ঈদ উৎসব নিয়ে কথা by আহমদ রফিক

ঈদ প্রকৃতপক্ষে যতটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ততটাই সামাজিক উৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের যেমন শারদীয় পূজা উৎসব। শারদ সংখ্যা সাহিত্যপত্রের মতো ঢাউস ঈদ সংখ্যা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের রেওয়াজ বিশেষভাবে স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে। ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে এতটা গুরুত্বে সাহিত্যসম্ভার দেখা যায়নি।


সামাজিক উৎসব হওয়ার কারণে ঈদ উৎসব-অনুষ্ঠানে সাহিত্য সৃষ্টিতে সাজো সাজো অবস্থা এবং সেই সঙ্গে রমরমা বাজার। অবশ্য পোশাক ও অলঙ্কারের তুলনায় কম। তবু সাহিত্যের প্রকাশও এ সময়ের এক পণ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সফল নান্দনিক বাণিজ্য।
ঈদ উপলক্ষে লেখা ও প্রকাশনার বাজার এত বড় বলেই এ সময় লেখকদের তৎপরতা বাড়ে_ কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও প্রবন্ধ রচনায়। আর দৈনিকের বিশেষ পাতার জন্য ছোটখাটো লেখার দাবি মেটাতে হয় লেখকদের। বয়সী লেখক অনেকে এ সময় শৈশব-কৈশোরে ফিরে যান, নানা তথ্যে স্মৃতিচারণ_ সেখানে কিছু আবেগ, কিছু নস্টালজিয়া। প্রায়শ গ্রাম ঘিরে। তবে মহানাগরিক টিভির বিনোদন বাণিজ্য মহাআয়তনিক।
আমারও শৈশব ও কৈশোরের কিছু সময় কেটেছে গ্রামে_ সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগেকার রূপময়, বর্ণময় গ্রামে পৈতৃক ভিটায়। চারপাশে বৃহত্তর পরিবারের নিকটাত্মীয়-স্বজনের পরিবার। ঈদ মানে নতুন পোশাক আর সুস্বাদু খাবারদাবার। দুটোতেই ঘ্রাণ ইন্দ্রিয়ের আনন্দময় অভিজ্ঞতা। আর দুপুরের আগেই স্বাদুভোজের তৃপ্তি। তবে কখনও কখনও বই উপহারে নান্দনিক তৃপ্তি।
ব্যক্তিক অভিজ্ঞতায় আজ থেকে সাত-সাড়ে সাত দশক আগেকার গ্রামীণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ঈদ উৎসবের ছবিটা প্রায়শ একই রকম। সূর্যহীন ভোর থেকে গৃহকর্ত্রীদের অন্তহীন ব্যস্ততা মূলত রান্নাঘরকেন্দ্রিক। বাতাসে সুস্বাদু ঘ্রাণ। অন্যদিকে পুরুষদের ধীরগম্ভীর চালচলন, স্নান শেষে নতুন পোশাকে ঈদের নামাজে যাওয়া, ফিরে এসে স্বাদুভোজ কখনও শুধু পারিবারিক সদস্যদের সঙ্গে, কখনও আমন্ত্রিত কাউকে নিয়ে। তবে এদিন প্রত্যেকে নিজ বাড়িতে আহার সম্পন্ন করতেই অভ্যস্ত ছিলেন। বিকেলে নিকটাত্মীয় বা বন্ধুজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তখন ছোটদের মধ্যে প্রচলিত প্রথা নিকটাত্মীয়-গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা। কৈশোরে শহুরে জীবনে এসব প্রথা চোখে পড়েনি। বরং ছিল সামাজিক জীবনে কিছুটা বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিজের মতো করে থাকা, যা আবার মেট্রোপলিটন সংস্কৃতিরূপে পরিচিত। তবে এর ব্যতিক্রম ঘটত ঈদ বা শারদ উৎসবে। অন্তত এ দিনটিতে সম্প্রদায়গত বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান ঘটত। নিমন্ত্রণ-পাল্টা নিমন্ত্রণে ঈদ ও শারদীয় পূজায় সম্প্রীতির প্রকাশ ঘটতে দেখেছি। দীর্ঘ ছয় দশকের ঢাকাই জীবনে ওই মেট্রোপলিটন চরিত্রটারই বিকাশ দেখেছি, যদিও পুরান ঢাকায় আতিথেয়তার সংস্কৃতি একেবারে ভিন্ন। অন্তত ঈদ উৎসবের মতো দিনে তো বটেই এবং তা চলেছে পরদিন পর্যন্ত যাওয়া-আসার ছুটির আমেজে। এখন বয়স্ক মননে বুঝি_ ঈদ অর্থ আমাদের জন্য অবকাশ। ঈদ অর্থ অতি নিকট জনকয়েকের সানি্নধ্য_ গল্পগুজব, কথকতা আর তাতে সমাজ-রাজনীতিই প্রধান_ রাজনীতির ভুলত্রুটি, কে হারে, কে জেতে তা নিয়ে আলোচনা বা বিতর্ক। কখনও বা সাহিত্য নিয়ে একান্ত কথা। গৃহকর্ত্রীদের তৎপরতা যথাপূর্বম তথাপরম।
কিন্তু আনুষ্ঠানিক চরিত্র বিচারে যেমন গ্রামে বিশেষভাবে, তেমনি শহরে-মহানগরে। আমার ধারণা, ঈদ এলেই শিশু-কিশোর ও তরুণদের উৎসব-অনুষ্ঠান, বয়স্কদের জন্য ধর্মীয় রীতিপ্রথা পালন তা প্রধানত একদিনকা। মহানগরীতে ঈদ উৎসব সামাজিক বিচারে কতটা অর্থবৈভবের প্রতিযোগিতা বা কতটা ইন্টেলেকচুয়াল চর্চার, তা অবশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো বিষয়। তবে প্রথমোক্ত সোনালি বিষয়টাই বড় সত্য, যা গ্রামীণ ঈদ উৎসবে দেখা যায়নি। অন্তত সেকালে দেখা যেত না। এই যে ঈদ বা বড় কোনো ছুটিতে ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসে [আর তাতে স্থায়ী বাসিন্দাদের স্বস্তি :আহ্ বাকি দিনগুলো যদি এমন হতো!] এটা সুস্থ সংস্কৃতিরই প্রকাশ মনে হয়। হোক তা শিকড়ের টানে বা বৃহত্তর পরিবার-পরিজনের টানে_ দিনকয় গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াতেও [এখন কতটা মুক্ত জানি না] সাময়িক আনন্দ_ এটাই কম কিসের?
তবে একটা প্রশ্ন :অত্যাধুনিক যুগে পেঁৗছে মেট্রোপলিটন মনের কাছে ঈদের ধর্মীয় তাৎপর্য কি এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের তুলনায় গৌণ এবং তা একান্তই শুদ্ধ উৎসবে পরিণত? উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপটে তা মনে হয় না। 'রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ' সম্ভবত ধর্মীয় তাৎপর্যে এখনও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যতিক্রমীদের বাদ দিলে এর ধর্মীয় উপকরণই বড়। ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রিসমাসের চরিত্র এমন কি-না জানি না। তবে আমরা যতই আধুনিক হই, যতই ইন্টেলেকচুয়াল বা মহানাগরিকই হই; ধর্মীয় উপকরণটি চেতনায় এখনও সদা জাগ্রত। সত্যিকার মেট্রোপলিটন আমরা হতে পারিনি। হ
 

No comments

Powered by Blogger.