এবং বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার কথাগুলো তুলে ধরতে হয়েছে। আশা এই যে ইলিয়াস আলীকে যারা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে গুম করেছে, জনাব আলীকে মুক্ত করে তাদের সঠিক রূপ উন্মোচন করতে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে এবং তাতে সফল হবে। রাজনীতির গুণগত মান উন্নয়নের জন্য এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য তা নিতান্তই মূল্যবান। হত্যা ও গুমের রাজনীতির অবসান ঘটাতে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
আগামী সাধারণ নির্বাচন যাতে মুক্ত, স্বাধীন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অংশীদারিতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। সেটি যে কেবল মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছেন বলেই নয়, দেশের জনগণও সেই ধরনের একটি নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। টেকসই গণতন্ত্রই উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিতে পারে, যে কথা হিলারি ক্লিনটন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সবিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। অন্যথায় এই সফর কোনো স্থায়ী সুফলই বয়ে আনবে না।
২০০৫ সালে তাঁর কন্যা চেলসিসহ বাংলাদেশ সফর যে তাঁর মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়েও একটি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে, তা হিলারি ক্লিনটন এই সফরকালে উল্লেখ করেছেন। এই সফরে যে তিনি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এবং স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, তা সেই আগ্রহেরই পরিচায়ক। একই সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নাগরিক সমাজ ও স্বাধীন গণমাধ্যমের ভূমিকার কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
হিলারি ক্লিনটন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেটিক দলের একজন সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগামীর রাজনীতিতে তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা অবশ্যই রইবে। অতএব, তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর বর্তমান বংলাদেশ সফরের সার্থকতা যদি আমরা আমাদের অর্জনের মাধ্যমে তুলে ধরতে পারি, তা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচকই হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে গত বছরেই আমরা যুরক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানি আয় করেছি এবং সেই দেশ থেকে আমদানি করেছি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের সামগ্রী। কিন্তু বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ মাত্র এক বিলিয়ন ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি এই বিনিয়োগকে অনেক গুণ বাড়াতে পারে। আর সেজন্য প্রয়োজন অব্যাহত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে বিশেষ করে তাঁর কলকাতা সফর যদি সহায়ক হয়, তাহলে আমরা তাকে সাধুবাদ জানাব। আশা করি, ৭ মে, ২০১২ থেকে দিল্লিতে অনুষ্ঠেয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যে যৌথ কমিশন বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে, তার ওপর এই সফরটি একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আমরা অবশ্যই একজোট। তবে সেই প্রক্রিয়ায় আমরা যেন আমাদের নিজেদের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রাখার স্বাধীনতার ওপর কোনোভাবে আঘাত হানতে না দিই। এই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের যথাযথ শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের দেশের রাজনীতি যেন কখনো যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশনির্ভর না হয়, কেবল অন্য দেশের স্বল্পমেয়াদি অথবা দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ উন্নয়নে যেন আমাদের দেশের রাজনীতি ব্যবহূত না হয়। পাকিস্তানের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি যে তার পরিণাম বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ হতে পারে।
ফারুক চৌধুরী: সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও কলাম লেখক।
zaaf@bdmail.net
No comments