প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের একটি সফর : কিছু কথা by শাহনেওয়াজ বিপ্লব

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বের মাপকাঠিতে প্রথম সারির হবে, এই একটি স্লোগান ইদানীং চালু হয়েছে। 'দুঃখের তিমিরে আশার আলো'-এই স্লোগানটি। শুনতে ভালো লাগে; কিন্তু বাস্তব এবং বচনে অনেক ফারাক। বলা সোজা, করা কঠিন।


অসহ্য অবহেলা, বিশৃঙ্খলা, অশান্তি এবং নোংরা রাজনীতির শিকার আমাদের দেশের প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় তো বটেই, এমনকি শিক্ষা জগতের শেষ সোপান বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এ রাজনীতির শিকার হয়ে বিশ্বমানের পড়াশোনা করার কারো কোনো স্পৃহা বা উদ্যম নেই, শিশুদের মানও সেই মাপের। বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ভালো করছে এখনো, কেবল নিজেদের অধ্যবসায় আর মেধার জোরে। সত্য স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এই হচ্ছে বাংলাদেশে শিক্ষার বর্তমান চিত্র।
এই বাংলাদেশে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করব বলে আমরা মরিয়া হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি; কিন্তু কোনো মানই নেই যেখানে, সেখান থেকে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে একেবারে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যায় না রাতারাতি। ধরা যাক, ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ড দীর্ঘ ৮০০ বছর ধরে শুধু বিশ্বমানের শিক্ষাক্ষেত্রই নয়, মৌলিক গবেষণার এক অতুলনীয় ভাণ্ডার। আজকের নয়, কম করে ৫০০ বছর ধরে।
এসব আমরা সবাই জানি; কিন্তু সত্যটা হজম করতে আমাদের বড় আপত্তি। ঘটনা হলো, ধীরে ধীরে পরিবর্তনের ধারাকে নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য দরকার গভীর অধ্যবসায় ও অপরিসীম ধৈর্য।
ধান ভানতে গিয়ে এই শিবের গীত গাইতে হলো আমাদের ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব এম এম নিয়াজ উদ্দিনের কল্যাণে! পত্রিকান্তরে জানা গেছে, আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানে নিয়ে আসার জন্য ঈদের আগে আগে এক সফরে বেরিয়েছিলেন! সে সফরে তিনি চট্টগ্রাম শহর, কক্সবাজারের উখিয়া এবং সীতাকুণ্ডে কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করেছেন। কোনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি অবস্থান করেছেন পাঁচ মিনিট, কোনোটিতে সাত মিনিট আবার কোনোটিতে ১০ মিনিট। তবে যেখানেই তিনি গিয়েছেন_সব স্কুল থেকে একজন করে শিক্ষক বরখাস্ত করেছেন। বরখাস্তের পর যে নোটিশ তিনি পাঠিয়েছেন, তা অত্যন্ত চমকপ্রদ! এর একটি আমার পড়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছেন পরিদর্শনে দেখা যায়, প্রাথমিক স্তরে ছাত্রের নূ্যনতম দক্ষতার অভাব রয়েছে এবং ছাত্রের হাতের লেখা বর্ণ অস্পষ্ট। সে কারণে প্রধান শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্তের ওই কারণ জানার পর আমার ইচ্ছা ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবকে আমাদের চট্টগ্রামের দু-তিনজন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন পাঠাতে। অস্পষ্ট হাতের লেখা কাকে বলে, তখন তিনি বিষয়টা বুঝতেন। পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানীগুণীর হাতের লেখাও কিন্তু পাঠোদ্ধার করা কঠিন। এটা তেমন বড় কোনো ব্যাপার নয়_অথচ এ রকম একটা অজুহাতে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বরখাস্ত করেছেন, বরখাস্তের নোটিশটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। বরখাস্তের ঘটনায় একজন শিক্ষক অশ্রুসজল হয়ে আমাকে জানিয়েছেন, ওই বিদ্যালয়ে সচিব সাহেব ১০ মিনিট ছিলেন। প্রথম পাঁচ মিনিটে দু-একটি রেজিস্টার পরীক্ষা করার পর হঠাৎ তিনি ছাত্রদের পরীক্ষা চলছিল যে কক্ষে, সে কক্ষে যান এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর এক ছাত্রের পরীক্ষার খাতা নিয়ে তার হাতের লেখা অস্পষ্ট কেন জানতে চান? সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের একজন সচিব হিসেবে এইটুকু জানার অধিকার তাঁর আছে এবং তিনি কারণ দর্শাও নোটিশও দিতে পারতেন; কিন্তু সে পথে না গিয়ে তিনি সরাসরি শিক্ষকদের বরখাস্ত করেছেন, যা এখতিয়ার ও প্রশ্নসাপেক্ষ বটে।
যে ছাত্রটির হাতের লেখা অস্পষ্ট ছিল, সে মাত্র দ্বিতীয় শ্রেণীর শিশু। এ রকম একটি শিশুর গড়ে ওঠার জন্য মা-বাবা, শিক্ষক, সমাজ সবার অবদান অনস্বীকার্য। ছাত্রের হাতের লেখা অস্পষ্ট হওয়ার জন্য শুধু শিক্ষকদের দায়ী করা_এ ধরনের নজির আগে কখনো শোনা যায়নি।
তাই অস্পষ্ট হাতের লেখার জন্য শিক্ষকদের বরখাস্ত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব কী বার্তা দিতে চেয়েছেন জানি না। তবে দুর্মুখেরা বলছেন অন্য কথা। অনেকটা নিজের ক্ষমতা জাহির করাই তাঁর এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল বলে অনেকেই মনে করছেন। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে এম এম নিয়াজ উদ্দিন সদ্য বদলি হয়ে এসেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ে তিনি কোনো স্পেশালিস্ট নন। এর আগে তিনি পরিকল্পনা অধিদপ্তরে ছিলেন। নতুন মন্ত্রণালয়ে ক্ষমতা জাহির করার অজুহাতে তিনি সচিব হিসেবে তাঁর প্রথম সফরে ছাপোষা গরিব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বরখাস্ত করেছেন বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
ঘটনা যাই হোক। সচিবের কাছে আমার একটি প্রশ্ন : প্রাইমারি স্কুলের গরিব মাস্টাররা কত টাকা বেতন পান মাসে? সেটা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। এই যে ঈদের আগে আগে তিনি ঠুনকো এক অজুহাতে গরিব স্কুলশিক্ষকদের বরখাস্ত করলেন, ঈদের আগে তাঁদের বেতনের অর্ধেক টাকা কেটে নিয়ে তাঁদের পরিবার-পরিজনের ঈদের আনন্দ ম্লান করে দিলেন, এ জন্য নিজের বিবেকের কাছে তাঁর কোনো দায় আছে কি না?
আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের মতো অনেকেই ভেবে থাকেন, শুধু শিক্ষকরা চাইলেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বদলে দিতে পারেন; কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। সমাজের কাঠামো বা দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখেই ছাত্রছাত্রীরা তৈরি হয়। সমাজ যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়, অশিক্ষিত হয়, গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেয়, ছাত্রছাত্রীরা সেদিকেই ছোটে। বাংলাদেশে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী কোনো রকমে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যায়। অনেকেই খাতা-কলমও জোগাড় করতে পারে না। আর এভাবে তিন-চার ক্লাস পড়তে না পড়তেই বিদ্যালয়কে বিদায় জানিয়ে দুই পয়সা জোগাড় করতে মাঠে নামে। হাতের লেখা নিয়ে তাদের ভাববার সময় কই? এই বুকফাটা কাহিনী বাংলাদেশের শহরে অতটা নয়; কিন্তু বিশেষত এই দেশের অগণিত গ্রামগঞ্জের প্রতিদিনের কাহিনী।
যাহোক, একটা সহজ কথা সহজ করেই বলি। আজকের গরিব, দুস্থ ছেলেমেয়েরাই তো আগামী দিনের বাংলাদেশ গড়বে। তারা পড়াশোনা করছে বাংলাদেশে ছড়িয়ে থাকা দরিদ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে। এর মধ্যে অনেক প্রাইমারি স্কুলে প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষক অপ্রতুল। বসার টেবিল-চেয়ার নেই; কিন্তু তার পরও একমাত্র প্রাইমারি শিক্ষকরাই পারেন এই আগামী দিনের নাগরিকদের গড়ে তুলতে। তাই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবের কাছে সবিনয় নিবেদন, প্রাইমারি শিক্ষার উন্নতি করতে চাইলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছুতোনাতায় বরখাস্ত নয় বরং সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর উন্নয়ন করুন। প্রাথমিক শিক্ষকদের আরো বেতন বাড়ান, তাঁদের আরো সুযোগ-সুবিধা দিন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবহেলা করবেন না। কারণ তাঁদের হাত ধরেই গড়ে উঠবে বিশ্বমানের শিক্ষা কাঠামো।

লেখক : গল্পকার

No comments

Powered by Blogger.