সাদাকালো-পরাশক্তির ষড়যন্ত্রজালে মিসরীয় গণতন্ত্রের চাওয়া-পাওয়া by আহমদ রফিক

প্রিয় পাঠক, আপনি যখন মনোযোগের সঙ্গে ভোরে কাগজ পড়ার উপভোগ্য সময়ে খবরের খুঁটিনাটি পড়তে থাকেন তখন বিশ্বের পরাশক্তি, যাকে অনেকে 'বিশ্ব মোড়ল' নামে আখ্যায়িত করে থাকেন, তাঁদের রাজনৈতিক কুকীর্তির ছোট-বড় কোনো না কোনো তথ্য আপনার নজরে আসবেই।


সে তথ্যের ঘটনা হতে পারে প্রচ্ছন্ন বা প্রকট, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে বিশ্বরাজনীতির ঘটন-অঘটনের সঙ্গে জড়িত।
হতে পারে তা আফগানিস্তানে চালিয়ে যাওয়া দীর্ঘ সময়ের অভিযানবিষয়ক কোনো বাণী_কথিত গণতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বা ততোধিক গণতন্ত্রী বিদেশসচিব হিলারি ক্লিনটনের। কিংবা আফ্রিকার কোনো দেশের ভালোমন্দ নিয়ে কথা, তাদের ভলোমন্দ নিয়ে অভিভাবকসুলভ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, যার পেছনে রয়েছে তাদের বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থ।
তাদের এ কর্মকাণ্ড যে কত অমানবিক, কত বৈনাশিক, তাদের তা অজানা নয়। তবু মানুষ, অর্থাৎ অসৎ মানুষ যেমন নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সব অপকর্মই করতে পারে, তাদের তুলনা বিশ্বের কোনো কোনো পরাশক্তির। তাই বিশ্বভুবনের ভার তাদের ওপর না থাকলেও তারা নিজ থেকে সেই ভার বা দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। কোনো রাষ্ট্রের গণেশ ওল্টাতে হলে হয় সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান ঘটানো, না হয় কিছু ভিন্নমতাবলম্বী বা বিদ্রোহী নওজোয়ানকে উসকে দিয়ে অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শাসন-ভাঙচুরের ঘটনা ঘটানো।
সেই কবে এ কাজ শুরু। তখন ইসলামী জঙ্গিবাদও মিত্র মনে হয় তাদের চোখে। একদা দক্ষিণ আমেরিকা ছিল তাদের বিচরণের অভয়ারণ্য, এখন সেখানে বিচরণক্ষমতা কিছু সীমিত হয়ে এসেছে বিধায় এশিয়া-আফ্রিকার কপালে নতুন করে ভোগান্তি শুরু হয়েছে। ভেবে দেখুন তো, লিবিয়ায় যদি গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে, সে সমস্যা তারা নিজেরাই সামলে নেবে। সেখানে ন্যাটো কোন অধিকারে সরকারি বাহিনীর ওপর বোমা ফেলবে; নো ফ্লাই জোন ঘোষণার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
দিক না দিক, তারা 'আপনি মোড়ল'। তাই সব কিছু দেখভাল করার অধিকার তাদেরই। তাই সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে টেনে বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত করা হয়েছে। তুরস্কের মতো মেরুদণ্ডহীন রাষ্ট্রকে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে সিরিয়ার পেছনে। কোন আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির বলে তুর্কি বিমান সিরিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে? আবার তা ভূপাতিত করা হলে প্রবল তর্জন-গর্জন এবং তা পরাশক্তির পক্ষেও। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, বাশারকে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না, তাই আরব দেশগুলোকে তাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে সিরিয়ার সদস্যপদ স্থগিত করতে।
এ-জাতীয় অঘটনের তালিকা বলা বাহুল্য দীর্ঘ। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের দুনিয়া মুঠোয় নিতে উঠে আসা রাষ্ট্রশক্তির অনাসৃষ্টির কাহিনী সময়ের কক্ষে যা রক্ষিত, কেউ সেদিকে তাকায়, কেউ তাকায় না। তবে বাংলাদেশি কাগজগুলোর মতো এখনকার কলাম লেখকরাও খুব তুখোড়। তাই বিশ্বরাজনীতির অঘটন নিয়ে লেখার বিরাম নেই।
দেখছি একজন লিখেছেন, 'কার জন্য এই বিভীষিকা?' আফগানিস্তানে সম্প্রতি ন্যাটো সেনাদের হত্যা এবং মার্কিন সেনাদের বর্ধমান আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে লেখাজোখা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি নাউয়ের বরাত দিয়ে ওই কলামে বলা হয়েছে, '২০১২ সালের সাত মাসে ১৫৪ জন মার্কিন সেনা আত্মহত্যা করেছে।' অর্থাৎ অন্যায় যুদ্ধের মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে তাদের আত্মহনন।
