অভিমত ॥ জেলজরিমানায় বিষমুক্ত হবে না by শিখা ব্যানার্জী

দুষ্টচক্রের লোভের ঘড়া ভরে দেবার জিম্মাদার বনে গেছি আমরা। প্রতিদিন একটু একটু করে বিষ গিলে চলেছি। ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ যা কিছু খাচ্ছি, তাতেই মিশে আছে বিষাক্ত রাসায়নিক। তাই ফল, সবজি, মাছ-মাংস এখন আর দু-চার দিনে তো নয়ই, ২/১ মাসেও পচে গলে নষ্ট হয় না,


একদম তরতাজা থাকে, যেন ভ্রম হয়, সদ্য গাছ থেকে পেড়ে এনেছে, নয়তো সদ্য ধৃত, বা জবাইকৃত স্ব-স্ব দ্রব্য। তাছাড়া সেমাই, নুডলস, কেক-বিস্কুট, জুস, মসলা, ঘি-তেল সব কিছুতেই বিষ ভেজাল। আর আমরা বাধ্য হচ্ছি সেগুলোই কিনে খেতে, আর কোন উপায় নেই বলে। আমরা এমন এক দেশে বাস করছি, যার একদা গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য থাকলেও বর্তমানে তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এখন বিশ্বে তার পরিচিতি কলঙ্কিত জাতি হিসেবে, কারণ এ দেশ জাতির পিতার রক্তে হাত রাঙিয়েছে। স্বাধীনতার শত্রুরা দাপিয়ে বেড়ায়ু দেশময়, রাজনীতির আদর্শ আজ আর রাজনীতিবিদদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে নতুন প্রজন্মও দিকভ্রষ্ট, লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে, যোগ্য উত্তরসূরি হওয়ার কোন শিক্ষাই তারা পাচ্ছে না কোথাও।
লোভ-লালসা সেই সুযোগে পাক্কা আসন গেড়ে বসেছে দুর্বৃত্তদের মনে ও মননে। লোভের পাপামৃত পানে বিরত থাকতে পারেনি আইনের যারা রক্ষক, ধারক ও বাহক। ফলে পাপিষ্ঠরা মহাউল্লাসে যা মন চায় তাই করে যাচ্ছে, কোন বিবেকবোধই তাদের অন্তরে জেগে উঠছে না, দেশের প্রতি কণামাত্র মমত্ববোধ তাদের মধ্যে অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছে না, দেশের মানুষ বাঁচল কি মরল তাতেও যেন তাদের কিছু যায়-আসে না। তারা এক ও অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে, আর তা হলো কিভাবে প্রতিটি ক্ষেত্র হতে মুনাফার ক্ষীর তুলে আনা যায়, আর বিলাস-ব্যসনে গা ভাসিয়ে দিয়ে তোলা যায় সুখের ঢেকুর।
বিএসটিআইর খাদ্য পরীক্ষাগার কর্মকর্তা ও মোবাইল কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেটরা প্রায় সমস্ত খাদ্য-দ্রব্যে বিষ ভেজালের উপস্থিতি দেখে হতভম্ব হয়ে গেছেন। স্বাস্থ্য-অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছেন, বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী ও পণ্য ব্যবহারে এদেশের মানুষ ক্যান্সার, কিডনি, লিভার নষ্টসহ মরণ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। তারা আরও বলেছেন যে, প্রতিবছর দ্বিগুণ হারে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছেন, এ বিষাক্ততা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ২০২০ সাল নাগাদ মরণ-ব্যাধি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়বে। তখন তারা সে ভয়াবহতা সামাল দিতে পারবেন না বলেও হতাশা ব্যক্ত করলেন। তারা এও বললেন, সেদিনের সেই মহামারী রোধে চিকিৎসকদের নাকি কিছুই করার থাকবে না। অতিশয় সরল ও অকপট স্বীকারোক্তি তাদের!
