উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ-উল-ফিতর উদ্যাপিত- রাজধানীতে বিদ্যুত পানি সঙ্কট ছিল না

দীর্ঘদিন পরে রাজধানীবাসী এবার স্বাচ্ছন্দ্যে ঈদ উদ্যাপন করতে পেরেছে। রাজধানীসহ বড় বড় শহরে ঈদ-উল-ফিতর উপলক্ষে বিদ্যুত সরবরাহ ছিল নিরবচ্ছিন্ন। এ সময় নিত্যপণ্যের দাম ছিল সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে। রমজানের শুরু থেকেই বিদ্যুত সরবরাহ ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।


কোথাও পানি সঙ্কট ছিল না। ঈদে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল নিয়ন্ত্রণে। সব মিলিয়ে বিভিন্ন নাগরিক সমস্যা এবারের রমজানে নিয়ন্ত্রণে ছিল। সর্বশেষ ঈদে আবহাওয়াও অনুকূলে থাকায় নগরবাসীর এবার ঈদ কেটেছে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে। ঈদে নগরবাসীর বিন্দুমাত্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি।
রাজধানীর পাশাপাশি সারাদেশে উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে উদ্যাপিত হয়েছে এবারের ঈদ-উল-ফিতর। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর গত সোমবার অনুষ্ঠিত হয় ঈদ-উল-ফিতর। রবিরার রমজান মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে নেমে আসে খুশির বন্যা। ঈদে অগণিত ধর্মপ্রাণ মুসলমান নিজ নিজ ঈদগাহ ও মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করেন। দেশের প্রধান ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় হাইকোর্টসংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। নামাজ শেষে সব ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলিতে মিলিত হয় মুসল্লিরা। একে অপরের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদের নামাজে বিশ্বশান্তি ও আখেরাতের মুক্তি কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত পরিচালনা করা হয়।
ঈদের দিন প্রত্যেক বাড়িতে বাড়িতে রান্না করা হয় সেমাই, জর্দা, পোলাও, কোরমা, ফিরনিসহ নানা ধরনের খাবার। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই আনন্দে মেতে ওঠে। সবাই নতুন জামা কাপড় পরে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে এক অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, আত্মীয়স্বজন ও পাড়াপ্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেয় সবাই। অনেকে মৃত আত্মীয়-স্বজনদের কবর জিয়ারত করেন। প্রতিবারের ন্যায় এবারও দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। দেশের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে। বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব ঈদের প্রধান জামাতের ইমামতি করেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সুপ্রীমকোর্টের বিচারপতি, দেশের সিনিয়র রাজনৈতিক নেতা, দেশে অবস্থিত মুসলিম দেশগুলোর কূটনীতিকরা ঈদের প্রধান জামাতে শরিক হন।
এদিকে সোমবার ঈদের জামাত শেষে রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ও বিরোধী দলের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন শ্রেণীপেশা ও কূটনীতিকের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ঈদের নামাজ শেষে রাষ্ট্রপতি ঈদ উপলক্ষে সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং কূটনীতিকদের জন্য বঙ্গভবনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবনে ঈদের দিন সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। এদিকে বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও লেডিসক্লাবে ঈদের দিন দুপুরে বিদেশী কূটনীতিকসহ দেশের সর্বস্তরের জনগণের সঙ্গে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
