নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়কই সমাধানের পথ by কাজী সিরাজ
এখন পর্যন্ত মূল দুই শিবিরে বিভক্ত আমাদের জাতীয় রাজনীতি বর্তমানে এক অস্থির সময় অতিক্রম করছে। জাতীয় অতীব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতেও জাতীয় ঐকমত্যের পথে প্রধান অন্তরায় বিভাজনের রাজনীতি। সাবেক রুশ-ভারত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অক্ষশক্তির অনুসারীরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুসরণের কথা বলে জাতীয় বিভাজনের রাজনীতিকে এখনো শাণিত করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, শক্তি এমনকি ব্যক্তিবিশেষের অবিস্মরণীয় অবদানকে তারা অগ্রাহ্য করে। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার তারাই যেন 'সোল এজেন্ট'। বস্তুত এটা স্বাধীনতার প্রাণপণ যুদ্ধে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ভূমিকা ও অবদান ছিনতাই করার শামিল। শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় নির্দল মানুষের অভিযোগ, নির্বাচিত সরকারের নামে তারা দেশে নির্বাচিত স্বৈরাচার কায়েম করেছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন শিবির নিজেদের খাঁটি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ধারার অনুসারী বলে দাবি করলেও আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের চরম ও প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। জামায়াতের সঙ্গে 'এক দেহে লীন' হয়ে তারা প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ধারার অনুসারী বলে দাবি করতে নৈতিক অধিকার কার্যত হারিয়ে ফেলেছে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী কোনো শক্তি দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী শক্তি হতে পারে না। বিএনপি নেতৃত্বাধীন এই শিবির বস্তুত দেশে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার ক্ষেত্র তৈরি করে চলেছে, যার চূড়ান্ত পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। বিপজ্জনক হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী এই দুই শিবিরের রাজনীতি ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বাবস্থার মতো সংঘর্ষপ্রবণ হয়ে উঠছে। সঠিক সময়ে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে নাগরিক সমাজে যথেষ্ট সন্দেহ থাকলেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এই প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে দুই পক্ষ শিগগিরই শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবে।
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে লীগ সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে তারা বারবার উচ্চ আদালতের নির্দেশের দোহাই দিচ্ছে। উচ্চ আদালতের যে রায়ের সূত্রে সরকার এমন একটি নাজুক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পূর্ণাঙ্গ সে রায়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি। যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আরো দুটি টার্ম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করা যেতে পারে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার রায়ে তার লাভের অংশটুকু গ্রহণ করেছে, ব্যবহার করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারপক্ষ আগামী নির্বাচনে তার জন্য একটা নিরাপদ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করলেও অতি শিগগিরই তা বিষফোড়ায় রূপ নেবে বলে মনে হচ্ছে। লীগ নেতা ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত ১০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনা-ত্রিশের লোকের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকালে সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংবিধানের বাইরে কোনো আলোচনার সুযোগ নেই।
একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ে এক বড় সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। তাঁরা কথা বলছেন এই ইস্যুতে দুই নেত্রীর পরস্পরবিরোধী অটল অবস্থানের আলোকে। প্রধানমন্ত্রী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাচক করে দিয়েছেন আর বিরোধীদলীয় নেত্রী হুঁশিয়ার করে বলেছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। এমন পরিস্থিতিতে সুধীজনরা বলছেন, দুই নেত্রী তাঁদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান পরিবর্তন করে কিছুটা নমনীয় না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক দল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিল কেন? প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সংবিধান সংশোধনের জন্য যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তারা প্রায় সবাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং তা মিডিয়ায়ও এসেছিল। যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরোধিতা করছেন, সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে এ ব্যবস্থা বহাল থাকবে। কমিটির সুপারিশ চূড়ান্তকরণের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরই পাল্টে গেল সব। কমিটির সদস্যরাও ভোল ও বোল পাল্টে ফেললেন। এখন তাঁরা বলছেন, ব্যবস্থাটি এখন যেহেতু সংবিধানে নেই, তাই তা আর হবে না। এ নিয়ে কোনো আলাপ করলেও যেন বউ তালাক হয়ে যাবে। আমাদের ধারণা, আলাপ হবে, হতে হবে। কারণ একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস ও সন্দেহ চরমে। তখন আমরা দেখব সুরঞ্জিত বাবুদের বউ তালাক হয় কি না।
১৯৯৪ সালে ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসনটি বিএনপির বাড়াবাড়িতে হাতছাড়া হওয়ার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যখন উত্থিত হয়, তখনো কিন্তু সংবিধানে এ ব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ১৯৯৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা অ্যানিয়াওকু পর্যন্ত ঢাকায় এসেছিলেন। দুই পক্ষের সংলাপ শুরু করানোর জন্য এরপর এমেকা অ্যানিয়াওকুর প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন একই বছরের ১৩ অক্টোবর। ২০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন এবং সমস্যার কোনো সুরাহা করতে না পেরে ২১ নভেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর আন্দোলন আরো তীব্র হয় এবং তা সহিংস রূপ ধারণ করে। দীর্ঘ আড়াই বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হরতাল, অবরোধ ও ৯ মার্চ ১৯৯৪ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২২ দিনব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের পর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং তা কার্যকর হয় ৩০ মার্চ ১৯৯৬। উল্লেখ্য, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির যুগপৎ আন্দোলনের মুখে দিশেহারা শাসকদল বিএনপিই সংসদে বিলটি উত্থাপন করেছিল। বিরোধী দলের দাবিও ছিল তাই যে সরকারি দলকেই সংসদে বিল উত্থাপন করতে হবে। এ কাজটি আরো আগে করলে বিরোধী দল হয়তো একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করত না।
এখনকার পরিস্থিতিও একই রকম মনে হচ্ছে। সংবিধান সংশোধনের পর এবার জটিলতা আরো বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী রেল মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে মধ্যরাতে গাড়িভর্তি টাকার বস্তা উপাখ্যানের নায়ক বলে জনগণের অভিযোগের আঙুল যাঁর দিকে, সেই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা যতই বলুন না কেন যে সংবিধানের বাইরে কিছু করা হবে না, সে ব্যাপারে অবশ্যই অটল থাকা যাবে না যদি সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হয়। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হবে। সংবিধানের ১২৩ (ক)তে বলা আছে, 'মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে, ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' সরকারের প্রস্তাবিত দলীয় বা সর্বদলীয় সরকারে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং সংসদও বহাল থাকবে আর বর্তমান এমপিরা এমপি হিসেবেই নির্বাচন করবেন_বিরোধী দল এ ব্যবস্থা মেনে নেবে বলে আশা করাটা কি ঠিক হবে? সংবিধান সংশোধন করে এ জটিলতার অবসান করতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানের পূর্বাবস্থায় ফেরত নেওয়া না হলেও নির্দলীয় একটি ব্যবস্থা নতুন পথ খুঁজতে হবে। ঈদের পরই বিএনপি তাদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার একটি রূপরেখা হাজির করবে বলে জানা গেছে। তখন এ ইস্যুতে আন্দোলনও নতুন গতিবেগ হবে বলে ধারণা করা যায়। সরকারের নানা ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ, যা জনগণ বিশ্বাস করেছে, রেলের কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে জনগণের ধারণায় স্বয়ং মন্ত্রীরই কালো বিড়াল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির তীব্র সংকট, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অগ্নিমূল্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, গুমসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে জনগণ ক্ষুব্ধ ও অনেকটা দ্রোহী হয়ে উঠছে। সরকারের গণ-বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নেবে বিরোধী দল, যদিও তাদের অতীতও ভালো নয়। কিন্তু সরকারই সংবিধান সংশোধনসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি করে বিরোধী দলকে আন্দোলনের সুযোগ ও শক্তি দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই আন্দোলন গড়ে উঠবে, যদি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় না হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক ও আদর্শিক লাইনের সংঘাত।
