আমাদের সামর্থ্য বাড়াতে হবে by মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর দেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। তাঁর এই সফর বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে, তা বিশ্লেষণ করেছেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও প্রবীণ কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তবে এই ঘোষণাকে চুক্তি হিসেবে দেখা যাবে না। দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কী কী বিষয় নিয়ে সহযোগিতামূলক কাজ হতে পারে, এই সমঝোতার মধ্যে তার একটা নীতিগত রূপরেখাই কেবল ঠিক হয়েছে। সমঝোতাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হচ্ছে বলে বেশি আলোচনা হচ্ছে। গত বছর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এলে এ রকম একটি সহযোগিতা-কাঠামো স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের বিষয় একেবারে নতুন নয়। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে নিয়মিতভাবে এ ধরনের আলোচনা চলে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথমবারের মতো এই সমঝোতা-কাঠামো ঠিক হলো। এখানে নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও শিক্ষা সহযোগিতার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
আমরা একটা অঙ্গীকার করলাম। দেখার বিষয় হচ্ছে, এই অঙ্গীকার আমরা কীভাবে পালন করব। এ থেকে আমরা কীভাবে সুবিধা নেব তা আমাদের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা এক নম্বর শক্তি। এ রকম একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ চালানোর জন্য প্রস্তুতি থাকা লাগবে। এর জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের ভিশনটা কী, সেটা আমাদের অনুসরণ করে যেতে হবে।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক একটা গতিশীল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া ভালোভাবে চালাতে পারলে আমরা সুবিধা পাব। এ ক্ষেত্রেও সক্ষমতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। এই সক্ষমতা বলতে আমলাতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং জনগণের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিষয়ে বোঝাপড়া তৈরির কথাই বোঝাচ্ছি। এসবের ভিত্তিতে অবস্থান ঠিক করার পরই আমরা সম্পর্কটাকে অনুকূলে নিয়ে আসতে পারি। আমরা কী মানব আর কী মানব না, সেটা নির্ভর করে আমাদের অবস্থান ঠিক করার পর।
অতীতেও যে যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছে তা পেয়েছে, তা নয়। আমরা তো মার্কিন অনুরোধে ইরাকে সৈন্য পাঠাইনি। আমরা মনে করেছিলাম, এটা আমাদের জন্য ভালো হবে না। যদি যুক্তি থাকে, তথ্য-উপাত্ত থাকে, শক্ত নীতিকাঠামো থাকে, জনমত তৈরি থাকে তাহলে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। সাত-আট লাখ বাংলাদেশি সেখানে বাস করে। শান্তি মিশনেও উভয় দেশের সেনারা একসঙ্গে কাজ করছে। সেখানে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি বাড়ছে। এখন প্রতি বছর রপ্তানি হয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে ৫০ বিলিয়ন ডলারেও তো উন্নীত করা যেতে পারে। উভয়পক্ষের যদি একটা নীতিকাঠামো থাকে, তাহলে তার অধীনে বছর বছর আলোচনা যুক্তি চাপাচাপি চালানো সম্ভব হবে।
তবে এ পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা তাতে শঙ্কাও আছে। আবার গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা দেখলে বলতে হবে শঙ্কাজনক কিছু ঘটেনি। আমরা যদি দুর্বল থাকি, সেটা আমাদের সমস্যা। এই সমঝোতা ভালো কি মন্দ সেই বিচারে যাওয়ার আগে দেখা দরকার, আমরা কী চাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। আমাদের যদি জানা না থাকে যে আমেরিকা কীভাবে কাজ করে, কীভাবে তাদের প্রভাবিত করা যায়—তাহলে এর সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারব না। আমাদের যদি দর-কষাকষি করার মানসিক শক্তি না থাকে, সেটা আমাদের সমস্যা। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, যদি জনশক্তিকে উন্নত করতে চাই, যদি উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়, তাহলে তো সুসম্পর্ক লাগবে।
সব দেশই যার যার স্বার্থের জন্য কাজ করে। ভারত হয়তো এই চুক্তিকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে। কিন্তু আমাদের অবস্থান যদি যৌক্তিক হয়, আমরা যদি কারও জন্য হুমকি না হই, তাহলে সমস্যা থাকার কথা নয়। আমাদের দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকলে তো তা উপমহাদেশের জন্যই সুখবর। ভারত নিজেও চীনের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলছে। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুদিন ধরে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের চর্চা করছে। পাকিস্তান আমেরিকার বন্ু্ল হলেও দ্বিমুখী আচরণ করে সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা অনিবার্য। বিশ্ব সংঘাতমূলক না হয়ে সহযোগিতার দিকে যাচ্ছে। আমরা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করছি, আমরা চীনের সঙ্গেও সহযোগিতা চাই। আমরা আমেরিকাকে বলতে পারি চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করো।