এবারে রমজানের শুরু থেকেই বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ফলে রমজানের ইফতার সেহ্রিসহ ঈদ উৎসব পালন হয়েছে নির্বিঘেœ। প্রতিবার বিদ্যুত পরিস্থিতি নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ থাকলেও এবার সে ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। বিদ্যুত পরিস্থিতি নিয়ে কেউ কোন অভিযোগও করেনি। রমজান ও ঈদে বিদ্যুতের সরবরাহের স্বাভাবিক পরিস্থিতি অতীতে কখনও দেখা যায়নি। প্রথম রমজান থেকেই বিদ্যুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছিল বিশেষ ব্যবস্থা। পিডিবির পক্ষ থেকেও প্রথম রমজান থেকে প্রতিটি জোনে পৃথকভাবে বিদ্যুত পরিস্থিতি তদারকি করা হয়েছে।
বিদ্যুত সরবরাহের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল সন্তোষজনক। দু’একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া বড় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ফলে ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে, ঈদে বাড়ি ফেরা ও ঈদ উদ্যাপন হয়েছে নির্বিঘেœ। সন্ত্রাস চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবেশে স্বস্তির ঈদ উদ্যাপন করা সম্ভব হয়েছে। ঈদে ঢাকাসহ গোটা দেশেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল ছিল। পবিত্র মাহে রমজানের শুরু থেকেই সারাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়। এ সময়ে রাজধানীজুড়ে ছিল অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রমজানে ও পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে বিভিন্ন মার্কেট, বিপণিবিতান, কাঁচাবাজার, আড়তের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। স্পর্শকাতর স্থান, সড়ক, স্থাপনা, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন, লঞ্চ টার্মিনালে অতিরিক্ত র‌্যাব মোতায়েন ছিল। ফলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। ডাকাতি ও ছিনতাইকারীদের গ্রেফতারে র‌্যাবের বিশেষ টিম সব সময়ই থেকেছে মাঠে। শহরের প্রবেশ ও বহির্গমন পথগুলোতে বাড়তি চেকপোস্ট বসানো হয়েছিল।
এদিকে রমজানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। ঈদের ছুটি শেষে বুধবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, এবারের ঈদে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। সার্বিকভাবে ঈদ কেনাকাটার পরিবেশও ছিল শঙ্কামুক্ত। মানুষ রাত ১-২টা পর্যন্ত কেনাকাটা করেছে। কোথাও কোন ছিনতাই চাঁদাবাজি হয়নি। ঈদে ঘরে ফেরার ক্ষেত্রেও মানুষকে তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। তিনি বলেন, এবার যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে তা অব্যাহত থাকবে।
বিদ্যুত পানির পাশাপাশি সবজিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্য, কাপড়-চোপড় এবং ঈদের অন্যান্য সামগ্রীর দামও ছিল লোকজনের ক্রয় সামর্থ্যরে মধ্যে। এবার রমজানে কিছু নিত্যপণ্যের দাম যেভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল এর আগে কখনও এমনটি ঘটতে দেখা যায়নি। আবার বাজারে সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ ছিল পর্যাপ্ত। প্রথম রমজান থেকেই বাজার মূল্য নিয়ন্ত্রণে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রায় ১৪টি টিম বাজার মনিটরিংয়ে কাজ করেছে ঈদের আগ পর্যন্ত।
তবে সারা রমজানে আবহাওয়া বৈরী থাকলেও ঈদের তিনদিনে আবহাওয়া ছিল সম্পূর্ণ অনুকূল। অনুকূল আবহাওয়া থাকায় ঈদ উদ্যাপনে বাড়তি সুবিধা যোগ হয়। ঈদের দিন আগে ও পরের দিন আকাশে যেমন মেঘ ছিল। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির দেখাও মিলেছে। আবার কখনও রোদের দেখা মিলেছে। সব মিলিয়ে এবারের ঈদ উদ্যাপন হয়েছে অনাবিল আনন্দঘন পরিবেশে। দীঘদিন পর রাজধানীসহ সারাদেশের মানুষ এমন পরিবেশে ঈদ উদ্যাপন করতে পেরে খুব খুশি।