এমেকা আর নিনিয়ান না হোক, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরা এ ব্যাপারে দূতিয়ালি শুরু করেছেন। তাতে কিছু না হলে আন্দোলনের নামে আবার সংঘাত-সংঘর্ষ। দেশে শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনী এনে আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন অথবা আবার ওয়ান-ইলেভেনের পট-পরিস্থিতি সরকারকে এই দুইয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। ইগোর কোনো মূল্য নেই এখানে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
kazi.shiraz@yahoo.Com
পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে লীগ সরকার সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে তারা বারবার উচ্চ আদালতের নির্দেশের দোহাই দিচ্ছে। উচ্চ আদালতের যে রায়ের সূত্রে সরকার এমন একটি নাজুক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পূর্ণাঙ্গ সে রায়টি এখনো সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি। যেটুকু প্রকাশ পেয়েছে, তাতে আরো দুটি টার্ম নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করা যেতে পারে বলে বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার রায়ে তার লাভের অংশটুকু গ্রহণ করেছে, ব্যবহার করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারপক্ষ আগামী নির্বাচনে তার জন্য একটা নিরাপদ অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে বলে মনে করলেও অতি শিগগিরই তা বিষফোড়ায় রূপ নেবে বলে মনে হচ্ছে। লীগ নেতা ও মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গত ১০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জনা-ত্রিশের লোকের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী নির্বাচনকালে সরকারব্যবস্থা নিয়ে সংবিধানের বাইরে কোনো আলোচনার সুযোগ নেই।
একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ে এক বড় সমাবেশে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া কোনো নির্বাচন হবে না। তাঁরা কথা বলছেন এই ইস্যুতে দুই নেত্রীর পরস্পরবিরোধী অটল অবস্থানের আলোকে। প্রধানমন্ত্রী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাচক করে দিয়েছেন আর বিরোধীদলীয় নেত্রী হুঁশিয়ার করে বলেছেন, নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। এমন পরিস্থিতিতে সুধীজনরা বলছেন, দুই নেত্রী তাঁদের পরস্পরবিরোধী অবস্থান পরিবর্তন করে কিছুটা নমনীয় না হলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য।
প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক দল তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিল কেন? প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সংবিধান সংশোধনের জন্য যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তারা প্রায় সবাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং তা মিডিয়ায়ও এসেছিল। যে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরোধিতা করছেন, সংসদীয় কমিটির কো-চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে এ ব্যবস্থা বহাল থাকবে। কমিটির সুপারিশ চূড়ান্তকরণের আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার পরই পাল্টে গেল সব। কমিটির সদস্যরাও ভোল ও বোল পাল্টে ফেললেন। এখন তাঁরা বলছেন, ব্যবস্থাটি এখন যেহেতু সংবিধানে নেই, তাই তা আর হবে না। এ নিয়ে কোনো আলাপ করলেও যেন বউ তালাক হয়ে যাবে। আমাদের ধারণা, আলাপ হবে, হতে হবে। কারণ একের প্রতি অপরের অবিশ্বাস ও সন্দেহ চরমে। তখন আমরা দেখব সুরঞ্জিত বাবুদের বউ তালাক হয় কি না।
