ইউনিপেটুইউর এমডি ও জিএম গ্রেপ্তার, থানায় শত শত গ্রাহক

বোরকা পরা এক নারী মোহাম্মদপুর থানার বন্ধ কলাপসিবল ফটকে মাথা ঠুকে চিৎকার করছিলেন, ‘ওদের ফাঁসি দেন, নাইলে আমাগো কাছে দ্যান। ওগো কন, আমাগো ট্যাকা ফেরত দিতে।’ তাঁর চারপাশে ছিল ক্ষোভে ফেটে পড়া এ রকম আরও অনেক মানুষ।


কথিত বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) প্রতিষ্ঠান ইউনিপেটুইউর দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের খবরে গতকাল রোববার সকালে এ রকম দৃশ্যেরই অবতারণা হয় মোহাম্মদপুর থানার সামনে।
ইউনিপেটুইউর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুনতাসীর হোসেন ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম) জামশেদুর রহমানকে গত শনিবার রাতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়ে অনেককে পথে বসিয়েছে বলে বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ।
পুলিশের মোহাম্মদপুর এলাকার জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার গোলাম মোস্তফা বলেন, শনিবার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এলাকা থেকে প্রথমে জামশেদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মুনতাসীর হোসেনকে। পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় দুটি প্রতারণার মামলা এবং এ মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।
মহানগর হাকিমের আদালত গতকাল দুই কর্মকর্তার তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
গ্রেপ্তার হওয়া এমডি মুনতাসীর সাংবাদিকদের কাছে বলেন, ২০০৯ সালের অক্টোবরে ব্যবসা শুরু করে ইউনিপেটুইউ সাড়ে ছয় লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে সাড়ে ১২০০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এ থেকে গ্রাহকদের কমিশন বাবদ কিছু অর্থ খরচ হয়েছে। শিল্পকারখানা ও বাগান তৈরির জন্য কিছু জমি কেনা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকে তিনটি হিসাবে ৪১৯ কোটি টাকা জমা রয়েছে। তবে সরকার ব্যাংকের হিসাবগুলো জব্দ করেছে।
জিএম জামশেদুর রহমান পুলিশকে বলেছেন, ইউনিপেটুইউর উপদেষ্টা মিঠু চৌধুরী ২০০ কোটি টাকা নিয়ে মালয়েশিয়ায় পালিয়েছেন। চেয়ারম্যান শাহীদুজ্জামান শাহীন ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ তাহের পালিয়েছেন ভারতে। জামশেদ পুলিশকে বলেছেন, শহীদুজ্জামানের কাছে ৭০ কোটি টাকা রয়েছে।
প্রতারিত গ্রাহকদের সংগঠন ইউনিপেটুইউ মেম্বারস ক্লাবের সভাপতি সরোয়ার মোর্শেদ সাংবাদিকদের বলেন, গত বছরের ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টের আদেশে কোম্পানির লেনদেন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তাঁরা আমানতের টাকা ফেরত পেতে ঘুরছেন। এমডি মুনতাসীর আজ-কাল করতে করতে হঠাৎ করে হওয়া হয়ে যান। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। কিন্তু গত মাসের মাঝামাঝি চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান পালিয়ে যান। সরোয়ার অভিযোগ করেন, সশস্ত্র বাহিনীর দুজন সাবেক কর্মকর্তা ইউনিপেটুইউর কর্মকর্তাদের বাঁচানোর জন্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তদবির করছেন।
ক্ষোভ আর হাহাকার: দুজনকে গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ইউনিপেটুইউর প্রতারিত দাবিদার কয়েক শ গ্রাহক ভিড় করেন মোহাম্মদপুর থানায়। বেলা ১১টার দিকে সংবাদ সম্মেলনের জন্য ওই দুজনকে থানাহাজত থেকে বের করা হলে বিক্ষুব্ধ জনতা মারমুখী হয়ে ওঠেন। জুতা দিয়ে তাঁদের মারতে উদ্যত হন অনেকে। পুলিশের পক্ষে বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে থানা ভবনের ফটকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন গ্রাহকেরা বাইরে দাঁড়িয়ে গালাগাল আর অভিসম্পাত দিতে থাকেন।
দুপুরের দিকে গ্রেপ্তার হওয়া দুজনকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার জন্য মাইক্রোবাসে তোলা হলে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেন গ্রাহকেরা। তাঁরা ওই দুজনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার দাবি করতে থাকেন। অনেকে মাইক্রোবাসের গায়ে আঘাত করেন। একপর্যায়ে পুলিশ তাঁদের সরিয়ে দেয়।
ক্ষুব্ধ লোকজনের মধ্যে বয়সে তরুণ শুভ নামের এক গ্রাহক থানার ফটকে দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, দুই বছর আগে তিনি পরিবার থেকে নিয়ে ২০ লাখ টাকা লগ্নি করেন ইউনিপেটুইউতে। কথা ছিল, ১০ মাসেই বিনিয়োগ করা টাকা দ্বিগুণ হবে। কিন্তু দুই বছর ধরে কোম্পানির কর্তারা কেবলই ঘোরাচ্ছেন, আসল টাকাই ফেরত পাচ্ছেন না। শুভ বলেন, তাঁদের পরিবার এত অর্থকষ্টে পড়েছে যে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর তিনি কোথাও ভর্তি পর্যন্ত হতে পারেননি।
থানার ফটকে দাঁড়ানো একটি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি সোহেল রহমান বলেন, তিনি যাবতীয় সহায় সম্পদ বিক্রি করে ১৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এখন নিঃস্ব হয়ে পথে পথে ঘুরছেন।
মোহাম্মদপুর থানা প্রাঙ্গণে একজন একটি আবেদনপত্রের ফরম নিয়ে ঘুরছিলেন। এতে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর ইউনিপেটুইউর বিরুদ্ধে অভিযোগ লেখা। প্রতারিত দাবিদার ব্যক্তিরা ফরমে নিজেদের নাম ও টাকার অঙ্ক বসিয়ে তা পুলিশের কাছে জমা দিচ্ছিলেন। গতকাল দুপুর পর্যন্ত এ রকম ৩৩টি অভিযোগ জমা পড়েছে। পুলিশ এগুলো যাচাই-বাছাই করছে।

No comments

Powered by Blogger.