‘বিপন্ন বোটানিক গার্ডেন’ by দ্বিজেন শর্মা
শিরোনামটি ছিল ডেইলি স্টার প্রত্রিকার ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১০ তারিখের শীর্ষ সংবাদ সংবাদ শিরোনাম।
বোটানিক গার্ডেনের মধ্য দিয়ে একটি ড্রেজিং পাইপলাইন বসানো নিয়ে উত্তপ্ত বঙ্গানুবাদ আসলে এ ধরনের উদ্যান সম্পর্কে সব সরকারের স্বল্প জ্ঞান ও চিরাচরিত ঔদাসিন্যেরই বহিঃপ্রকাশ, যারা একে বিনোদন-উদ্যানের অধিক কিছু ভাবে না।
বোটানিক গার্ডেনের মধ্য দিয়ে একটি ড্রেজিং পাইপলাইন বসানো নিয়ে উত্তপ্ত বঙ্গানুবাদ আসলে এ ধরনের উদ্যান সম্পর্কে সব সরকারের স্বল্প জ্ঞান ও চিরাচরিত ঔদাসিন্যেরই বহিঃপ্রকাশ, যারা একে বিনোদন-উদ্যানের অধিক কিছু ভাবে না।
কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বোটানিক গার্ডেন একটি বহুমাত্রিক গবেষণা সংস্থা। একটি একাডেমি। পরিতাপের বিষয়, পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত এই উদ্যানের তেমন কোনো লক্ষ্য নির্ধারিত ছিল না, যা স্বাধীন বাংলাদেশেও আর সংশোধিত হয়নি। হার্বেরিয়াম ও বোটানিক গার্ডেন অভিন্ন কাঠামোর অন্তর্গত থাকাই সাধারণ নিয়ম, কিন্তু আমরা তার ব্যত্যয় ঘটিয়েছি। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এগুলো বিচ্ছিন্ন ছিল। প্রথমটি গঠিত হয়েছে অধ্যাপক সালার খানের ব্যক্তিগত উদ্যোগে, দ্বিতীয়টি সরকারিভাবে। মধ্য নব্বইয়ে হার্বেরিয়ামটি আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয়করণ করলেও তা বোটানিক গার্ডেনের সঙ্গে যুক্ত হয়নি। এমন কোনো ভাবনার আলামত দেখা যায়নি।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র থাকাকালে (১৯৫৬-৫৮) আমাদের কোনো জাতীয় হার্বেরিয়াম ও জাতীয় বোটানিক গার্ডেন ছিল না। দুর্লভ বা অজানা প্রজাতি শনাক্ত করার জন্য আমাদের শিক্ষকেরা কলকাতার ভারতীয় ন্যাশনাল বোটানিক গার্ডেন ও লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের হার্বেরিয়ামের দ্বারস্থ হতেন। আমরা এ দুটি উদ্যান সম্পর্কে বইপত্রে বিস্তারিত পড়েছি এবং স্বদেশে এমন উদ্যান ও হার্বেরিয়ামের স্বপ্ন দেখেছি। এ দুটি সংস্থার নির্মাণ শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। আগেই বলেছি, বিচ্ছিন্নভাবে, যদিও ব্রিটিশ আমলের বোটানিক্যাল সার্ভের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই ছিল। এই সংস্থার অধীনেই দেশের উদ্ভিদ সন্ধান, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য হার্বেরিয়াম ও বোটনিক্যাল উদ্যান নির্মিত হতো।
আমাদের জাতীয় বোটানিক গার্ডেনের প্রথম কিউরেটর ছিলেন আমার সহপাঠী সোমেশ্বর দাস। আমি মগবাজারে তাঁর অস্থায়ী কার্যালয়ে অনেকবার গিয়েছি এবং বোটানিক গার্ডেনের নীলনকশা দেখার সুযোগ পেয়েছি। কাগুজে নকশা থেকে বাগানের ত্রিমাত্রিক কাঠামো বোঝার জ্ঞান না থাকলেও মনে হয়েছে, কাজটি বনবিভাগের নয়। তাই শুরুতেই সন্দেহ থেকে গিয়েছিল। তারপর অনেক বছর বিদেশ থেকেছি, লন্ডনের কিউ গার্ডেনসহ অনেকগুলো বোটানিক উদ্যান ও পার্ক দেখেছি এবং দেশে এলেই আমাদের বোটানিক উদ্যানে ছুটে গিয়েছি। প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। এটিকে বুনো পার্ক ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
