কোথাও কেউ নেই by আহসান হাবীব
আমাদের ছোটবেলায় ঈদগুলো ছিল অসাধারণ। প্রতি ঈদে সন্ধ্যায় বাড়ির বারান্দায় স্টেজ বানিয়ে অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানে থাকত নাচ, গান, নাটক, ম্যাজিক আর কমিক। এসবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আমাদের সবার দাদাভাই। মানে হুমায়ূন আহমেদ। পাড়ার সবাই সেখানে অংশগ্রহণ করত। ঈদের অনেক আগে থেকেই শুরু হতো এর রিহার্সেল।
কাজেই ঈদ-আনন্দের উত্তেজনা শুরু হতো ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকেই। এখন যেমন টিভি চ্যানেলগুলোয় বলা হয়, ঈদের দিন থেকে শুরু করে টানা সাত দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য ঈদ আয়োজন... অনেকটা সে রকম; তবে আমাদেরটা হতো ঈদের আগের সাত দিন থেকে বর্ণাঢ্য ঈদ আয়োজন। এতে ছোটরা যেমন অংশগ্রহণ করত; বড়রাও করতেন সমানভাবে।
আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, তার সৌজন্যে চমৎকার একটা শৈশব পার করেছি। শুধু আমি কেন, আমার বয়সী পাড়ার সবাই তাকে মনে রেখেছে। তার মৃত্যুর পর সবাই আমাদের বাসায় এসে হাজির হয়েছে। নস্টালজিক সেই সব নাটক আর অনুষ্ঠানের কুশীলবরা। সবাই অশ্রু ফেলেছে। যে আনন্দ সে দিয়ে গেছে, সেগুলোই কি এখন অশ্রু হয়ে নেমে আসছে?
আমি একবার মাত্র তাকে কাঁদতে দেখেছি। প্রায় ৪০ বছর আগে। আমরা তখন পিরোজপুরের এক গ্রামে পলাতক জীবনযাপন করছি। বাবা নিখোঁজ। হঠাৎ খবর এলো, বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। আমি তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে। সে শান্ত হয়ে খবরটা শুনল। এলাকার বয়স্ক লোকজন তাকে ধরে একটা মসজিদে নিয়ে গেল। সঙ্গে মেজ ভাই আর এক মামা। উদ্দেশ্য সদ্য শহীদ বাবার আত্মার জন্য একটু দোয়া-দরুদ পড়া হোক। অজ পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট ছাপড়া একটা মসজিদে বসে আছি আমরা কয়েকজন। হঠাৎ বড় ভাই কাঁদতে শুরু করল হু হু করে। আমি তখন ফাইভ-সিক্সের ছাত্র, বাবার মৃত্যু সংবাদটা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু বড় ভাইকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আশ্চর্য হলাম। আমার প্রাণবন্ত হাসি-খুশি ভাইটা কাঁদছে। যার মাথা টিপে দিলে অসাধারণ সব মজার গল্প বলে, যে হঠাৎ মধ্যরাতে সবাইকে জাগিয়ে বিখ্যাত সব কবিতা আবৃত্তি করে, যে হঠাৎ কোনো ভালো বই পেলে সবাইকে ডেকে নিয়ে পড়ে শোনায়, আর আমরা অবাক হয়ে শুনি_ সেই ভাইটা এখন মাথা নিচু করে হু হু করে কাঁদছে! ৪০ বছর আগের সেই স্মৃতি... এখনও কী স্পষ্ট ভাসে চোখের সামনে!
সে চলে গেছে, এখনও তার সেই কান্না রেখে গেছে যেন আমাদের জন্য। তাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারের সব আনন্দ। এখন সেই আনন্দের মানুষটা নেই। সব আনন্দ এখন অশ্রু হয়ে ঝরছে...!
সেদিন এক টিভি চ্যানেল থেকে আমাকে ফোন করল_ হাবীব ভাই, একটু আসতে চাই আপনার বাসায়।
_ কেন?
_ একটু কথা বলব।
_ কী বিষয়ে?
_ স্যারকে ছাড়া আপনারা কীভাবে ঈদ করবেন_ সেটা একটু জানতে চাই।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই তার কথায়। এটা একটা জানার বিষয়? তাকে ছাড়া আমাদের ঈদটা হবে কীভাবে?... অনেক আগে ঈদের আগের দিন আমাদের সব ভাইবোন চলে আসত আমার পল্লবীর বাসায়। মা যেহেতু আমার সঙ্গে থাকেন, তাই মায়ের কড়া নির্দেশ_ তার সঙ্গে সবাইকে ঈদ করতে হবে। সবাই চলে আসত। আমরা তিন ভাই যেতাম একসঙ্গে ঈদের নামাজে। ফিরে এসে ভাইবোন তাদের ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে কত আনন্দ! রাতে সে একটা লটারির আয়োজন করত। সেই লটারির পুরস্কার পাওয়া নিয়ে ছোট-বড় সবার কী উত্তেজনা!
পরে অবশ্য চিত্রটা একটু বদলে গেল। ঈদের আগের দিন মা চলে যেতেন বড় ভাইয়ের বাসায়। সকালে উঠে আমি যেতাম তার বাসায়। মাকে সালাম করে তার সঙ্গে বসে নাস্তা করতাম। তারপর চলে আসতাম নিজের বাসায়। এখন তো সে আনন্দটাও নেই। কোনো আনন্দই নেই। কোনো ঈদ সংখ্যায় তার লেখা নেই। তার সরাসরি পরিচালিত কোনো নাটক নেই। সে নেই কোনোখানে... সে নেই মানে যেন এখন আর 'কোথাও কেউ নেই!'
তারপরও বাংলাদেশের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে হিমুরা বের হবে চন্দ্র অবগাহনে। ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে কোনো শ্রাবণের ব্যাকুল সন্ধ্যায়। উথাল-পাথাল হাওয়ায় পতপত করে জানালার পর্দা উড়বে পতাকার মতো... সেন্ট মার্টিনের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়বে 'সমুদ্রবিলাসের' আঙিনায়। শুধু এগুলো নিয়ে লেখার কেউ একজন থাকবে না। সে শুয়ে থাকবে নিঃসহায় একা নুহাশ পল্লীতে... হয়তো তার প্রিয় বৃক্ষরা তার সঙ্গী হবে, ঘিরে থাকবে তাকে!
[যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের... মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা!] হ
আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, তার সৌজন্যে চমৎকার একটা শৈশব পার করেছি। শুধু আমি কেন, আমার বয়সী পাড়ার সবাই তাকে মনে রেখেছে। তার মৃত্যুর পর সবাই আমাদের বাসায় এসে হাজির হয়েছে। নস্টালজিক সেই সব নাটক আর অনুষ্ঠানের কুশীলবরা। সবাই অশ্রু ফেলেছে। যে আনন্দ সে দিয়ে গেছে, সেগুলোই কি এখন অশ্রু হয়ে নেমে আসছে?
আমি একবার মাত্র তাকে কাঁদতে দেখেছি। প্রায় ৪০ বছর আগে। আমরা তখন পিরোজপুরের এক গ্রামে পলাতক জীবনযাপন করছি। বাবা নিখোঁজ। হঠাৎ খবর এলো, বাবাকে মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। আমি তখন তার পাশে দাঁড়িয়ে। সে শান্ত হয়ে খবরটা শুনল। এলাকার বয়স্ক লোকজন তাকে ধরে একটা মসজিদে নিয়ে গেল। সঙ্গে মেজ ভাই আর এক মামা। উদ্দেশ্য সদ্য শহীদ বাবার আত্মার জন্য একটু দোয়া-দরুদ পড়া হোক। অজ পাড়াগাঁয়ের ছোট্ট ছাপড়া একটা মসজিদে বসে আছি আমরা কয়েকজন। হঠাৎ বড় ভাই কাঁদতে শুরু করল হু হু করে। আমি তখন ফাইভ-সিক্সের ছাত্র, বাবার মৃত্যু সংবাদটা তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। কিন্তু বড় ভাইকে ওভাবে কাঁদতে দেখে আশ্চর্য হলাম। আমার প্রাণবন্ত হাসি-খুশি ভাইটা কাঁদছে। যার মাথা টিপে দিলে অসাধারণ সব মজার গল্প বলে, যে হঠাৎ মধ্যরাতে সবাইকে জাগিয়ে বিখ্যাত সব কবিতা আবৃত্তি করে, যে হঠাৎ কোনো ভালো বই পেলে সবাইকে ডেকে নিয়ে পড়ে শোনায়, আর আমরা অবাক হয়ে শুনি_ সেই ভাইটা এখন মাথা নিচু করে হু হু করে কাঁদছে! ৪০ বছর আগের সেই স্মৃতি... এখনও কী স্পষ্ট ভাসে চোখের সামনে!