হতদরিদ্র দেশ আমাদের, এখনও সিংহভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে এ দেশে। রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে খোলা আকাশের নিচে হাজার হাজার ছিন্নমূল মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে, ডাস্টবিনের উচ্ছিষ্ট খাবার কুড়িয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি করছে। গণতন্ত্রের গলাবাজি চলছে এদেশে, কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের সুফল আজও জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারেনি। রাজনীতিবিদদের আদর্শচ্যুতি ঘটেছে, ফলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আইনের কঠোর বেষ্টনীও এখন ঝড়ো তা-বে নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেই সুযোগে মুনাফালোভীরা দেশময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের সমস্ত অপকর্মে তারা শীর্ষ পর্যায় থেকে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও সহযোগিতা পাচ্ছে । যেমন মোবাইল কোর্ট যখন ভেজালবিরোধী অভিযানে নামে, তাদের নানাভাবে বিভ্রান্ত করা হয় ভুল তথ্য দিয়ে, মাঠ পর্যায়ের এক শ্রেণীর লোভী কর্মকর্তা সেলামি পাওয়ার লোভে বিষাক্ত খাদ্যসামগ্রী উৎপাদনকারীদের পক্ষে ভাল তথ্য দেয়। আর যারা এখনও এই নষ্ট দুনিয়ায় সততার পরিচয়ে মানসম্মত ও ভেজালমুক্ত খাদ্যসামগ্রী তৈরি করছে তাদের সম্বন্ধে ভুল তথ্য দিয়ে হয়রানি করা হয়। যেন ভেজালকারীরাই এই দালালদের উচ্চমূল্যের টোপ গিলিয়ে বাজারে সেট করে রেখেছে। এ রকম ভেজালমুক্ত প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পাওয়া গেছে ধামরাই উপজেলায়। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে জুস, কোল্ডড্রিংস, দুধসহ নানাবিধ খাদ্যসামগ্রী উৎপাদন করে থাকে একটি কোম্পানি। তাদের উৎপাদিত পণ্য ১০০% স্বাস্থ্যসম্মত বলে সরকারী পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হয়েছে। তারা অভিযোগ করেছে যে, মুনাফালোভী বিষাক্ত চক্র তাদের নানাভাবে হয়রানির চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাইছে, আমরা নষ্ট, তোমরা স্পষ্ট থাকবে কেন?
আরও একটি স্বচ্ছতার ঠিকানা আমরা খুঁজে পেয়েছি পুরান ঢাকায়, সেখানেও একটি কোম্পানি শুরু থেকেই তারা ভেজালমুক্ত পরিবেশে খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে আসছে। তাদের এ বেকারি থেকে রমজান মাসজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে। শুনে প্রশান্তিতে মন ভরে গেল, এখনও তাহলে কিছু অবশিষ্ট আছে! সততার নির্বাসন শতভাগ হয়নি তাহলে! তবে এরা সংখ্যায় এত কম যে অনেকটা মাথা নিচু করে টিকে আছে।
এভাবেই চলছে দেশময় বিষ-ভেজালের মারণ-যজ্ঞ। এ রকম দাপটের নষ্ট বাজারে মোবাইল কোর্টের ২/৫ জনের ভেজালবিরোধী অভিযান হাস্যকর নয় কি? কি ফল বয়ে এনেছে বা ভবিষ্যতে বয়ে আনবে মাঝে মাঝে দু-দশ বস্তা বিষাক্ত সেমাই, ফলমূল কিংবা অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী নষ্ট করে? কি শিক্ষা পাবে ২/৪ মাস জেল খেটে বা ২/৪ লাখ টাকা জরিমানা দিয়ে?
দেশ পরিচালনায় যখন যারা থাকেন, তাদের ওপর সমগ্র জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের গুরুদায়িত্ব বর্তায়। কারণ এটা গণতান্ত্রিক দেশ, জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে হয়, তাই জনস্বার্থ উপেক্ষা করার কোন এখতিয়ার তাদের নেই।
দেশে যখন ভেজালের মহোৎসব লেগেই আছে, জনস্বাস্থ্য যখন চরম হুমকির সম্মুখীন, এহেন মারাত্মক বিপর্যয়ে কঠোরতম পদক্ষেপ নেয়া ছাড়া সরকারের সামনে আর দ্বিতীয় কোন বিকল্প পথ খোলা নেই। আর সে কঠোরতম পথটি হলো বিষাক্ত বিষ-ভেজালকারীদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা এবং অবিলম্বে তা কার্যকর করা।
shikha231960@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.