১৯৯৪ সালে ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের আসনটি বিএনপির বাড়াবাড়িতে হাতছাড়া হওয়ার পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি যখন উত্থিত হয়, তখনো কিন্তু সংবিধানে এ ব্যবস্থা ছিল না। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য ১৯৯৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর কমনওয়েলথ মহাসচিব এমেকা অ্যানিয়াওকু পর্যন্ত ঢাকায় এসেছিলেন। দুই পক্ষের সংলাপ শুরু করানোর জন্য এরপর এমেকা অ্যানিয়াওকুর প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন একই বছরের ১৩ অক্টোবর। ২০ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন এবং সমস্যার কোনো সুরাহা করতে না পেরে ২১ নভেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর আন্দোলন আরো তীব্র হয় এবং তা সহিংস রূপ ধারণ করে। দীর্ঘ আড়াই বছর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, হরতাল, অবরোধ ও ৯ মার্চ ১৯৯৪ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ২২ দিনব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের পর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে ১৯৯৬ সালের ২৫ মার্চ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয় এবং তা কার্যকর হয় ৩০ মার্চ ১৯৯৬। উল্লেখ্য, বিরোধী দল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টির যুগপৎ আন্দোলনের মুখে দিশেহারা শাসকদল বিএনপিই সংসদে বিলটি উত্থাপন করেছিল। বিরোধী দলের দাবিও ছিল তাই যে সরকারি দলকেই সংসদে বিল উত্থাপন করতে হবে। এ কাজটি আরো আগে করলে বিরোধী দল হয়তো একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করত না।
এখনকার পরিস্থিতিও একই রকম মনে হচ্ছে। সংবিধান সংশোধনের পর এবার জটিলতা আরো বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী রেল মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে মধ্যরাতে গাড়িভর্তি টাকার বস্তা উপাখ্যানের নায়ক বলে জনগণের অভিযোগের আঙুল যাঁর দিকে, সেই মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা যতই বলুন না কেন যে সংবিধানের বাইরে কিছু করা হবে না, সে ব্যাপারে অবশ্যই অটল থাকা যাবে না যদি সব দলকে নিয়ে নির্বাচন করতে হয়। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সংসদ বহাল রেখেই নির্বাচন হবে। সংবিধানের ১২৩ (ক)তে বলা আছে, 'মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে, ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদ সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' সরকারের প্রস্তাবিত দলীয় বা সর্বদলীয় সরকারে শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন এবং সংসদও বহাল থাকবে আর বর্তমান এমপিরা এমপি হিসেবেই নির্বাচন করবেন_বিরোধী দল এ ব্যবস্থা মেনে নেবে বলে আশা করাটা কি ঠিক হবে? সংবিধান সংশোধন করে এ জটিলতার অবসান করতে হবে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংবিধানের পূর্বাবস্থায় ফেরত নেওয়া না হলেও নির্দলীয় একটি ব্যবস্থা নতুন পথ খুঁজতে হবে। ঈদের পরই বিএনপি তাদের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার একটি রূপরেখা হাজির করবে বলে জানা গেছে। তখন এ ইস্যুতে আন্দোলনও নতুন গতিবেগ হবে বলে ধারণা করা যায়। সরকারের নানা ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা, পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ, যা জনগণ বিশ্বাস করেছে, রেলের কালো বিড়াল ধরতে গিয়ে জনগণের ধারণায় স্বয়ং মন্ত্রীরই কালো বিড়াল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির তীব্র সংকট, যোগাযোগব্যবস্থার বেহাল দশা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অগ্নিমূল্য, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হত্যা, গুমসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতিতে জনগণ ক্ষুব্ধ ও অনেকটা দ্রোহী হয়ে উঠছে। সরকারের গণ-বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নেবে বিরোধী দল, যদিও তাদের অতীতও ভালো নয়। কিন্তু সরকারই সংবিধান সংশোধনসহ নানা জটিলতার সৃষ্টি করে বিরোধী দলকে আন্দোলনের সুযোগ ও শক্তি দিয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতেই আন্দোলন গড়ে উঠবে, যদি সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় না হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক ও আদর্শিক লাইনের সংঘাত।
এমেকা আর নিনিয়ান না হোক, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকরা এ ব্যাপারে দূতিয়ালি শুরু করেছেন। তাতে কিছু না হলে আন্দোলনের নামে আবার সংঘাত-সংঘর্ষ। দেশে শান্তিপূর্ণ সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার স্বার্থে সংবিধানের ষষ্ঠদশ সংশোধনী এনে আবার নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন অথবা আবার ওয়ান-ইলেভেনের পট-পরিস্থিতি সরকারকে এই দুইয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে। ইগোর কোনো মূল্য নেই এখানে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
kazi.shiraz@yahoo.Com
No comments