তবু মানবিক বোধ অন্যের ঘরে হামলা চালানো থেকে তাদের বিরত করবে না। দিন কয়েক আগের এক খবরে দেখা গেল, ব্রিটেন সিরীয় বিদ্রোহীদের অর্থ সাহায্য দেবে। কেন? কী স্বার্থ তাদের? স্বার্থ নিশ্চয়ই আছে। তাই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন তাদের সাম্রাজ্য হারিয়েও আধিপত্যবাদী অভিযান থেকে পিছিয়ে থাকছে না। পৃথিবীর যেখানে যত অনাসৃষ্টি, সেখানেই যত পরাশক্তি।
অন্নদাশঙ্কর রায়ের চমকপ্রদ ব্যঙ্গাত্মক ছড়ার কিছু ছত্র তাদের বেলায় খুবই জুতসই, তবে অবশ্য চরিত্র পাল্টে। গিন্নি বলেন, 'যেখানে যা কিছু অনিষ্টি/সকলের মূলে কমিউনিটি'। 'স্পেক্টর ইজ হন্টিং ইউরোপ'-এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বব্যাপী এমনই বিস্তার ঘটেছিল যে এর বাংলার অন্দরমহলও তা থেকে বাদ যায়নি_এরই প্রকাশ অন্নদাশঙ্করের বিদ্রূপাত্মক ছড়ায় বিপরীত মাত্রায়। আর তাই সঠিক চরিত্রে দেখা যাচ্ছে বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির খেলায়।
কোথায় নেই তারা? কবে নেই? শোকাবহ ১৫ আগস্টের কাগজে 'ভুট্টো-কিসিঞ্জার সংলাপ' বিষয়ক একটি লেখায়ও দেখা যাচ্ছে একাত্তরের বিরোধিতার পরও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের মাথাব্যথা যাচ্ছে না। তখনো পাকিস্তান-বাংলাদেশ কনফেডারেশনের অলীক স্বপ্ন যেমন ভুট্টোর, তেমনি কিসিঞ্জারের। এমনকি সেই ভবিষ্যদ্বাণী : 'মুজিব টিকবে না, সেনাবাহিনী আসবে।' যে যা-ই বলুন, আমার ধারণা, পঁচাত্তর ট্র্যাজেডির ষড়যন্ত্র এমন খোলামেলা ছিল যে তা সিআইএর অজানা থাকার কথা নয়, সংশ্লিষ্টতা থাকুক না থাকুক। শেষোক্ত বিষয়ে শেষ কথা বলা এখনো অনেক বাকি। ভবিষ্যৎ তথ্যই তা বলবে।
আসলে পাঠক, যে কথা বলতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির এত সাতকাহন তা হলো, মিসরের বর্তমান ক্ষমতাসীনদের চরিত্র বিচার নিয়ে। উদার গণতন্ত্রী নাসেরকে নিয়ে কম উদ্বেগ ছিল না ওয়াশিংটনের। আনোয়ার সাদাত ও হোসনি মুবারককে দিয়ে সে হতাশা কাটিয়ে ওঠে পেন্টাগন। কিন্তু অপশাসনের প্রতিক্রিয়ায় উঠে আসা ইসলামী বিপ্লবী দল যত অনর্থের মূল। বহুলপ্রচারিত ভাবনা যে সাদাত হত্যার পেছনে ছিল ইসলামী জঙ্গি গোষ্ঠী। যেমন তাদের উত্থান একই প্রক্রিয়ায় আলজেরিয়ায়, যা আলজেরীয় বিপ্লবের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছে। অবশ্য সে জন্য বিপ্লবোত্তর শাসকরাও কম দায়ী নন।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী জঙ্গি উত্থান অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। স্বৈরশাসন, অপশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ তোষণ এ-জাতীয় উত্থান বা অভ্যুত্থানের অন্যতম নেপথ্য কারণ। সাদাত থেকে মুবারক ওয়াশিংটন-তেল আবিবের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তাই জনস্তরে এবং শিক্ষিত শ্রেণীর নানা স্তরে মিসরীয় শাসনের একনায়কত্বের বিরোধিতার পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ, বিশেষ করে ইঙ্গ-মার্কিন বিরোধিতার বিষয় লুকোছাপা ছিল না।
তাই মিসরে আরব বসন্তের ঘনঘটায় কারো কারো প্রত্যাশা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু মুবারক শাসনে গণতন্ত্রীদের উঠে আসতে না পারা এবং গোপনে বেড়ে ওঠা ইসলামী জঙ্গি তৎপরতাও সাংগঠনিক বৃদ্ধি যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে রেখেছিল, তাতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রভাব প্রধান হয়ে ওঠার কথা। মূলত গণতন্ত্রীদের নেতৃত্বের অভাব তাদের জন্য সুযোগ তৈরি করে দেয়। মুবারক শাসনে অতিষ্ঠ সংশ্লিষ্ট গণতন্ত্রমনা মিসরীয় নাগরিকের সেই দলের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার কথা নয়। তাই নেতিবাচক ভোটে ইসলামী ফ্রন্টের ড. মুহাম্মদ মুরসির বিজয়।
এরপর যথারীতি সেনাবাহিনী বনাম প্রেসিডেন্ট মুরসির দ্বন্দ্ব। যথারীতি ওয়াশিংটন ঘটনাবলির পর্যবেক্ষক। সিদ্ধান্ত নেওয়া একটু কঠিন হয়ে উঠেছিল কোন পক্ষকে সমর্থন দেওয়া যেতে পারে তা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট মুরসির পক্ষেই গেল সিদ্ধান্ত। ওয়াশিংটনের ঘোষণা যথারীতি কূটনৈতিক; যেমন_মিসরের সেনাবাহিনীতে রদবদল প্রত্যাশিত ছিল, অর্থাৎ ওয়াশিংটন তা সমর্থন করে।
এর কারণ একাধিক। আমার ধারণা, এর মূল কারণ জনগণের প্রতিক্রিয়া এবং গণমাধ্যমের নয়া প্রেসিডেন্টের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ। তা ছাড়া মুবারক সমর্থক সেনাপ্রধানদের সরিয়ে দেওয়া হলেও বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অন্যতম। মুরসি আপাতত নমনীয় পথ ধরে চলার ঘোষণা দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর তরুণ সদস্যদের মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট মাত্রায় মুরসির পক্ষে সমর্থন। প্রবীণ সামরিক কর্মকর্তাদের বাড়াবাড়ি কোনো পক্ষেরই সমর্থন পায়নি।
এ অবস্থায় ড. মুরসিকে ওয়াশিংটনের সমর্থন কিছুটা বিস্ময়কর মনে হলেও আদৌ তা নয়। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আপাতত নমনীয়তা ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক কূটনীতির মধ্যেই পড়ে। এরপর অনুকূল সময়ের জন্য অপেক্ষা। এদিক থেকে ইসরায়েলও কম চৌকস নয়, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে অদূরদর্শী ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে। তবে ওয়াশিংটন এসব বিষয়ে ধীরস্থির। তারা অপেক্ষা করতে জানে।
তবে এসব ঘটনা তাহরির স্কয়ারে প্রাথমিক পর্যায়ে উপস্থিত লাখো মানুষের গণতন্ত্রী বা প্রগতিবাদীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, তাদের আশ্বস্ত করেছে, না উদ্বিগ্ন করেছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এটা ঠিক, অনেকটা দুয়ে দুয়ে চার হিসাবে মেলানোর মতো যে দীর্ঘ একনায়কী অপশাসনের ফলে জনসাধারণের তখনকার শাসকবিরোধী মুসলিম ব্রাদারহুডের পক্ষে সমর্থন বড় একটা কম নয়।
গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের জন্য দুর্ভাগ্য যে ঔপনিবেশিক বা স্বৈরশাসন থেকে মুক্ত দেশগুলোতে শাসকশ্রেণী জনস্বার্থের পক্ষে সুষ্ঠু ভূমিকা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাখেনি। ফলে জনমনে হতাশা। আবির্ভাব ইসলামী গোষ্ঠীর, ক্রমে তাদের জনপ্রিয়তা এটা যেন এক ধরনের নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে। গণতন্ত্রীরা বা প্রগতিবাদীরা এসব ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়নি এবং নিচ্ছে না। ফলে ক্ষমতাসীন ইসলামী শাসনতন্ত্রও কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তির সমর্থন পেয়ে যাচ্ছে, সেটা পরিস্থিতির কারণে। আফগানিস্তানে তারা তা-ই করেছে।
মিসরের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় সব পক্ষই সময়ের অপেক্ষায়। যেমন_ওয়াশিংটন, পেন্টাগন, তেমনি মিসরীয় বাহিনীর সাবেক জেনারেলদের সমর্থকরা; তেমনি মুসলিম ব্রাদারহুডের নেপথ্য নায়করা। সবাই পরিস্থিতির ওপর কড়া নজর রাখছে অনুকূল সময়ের জন্য। আমাদেরও অপেক্ষা কাদের পক্ষে শিকে ছেঁড়ে তা দেখার জন্য। মুরসি আপাত দৃষ্টিতে দক্ষ খেলোয়াড় বলেই তিনি জানেন উগ্রপন্থা বা হঠকারী পদক্ষেপ সাধারণত সুফল দেয় না। তাই বাইরের নমনীয়তা রক্ষা করে তার ধীরস্থির চাল। তেমনি অপেক্ষা পেন্টাগনের সঠিক সময়ে সঠিক চাল দেওয়ার জন্য। কারণ আরববিশ্বের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হাতছাড়া করা
যায় না।
লেখক : ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.