বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৩৮৭ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। কাজী নূরুজ্জামান, বীর উত্তম সাহসী এক সেক্টর কমান্ডার ১৯৭১ সালের ২৫-২৬ মার্চ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ দেখে ৪৬ বছর বয়সী কাজী নূরুজ্জামান নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। ঢাকা থেকে ৩০ মার্চ উপস্থিত হন ময়মনসিংহে।
সেখানে তখন অবস্থান করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে তিনি এই রেজিমেন্টের সঙ্গে যোগ দেন।
কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর কাজী নূরুজ্জামান দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় যান। সেখানে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় তিনিও যোগ দেন। সভায় বিদ্রোহী বাহিনীগুলোকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে তিনি দায়িত্ব পান মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে। মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তিনি নানা ভূমিকা পালন করেন।
জুন মাসে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য অফিসার নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাজী নূরুজ্জামানের ওপর দায়িত্ব পড়ে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের জন্য ক্যাডেট নির্বাচনের। ভারতের বিভিন্ন শিবির থেকে নির্বাচন করা ছাত্র-যুবকদের মধ্যে থেকে তিনি চূড়ান্তভাবে ক্যাডেট বাছাই করেন। তাঁর বাছাই করা ছাত্র-যুবকদের নিয়ে শুরু হয় প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের প্রশিক্ষণ।
সেপ্টেম্বর মাসে কাজী নূরুজ্জামানকে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এই সেক্টরের আওতায় ছিল গোটা রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার অংশবিশেষ। উত্তর বঙ্গের অর্ধেকের বেশি এলাকা নিয়ে ছিল এই সেক্টর। এর অধীনে সাব-সেক্টর ছিল নয়টি।
কাজী নূরুজ্জামান ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পাওয়ার পর শাহপুর গড়সহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে শাহপুর গড়ের যুদ্ধে রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে তিনি নিজেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে অগ্রসর হন। ১৩ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুদ্ধ হয়।
একটি যুদ্ধের বর্ণনা শোনা যাক কাজী নূরুজ্জামানের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন: ‘আমরা খঞ্জনপুর ও সাপাহার দখলের পরিকল্পনা করি। আক্রমণ করার আগে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়। সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে খঞ্জনপুর ও সাপাহার আক্রমণ করবে। দুদিন পর অপারেশন শুরু হলো। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলেন, ভোর রাত থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। সূর্য উঠতে উঠতে দেখি আঘাতপ্রাপ্ত ছেলেরা ফিরে আসছে। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধাদের দলনায়ক ইদ্রিসকেও খুঁড়িয়ে আসতে দেখলাম।
‘জানতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়ার পথে ছিল অসংখ্য অ্যান্টিপারসোনাল মাইন। মুক্তিযোদ্ধারা মাইনে বাধাপ্রাপ্ত হন। এ সময় পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা আর অগ্রসর হতে পারেননি।
‘ইদ্রিস বলে, অগ্রসর হওয়ার সময় একটি মাইনে তার পায়ের চাপ লাগে। কিন্তু মাইন পুরোপুরি ফাটেনি। তাকে কেবল কয়েক গজ ছিটকে দিয়েছে। অ্যান্টিমাইনে মুক্তিযোদ্ধারা এত বেশি আহত হয়েছিলেন যে আমাদের ফার্স্ট এইডের ওষুধ ও ব্যান্ডেজ যা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। আমাদের এই অপারেশন সফল হয়নি। কারণ, শত্রুপক্ষ আমাদের পরিকল্পনা জেনে ফেলেছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য কাজী নূরুজ্জামানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫।
কাজী নূরুজ্জামান ২০১১ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার চাটদহ গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা—বাড়ি ৬৯, সড়ক-৫, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম কাজী সাদরুলওলা, মা রতুবুন্নেছা, স্ত্রী সুলতানা সারওয়াত আরা জামান। তাঁদের দুই মেয়ে এক ছেলে।
সূত্র: রাফিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
