শান্তি ও শ্বেতশুভ্রর প্রতীক, আত্মমর্যাদায় গড়ে উঠছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা- নারী শিক্ষায় অগ্রণী বগুড়া সরকারী বালিকা বিদ্যালয় by সমুদ্র হক
মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি নিয়ে দেড় শ’ বছর আগে নারী শিক্ষার অগ্রগতির ধারায় গড়ে ওঠা বগুড়া সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মননশীলতা, নৈতিকতা ও সৃজনশীলতায় দেশ গড়ার অঙ্গীকারে এগিয়ে চলেছে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা স্নিগ্ধতার আভায় নতুন আলোয় সুন্দর পৃথিবী গড়ার শপথ নেয়।
উন্নত মননশীলতার শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ আগামী পৃথিবীর উপযোগী করে আত্ম-মর্যাদার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলছেন শান্তি ও শ্বেতশুভ্রর প্রতীক নীল-সাদায় স্কুল ড্রেসের শিক্ষার্থীদের। যার ধারাবাহিকতায় নিত্যবছর বড় সাফল্যের দুয়ার অতিক্রম করছে এই স্কুল। এ বছরও মাধ্যমিকে বোর্ডে শীর্ষ স্থান ও সারা দেশে ষষ্ঠ স্থানের মুকুট পরেছে। গত ক’বছর ধরেই সাফল্যের কারুকার্যে খচিত এমন মুকুটে অনুরনিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। স্কুলর বড় বৈশিষ্ট্য একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সুন্দর মনের পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ার পাঠ দান, যা ব্যক্তিজীবনে অগ্রসরতার ধারায় প্রবাহিত করে। পারিবারিক জীবনে মমত্বের বাঁধন গড়ে তোলে। প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখিয়ে দেশপ্রেমের দীক্ষা দেয়। ১৪৩ বছর আগে ১৮৬৯ সালে উত্তরাঞ্চলে ‘ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল (ভিএম) গার্লস স্কুল’ নামে বগুড়া শহরের নবাববাড়ি সড়কের ধারে নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে। লম্বা একটি মাটির ঘরে পাঠদান শুরু হয়। বাঁশ দিয়ে ঘেরা ছিল চার ধারে। তার মধ্যে মেয়েদের হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা হয়, যা গত শতকের ত্রিশের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত ছিল। ওই সময়ে শিক্ষায় নারীদের পথ চলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বনেদি পরিবারের মেয়েরাও ছিল রক্ষনশীলতায় ঘেরা। তার মধ্যেই মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে রক্ষণশীলতা ও গোঁড়ামির জাল ছিঁড়ে প্রগতিশীলতার ধারায় বের হয়ে আসে নারী। মর্যাদা রক্ষার এই রণক্ষেত্রে সারাদেশে বগুড়ার নারী বিজয়ী হয়। নারী শিক্ষায় এগিয়ে চলার মসৃণ পথ তৈরি করে ওই স্কুল। চল্লিশের দশকে এই স্কুলের শিক্ষার্থীর উল্লেখযোগ্য অংশ ঢাকার ইডেন কলেজে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সুযোগ করে নেয় মেধার গুণে। তখনই বলাবলি হতো বগুড়ার মেয়েরা শুধু লেখাপড়ায় নয় সবদিক থেকেই ফরোয়ার্ড। নারীর অগ্রসরতার পথ তৈরির সেই ভিএম স্কুল ১৯৬৩ সালে জাতীয়করণ হয়ে আজকের সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর হতে আজও এই স্কুলের অনেক মেয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বড় অবদান ও সম্মান বয়ে আনছেন। দেশের গ-ি ছাড়িয়ে এই সম্মান বিদেশেও পৌঁছেছে। শিক্ষা সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য চিকিৎসা প্রকৌশল সিভিল সার্ভিসসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই খুঁজে পাওয়া যায় এই স্কুলের শিক্ষার্থীকে। এমনকি ষাটের দশকে এই স্কুলেরই এক শিক্ষার্থী বিমান চালনা করেছেন। স্কুলের