সে চলে গেছে, এখনও তার সেই কান্না রেখে গেছে যেন আমাদের জন্য। তাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পরিবারের সব আনন্দ। এখন সেই আনন্দের মানুষটা নেই। সব আনন্দ এখন অশ্রু হয়ে ঝরছে...!
সেদিন এক টিভি চ্যানেল থেকে আমাকে ফোন করল_ হাবীব ভাই, একটু আসতে চাই আপনার বাসায়।
_ কেন?
_ একটু কথা বলব।
_ কী বিষয়ে?
_ স্যারকে ছাড়া আপনারা কীভাবে ঈদ করবেন_ সেটা একটু জানতে চাই।
আমি আশ্চর্য হয়ে যাই তার কথায়। এটা একটা জানার বিষয়? তাকে ছাড়া আমাদের ঈদটা হবে কীভাবে?... অনেক আগে ঈদের আগের দিন আমাদের সব ভাইবোন চলে আসত আমার পল্লবীর বাসায়। মা যেহেতু আমার সঙ্গে থাকেন, তাই মায়ের কড়া নির্দেশ_ তার সঙ্গে সবাইকে ঈদ করতে হবে। সবাই চলে আসত। আমরা তিন ভাই যেতাম একসঙ্গে ঈদের নামাজে। ফিরে এসে ভাইবোন তাদের ছেলেমেয়ে সবাইকে নিয়ে কত আনন্দ! রাতে সে একটা লটারির আয়োজন করত। সেই লটারির পুরস্কার পাওয়া নিয়ে ছোট-বড় সবার কী উত্তেজনা!
পরে অবশ্য চিত্রটা একটু বদলে গেল। ঈদের আগের দিন মা চলে যেতেন বড় ভাইয়ের বাসায়। সকালে উঠে আমি যেতাম তার বাসায়। মাকে সালাম করে তার সঙ্গে বসে নাস্তা করতাম। তারপর চলে আসতাম নিজের বাসায়। এখন তো সে আনন্দটাও নেই। কোনো আনন্দই নেই। কোনো ঈদ সংখ্যায় তার লেখা নেই। তার সরাসরি পরিচালিত কোনো নাটক নেই। সে নেই কোনোখানে... সে নেই মানে যেন এখন আর 'কোথাও কেউ নেই!'
তারপরও বাংলাদেশের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে, হলুদ পাঞ্জাবি গায়ে হিমুরা বের হবে চন্দ্র অবগাহনে। ঝরঝর করে বৃষ্টি নামবে কোনো শ্রাবণের ব্যাকুল সন্ধ্যায়। উথাল-পাথাল হাওয়ায় পতপত করে জানালার পর্দা উড়বে পতাকার মতো... সেন্ট মার্টিনের উত্তাল ঢেউ আছড়ে পড়বে 'সমুদ্রবিলাসের' আঙিনায়। শুধু এগুলো নিয়ে লেখার কেউ একজন থাকবে না। সে শুয়ে থাকবে নিঃসহায় একা নুহাশ পল্লীতে... হয়তো তার প্রিয় বৃক্ষরা তার সঙ্গী হবে, ঘিরে থাকবে তাকে!
[যে জীবন দোয়েলের ফড়িঙের... মানুষের সাথে তার হয় নাকো দেখা!] হ
No comments