আমার ভুল হতে পারে ভেবে বোটানিক গার্ডেন বস্তুটি কী তা জানার জন্য কিউ উদ্যানের কিউরেটরকে একটি চিঠি লিখি এবং উত্তরে তিনি জানান, ‘অন্যান্য উদ্যানের তুলনায় বোটানিক গার্ডেনের কিছু বাড়তি চাহিদা থাকে। আর সেগুলো হলো, সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্ম ও সর্বসাধারণকে তা দেখানো। সাধারণভাবে বোটানিক গার্ডেন হবে স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় চাহিদার অনুপুঙ্খ সমীক্ষানির্ভর। এতে থাকা চাই সংগৃহীত উদ্ভদরাজির বিনোদনমূল্যের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য।’ তিনি আমাকে একটি বই The role and goal of tropical Botanical gardens পড়তেও লেখেন। বইটি থেকে মালয়েশিয়ায় প্রথম বোটানিক গার্ডেন প্রতিষ্ঠা ১৯৭৪ উপলক্ষে মালয় রিম্বা ইলমু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আহমেদ ইব্রাহিমের স্বাগত ভাষণে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু পঙিক্ত উদ্ধৃত হলো। ‘...বোটানিক গার্ডেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে।... এটি কোনো প্রদর্শবস্তুর পার্ক বা সুন্দর ফুলবাগান হিসেবে নয়, পরিকল্পিত হয়েছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। ... হবে একটি বিদ্যালয়, উদ্ভিদ গবেষণার একটি কেন্দ্র... অর্জন করবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।... এখানে উদ্ভিদবিদ্যার গ্রন্থাগারসহ হার্বেরিয়াম থেকে কম্পিউটারে ধৃত তথ্যানুসন্ধান কেন্দ্রও গড়ে তোলা যায়। এখানে শুধু বাগানকর্মী নয়, থাকবেন ট্যাক্সোনমিস্ট, হর্টিকালচারিস্ট, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, ইকোলজিস্ট ও উদ্ভিদশারীরবিদ। আমাদের উদ্যানের তিনটি লক্ষ্য: ১. সম্ভাব্য সর্বাধিকসংখ্যক মালয়শীয় উদ্ভিদপ্রজাতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ; ২. শ্রেণীবিন্যাস থেকে উদ্ভিদরসায়ন পর্যন্ত এগুলোর পরীক্ষা এবং এভাবে সম্ভাবনাশীল প্রজাতিগুলো শনাক্তি; ৩. এসব প্রজাতির বৃদ্ধির শর্তাবলী, পুষ্টিবস্তুর চাহিদা, প্রজননতত্ত্ব জানা; যাতে এগুলোর ইকোসিস্টেমের জ্ঞান আমাদের নাগালে আসে।... বোটানিক গার্ডেন কার্যত প্রায়োগিক উদ্ভিদবিদ্যার সঙ্গে তত্ত্বীয় উদ্ভিদবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটায়।... বোটানিক গার্ডেন গবেষণার স্থায়ী আগ্রহ ও মূল্য আছে। ... আমাদের নার্সারি ও ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যের জন্য চাই আরও বৈচিত্র্য, আরও গাছপালার ভ্যারাইটি এবং তা অনাবাদি অঞ্চল পুনরুদ্ধার, ক্ষয়প্রবণ আবাসিক এলাকা ও বঞ্চিত শহরকেন্দ্র উন্নয়নের জন্য।... আমরা একে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে চাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রমের সঙ্গে এবং আশা করি শিক্ষার্থীরা এখানকার নানা গবেণষার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবে। আমরা জনসাধারণকেও দূরে রাখতে চাই না, বরং দেখাতে চাই যে এটি তাদের জীবনেও কল্যাণমুখী প্রভাব ফেলবে। আশা করি, কয়েক বছরের মধ্যেই এটি মালয়েশিয়া, এমনকি গোটা উষ্ণমণ্ডলের জন্য কল্যাণমুখী ভূমিকা রাখতে শুরু করবে।...’
