মেডিক্যালে ভর্তি পদ্ধতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা by ড. নিয়াজ আহম্মেদ
হঠাৎ করে সরকারের নীতিনির্ধারক মহল মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজগুলোয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীরা ফুঁসে ওঠে। সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত অভিভাবক মহলসহ অনেকের উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
শঙ্কা কাজ করে সত্যিকার মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারবে কি না। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে ফেটে পড়ে। সাময়িক সময়ের জন্য তারা আন্দোলন স্থগিত করেছে, তবে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার না হলে ঈদের পর বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে।
ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলা এড়ানো ও কোচিং-দৌরাত্ম্য বন্ধের জন্য ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো নিঃসন্দেহে একটি ভালো পন্থা। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়া অন্য কোথাও এ পদ্ধতিতে ভর্তি করানো হয় কি না তা আমার জানা নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষার দ্বিতীয় স্তরে এ পদ্ধতিতে ভর্তি করানো কতটুকু সঠিক হবে তা ভাবনার বিষয়। উচ্চশিক্ষার এ স্তরটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মোটা দাগে এ স্তরটির শিক্ষা সরাসরি এবং দ্রুত মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে। একজন ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার পর তার জ্ঞানের প্রয়োগ আমাদের মতো দেশে দ্রুত হওয়াটা স্বাভাবিক। জ্ঞান প্রয়োগের যে ক্ষেত্রটি মানুষের জীবন-মরণ ও উন্নত স্বাস্থ্য উপহারের সঙ্গে সম্পর্কিত সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও সঠিক না হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। আমাদের পথ ও মত হওয়া উচিত সর্বোচ্চ মেধাবীদের মেডিক্যালে ভর্তি করানো। সে ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়াটি আমরা সঠিক বলে মনে করি, সেটি অবলম্বন করাই শ্রেয়।
ধরুন, একজন শিক্ষার্থী সারা বছর ভালোভাবে পড়াশোনা করেছে। শিক্ষার্থীটি মেধাবী ও সৃজনশীল। কিন্তু পরীক্ষার সময় কোনো না কোনো কারণে পরীক্ষা একটু খারাপ হওয়ায় জিপিএ ৫ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। জিপিএ ৫ না পাওয়ার কারণে আমি কি বলব শিক্ষার্থীটি মেধাবী নয়! তার দুর্ঘটনার জন্য আমি কি তার সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করব না? তাকে তার মেধা যাচাইয়ের জন্য ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেব না? যদি না দিই, তাহলে আমি কি মেধাবী শিক্ষার্থীটিকে বঞ্চিত করছি না? একমাত্র জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই মেধাবী, অন্যরা নয়_এমন লেভেল দেওয়া কি সঠিক? পাবলিক পরীক্ষায় ড্রপ দিলে এক বছর পিছিয়ে যাবে এ মানসে শিক্ষার্থীটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেহেতু লেখাপড়ায় সে ভালো, সেহেতু ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেকআপ দেওয়া তার পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়। এ কারণে শিক্ষার্থী হয়তো তার সৃজনশীলতার গুণে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিলে শিক্ষার্থীটি এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে আর জিপিএর গুণে অন্য একজন ভর্তির সুযোগ পাবে_এমনটি হওয়া সঠিক নয়।
প্রতিবছরের পরীক্ষার পাসের হারের দিকে তাকালে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এক বোর্ডের পাসের হার অন্য বোর্ডের পাসের হারের চেয়ে কম বা বেশি। কখনো কখনো এ কম-বেশি ১০ শতাংশকেও ছাড়িয়ে যায়। আবার জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যার ক্ষেত্রেও ব্যবধান বিভিন্ন বোর্ডে লক্ষণীয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কিংবা মানের জন্য এ ব্যবধান হলে আমরা মেনে নিতে পারি; কিন্তু অন্য কোনো কারণে এ ব্যবধান হলে আমাদের মেনে নেওয়া সহজ নয়। কোনো বোর্ড উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যাপারে উদার হলে সেই বোর্ডের পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে_এমনটি স্বাভাবিক। তখন অন্য বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা ভালো করবে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার এ স্তরে উত্তরপত্রগুলো দ্বিতীয় পরীক্ষকের দ্বারা মূল্যায়নের সুযোগ নেই। কাজেই পরীক্ষক যে নম্বরটি প্রদান করবেন সেটিই শিরোধার্য। আবার উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিজস্ব মতামত ও চিন্তাধারার প্রতিফলনও থাকতে পারে। সাধারণত মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় এর প্রতিফলন বেশ দেখা যায়। যখন আমরা শুধু ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির ব্যবস্থা করব তখন মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য এক ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতা আরো বেশি মাত্রায় শুরু হবে। কেননা যত বেশি সিজিপিএ পাওয়া যাবে তত বেশি লাভ। শুধু মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা নয়, থিওরি পরীক্ষায়ও বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা বোর্ডে গিয়ে ধরনা দিতেও দ্বিধা করবেন না। সিজিপিএ বাড়ানোর এক অশুভ প্রতিযোগিতা সর্বত্র শুরু হবে।
