চারদিক-তবু থামেনি বেপরোয়া চলাচল by উদিসা ইসলাম

সকাল সাতটা। আসাদ গেট। স্কুলের পোশাক পরে ঘুমচোখে বাচ্চারা রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। এক ঘণ্টায় একজন শিশুকেও ফুটওভারব্রিজ ব্যবহার করতে দেখা গেল না। চলন্ত গাড়ির দিকে হাত তুলে গতিরোধ করে এগিয়ে যাচ্ছে সবাই।


অথচ তারাই বলছে, রাস্তার মাঝখানে বাঁকা করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখার কারণে পেছন থেকে কোনো যান এলে তা দেখা যায় না। ফলে যতবারই অভিভাবকের সঙ্গে রাস্তা পার হতে শিশুটি এগোচ্ছে, ততবারই পেছন থেকে বাস, মোটরসাইকেল বা অন্য কোনো যান বেরিয়ে আসে। এ রকম দৃশ্য রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কমবেশি সারা দিনই দেখা যায়।
এক সপ্তাহে রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে দুটি শিশু—হামিম ও সুমি। তবু রাস্তা পারাপার ও বাস চালানোয় বাড়তি সতর্কতা বা প্রশাসনিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। থামেনি রাস্তায় বেপরোয়া চলাচল। এলোমেলোভাবে চলছে যানবাহন আর তার ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে রাস্তা পার হচ্ছে মানুষ।
রাজধানীর তিনটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, স্কুল শুরু ও ছুটির সময়ে শিক্ষার্থীদের ভিড় ফুটপাত ছাড়িয়ে রাস্তায় নেমেছে। প্রধান সড়কের সামনে স্কুল-কলেজ থাকার পরও গাড়ির গতি কমাচ্ছেন না চালকেরা। বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা মনে করছেন, এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে রাস্তায় চলাচলের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি আর ঘটে যাওয়া ঘটনার বিচারের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। আর প্রশাসন বলছে, রাস্তা পার হতে ওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ার কথা।
৪ ফেব্রুয়ারি কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের কেজি ওয়ানের শিক্ষার্থী ইয়াসিন হামিম সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হলে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ডাক দিতে মানববন্ধনে দাঁড়ায় ভুক্তভোগীরা। হাত ধরে দাঁড়িয়ে দাবি জানিয়ে তারাই আবার রাস্তার মাঝখানে দৌড়ে গিয়ে বাসে ওঠে।
এখন প্রশ্ন, সড়ক দুর্ঘটনা যে প্রাণগুলো কেড়ে নিয়েছে, আমিও যে আগামীকাল সে কাতারে পড়ব না, সেটা কী করে বলি। যাত্রী, পথচারী আর চালক সবাইকেই সচেতন হতে বাধ্য করবে কে?
রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের পাশে অবস্থিত সিটি কলেজ ও হলিক্রস কলেজের সামনে অভিভাবকেরা রাস্তা পার হতে ভয় পেলেও ফুটওভারব্রিজে উঠতে চান না। কারণ জানতে চাইলে মিসেস আখতার জাহান বলেন, ‘ওখানে চারপাশে মাদকাসক্তদের ভিড়।’
গতকাল মঙ্গলবারের ঘটনা। ৩১/বি রুটের একটি বাস বিকেল চারটায় মগবাজার রেল ক্রসিং পার হবে। ঠিক আগ মুহূর্তে দরজা দিয়ে ছিটকে পড়ল ১৫ বছরের এক কিশোর। ছেলেটির পাশে পৌঁছাতে না পৌঁছাতে গাড়ি পালিয়েছে অনেকদূর। কীভাবে পড়লে জানতে চাইলে বলল, ‘ওঠানোর সময় ডেকে ডেকে ওঠায়, আর নামানোর সময় একটু দেরি হলেই গালি আর ধাক্কা দেয়।’
২০০৭ সালে সিটি কলেজের সামনে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাদিয়া আফরিন। অভিভাবকেরা মেয়ের ঘাতককে বিচারের কাঠগড়ায় দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি। বরং অভিযুক্ত চালক দুই মাস পর জামিন নিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা মামলারই কোনো খোঁজ পাননি।
ফার্মগেট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আসা বাসগুলো অধিক যাত্রী নিয়ে অদক্ষ চালকের মাধ্যমে এলোমেলো চলার কারণে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। সিটি বাসের এক চালককে প্রেসক্লাবের সামনে বয়স বলতে বললে তিনি ১৭ বছর বলেন। পরে সাংবাদিক পরিচয় জেনে তিনি ভুল শুধরে নিজের বয়স কম করে ২২ হবে বলে জানান। তিনিও জানেন, গাড়ি চালাতে যে শক্তি, সামর্থ্য ও বয়স লাগে, এর কোনোটাই তাঁর হয়নি। যাত্রীরা বলছে, একজনকে সাজা দিতে পারলে সবাই সতর্ক হতে পারে। রাস্তা পার হওয়ার সময় ওভারব্রিজ ব্যবহার না করার বিষয়ে জানতে চাইলে তারা জানায়, ওভারব্রিজে নানা রকম মানুষ শুয়ে-বসে থাকে। আর অনেকটা সময়ও লাগে।
সে ক্ষেত্রে আইন বাস্তবায়নের জন্য সর্বস্তরে সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম জরুরি। বিভিন্ন বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ির চালকেরা বলছেন, এলোমেলোভাবে হাঁটাচলার জন্যই দুর্ঘটনা ঘটে। একাধিক চালক বলেন, রাস্তায় চলন্ত গাড়িকে হাত দেখিয়ে থামতে বলা হয়। তাত্ক্ষণিকভাবে সেটা সব সময় পারা যায় না। স্কুল-কলেজের সামনের রাস্তায় গতি কমিয়ে চলাচল করার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা উত্তর দেয়নি। তবে মোটরযান-সংক্রান্ত আইনে এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনা আছে কি না, কিংবা দুর্ঘটনার অপরাধে কতদিনের শাস্তি দেওয়া হয়—সেসব সম্পর্কে বিভিন্ন পরিবহনের চালকের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। তাঁরা বলেছেন—‘জানি না।’
আইনি জটিলতার কথা বলতে গিয়ে সাংসদ তারানা হালিম বলেন, ‘লঘু দণ্ডের বিধানের কারণে বিষয়টি কোনো পক্ষই আমলে নেয় না। যাত্রীদের সচেতন করে তোলার পাশাপাশি স্থানভেদে গতিসীমা নির্ধারণ করাও জরুরি। আইনের ফাঁক দিয়ে কত তাজা প্রাণ নিষ্প্রাণ হবে, সেটা এখন পরিবার-পরিজন হারানো মানুষের প্রশ্ন। সবার আগে প্রতিষ্ঠিত হোক—সড়ক দুর্ঘটনায় চলে যাওয়াটা কি অপমৃত্যু, না হত্যাকাণ্ড। হত্যার বিচার
সভ্যতার দাবি।

No comments

Powered by Blogger.