কাজী নূরুজ্জামান ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা। ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৯৪৭ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশন পান। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন। তখন তাঁর পদবি ছিল মেজর।
মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার পর কাজী নূরুজ্জামান দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় যান। সেখানে ৪ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় তিনিও যোগ দেন। সভায় বিদ্রোহী বাহিনীগুলোকে একটি কমান্ড চ্যানেলে এনে সমন্বিতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের আলোকে তিনি দায়িত্ব পান মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রীয় দপ্তরে। মুক্তিবাহিনীর পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ায় তিনি নানা ভূমিকা পালন করেন।
জুন মাসে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জন্য অফিসার নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কাজী নূরুজ্জামানের ওপর দায়িত্ব পড়ে প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের জন্য ক্যাডেট নির্বাচনের। ভারতের বিভিন্ন শিবির থেকে নির্বাচন করা ছাত্র-যুবকদের মধ্যে থেকে তিনি চূড়ান্তভাবে ক্যাডেট বাছাই করেন। তাঁর বাছাই করা ছাত্র-যুবকদের নিয়ে শুরু হয় প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সের প্রশিক্ষণ।
সেপ্টেম্বর মাসে কাজী নূরুজ্জামানকে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। এই সেক্টরের আওতায় ছিল গোটা রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলা এবং দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার অংশবিশেষ। উত্তর বঙ্গের অর্ধেকের বেশি এলাকা নিয়ে ছিল এই সেক্টর। এর অধীনে সাব-সেক্টর ছিল নয়টি।
কাজী নূরুজ্জামান ৭ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব পাওয়ার পর শাহপুর গড়সহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে শাহপুর গড়ের যুদ্ধে রণাঙ্গনে উপস্থিত থেকে তিনি নিজেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি মুক্তিবাহিনীর একটি দল নিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ অভিমুখে অগ্রসর হন। ১৩ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জে যুদ্ধ হয়।
একটি যুদ্ধের বর্ণনা শোনা যাক কাজী নূরুজ্জামানের লেখা থেকে। তিনি লিখেছেন: ‘আমরা খঞ্জনপুর ও সাপাহার দখলের পরিকল্পনা করি। আক্রমণ করার আগে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হয়। সিদ্ধান্ত হলো, আমাদের ১২০ জন মুক্তিযোদ্ধা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে খঞ্জনপুর ও সাপাহার আক্রমণ করবে। দুদিন পর অপারেশন শুরু হলো। রাতে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ করলেন, ভোর রাত থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ। সূর্য উঠতে উঠতে দেখি আঘাতপ্রাপ্ত ছেলেরা ফিরে আসছে। কিছুক্ষণ পর মুক্তিযোদ্ধাদের দলনায়ক ইদ্রিসকেও খুঁড়িয়ে আসতে দেখলাম।
‘জানতে পারলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের যাওয়ার পথে ছিল অসংখ্য অ্যান্টিপারসোনাল মাইন। মুক্তিযোদ্ধারা মাইনে বাধাপ্রাপ্ত হন। এ সময় পাকিস্তানিরা প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে মুক্তিযোদ্ধারা আর অগ্রসর হতে পারেননি।
‘ইদ্রিস বলে, অগ্রসর হওয়ার সময় একটি মাইনে তার পায়ের চাপ লাগে। কিন্তু মাইন পুরোপুরি ফাটেনি। তাকে কেবল কয়েক গজ ছিটকে দিয়েছে। অ্যান্টিমাইনে মুক্তিযোদ্ধারা এত বেশি আহত হয়েছিলেন যে আমাদের ফার্স্ট এইডের ওষুধ ও ব্যান্ডেজ যা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। আমাদের এই অপারেশন সফল হয়নি। কারণ, শত্রুপক্ষ আমাদের পরিকল্পনা জেনে ফেলেছিল।’
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য কাজী নূরুজ্জামানকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের সরকারি গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ৫।
কাজী নূরুজ্জামান ২০১১ সালে মারা গেছেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার চাটদহ গ্রামে। বর্তমান ঠিকানা—বাড়ি ৬৯, সড়ক-৫, পুরাতন ডিওএইচএস, বনানী, ঢাকা। তাঁর বাবার নাম কাজী সাদরুলওলা, মা রতুবুন্নেছা, স্ত্রী সুলতানা সারওয়াত আরা জামান। তাঁদের দুই মেয়ে এক ছেলে।
সূত্র: রাফিয়া চৌধুরী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৭।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments