পিলখানায় সেনা অফিসারদের নির্মম হত্যাকাণ্ডঃ দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রের অংশ by শেখ শওকত হোসেন নিলু
বড়াইবাড়ি থেকে পিলখানা হত্যাকাণ্ড
সীমান্ত রক্ষায় যে বিডিআর ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলায় বড়াইবাড়িতে জীবন বাজি রেখে ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেদের দেশপ্রেম ও বীরত্ব প্রমাণ করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যে বিডিআর সীমান্ত রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে, সেই বিডিআরের কিছু বিপথগামী সদস্য দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করেছে।
সীমান্ত রক্ষায় যে বিডিআর ভারতীয় আগ্রাসন মোকাবিলায় বড়াইবাড়িতে জীবন বাজি রেখে ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করে নিজেদের দেশপ্রেম ও বীরত্ব প্রমাণ করেছিল, দেশ স্বাধীনের পর থেকে আজ পর্যন্ত যে বিডিআর সীমান্ত রক্ষায় যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে আসছে, সেই বিডিআরের কিছু বিপথগামী সদস্য দেশি-বিদেশি কুচক্রীমহলের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে গত বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করেছে।
আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী যেকোনো বিদেশি আগ্রাসন মোকাবিলা করতে ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম। তাই এ কুচক্রীমহল চেয়েছিল বিপথগামী এই বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ধ্বংস করে দিতে। তারা চেয়েছিল বিডিআর ও সেনাবাহিনীর মধ্যে আক্রোশ-দ্বন্দ্ব ও বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে একেবারে নির্মূল করে দিতে। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি।
আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে আবার ঐক্য ফিরে আসছে এবং বিডিআর পুনর্গঠিত হয়ে আবার নিজস্ব সক্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। ১৮ এপ্রিল বড়াইবাড়ি দিবস উপলক্ষে বিডিআর ও সেনাবাহিনী জওয়ানরা নিজেদের ঐক্য ও সংহতি ফিরে পাবে এটাই দেশবাসীর কামনা।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে কথিত বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা। এত বড় হত্যাকাণ্ড এর আগে কখনও দৃষ্টিগোচর হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি পদাতিক যুদ্ধকে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর একটি হলো হিটলারের বাহিনী কর্তৃক ডানজিক সমুদ্রবন্দর দখল, সেখান থেকে প্রায় সাত লাখ ব্রিটিশ সেনা ও নাগরিককে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়টি হলো জার্মান বাহিনী কর্তৃক রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ দখলের অভিযান (১৯৪৩ সালে)। এই দুটি যুদ্ধেও একদিনে জেনারেলসহ ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যার নজির নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ২৫ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড সুপরিকল্পিত। ইতিহাসের সর্ববৃহত্ হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে।
২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআরের সালাম গ্রহণ করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমত সেইদিন কোনো অঘটন ঘটেনি। অর্থাত্ ২৫ তারিখের হত্যাকাণ্ড যদি সরকারকে অপসারিত করার জন্য পরিচালিত হতো তাহলে ২৪ তারিখেই ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রিরা তা করতে সক্ষম হতো, যা তারা করেছে ২৫ ফেব্রুয়ারি। যদি বিদ্রোহটি শুধু তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করার বিষয় হতো তাহলে ২৪ তারিখে তারা সরকার প্রধানকে স্মাকরলিপি দিয়ে অবহিত করতে পারত। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, কোন অফিসার কোন স্থানে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটা সেই অফিসারের কিংবা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মোটেই নির্ভর করে না। সরকারি সিদ্ধান্তের ওপরে এবং চাকরির বিধান অনুসারে সরকারি চাকরিজীবী সরকারি আইন মেনে নিতে আইনগতভাবে বাধ্য।
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য বিডিআর বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী অন্যতম। তবে সেনাবাহিনী ও বিডিআর বাহিনীকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমেই।
মোটামুটি সেনাবাহিনীর লোকবল এক লাখ পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। বিডিআরের লোকবল ৪২ হাজারেরও উপরে, সেনাবাহিনীর অন্য সব ডিভিশনের মতো বিডিআরেরও একজন প্রধান থাকে। তাকে ডিজি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি বিডিআরের কমান্ডিং অথরিটি হিসেবে গণ্য হন।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমাদের সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দুই দেশের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। গঠিত হয় যৌথ কমান্ড এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান করা হয় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জে. জগজিত সিং অরোরাকে। প্রস্তাবিত যৌথ স্মারক রচনা করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা শ্রী ডিপি ধর। খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদের আপত্তির কারণে সেই স্মারকের কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়। কিন্তু অলিখিত দুটি বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমত, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দ্বিতীয়ত, পররাষ্ট্রনীতি।
অর্থাত্ বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য বেশি সহায়-সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে না তুলে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতো না করে কথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মতো করা বা ভারত কর্তৃক পরিচালিত করা—অর্থাত্ তখনকার সময়ের ভুটানের আঙ্গিকে করা।
কিন্তু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে উপরে উল্লিখিত দুটি অলিখিত সিদ্ধান্তকে পরিহার করেন। এর মূল কারণ ছিল তত্কালীন বিশ্বব্যবস্থায় একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বলয় এবং চীন-পাকিস্তান-সৌদি আরব বলয়। এই ত্রিবিভাজন পরিস্থিতিতে শুধু ভারত-সোভিয়েত বলয়ের মধ্য থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে কারও করদ রাজ্যে পরিণত করতে চাননি। তিনি কাশ্মীরের শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর পরিণতি ও হায়দরাবাদের নিজামের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রথম রাজনৈতিক শিকার হলো প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধু নিজেই সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় কাজটি তিনি করেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে প্রধান ভূমিকা পালনকারী শক্তি ভারতীয় বাহিনীকে সহযোগী বাহিনী হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে। তাদের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সরকারি সেনাবাহিনী ও বিডিআর বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিজের গড়া দল ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ বিভক্ত হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গড়ে উঠল। এর তাত্ত্বিকগুরু সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ। গণসংগঠনের নেতা মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু আর সেনাবাহিনীর মধ্যের নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান ঘটানো হয়।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, সংবাদপত্র ও সেনাবাহিনী পরিচালিত হয় চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপমৃত্যু হলেও সিভিল প্রশাসন ও সেনাপ্রশাসনের চেইন-অব কমান্ড ঠিকই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নতুন তত্ত্ব সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল; তাহলো—‘সিপাহি জনতা ভাই ভাই-জেসিওর উপরে অফিসার নাই।’ এই তত্ত্ব বাস্তবায়িত করতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে আটজন সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর শক্তি ও মর্যাদা নির্ভর করে বাহিনীর কমান্ডের উপরে। ওপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি গড়ে উঠুক প্রথম থেকেই বন্ধু রাষ্ট্র ভারত তা চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, জার্মানি কেউই চায় না তাদের চেয়ে বেশি সামরিক শক্তিতে কেউ বলীয়ান হোক। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
আমি উল্লেখ করেছি সেনাবাহিনীর ও বিডিআর বাহিনী আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে আধুনিক অস্ত্রদ্বারা সজ্জিত থাকে। সেনাবাহিনী থাকে মূলত ক্যান্টনমেন্টে তাদের প্রশিক্ষণ ও নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে; প্রেসিডেন্টের গার্ডরেজিমেন্ট ও এসএসএফ ছাড়া বাকিরা থাকে জরুরি কাজে সরকারকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে।
বিডিআর মূলত সীমান্তরক্ষা, চোরাচালান প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থাকে। বিডিআরের কমান্ড থাকে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হাতে। সরকারের প্রশাসনিক নীতি অনুসারেই এই কমান্ডিং অফিসাররা থাকবে এটা বিডিআরের জওয়ানরা নির্ধারণ করবেন না। এটা নির্ধারিত হবে সরকারের প্রশাসনিক নীতির আলোকে। কিন্তু মনে হয় যারা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার মূল লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কিংবা যারা মনে করেন বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই কিংবা যারা জাতীয় নিরাপত্তা অন্যের হাতে তুলে দিতে চায় তারাই অত্যন্ত কৌশলে সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে একটি মানসিক অসন্তোষ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। গত অন্তর্বর্তী (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের আমলে বিডিআরকে মুদির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কাঁচা টাকা হাতাহাতির ব্যবস্থা করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে লাভ-লোকসানের ছল-চাতুরি করার সুযোগ দিয়েছে অসত্ উদ্দেশ্যে। যা হওয়ার তাই হয়েছে—বিডিআরের অভ্যন্তরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠেছিল। অত্যন্ত কৌশলে ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের সৃষ্টি করা হয় অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে। এর মধ্যে হয়তোবা অফিসারদের অসাবধানি ব্যবহার শত্রুদের কর্ম চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছে। যে প্রতিষ্ঠানের যে কাজ না তাকে দিয়ে সেই কাজ করাতে চাইলে সঙ্কট হবেই, এটাই স্বাভাবিক।
বিডিআরের দায়িত্ব সীমান্ত পাহারা দেয়া। আটা আর চাল বিক্রি করা নয়। তাই ডাল-ভাত কর্মসূচি যারা প্রণয়ন করেছিল তাদের উদ্দেশ্য সত্ মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়নি—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা
পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তের ছোটখাটো সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কোনো বাধা থাকার সুযোগ নেই যে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর থেকে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সিভিল আমলাদের কাউকে কাউকে হয়রানি করা ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আর কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অন্যের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা বিবেকহীন বরফে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় সংসদের মতো পবিত্র জায়গাতে তারা অন্ধ বিচারালয় স্থাপন করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে অপমান করেছে বিশ্বদরবারে।
আবার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ ব্যতিরেকে এসএসএফ দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছে তাদের সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তা। সেই কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো গোয়েন্দা সংবাদ সরকারের কাছে ছিল না। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর জওয়ানদের পক্ষ থেকে তাদের দাবি-দাওয়া সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গাতে। তারপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো প্রকার সতর্ক সংবাদ দিতে পারেনি সরকারকে।
অন্যদিকে এতবড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদের কর্মকর্তাদের আরো একটু বেশি চৌকস হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু কী কারণে তা অনুপস্থিত ছিল তা শুধু ভবিষ্যত্ ইতিহাসই বলতে পারবে। বিডিআরের কর্মসূচি ছিল তিন দিনের জন্য। ২৪ তারিখে প্যারেড, ২৫ তারিখে দরবার হলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও ২৬ তারিখে প্রীতিভোজের কর্মসূচি—যাতে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেননি। ২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রী প্যারেড কর্মসূচি শেষ করে তার সরকারি বাসভবনে ফিরে আসেন। ২৫ তারিখ সকাল ৮টায় দরবার হলের কর্মসূচি ১ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। কর্মসূচি শুরু হয় সকাল ৯টায়। সকাল ৮টায় বিডিআরের ডিজি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বিডিআর বিদ্রোহের সংবাদ দেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা সাহায্য চান। প্রধানমন্ত্রী তাকে বিদ্রোহ দমনে সেনা সাহায্য প্রদানের জন্য আশ্বস্ত করেছিলেন বলে সংবাদপত্রে দেখতে পেয়েছি। তারপর বিডিআরের ডিজি যোগাযোগ স্থাপন করেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে। তিনিও বিদ্রোহ দমনে সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কোনো সাহায্য বা উদ্ধার অভিযান পরিলক্ষিত হয়নি। এরই মধ্যে বিদ্রোহীরা বিডিআরসহ ১১ জন অফিসারকে হত্যা করে। তারপর ছোটে ডিজির বাংলোর দিকে। হত্যা করে ডিজির এক আমন্ত্রিত বন্ধু ও তার স্ত্রীকে। ডিজির স্ত্রীকে খুঁজে বের করে অমানবিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় এবং তারপর হত্যা করা হয়। এরই মধ্যে বিডিআরের বিদ্রোহকে শান্ত করার জন্য যুবপর্যায়ের সরকারি নেতৃত্বকে বিডিআর গেটে প্রেরণ করা হয়। তারা অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদ্রোহের মূলনেতাদের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিদ্রোহীদের মূল নেতা ডিএডি তৌহিদকে সরকারের যুবনেতারা চিনল কেমন করে?
তাহলে কি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের পূর্বযোগাযোগ ছিল? এরা কি তাহলে পূর্ব পরিচিত? পূর্বপরিচিত হতেই পারে। তবে এর মধ্যে আমি কোনো ষড়যন্ত্র দেখতে পাই না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—যে কোনো বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করাই ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক বিধান। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহ দমনে সেই স্বাভাবিক বিধান মেনে কাজ করা হয়নি কেন? আমরা যদি পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব-মিজোরাম প্রদেশে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করলে ভারতীয় বিমানবাহিনী সেখানে কার্পেট বোম্বিং করে বিদ্রোহ দমন করেছিল। ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময় শিখ সম্প্রদায় স্বর্ণমন্দিরকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহ করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে নিষ্ঠুরতম হামলা চালিয়ে স্বর্ণমন্দির ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা। কোনো কিছু না জেনেই বিদ্রোহীদের ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে বিকাল থেকে সারারাত খুঁজে খুঁজে সেনা অফিসারদের হত্যা করার সুযোগ হয়েছে। শুধু এখানেই ঘটনার প্রবাহ থেমে থাকেনি—বিদ্রোহীরা ৪০ ফুট গর্ত করে গণকবরের ব্যবস্থা করেছে। মাটি চাপা দিয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের মধ্যে সেনা অফিসারদের লাশ নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে পিলখানার চর্তুরপাশে তিন মাইল জায়গা খালি করার মাইকিং করা হয়েছিল কী উদ্দেশ্যে? কোন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আজ পর্যন্ত তার কোনো পরিষ্কার ধারণা দেশবাসীকে দেয়া হয়নি। অনেকেই মনে করেন এর ফলে কামরাঙ্গিরচর দিয়ে বহিরাগত হত্যাকারীরা নিরাপদে পিলখানা এলাকা ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি
পিলখানা সেনা হত্যাকাণ্ডের পর বিডিআর বিদ্রোহের রহস্য উদঘাটনে সরকার তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সমন্বয়কারী নিয়োগ করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুক খানকে। তদন্ত কমিটিগুলোর সমন্বিত রিপোর্ট জাতি জানতে পারেনি। যদিও এরই মধ্যে সরকারের সাবেক সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়া হলেও তা তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু পিলখানা সেনা হত্যা তদন্তের সমন্বয়কারী বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছেন, এর সঙ্গে জঙ্গি শক্তিগুলোর হাত থাকতে পারে। যদিও সর
আল্লাহর অশেষ মেহেরবাণীতে সেনাবাহিনী ও বিডিআরের মধ্যে আবার ঐক্য ফিরে আসছে এবং বিডিআর পুনর্গঠিত হয়ে আবার নিজস্ব সক্রিয়তা ফিরে পাচ্ছে। ১৮ এপ্রিল বড়াইবাড়ি দিবস উপলক্ষে বিডিআর ও সেনাবাহিনী জওয়ানরা নিজেদের ঐক্য ও সংহতি ফিরে পাবে এটাই দেশবাসীর কামনা।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে কথিত বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা। এত বড় হত্যাকাণ্ড এর আগে কখনও দৃষ্টিগোচর হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি পদাতিক যুদ্ধকে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এর একটি হলো হিটলারের বাহিনী কর্তৃক ডানজিক সমুদ্রবন্দর দখল, সেখান থেকে প্রায় সাত লাখ ব্রিটিশ সেনা ও নাগরিককে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয়টি হলো জার্মান বাহিনী কর্তৃক রাশিয়ার সেন্টপিটার্সবার্গ দখলের অভিযান (১৯৪৩ সালে)। এই দুটি যুদ্ধেও একদিনে জেনারেলসহ ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যার নজির নেই। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ২৫ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ড সুপরিকল্পিত। ইতিহাসের সর্ববৃহত্ হত্যাকাণ্ড নিঃসন্দেহে।
২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআরের সালাম গ্রহণ করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অশেষ রহমত সেইদিন কোনো অঘটন ঘটেনি। অর্থাত্ ২৫ তারিখের হত্যাকাণ্ড যদি সরকারকে অপসারিত করার জন্য পরিচালিত হতো তাহলে ২৪ তারিখেই ষড়যন্ত্রকারী ও কুচক্রিরা তা করতে সক্ষম হতো, যা তারা করেছে ২৫ ফেব্রুয়ারি। যদি বিদ্রোহটি শুধু তাদের দাবি-দাওয়া আদায় করার বিষয় হতো তাহলে ২৪ তারিখে তারা সরকার প্রধানকে স্মাকরলিপি দিয়ে অবহিত করতে পারত। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, কোন অফিসার কোন স্থানে দায়িত্ব পালন করবেন, সেটা সেই অফিসারের কিংবা ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর মোটেই নির্ভর করে না। সরকারি সিদ্ধান্তের ওপরে এবং চাকরির বিধান অনুসারে সরকারি চাকরিজীবী সরকারি আইন মেনে নিতে আইনগতভাবে বাধ্য।
আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য বিডিআর বাহিনী, পুলিশ বাহিনী, আনসার বাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী অন্যতম। তবে সেনাবাহিনী ও বিডিআর বাহিনীকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা হয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমেই।
মোটামুটি সেনাবাহিনীর লোকবল এক লাখ পাঁচ হাজারের কাছাকাছি। বিডিআরের লোকবল ৪২ হাজারেরও উপরে, সেনাবাহিনীর অন্য সব ডিভিশনের মতো বিডিআরেরও একজন প্রধান থাকে। তাকে ডিজি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি বিডিআরের কমান্ডিং অথরিটি হিসেবে গণ্য হন।
প্রেক্ষাপট
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমাদের সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে দুই দেশের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। গঠিত হয় যৌথ কমান্ড এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান করা হয় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলের সেনাপ্রধান লে. জে. জগজিত সিং অরোরাকে। প্রস্তাবিত যৌথ স্মারক রচনা করেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা শ্রী ডিপি ধর। খন্দকার মোস্তাক আহম্মেদের আপত্তির কারণে সেই স্মারকের কিছু পরিবর্তন সাধন করা হয়। কিন্তু অলিখিত দুটি বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমত, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দ্বিতীয়ত, পররাষ্ট্রনীতি।
অর্থাত্ বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য বেশি সহায়-সম্পদ ব্যবহারের মাধ্যমে শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে না তুলে ভারতের ওপর নির্ভরশীল থাকা এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মতো না করে কথিত বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মতো করা বা ভারত কর্তৃক পরিচালিত করা—অর্থাত্ তখনকার সময়ের ভুটানের আঙ্গিকে করা।
কিন্তু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এসে উপরে উল্লিখিত দুটি অলিখিত সিদ্ধান্তকে পরিহার করেন। এর মূল কারণ ছিল তত্কালীন বিশ্বব্যবস্থায় একদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপান বলয় এবং চীন-পাকিস্তান-সৌদি আরব বলয়। এই ত্রিবিভাজন পরিস্থিতিতে শুধু ভারত-সোভিয়েত বলয়ের মধ্য থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশকে কারও করদ রাজ্যে পরিণত করতে চাননি। তিনি কাশ্মীরের শেখ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহর পরিণতি ও হায়দরাবাদের নিজামের পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রথম রাজনৈতিক শিকার হলো প্রবাসী সরকার। বঙ্গবন্ধু নিজেই সরকার প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
দ্বিতীয় কাজটি তিনি করেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে প্রধান ভূমিকা পালনকারী শক্তি ভারতীয় বাহিনীকে সহযোগী বাহিনী হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে। তাদের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে সম্মানের সঙ্গে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে। বঙ্গবন্ধু সরকারি সেনাবাহিনী ও বিডিআর বাহিনী গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিজের গড়া দল ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ বিভক্ত হয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) গড়ে উঠল। এর তাত্ত্বিকগুরু সিরাজুল আলম খান ও কাজী আরেফ আহমেদ। গণসংগঠনের নেতা মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, হাসানুল হক ইনু আর সেনাবাহিনীর মধ্যের নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তাহের। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবসান ঘটানো হয়।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দল, বিচার বিভাগ, সিভিল প্রশাসন, সংবাদপত্র ও সেনাবাহিনী পরিচালিত হয় চেইন অব কমান্ডের মাধ্যমে। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অপমৃত্যু হলেও সিভিল প্রশাসন ও সেনাপ্রশাসনের চেইন-অব কমান্ড ঠিকই ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নতুন তত্ত্ব সেনাবাহিনীকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল; তাহলো—‘সিপাহি জনতা ভাই ভাই-জেসিওর উপরে অফিসার নাই।’ এই তত্ত্ব বাস্তবায়িত করতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে আটজন সেনা অফিসারকে হত্যা করা হয়েছিল। সেনাবাহিনীর শক্তি ও মর্যাদা নির্ভর করে বাহিনীর কমান্ডের উপরে। ওপরের আলোচনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী সামরিক শক্তি গড়ে উঠুক প্রথম থেকেই বন্ধু রাষ্ট্র ভারত তা চায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, চীন, জার্মানি কেউই চায় না তাদের চেয়ে বেশি সামরিক শক্তিতে কেউ বলীয়ান হোক। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
আমি উল্লেখ করেছি সেনাবাহিনীর ও বিডিআর বাহিনী আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে আধুনিক অস্ত্রদ্বারা সজ্জিত থাকে। সেনাবাহিনী থাকে মূলত ক্যান্টনমেন্টে তাদের প্রশিক্ষণ ও নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে; প্রেসিডেন্টের গার্ডরেজিমেন্ট ও এসএসএফ ছাড়া বাকিরা থাকে জরুরি কাজে সরকারকে সহযোগিতার অংশ হিসেবে।
বিডিআর মূলত সীমান্তরক্ষা, চোরাচালান প্রতিহত করাসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত থাকে। বিডিআরের কমান্ড থাকে সেনাবাহিনীর অফিসারদের হাতে। সরকারের প্রশাসনিক নীতি অনুসারেই এই কমান্ডিং অফিসাররা থাকবে এটা বিডিআরের জওয়ানরা নির্ধারণ করবেন না। এটা নির্ধারিত হবে সরকারের প্রশাসনিক নীতির আলোকে। কিন্তু মনে হয় যারা সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার মূল লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে কিংবা যারা মনে করেন বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই কিংবা যারা জাতীয় নিরাপত্তা অন্যের হাতে তুলে দিতে চায় তারাই অত্যন্ত কৌশলে সেনা অফিসারদের বিরুদ্ধে একটি মানসিক অসন্তোষ ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। গত অন্তর্বর্তী (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের আমলে বিডিআরকে মুদির ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। কাঁচা টাকা হাতাহাতির ব্যবস্থা করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে লাভ-লোকসানের ছল-চাতুরি করার সুযোগ দিয়েছে অসত্ উদ্দেশ্যে। যা হওয়ার তাই হয়েছে—বিডিআরের অভ্যন্তরে বিশ্বাস-অবিশ্বাস দানা বেঁধে উঠেছিল। অত্যন্ত কৌশলে ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের সৃষ্টি করা হয় অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে। এর মধ্যে হয়তোবা অফিসারদের অসাবধানি ব্যবহার শত্রুদের কর্ম চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে সাহায্য করেছে। যে প্রতিষ্ঠানের যে কাজ না তাকে দিয়ে সেই কাজ করাতে চাইলে সঙ্কট হবেই, এটাই স্বাভাবিক।
বিডিআরের দায়িত্ব সীমান্ত পাহারা দেয়া। আটা আর চাল বিক্রি করা নয়। তাই ডাল-ভাত কর্মসূচি যারা প্রণয়ন করেছিল তাদের উদ্দেশ্য সত্ মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়নি—এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
গোয়েন্দা ব্যর্থতা
পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তের ছোটখাটো সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে কোনো বাধা থাকার সুযোগ নেই যে, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো প্রকৃত অর্থেই সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারির পর থেকে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও সিভিল আমলাদের কাউকে কাউকে হয়রানি করা ছাড়া গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আর কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, অন্যের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তারা বিবেকহীন বরফে পরিণত হয়েছিল। জাতীয় সংসদের মতো পবিত্র জায়গাতে তারা অন্ধ বিচারালয় স্থাপন করেছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র ব্যবহার করে অপমান করেছে বিশ্বদরবারে।
আবার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ ব্যতিরেকে এসএসএফ দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করে প্রমাণ করেছে তাদের সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তা। সেই কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্র সম্পর্কে কোনো গোয়েন্দা সংবাদ সরকারের কাছে ছিল না। ২৪ ফেব্রুয়ারি বিডিআর জওয়ানদের পক্ষ থেকে তাদের দাবি-দাওয়া সংবলিত লিফলেট বিলি করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গাতে। তারপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কোনো প্রকার সতর্ক সংবাদ দিতে পারেনি সরকারকে।
অন্যদিকে এতবড় ষড়যন্ত্র হচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তাদের কর্মকর্তাদের আরো একটু বেশি চৌকস হওয়ার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু কী কারণে তা অনুপস্থিত ছিল তা শুধু ভবিষ্যত্ ইতিহাসই বলতে পারবে। বিডিআরের কর্মসূচি ছিল তিন দিনের জন্য। ২৪ তারিখে প্যারেড, ২৫ তারিখে দরবার হলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও ২৬ তারিখে প্রীতিভোজের কর্মসূচি—যাতে যোগদানের আমন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেননি। ২৪ তারিখে প্রধানমন্ত্রী প্যারেড কর্মসূচি শেষ করে তার সরকারি বাসভবনে ফিরে আসেন। ২৫ তারিখ সকাল ৮টায় দরবার হলের কর্মসূচি ১ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়া হয়। কর্মসূচি শুরু হয় সকাল ৯টায়। সকাল ৮টায় বিডিআরের ডিজি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে বিডিআর বিদ্রোহের সংবাদ দেন এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনা সাহায্য চান। প্রধানমন্ত্রী তাকে বিদ্রোহ দমনে সেনা সাহায্য প্রদানের জন্য আশ্বস্ত করেছিলেন বলে সংবাদপত্রে দেখতে পেয়েছি। তারপর বিডিআরের ডিজি যোগাযোগ স্থাপন করেন সেনাপ্রধানের সঙ্গে। তিনিও বিদ্রোহ দমনে সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে কোনো সাহায্য বা উদ্ধার অভিযান পরিলক্ষিত হয়নি। এরই মধ্যে বিদ্রোহীরা বিডিআরসহ ১১ জন অফিসারকে হত্যা করে। তারপর ছোটে ডিজির বাংলোর দিকে। হত্যা করে ডিজির এক আমন্ত্রিত বন্ধু ও তার স্ত্রীকে। ডিজির স্ত্রীকে খুঁজে বের করে অমানবিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয় এবং তারপর হত্যা করা হয়। এরই মধ্যে বিডিআরের বিদ্রোহকে শান্ত করার জন্য যুবপর্যায়ের সরকারি নেতৃত্বকে বিডিআর গেটে প্রেরণ করা হয়। তারা অসীম সাহসিকতা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিদ্রোহের মূলনেতাদের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করে দেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিদ্রোহীদের মূল নেতা ডিএডি তৌহিদকে সরকারের যুবনেতারা চিনল কেমন করে?
তাহলে কি বিদ্রোহীদের সঙ্গে তাদের পূর্বযোগাযোগ ছিল? এরা কি তাহলে পূর্ব পরিচিত? পূর্বপরিচিত হতেই পারে। তবে এর মধ্যে আমি কোনো ষড়যন্ত্র দেখতে পাই না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়—যে কোনো বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করাই ন্যায়সঙ্গত ও স্বাভাবিক বিধান। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারির বিদ্রোহ দমনে সেই স্বাভাবিক বিধান মেনে কাজ করা হয়নি কেন? আমরা যদি পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব-মিজোরাম প্রদেশে স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করলে ভারতীয় বিমানবাহিনী সেখানে কার্পেট বোম্বিং করে বিদ্রোহ দমন করেছিল। ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সময় শিখ সম্প্রদায় স্বর্ণমন্দিরকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহ করলে ভারতীয় সেনাবাহিনী সেখানে নিষ্ঠুরতম হামলা চালিয়ে স্বর্ণমন্দির ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছে ঠিক তার উল্টোটা। কোনো কিছু না জেনেই বিদ্রোহীদের ক্ষমা ঘোষণা করার ফলে বিকাল থেকে সারারাত খুঁজে খুঁজে সেনা অফিসারদের হত্যা করার সুযোগ হয়েছে। শুধু এখানেই ঘটনার প্রবাহ থেমে থাকেনি—বিদ্রোহীরা ৪০ ফুট গর্ত করে গণকবরের ব্যবস্থা করেছে। মাটি চাপা দিয়ে স্যুয়ারেজ লাইনের মধ্যে সেনা অফিসারদের লাশ নিক্ষেপ করা হয়েছে। ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে পিলখানার চর্তুরপাশে তিন মাইল জায়গা খালি করার মাইকিং করা হয়েছিল কী উদ্দেশ্যে? কোন কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আজ পর্যন্ত তার কোনো পরিষ্কার ধারণা দেশবাসীকে দেয়া হয়নি। অনেকেই মনে করেন এর ফলে কামরাঙ্গিরচর দিয়ে বহিরাগত হত্যাকারীরা নিরাপদে পিলখানা এলাকা ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছে।
সরকারের পক্ষ থেকে তিনটি তদন্ত কমিটি
পিলখানা সেনা হত্যাকাণ্ডের পর বিডিআর বিদ্রোহের রহস্য উদঘাটনে সরকার তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। সমন্বয়কারী নিয়োগ করা হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ফারুক খানকে। তদন্ত কমিটিগুলোর সমন্বিত রিপোর্ট জাতি জানতে পারেনি। যদিও এরই মধ্যে সরকারের সাবেক সচিবের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির আংশিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর নিজস্ব তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জমা দেয়া হলেও তা তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু পিলখানা সেনা হত্যা তদন্তের সমন্বয়কারী বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেছেন, এর সঙ্গে জঙ্গি শক্তিগুলোর হাত থাকতে পারে। যদিও সর
No comments