বুশ-দালাইলামা বৈঠকঃ যুক্তরাষ্ট্রের শঠতাপূর্ণ কূটনীতি by আহমেদ জামিল
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তিব্বতের বিতর্কিত ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার বৈঠক ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কের মাঝে প্রবল উত্তেজনা সৃষ্টি করে। চীন সরকারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দালাইলামার সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা তার বৈঠক সম্পন্ন করেন।
এই নিয়ে তিনজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট চীনের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দালাইলামার সঙ্গে বৈঠক করলেন। তবে এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তার অপর দুই পূর্বসূরির চেয়ে অনেক বেশি কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। চীনকে ঠাণ্ডা রাখার জন্য হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে প্রচার করা হয়, এ বৈঠকটি কোনো রাজনৈতিক নয়, নিছক একজন বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত্। বিষয়টিকে হালকা করে দেখানোর উদ্দেশ্যে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার পূর্বসূরিদের মতো দালাইলামার সঙ্গে বৈঠক ওভাল অফিসে না করে অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ‘ম্যাপ’ অফিসে করেন।
প্রায় ৪৫ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকের সময় মিডিয়ার প্রবেশাধিকার ছিল না। বৈঠকের কিছু মামুলি তথ্য ছাড়া হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে যা জানা গেছে তা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে বৈঠকের সময় অহিংস আন্দোলন এবং চীনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে ওবামা তিব্বতের মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য, ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখার ক্ষেত্রে দালাইলামার প্রয়াসের প্রশংসা করেন। যা হোক, দালাইলামা এখন তিব্বতের চীনা শাসন মেনে নেয়ার কথা বললেও, সেই সঙ্গে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে চীন সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা চেয়েছেন।
তারপরও চীন সরকার দালাইলামাকে বিপজ্জনক এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে মনে করে থাকে। যে কারণে শুরু থেকে চীন সরকার দালাইলামার ওয়াশিংটন সফরের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। চীন সরকার এ সফর বাতিলের জোর আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা এবার তাতে কর্ণপাত করেননি। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, দালাইলামা গত বছর অর্থাত্ ওবামা ক্ষমতায় বসার মাত্র কয়েক দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেইজিং নাখোশ হবে, এ ভয়ে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে দালাইলামাকে সাক্ষাত্দান করা থেকে বিরত থাকেন। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কঠিন আর্থিক সঙ্কট চলছিল। এ ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করে দেয়।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ওবামা প্রশাসন চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যে কারণে সে সময় ওবামা দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন তার অর্থনৈতিক মন্দা দশা কাটিয়ে উঠছে সে প্রেক্ষাপটে দালাইলামার সঙ্গে চীনের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে সাক্ষাত্ করেছেন ওবামা। যা হোক, শুরুতে হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে দালাইলামার সঙ্গে ওবামার বৈঠককে অরাজনৈতিক এবং নিছক এক বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত্ বলে প্রচার করা হলেও পরে প্রমাণিত হয়েছে এ বৈঠকটি ছিল পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক।
দালাইলামার মুখপাত্র সিমেসোয়া লিয়াজো বলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতীদের সাহায্য করছে। আর তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা ধর্মীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকে সব সময় মার্কিনসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের স্বার্থের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করছে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের ইন্ধনে তিনি এখনও তিব্বতকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত আছেন। কয়েক বছর আগে তিব্বতে যে ভয়াবহ অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে ইন্ধন ছিল দালাইলামার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেরও। লক্ষ্যণীয় দিক হলো, গত বছরের অক্টোবর মাসে দালাইলামা বিতর্কিত অরুণাচল প্রদেশ সফরের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এ থেকে তিব্বত ইস্যু তথা চীনের অখণ্ডতা নাশ তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তত্পরতার ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন আঁতাত আবারও প্রকাশ্যে এলো। আর এ আঁতাত সাম্প্রতিক সময়ের নয়, কয়েক দশকের পুরনো। ভূ-রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশলগত স্বার্থে ও চীনকে চাপে রাখার জন্য চীনের প্রতি তিব্বত কার্ড খেলার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও আগ্রহ অনেক দিনের। ১৯৫৩ সালে ভারতের স্বাধীনতার চতুর্থ বছরে নেহরু সরকার তিব্বতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ট বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিদ্রোহ দমনে চীনা গনমুক্তি ফৌজের দমনাভিযানের কঠোর বিরোধিতা করেছিল।
’৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে আরও বেশকিছু ইস্যুর মতো তিব্বত ইস্যুটিও ছিল। উল্লেখ্য, মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীন বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর মার্কিনসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশের চীন বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারতও শরিক হয়। যা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী তথা বর্তমান সময়ে এ আঁতাত আরও প্রকাশ্য ও জোরদার হয়ে উঠেছে। সুতরাং দালাইলামার বিতর্কিত অরুণাচল রাজ্য সফরের সময় ভারত সরকারের তরফ থেকে কোনো বাধা প্রদান না করা, বরং তাতে প্রকাশ্যে অনুমতি দান করা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার দালাইলামাকে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাত্দান দুইয়ের মাঝে অদ্ভুত এক যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাত্ চীনকে অপদস্ত, বিব্রত এবং ক্ষতিগ্রস্ত করতে ভারত-মার্কিন আঁতাত যে এখন একাট্টা, সেটিই উপরিল্লিখিত দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো।
শুধু ভারত নয়, মূল চীনা ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাইওয়ানকে নিয়েও ওবামা প্রশাসন নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে। চীনের ওপর নতুন করে সামরিক চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে নতুন করে অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের বিশাল সামরিক শক্তিমত্তাকে প্রতিহত করার জন্যই ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে নতুন করে রণসাজে সজ্জিত করতে শুরু করেছে। বুশ প্রশাসন ইতোমধ্যে তাইওয়ানে ৬ দশমিক চার বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। এর পাশাপাশি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্লাক হক হেলিকপ্টারের মতো আরও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসন চীনের ওপর নাখোশ হয়েছে আরও একটি কারণে; তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে বিকাশমান আঞ্চলিক শক্তি এবং ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের আপত্তি।
ওয়াশিংটনের ভয় ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে চীন তাতে ভেটো প্রদান করতে পারে। তাছাড়া ইদানীং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি গোপন তথ্য পাচারের জন্য গুগুলের কার্যক্রম চীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নিয়েও ওয়াশিংটন চীনের প্রতি বিরক্ত। সুতরাং চীনকে বিব্রত করা এবং চাপের মুখে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা চীনা নীতিতে তার কঠোর অবস্থানের কথাও জানান দিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই চীন সরকার ওবামা-দালাইলামা বৈঠকের ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাঝা চৌ বলেছেন, এই বৈঠক তিব্বত বিষয়ে চীনা নীতির পরিপন্থী এবং এই বৈঠকের ব্যাপারে চীন ভীষণ অসন্তুষ্ট। সুতরাং চীনের দাবি সম্পর্ক ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। যা হোক; দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা যে শঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের মতলবী ও দেউলিয়া কূটনীতিরই প্রকাশ ঘটেছে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
প্রায় ৪৫ মিনিট স্থায়ী এই বৈঠকের সময় মিডিয়ার প্রবেশাধিকার ছিল না। বৈঠকের কিছু মামুলি তথ্য ছাড়া হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র বিস্তারিত কিছু জানাননি। তবে প্রাপ্ত তথ্য থেকে যা জানা গেছে তা হলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামার সঙ্গে বৈঠকের সময় অহিংস আন্দোলন এবং চীনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার প্রশংসা করেন। একই সঙ্গে ওবামা তিব্বতের মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য, ভাষা-সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখার ক্ষেত্রে দালাইলামার প্রয়াসের প্রশংসা করেন। যা হোক, দালাইলামা এখন তিব্বতের চীনা শাসন মেনে নেয়ার কথা বললেও, সেই সঙ্গে তিব্বতের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে চীন সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা চেয়েছেন।
তারপরও চীন সরকার দালাইলামাকে বিপজ্জনক এক বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা বলে মনে করে থাকে। যে কারণে শুরু থেকে চীন সরকার দালাইলামার ওয়াশিংটন সফরের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে। চীন সরকার এ সফর বাতিলের জোর আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা এবার তাতে কর্ণপাত করেননি। প্রসঙ্গক্রমে বলা হচ্ছে, দালাইলামা গত বছর অর্থাত্ ওবামা ক্ষমতায় বসার মাত্র কয়েক দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেইজিং নাখোশ হবে, এ ভয়ে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে দালাইলামাকে সাক্ষাত্দান করা থেকে বিরত থাকেন। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কঠিন আর্থিক সঙ্কট চলছিল। এ ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে বিশ্ববাসীর কাছে উন্মুক্ত করে দেয়।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ওবামা প্রশাসন চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যে কারণে সে সময় ওবামা দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেননি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন তার অর্থনৈতিক মন্দা দশা কাটিয়ে উঠছে সে প্রেক্ষাপটে দালাইলামার সঙ্গে চীনের প্রবল আপত্তি উপেক্ষা করে সাক্ষাত্ করেছেন ওবামা। যা হোক, শুরুতে হোয়াইট হাউসের তরফ থেকে দালাইলামার সঙ্গে ওবামার বৈঠককে অরাজনৈতিক এবং নিছক এক বিশিষ্ট ধর্মীয় নেতার সঙ্গে সাক্ষাত্ বলে প্রচার করা হলেও পরে প্রমাণিত হয়েছে এ বৈঠকটি ছিল পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক।
দালাইলামার মুখপাত্র সিমেসোয়া লিয়াজো বলেন, রাজনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র তিব্বতীদের সাহায্য করছে। আর তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাইলামা ধর্মীয় নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ থেকে সব সময় মার্কিনসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের স্বার্থের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করছে।
সাম্রাজ্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের ইন্ধনে তিনি এখনও তিব্বতকে চীন থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত আছেন। কয়েক বছর আগে তিব্বতে যে ভয়াবহ অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে ইন্ধন ছিল দালাইলামার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতেরও। লক্ষ্যণীয় দিক হলো, গত বছরের অক্টোবর মাসে দালাইলামা বিতর্কিত অরুণাচল প্রদেশ সফরের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। এ থেকে তিব্বত ইস্যু তথা চীনের অখণ্ডতা নাশ তথা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে তত্পরতার ক্ষেত্রে ভারত-মার্কিন আঁতাত আবারও প্রকাশ্যে এলো। আর এ আঁতাত সাম্প্রতিক সময়ের নয়, কয়েক দশকের পুরনো। ভূ-রাজনৈতিক এবং সামরিক কৌশলগত স্বার্থে ও চীনকে চাপে রাখার জন্য চীনের প্রতি তিব্বত কার্ড খেলার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতেরও আগ্রহ অনেক দিনের। ১৯৫৩ সালে ভারতের স্বাধীনতার চতুর্থ বছরে নেহরু সরকার তিব্বতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ট বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিদ্রোহ দমনে চীনা গনমুক্তি ফৌজের দমনাভিযানের কঠোর বিরোধিতা করেছিল।
’৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে আরও বেশকিছু ইস্যুর মতো তিব্বত ইস্যুটিও ছিল। উল্লেখ্য, মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীন বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর মার্কিনসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী দেশের চীন বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারতও শরিক হয়। যা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী তথা বর্তমান সময়ে এ আঁতাত আরও প্রকাশ্য ও জোরদার হয়ে উঠেছে। সুতরাং দালাইলামার বিতর্কিত অরুণাচল রাজ্য সফরের সময় ভারত সরকারের তরফ থেকে কোনো বাধা প্রদান না করা, বরং তাতে প্রকাশ্যে অনুমতি দান করা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার দালাইলামাকে হোয়াইট হাউসে সাক্ষাত্দান দুইয়ের মাঝে অদ্ভুত এক যোগসূত্র রয়েছে। অর্থাত্ চীনকে অপদস্ত, বিব্রত এবং ক্ষতিগ্রস্ত করতে ভারত-মার্কিন আঁতাত যে এখন একাট্টা, সেটিই উপরিল্লিখিত দুটো ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো।
শুধু ভারত নয়, মূল চীনা ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া তাইওয়ানকে নিয়েও ওবামা প্রশাসন নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে। চীনের ওপর নতুন করে সামরিক চাপ সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানের কাছে নতুন করে অস্ত্র বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের বিশাল সামরিক শক্তিমত্তাকে প্রতিহত করার জন্যই ওয়াশিংটন তাইওয়ানকে নতুন করে রণসাজে সজ্জিত করতে শুরু করেছে। বুশ প্রশাসন ইতোমধ্যে তাইওয়ানে ৬ দশমিক চার বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করেছে। এর পাশাপাশি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং ব্লাক হক হেলিকপ্টারের মতো আরও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওবামা প্রশাসন চীনের ওপর নাখোশ হয়েছে আরও একটি কারণে; তা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে বিকাশমান আঞ্চলিক শক্তি এবং ইসরাইলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি হয়ে ওঠা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীনের আপত্তি।
ওয়াশিংটনের ভয় ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে চীন তাতে ভেটো প্রদান করতে পারে। তাছাড়া ইদানীং বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও বেইজিং ও ওয়াশিংটনের মধ্যে মতবিরোধ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এর পাশাপাশি গোপন তথ্য পাচারের জন্য গুগুলের কার্যক্রম চীনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নিয়েও ওয়াশিংটন চীনের প্রতি বিরক্ত। সুতরাং চীনকে বিব্রত করা এবং চাপের মুখে রাখার জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামা দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়ে জোর দিয়েছেন। আর প্রেসিডেন্ট ওবামা চীনা নীতিতে তার কঠোর অবস্থানের কথাও জানান দিয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই চীন সরকার ওবামা-দালাইলামা বৈঠকের ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করেছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মাঝা চৌ বলেছেন, এই বৈঠক তিব্বত বিষয়ে চীনা নীতির পরিপন্থী এবং এই বৈঠকের ব্যাপারে চীন ভীষণ অসন্তুষ্ট। সুতরাং চীনের দাবি সম্পর্ক ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে। যা হোক; দালাইলামার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় প্রেসিডেন্ট ওবামা যে শঠতার আশ্রয় নিয়েছিলেন তাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের মতলবী ও দেউলিয়া কূটনীতিরই প্রকাশ ঘটেছে।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও কলাম লেখক
No comments