আমাদের আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদা হার্বেরিয়াম জাতীয়করণের মাধ্যমে এই যাত্রার যে শুভ সূচনা সম্পন্ন করেছিলেন, এবার বোটানিক উদ্যানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তা সম্পূর্ণ করবেন।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র থাকাকালে (১৯৫৬-৫৮) আমাদের কোনো জাতীয় হার্বেরিয়াম ও জাতীয় বোটানিক গার্ডেন ছিল না। দুর্লভ বা অজানা প্রজাতি শনাক্ত করার জন্য আমাদের শিক্ষকেরা কলকাতার ভারতীয় ন্যাশনাল বোটানিক গার্ডেন ও লন্ডনের কিউ বোটানিক গার্ডেনের হার্বেরিয়ামের দ্বারস্থ হতেন। আমরা এ দুটি উদ্যান সম্পর্কে বইপত্রে বিস্তারিত পড়েছি এবং স্বদেশে এমন উদ্যান ও হার্বেরিয়ামের স্বপ্ন দেখেছি। এ দুটি সংস্থার নির্মাণ শুরু হয়েছিল ষাটের দশকে। আগেই বলেছি, বিচ্ছিন্নভাবে, যদিও ব্রিটিশ আমলের বোটানিক্যাল সার্ভের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনেই ছিল। এই সংস্থার অধীনেই দেশের উদ্ভিদ সন্ধান, সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য হার্বেরিয়াম ও বোটনিক্যাল উদ্যান নির্মিত হতো।
আমাদের জাতীয় বোটানিক গার্ডেনের প্রথম কিউরেটর ছিলেন আমার সহপাঠী সোমেশ্বর দাস। আমি মগবাজারে তাঁর অস্থায়ী কার্যালয়ে অনেকবার গিয়েছি এবং বোটানিক গার্ডেনের নীলনকশা দেখার সুযোগ পেয়েছি। কাগুজে নকশা থেকে বাগানের ত্রিমাত্রিক কাঠামো বোঝার জ্ঞান না থাকলেও মনে হয়েছে, কাজটি বনবিভাগের নয়। তাই শুরুতেই সন্দেহ থেকে গিয়েছিল। তারপর অনেক বছর বিদেশ থেকেছি, লন্ডনের কিউ গার্ডেনসহ অনেকগুলো বোটানিক উদ্যান ও পার্ক দেখেছি এবং দেশে এলেই আমাদের বোটানিক উদ্যানে ছুটে গিয়েছি। প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। এটিকে বুনো পার্ক ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি।
আমার ভুল হতে পারে ভেবে বোটানিক গার্ডেন বস্তুটি কী তা জানার জন্য কিউ উদ্যানের কিউরেটরকে একটি চিঠি লিখি এবং উত্তরে তিনি জানান, ‘অন্যান্য উদ্যানের তুলনায় বোটানিক গার্ডেনের কিছু বাড়তি চাহিদা থাকে। আর সেগুলো হলো, সংশ্লিষ্ট গবেষণাকর্ম ও সর্বসাধারণকে তা দেখানো। সাধারণভাবে বোটানিক গার্ডেন হবে স্থানীয় অভিজ্ঞতা ও স্থানীয় চাহিদার অনুপুঙ্খ সমীক্ষানির্ভর। এতে থাকা চাই সংগৃহীত উদ্ভদরাজির বিনোদনমূল্যের সঙ্গে শিক্ষামূলক ও বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য।’ তিনি আমাকে একটি বই The role and goal of tropical Botanical gardens পড়তেও লেখেন। বইটি থেকে মালয়েশিয়ায় প্রথম বোটানিক গার্ডেন প্রতিষ্ঠা ১৯৭৪ উপলক্ষে মালয় রিম্বা ইলমু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আহমেদ ইব্রাহিমের স্বাগত ভাষণে আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক কিছু পঙিক্ত উদ্ধৃত হলো। ‘...বোটানিক গার্ডেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে অধিকতর সাফল্যের সঙ্গে মূল্যবান অবদান রাখতে পারে।... এটি কোনো প্রদর্শবস্তুর পার্ক বা সুন্দর ফুলবাগান হিসেবে নয়, পরিকল্পিত হয়েছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। ... হবে একটি বিদ্যালয়, উদ্ভিদ গবেষণার একটি কেন্দ্র... অর্জন করবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি।... এখানে উদ্ভিদবিদ্যার গ্রন্থাগারসহ হার্বেরিয়াম থেকে কম্পিউটারে ধৃত তথ্যানুসন্ধান কেন্দ্রও গড়ে তোলা যায়। এখানে শুধু বাগানকর্মী নয়, থাকবেন ট্যাক্সোনমিস্ট, হর্টিকালচারিস্ট, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ, ইকোলজিস্ট ও উদ্ভিদশারীরবিদ। আমাদের উদ্যানের তিনটি লক্ষ্য: ১. সম্ভাব্য সর্বাধিকসংখ্যক মালয়শীয় উদ্ভিদপ্রজাতি সংগ্রহ ও সংরক্ষণ; ২. শ্রেণীবিন্যাস থেকে উদ্ভিদরসায়ন পর্যন্ত এগুলোর পরীক্ষা এবং এভাবে সম্ভাবনাশীল প্রজাতিগুলো শনাক্তি; ৩. এসব প্রজাতির বৃদ্ধির শর্তাবলী, পুষ্টিবস্তুর চাহিদা, প্রজননতত্ত্ব জানা; যাতে এগুলোর ইকোসিস্টেমের জ্ঞান আমাদের নাগালে আসে।... বোটানিক গার্ডেন কার্যত প্রায়োগিক উদ্ভিদবিদ্যার সঙ্গে তত্ত্বীয় উদ্ভিদবিদ্যার মেলবন্ধন ঘটায়।... বোটানিক গার্ডেন গবেষণার স্থায়ী আগ্রহ ও মূল্য আছে। ... আমাদের নার্সারি ও ল্যান্ডস্কেপ স্থাপত্যের জন্য চাই আরও বৈচিত্র্য, আরও গাছপালার ভ্যারাইটি এবং তা অনাবাদি অঞ্চল পুনরুদ্ধার, ক্ষয়প্রবণ আবাসিক এলাকা ও বঞ্চিত শহরকেন্দ্র উন্নয়নের জন্য।... আমরা একে নিবিড়ভাবে যুক্ত করতে চাই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রমের সঙ্গে এবং আশা করি শিক্ষার্থীরা এখানকার নানা গবেণষার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করবে। আমরা জনসাধারণকেও দূরে রাখতে চাই না, বরং দেখাতে চাই যে এটি তাদের জীবনেও কল্যাণমুখী প্রভাব ফেলবে। আশা করি, কয়েক বছরের মধ্যেই এটি মালয়েশিয়া, এমনকি গোটা উষ্ণমণ্ডলের জন্য কল্যাণমুখী ভূমিকা রাখতে শুরু করবে।...’
আমাদের আশা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একদা হার্বেরিয়াম জাতীয়করণের মাধ্যমে এই যাত্রার যে শুভ সূচনা সম্পন্ন করেছিলেন, এবার বোটানিক উদ্যানটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে তা সম্পূর্ণ করবেন।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।
No comments