প্রবীণ প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ বগুড়া সরকারী মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ হাবিবা বেগম স্মৃতির পাতা মেলে ধরলেন- ১৯৫৪ সালে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। শহরতলির চেলোপাড়া থেকে দল বেঁধে মেয়েরা হেঁটে আসত। করতোয়া নদী পারাপারের সময় খেয়াঘাটের মাঝি ড্রেস দেখে দ্রুত নৌকায় তুলে নিতেন। স্কুলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা খেলাধুলা ছিল আনন্দের অংশ। সাইকেল চালাতেন তিনি। শিক্ষকদের মধ্যে রওশন আরা আপা বাংলা পড়াতেন। গীতা দিদির কথা এখনও মনে পড়ে। তাঁরা দেখতেও যেমন সুন্দর, মনেও ছিলেন তেমনি সুন্দর। অঙ্ক পড়াতের মাধব স্যার। হেড ম্যাডাম সালেহা আপার স্নেহের সুরে শাসন আজও ভোলেননি। ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (বর্তমানের এসএসসি) পরীক্ষায় শীর্ষ বিভাগে উত্তীর্ণ হন। স্কুলজীবনের এই দীক্ষাই তাঁকে এগিয়ে নিয়েছে জীবনের পথে। স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনসহ সকল শিক্ষক অভিবাবকদের উদ্দেশে বলেছেন-সন্তানকে বেশি করে সময় দিন। লেখাপড়ার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে জড়িত করুন। নাচ গান আবৃত্তি অভিনয়ে অংশ নিতে দিন। একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক মমত্ববোধ, নৈতিকতা সৃজনশীলতা, শিষ্টাচার দেশের প্রতি ভালবাসার শিক্ষা প্রদান করুন। যে জাতি নিজস্ব সংস্কৃতিতে যত উন্নত, বিশ্বে তারাই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনার সন্তানের প্রতিদিনের পড়া, বাড়ির কাজ ও শিক্ষকগণের নির্দেশ স্কুল নোটের মাধ্যমে জেনে নেবেন এবং গঠনমূলক পরামর্শ দেবেন। বিষয়গুলো শিক্ষার্থীদের ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা আছে। জাতীয় অনুষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন করা হয়। প্রকৃতির অবদানকে হৃদয়ে লালন করে প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয়ী হওয়ার মানসিকতায় গড়ে তুলে নিজের কাজ নিজে করার দীক্ষা দিয়ে শিশু মনেই স্বাবলম্বীর ধারা তৈরি করা হয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় মেধাকে শানিত করে তোলা হয়। যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রে সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারে। প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বলা হয়, সংস্কৃতির পথে যে কোন একটি পদক্ষেপ মুক্তির পথেরই একটি পদক্ষেপ। শিক্ষার্থীদের শেখানো হয়, অতীতের দিকে তাকাবে দুঃখবোধ ছাড়াই, বর্তমানকে গ্রহণ করবে সাহসিকতার সঙ্গে, ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে। শিক্ষার্থীদের এমন আত্মবিশ্বাস দেখে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বগুড়ার সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) দুর্নীতিবিরোধী শপথ পাঠ করিয়েছেন তাদের। স্কুলের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুন ওই অনুষ্ঠানে বলেছেন, আজকের মেয়েশিশুরাই একদিন দেশের দায়িত্বভার নেবে। স্কুলে তাদের নৈতিকতা, মননশীলতা গঠনের দায়িত্ব যেমন শিক্ষকগণের, তেমনি ঘরে অভিভাবকগণের আছে দায়িত্ব। আবার এই শিশুরাই একদিন মা হবে। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের কথায় উত্তম দেশ গড়তে উত্তম মা দরকার। বগুড়ার প্রাচীন এই স্কুল নারী শিক্ষার আলোকবর্তিকার ঐতিহ্যের সেই পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে।
No comments