চট্টগ্রামে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদ উদ্যাপিত
স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, চট্টগ্রামে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে সোমবার ঈদ-উল-ফিতর উদ্যাপিত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে এবারের ঈদ জামাতগুলোর ঈদগায়ে না হয়ে মসজিদে মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তাই একাধিক মসজিদে একাধিক জামাতের আয়োজন করা হয়েছিল। নানা আয়োজন এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে এ দিনটি বর্ষণমুখর দিনেও জমে ওঠে মসজিদগুলোতে। এদিন নগরী ও বিভিন্ন জেলার ঈদ জামাতে অংশ নিয়ে দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। চট্টগ্রামে প্রধান ঈদ জামাত অনুষ্ঠিত হয় ওয়াসার মোড়স্থ জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে।
চট্টগ্রাম নগরীতে এদিন সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় প্রায় তিন শ’ ঈদ জামাত। এছাড়া স্থানীয়ভাবে শহর ও জেলায় অসংখ্য ঈদ জামাতের আয়োজন করা হয়। তবে চসিকের ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে বড় জামাতটি অনুষ্ঠিত হয় জমিয়তুল ফালাহ জাতীয় জামে মসজিদ ময়দানে। এখানে দু’দফা জামাতে অংশগ্রহণ করেন প্রায় ৪০ হাজার মুসল্লি। সবচেয়ে বড় জামাত হওয়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে জনস্রোত এ মাঠের অভিমুখে ছিল বেশি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সকাল সাড়ে ৮টায় প্রধান জামাতটি অনুষ্ঠিত হয় নগরীর আউটার স্টেডিয়ামে। এখানেও অংশগ্রহণ করেন সর্বস্তরের হাজার হাজার মানুষ।
মুসলিমদের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের এ দিনটি পালিত হয় আনন্দমুখর পরিবেশে। নামাজ শেষে চলে একে অপরের সঙ্গে কোলাকুলি এবং কুশল বিনিময়। রাজনৈতিকভাবে ভিন্ন মতের অনুসারী হলেও নেতারা নামাজ আদায়ের জন্য দাঁড়ান একই কাতারে। বিশেষ এ দিনটি বরাবরই যেন বিরোধ ভুলে যাওযার দিন। চরম বৈরী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি নেতারাও একে অপরের সঙ্গে অত্যন্ত হাসি মুখে আলাপে মত্ত হন। নামাজ শেষে সকলেই ছোটেন চট্টগ্রাম স্টেশনসংলগ্ন কবরস্থান, গরীবুল্লাহ শাহ মাজারসংলগ্ন কবরস্থান ও পারিবারিক কবরস্থানে। এছাড়াও মাজারসংশ্লিষ্ট কবরস্থানগুলোতেও ছিল জিয়ারতের জন্য আসা মুসল্লিদের ভিড়। প্রয়াত স্বজনদের আত্মার শান্তি কামনা করে তারা জিয়ারত করেন। এরপর চলে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের পালা। পুরো দিনটিই অতিবাহিত হয় এভাবেই। আর শিশুদের জন্য মহা আনন্দের দিন ঈদ-উল-ফিতর। নতুন জামা পরিহিত শিশু-কিশোরদের বিচরণ ও কোলাহলে মুখর হয় চারপাশ।
চট্টগ্রামে ঈদ-উল-ফিতরের দিন পর্যটন স্পটগুলোতে ছিল দর্শনার্থীদের ভিড়। এদিন বিকেলে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানুষকে ছুটতে দেখা যায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ফয়’স লেক, স্বাধীনতা পার্কসহ দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলোর দিকে। কারাগারে বন্দীদের মাঝে পরিবেশন করা হয় উন্নত খাবার। লম্বা ছুটিতে অধিকাংশ মানুষ গ্রামে চলে যাওয়ায় সড়কগুলো ছিল তুলনামূলক ফাঁকা। ফলে রাস্তায় দেখা গেছে অটোরিক্সা, রিক্সা এবং প্রাইভেট গাড়ির আধিক্য। যানবাহন কম থাকায় হাঁটাচলা সম্ভব হয়েছে নির্বিঘেœ। ঈদের ছুটি শেষ হলেও উৎসবের আমেজ এখনও অব্যাহত রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.