অনেকে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ককে দুর্বলতা ভাবছেন। এটা সত্য, আমরা আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল না। আমেরিকা তো একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। তবুও কি আমরা স্বাধীন হইনি? অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের কারণে আমরা হয়তো সবকিছু পাব না। কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা মাথায় রেখে কৌশলগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এটা একটা গাড়ি, এটাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ও সামর্থ্যের ব্যাপার।
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের বিষয় একেবারে নতুন নয়। দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে নিয়মিতভাবে এ ধরনের আলোচনা চলে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রথমবারের মতো এই সমঝোতা-কাঠামো ঠিক হলো। এখানে নিরাপত্তাসহ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ও শিক্ষা সহযোগিতার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
আমরা একটা অঙ্গীকার করলাম। দেখার বিষয় হচ্ছে, এই অঙ্গীকার আমরা কীভাবে পালন করব। এ থেকে আমরা কীভাবে সুবিধা নেব তা আমাদের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও তারা এক নম্বর শক্তি। এ রকম একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ চালানোর জন্য প্রস্তুতি থাকা লাগবে। এর জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আমাদের ভিশনটা কী, সেটা আমাদের অনুসরণ করে যেতে হবে।
রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সম্পর্ক একটা গতিশীল প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া ভালোভাবে চালাতে পারলে আমরা সুবিধা পাব। এ ক্ষেত্রেও সক্ষমতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। এই সক্ষমতা বলতে আমলাতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং জনগণের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিষয়ে বোঝাপড়া তৈরির কথাই বোঝাচ্ছি। এসবের ভিত্তিতে অবস্থান ঠিক করার পরই আমরা সম্পর্কটাকে অনুকূলে নিয়ে আসতে পারি। আমরা কী মানব আর কী মানব না, সেটা নির্ভর করে আমাদের অবস্থান ঠিক করার পর।
অতীতেও যে যুক্তরাষ্ট্র যা চেয়েছে তা পেয়েছে, তা নয়। আমরা তো মার্কিন অনুরোধে ইরাকে সৈন্য পাঠাইনি। আমরা মনে করেছিলাম, এটা আমাদের জন্য ভালো হবে না। যদি যুক্তি থাকে, তথ্য-উপাত্ত থাকে, শক্ত নীতিকাঠামো থাকে, জনমত তৈরি থাকে তাহলে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমরা উপেক্ষা করতে পারব না। সাত-আট লাখ বাংলাদেশি সেখানে বাস করে। শান্তি মিশনেও উভয় দেশের সেনারা একসঙ্গে কাজ করছে। সেখানে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি বাড়ছে। এখন প্রতি বছর রপ্তানি হয় পাঁচ বিলিয়ন ডলার। এ ধরনের সহযোগিতার মাধ্যমে তাকে ৫০ বিলিয়ন ডলারেও তো উন্নীত করা যেতে পারে। উভয়পক্ষের যদি একটা নীতিকাঠামো থাকে, তাহলে তার অধীনে বছর বছর আলোচনা যুক্তি চাপাচাপি চালানো সম্ভব হবে।
তবে এ পর্যন্ত যে অভিজ্ঞতা তাতে শঙ্কাও আছে। আবার গত ২০ বছরের অভিজ্ঞতা দেখলে বলতে হবে শঙ্কাজনক কিছু ঘটেনি। আমরা যদি দুর্বল থাকি, সেটা আমাদের সমস্যা। এই সমঝোতা ভালো কি মন্দ সেই বিচারে যাওয়ার আগে দেখা দরকার, আমরা কী চাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। আমাদের যদি জানা না থাকে যে আমেরিকা কীভাবে কাজ করে, কীভাবে তাদের প্রভাবিত করা যায়—তাহলে এর সুফল আমরা ঘরে তুলতে পারব না। আমাদের যদি দর-কষাকষি করার মানসিক শক্তি না থাকে, সেটা আমাদের সমস্যা। আমরা যদি গণতন্ত্র চাই, যদি জনশক্তিকে উন্নত করতে চাই, যদি উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োজন হয়, তাহলে তো সুসম্পর্ক লাগবে।
সব দেশই যার যার স্বার্থের জন্য কাজ করে। ভারত হয়তো এই চুক্তিকে ভালোভাবে নাও নিতে পারে। কিন্তু আমাদের অবস্থান যদি যৌক্তিক হয়, আমরা যদি কারও জন্য হুমকি না হই, তাহলে সমস্যা থাকার কথা নয়। আমাদের দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকলে তো তা উপমহাদেশের জন্যই সুখবর। ভারত নিজেও চীনের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে ফেলছে। চীনও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহুদিন ধরে সহযোগিতামূলক সম্পর্কের চর্চা করছে। পাকিস্তান আমেরিকার বন্ু্ল হলেও দ্বিমুখী আচরণ করে সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছে।
নতুন বিশ্বব্যবস্থায় পারস্পরিক সহযোগিতা অনিবার্য। বিশ্ব সংঘাতমূলক না হয়ে সহযোগিতার দিকে যাচ্ছে। আমরা ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করছি, আমরা চীনের সঙ্গেও সহযোগিতা চাই। আমরা আমেরিকাকে বলতে পারি চীনের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করো।
অনেকে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ককে দুর্বলতা ভাবছেন। এটা সত্য, আমরা আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল না। আমেরিকা তো একাত্তরে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। তবুও কি আমরা স্বাধীন হইনি? অসম ক্ষমতা-সম্পর্কের কারণে আমরা হয়তো সবকিছু পাব না। কিন্তু আমাদের জাতীয় স্বার্থের বিবেচনা মাথায় রেখে কৌশলগতভাবে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। এটা একটা গাড়ি, এটাকে আমরা কোথায় নিয়ে যাব সেটা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির ও সামর্থ্যের ব্যাপার।
মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির: যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments