হিলারির সফর দুই দেশের সম্পর্ক সুদৃঢ় করবে by শাহজাহান মিয়া
দেশের রাজনীতির মাঠ এখন উত্তপ্ত। তবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহটি দেশের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। কারণ, বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন দুই দিনের সফরে ৫ মে দুপুর ১টায় বাংলাদেশে আসেন।
কাকতালীয় হলেও সত্যি যে বাংলাদেশের বিশাল প্রতিবেশী ভারতের প্রবীণ রাজনীতিক ও অর্থমন্ত্রীও আসেন একই দিন বিকেলে। আর সংগত কারণেই একই সময়ে এই দুটি দেশের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর এ দেশের জনগণের মধ্যে বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করে। জাপানের উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদাও গত ৩ মে দুই দিনের সফরে ঢাকা এসেছিলেন। ঢাকা সফর শেষে হিলারি কলকাতায় গেছেন। সেখানে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা করে নয়াদিলি্ল যাওয়ার কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সাবেক ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির আমন্ত্রণে এ সফরে আসছেন। চীন ও ভারতসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সফরের অংশ হিসেবে ৬৫ বছর বয়স্ক হিলারি বাংলাদেশে আসেন। হিলারির এ সফরে সন্ত্রাসবাদ দমন, গণতন্ত্র বিকাশ ও ধর্মীয় সহনশীলতায় বাংলাদেশের অর্জনের স্বীকৃতি বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো শক্তিশালী হবে। আসন্ন সফরে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং গত বছর দুই দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রথমবারের মতো ৬০০ কোটি ডলার অতিক্রম করেছিল।
আসন্ন সফরে বহুল আলোচিত 'ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট' বা টিকফা চুক্তি সই হয়েছে। হিলারির সফরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ এ সুবিধাটি চেয়ে এলেও এখনো পর্যন্ত তা পায়নি। এ কথা ঠিক, টিকফা সইয়ের ফলে দ্বিপক্ষীয় একটি প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারসহ অন্যান্য বিষয়েও দর-কষাকষি করার সুযোগ হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরে অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এক দশক আগে 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট' বা টিফা নামে প্রস্তাবটি প্রথম তোলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামোগত চুক্তি টিফা সই করার বিষয়ে বিগত সরকারের আমলেই আলোচনা শুরু হয়েছিল এবং জোট সরকার চুক্তিতে সই করার আগ্রহও দেখিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে আর তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সহকারী মাইকেল ডিলোনি তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও পরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করার পরও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকসহ বিশ্বের ৩০টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটি সই করেছে। চুক্তির মধ্যে কিছু শর্তের বিষয়ে আপত্তি তোলার পর কয়েকটি শর্ত পরিবর্তন করে নতুন করে টিকফা নামে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মতি জানায় বলে আসন্ন সফরের সময় চুক্তিটি সই হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভালো সহযোগিতা পেয়ে আসছে। নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হলেও এ বিষয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানা গেছে। কারণ, নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়টি ব্যাপক। নিরাপত্তা চুক্তি হলে তা এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলবে। মিয়ানমারে অং সান সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক সমঝোতা হলেও এ অঞ্চলে জঙ্গিদের আস্তানা বলে খ্যাত পাকিস্তান আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে। অবশ্য খাদ্যনিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ, মানব ও মাদকপাচার, আন্তদেশীয় অপরাধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অনেক ঝুঁকি মোকাবিলায় দুটি দেশের একযোগে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবু এ দেশের কোনো কোনো মহল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তুলতে পারে।
সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। হিলারি নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও দেখা করেন। গণতন্ত্র, কঠোর হস্তে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, বাণিজ্যসহ আরো অনেক বিষয়ে অর্জন ও অগ্রগতি নিশ্চয়ই বর্তমান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। সরকার অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে আবারও অনুরোধ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরম বন্ধু বলে পরিচিত ড. ইউনূসকে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগও সরকারের নেওয়া উচিত। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গুপ্তহত্যা, গুম ও নির্যাতন-নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিও উত্থাপন করেন। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলোও হিলারির সফরের সময় আলোচনায় আসতে পারে। কারণ, বঙ্গোপসাগরে আইনগতভাবে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা প্রাপ্তি বিশ্বে এ দেশের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে। বিশাল দেশ না হলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাজনীতিতে বাংলাদেশের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্ব বহন করে। অন্যদিকে উন্নয়নের সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেও বাংলাদেশের প্রয়োজন। বিষয়গুলো হিলারির সঙ্গে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের বিরাজমান কিছু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। চিঠিটি লেখার ছয় মাসের মধ্যে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেও হিলারির বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের বিজয়সহ পরিবর্তিত পরিস্থিতি হিলারির বাংলাদেশ সফরে আগমন ত্বরান্বিত করেছে। কারণ, গত কয়েক বছর হিলারি ক্লিনটন প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে সফর করলেও বাংলাদেশে আসেননি। এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগী হওয়ারও সুযোগ এসেছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ অপরিসীম। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করার সুবাদে আমার তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছিল। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাংলাদেশ আধিপত্য লাভ করায় অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগ্রহ সৃষ্টি করবে, তা সহজেই অনুমেয়। এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। হিলারির সফরের সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই তিনি সফরে এসেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপে যোগ দিতে গত ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজনীতি ও সামরিকবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ডো শ্যাপিরো। ওয়েন্ডি শারমেনই হিলারির সফরের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, হিলারির সফরের সময় দুই দেশের সামগ্রিক বিষয়গুলো আলোচনা হবে। ২০১০ সালেই হিলারির বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ড. মুহম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে সফরটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই হিলারি ক্লিনটনের প্রথম বাংলাদেশ সফর। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ফার্স্ট লেডি হিসেবে।
গত মাসে এফবিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন একটি ফোরাম গড়ে উঠবে, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আরো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করা যাবে।' মজিনা আরেকটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এ দেশে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ব্যাপারে আমার উদ্যোগ ছিল। আমার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আগামী এক কিংবা দুই দশকের মধ্যেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশ সত্যিই এক আশীর্বাদপুষ্ট দেশ। তিনি বলেন, এ দেশের মাটি উর্বর ও উৎপাদনশীল এবং পানি পর্যাপ্ত। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। এখানকার বেসরকারি খাত এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগের চেতনা সব সময়ই স্পন্দনশীল। বেসরকারি খাত এবং উদ্যোক্তারা প্রাণবন্ত।' রাষ্ট্রদূত আরো বলেছেন, 'এ দেশের জনগণ উদ্যমী, প্রাণচঞ্চল, সৃষ্টিশীল, সহৃদয় এবং তাদের রয়েছে টিকে থাকার ক্ষমতা।' তিনি বলেন, 'দেশটি হতে পারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। মালবাহী জাহাজ নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধসামগ্রী ও চামড়াজাত দ্রব্য তৈরি, রেশম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাট তন্তুর নতুন নতুন ব্যবহারে বিশ্বের অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হতে পারে। বাংলাদেশ সম্পর্কে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের এমন অকুণ্ঠ ও আন্তরিক আশাবাদ আসলেই প্রশংসার দাবিদার। আমরা আশা করব, বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ দেশ সফরের বিষয়ে তাঁর স্বপ্ন যেমন পূরণ হয়েছে, তেমনি তিনি হিলারি ক্লিনটনকে সুপরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার ব্যাপারে প্রত্যয়ী ভূমিকা পালন করবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
আসন্ন সফরে বহুল আলোচিত 'ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম অ্যাগ্রিমেন্ট' বা টিকফা চুক্তি সই হয়েছে। হিলারির সফরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ এ সুবিধাটি চেয়ে এলেও এখনো পর্যন্ত তা পায়নি। এ কথা ঠিক, টিকফা সইয়ের ফলে দ্বিপক্ষীয় একটি প্লাটফর্ম তৈরি হয়েছে, যার ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারসহ অন্যান্য বিষয়েও দর-কষাকষি করার সুযোগ হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন সম্পর্কিত কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরে অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। এক দশক আগে 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট' বা টিফা নামে প্রস্তাবটি প্রথম তোলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ কাঠামোগত চুক্তি টিফা সই করার বিষয়ে বিগত সরকারের আমলেই আলোচনা শুরু হয়েছিল এবং জোট সরকার চুক্তিতে সই করার আগ্রহও দেখিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে এ বিষয়ে আর তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিষয়টি নিয়ে আবারও আলোচনা শুরু হয়। ২০০৯ সালের ২০ অক্টোবর ইউনাইটেড স্টেট ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভের (ইউএসটিআর) দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সহকারী মাইকেল ডিলোনি তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান ও পরাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করার পরও বিষয়টির সুরাহা হয়নি। শ্রীলঙ্কা, সোমালিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকসহ বিশ্বের ৩০টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটি সই করেছে। চুক্তির মধ্যে কিছু শর্তের বিষয়ে আপত্তি তোলার পর কয়েকটি শর্ত পরিবর্তন করে নতুন করে টিকফা নামে প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মতি জানায় বলে আসন্ন সফরের সময় চুক্তিটি সই হওয়ার প্রচুর সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ নিরাপত্তা বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ভালো সহযোগিতা পেয়ে আসছে। নিরাপত্তা বিষয়ে আলোচনা হলেও এ বিষয়ে চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে জানা গেছে। কারণ, নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়টি ব্যাপক। নিরাপত্তা চুক্তি হলে তা এ অঞ্চলের রাজনীতিতে বেশ প্রভাব ফেলবে। মিয়ানমারে অং সান সু চির নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক সমঝোতা হলেও এ অঞ্চলে জঙ্গিদের আস্তানা বলে খ্যাত পাকিস্তান আরো কোণঠাসা হয়ে পড়বে। অবশ্য খাদ্যনিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ, মানব ও মাদকপাচার, আন্তদেশীয় অপরাধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো অনেক ঝুঁকি মোকাবিলায় দুটি দেশের একযোগে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তবু এ দেশের কোনো কোনো মহল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি তুলতে পারে।
সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও দেখা করেন। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। হিলারি নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও দেখা করেন। গণতন্ত্র, কঠোর হস্তে জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, বাণিজ্যসহ আরো অনেক বিষয়ে অর্জন ও অগ্রগতি নিশ্চয়ই বর্তমান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেন। সরকার অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পাঠাতে আবারও অনুরোধ জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরম বন্ধু বলে পরিচিত ড. ইউনূসকে নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে তা কাটিয়ে ওঠার সুযোগও সরকারের নেওয়া উচিত। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, গুপ্তহত্যা, গুম ও নির্যাতন-নিপীড়নের কথা তুলে ধরেন। তাঁরা নিশ্চয়ই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টিও উত্থাপন করেন। আঞ্চলিক ও ভূ-রাজনীতির বিষয়গুলোও হিলারির সফরের সময় আলোচনায় আসতে পারে। কারণ, বঙ্গোপসাগরে আইনগতভাবে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা প্রাপ্তি বিশ্বে এ দেশের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র আরো আগ্রহী হয়ে উঠবে। বিশাল দেশ না হলেও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও রাজনীতিতে বাংলাদেশের সমর্থন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্ব বহন করে। অন্যদিকে উন্নয়নের সঙ্গী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেও বাংলাদেশের প্রয়োজন। বিষয়গুলো হিলারির সঙ্গে আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে, গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা এক চিঠিতে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের বিরাজমান কিছু পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। চিঠিটি লেখার ছয় মাসের মধ্যে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটেও হিলারির বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তিতে বাংলাদেশের বিজয়সহ পরিবর্তিত পরিস্থিতি হিলারির বাংলাদেশ সফরে আগমন ত্বরান্বিত করেছে। কারণ, গত কয়েক বছর হিলারি ক্লিনটন প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে সফর করলেও বাংলাদেশে আসেননি। এ সফর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠ করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগী হওয়ারও সুযোগ এসেছে। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর আগ্রহ অপরিসীম। ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে চাকরি করার সুবাদে আমার তা সরাসরি প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটেছিল। বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাংলাদেশ আধিপত্য লাভ করায় অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে এ দেশের ভৌগোলিক অবস্থান নতুন করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে আগ্রহ সৃষ্টি করবে, তা সহজেই অনুমেয়। এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা এসেছিলেন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও'ব্লেক। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের রাজনীতিবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শারমেন বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। হিলারির সফরের সম্ভাব্যতা যাচাই করতেই তিনি সফরে এসেছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে। সর্বশেষ দুই দেশের নিরাপত্তা সংলাপে যোগ দিতে গত ১৯ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছিলেন রাজনীতি ও সামরিকবিষয়ক সহকারী মন্ত্রী অ্যান্ডো শ্যাপিরো। ওয়েন্ডি শারমেনই হিলারির সফরের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, হিলারির সফরের সময় দুই দেশের সামগ্রিক বিষয়গুলো আলোচনা হবে। ২০১০ সালেই হিলারির বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু ড. মুহম্মদ ইউনূসকে নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে সফরটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এটাই হিলারি ক্লিনটনের প্রথম বাংলাদেশ সফর। ১৯৯৫ সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন ফার্স্ট লেডি হিসেবে।
গত মাসে এফবিসিসিআই আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন একটি ফোরাম গড়ে উঠবে, যার মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে আরো বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিঘ্ন সৃষ্টি করে এমন বিষয়গুলো চিহ্নিত করা যাবে।' মজিনা আরেকটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই এ দেশে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের ব্যাপারে আমার উদ্যোগ ছিল। আমার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'আগামী এক কিংবা দুই দশকের মধ্যেই স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ নিতে পারে। বাংলাদেশ সত্যিই এক আশীর্বাদপুষ্ট দেশ। তিনি বলেন, এ দেশের মাটি উর্বর ও উৎপাদনশীল এবং পানি পর্যাপ্ত। এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। এখানকার বেসরকারি খাত এবং ব্যবসায়িক উদ্যোগের চেতনা সব সময়ই স্পন্দনশীল। বেসরকারি খাত এবং উদ্যোক্তারা প্রাণবন্ত।' রাষ্ট্রদূত আরো বলেছেন, 'এ দেশের জনগণ উদ্যমী, প্রাণচঞ্চল, সৃষ্টিশীল, সহৃদয় এবং তাদের রয়েছে টিকে থাকার ক্ষমতা।' তিনি বলেন, 'দেশটি হতে পারে বিশ্বের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। মালবাহী জাহাজ নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধসামগ্রী ও চামড়াজাত দ্রব্য তৈরি, রেশম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, পাট তন্তুর নতুন নতুন ব্যবহারে বিশ্বের অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হতে পারে। বাংলাদেশ সম্পর্কে একজন বিদেশি রাষ্ট্রদূতের এমন অকুণ্ঠ ও আন্তরিক আশাবাদ আসলেই প্রশংসার দাবিদার। আমরা আশা করব, বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এ দেশ সফরের বিষয়ে তাঁর স্বপ্ন যেমন পূরণ হয়েছে, তেমনি তিনি হিলারি ক্লিনটনকে সুপরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দেশের সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করার ব্যাপারে প্রত্যয়ী ভূমিকা পালন করবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
No comments