আমরা তিন ঘণ্টার সিলেবাসযুক্ত পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিষয়ের ওপর একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করি। আমি এ পদ্ধতিকে পরিপূর্ণ বলছি না এ কারণে খুুঁটিনাটি অনেক কিছু না জেনেও একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করতে পারে। আবার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সঠিক না হলে কেউ কেউ বঞ্চিত, কেউ কেউ লাভবান হতে পারে। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য বোর্ডে আবেদন করে। তাদের মধ্যে অনেকের গ্রেডও পরিবর্তন হয়। তখন আমরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। মূল্যায়নের বিষয়ে যখন পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে তখন শুধু ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত। শিক্ষার্থীদের খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর দখল ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ একমাত্র হতে পারে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ, যাকে আমরা ভর্তি পরীক্ষা বলছি। এটি বাদ দিলে সত্যিকার মেধা যাচাই অপূর্ণ থেকে যাবে বৈকি।
কোচিং বর্তমানে একটি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে সরকার কোচিং বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করলেও পরোক্ষভাবে কোচিং করার অনুমতি দিয়েছে। কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে 'ভর্তি পরীক্ষা' বাদ দিয়ে মেধা যাচাই কতটুকু ফল দেবে তা ভেবে দেখতে হবে। সরকার সব জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিতে পারবে না। কোচিং এখন শুধু মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে নয়, প্রাইমারি ও হাই স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষ, বিসিএস পরীক্ষা, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি পরীক্ষা, এমনকি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ও সামাজিক জীবনে নিজেকে সুন্দর ও সঠিকভাবে উপস্থাপন ও বিকশিত করার জন্যও এখন অনেকে কোচিংয়ের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণ যখন বিদ্যমান ব্যবস্থায় সম্ভব হয় না, তখন বিকল্প হিসেবে কোচিংয়ের সাহায্য গ্রহণ করতে বাধা কোথায়। রাতারাতি এ ব্যবস্থা ও ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কাজেই কোচিংয়ের দোহাই দিয়ে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা বাদ দেওয়াকে আমরা সঠিক বলে মনে করি না।
তবে হ্যাঁ, মাত্র একটি কারণে নীতিনির্ধারকদের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সঠিক বলে মনে করতে পারি। তাদেরকে তথ্য দিয়ে বলতে হবে ইতিপূর্বে যারা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে তারা সবাই সর্বোচ্চ জিপিএর অধিকারী। অর্থাৎ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে যারা এগিয়ে ছিল তারাই মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাহলে আমি ধরেই নেব, একমাত্র জিপিএ ৫ যারা পেয়েছে তারাই সর্বোচ্চ মেধাবী। তাদের মেধা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু মেডিক্যালে নয়, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি দেখা যায় একমাত্র জিপিএ ৫ পাওয়া ছেলেমেয়েরাই এর আগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তাহলে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিয়ে একমাত্র ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির কাজটি সম্পন্ন করতে পারি।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
ভর্তি পরীক্ষার ঝামেলা এড়ানো ও কোচিং-দৌরাত্ম্য বন্ধের জন্য ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো নিঃসন্দেহে একটি ভালো পন্থা। বর্তমানে উচ্চ মাধ্যমিক ছাড়া অন্য কোথাও এ পদ্ধতিতে ভর্তি করানো হয় কি না তা আমার জানা নেই। কিন্তু উচ্চশিক্ষার দ্বিতীয় স্তরে এ পদ্ধতিতে ভর্তি করানো কতটুকু সঠিক হবে তা ভাবনার বিষয়। উচ্চশিক্ষার এ স্তরটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মোটা দাগে এ স্তরটির শিক্ষা সরাসরি এবং দ্রুত মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে। একজন ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার পর তার জ্ঞানের প্রয়োগ আমাদের মতো দেশে দ্রুত হওয়াটা স্বাভাবিক। জ্ঞান প্রয়োগের যে ক্ষেত্রটি মানুষের জীবন-মরণ ও উন্নত স্বাস্থ্য উপহারের সঙ্গে সম্পর্কিত সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও সঠিক না হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে। আমাদের পথ ও মত হওয়া উচিত সর্বোচ্চ মেধাবীদের মেডিক্যালে ভর্তি করানো। সে ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়াটি আমরা সঠিক বলে মনে করি, সেটি অবলম্বন করাই শ্রেয়।
ধরুন, একজন শিক্ষার্থী সারা বছর ভালোভাবে পড়াশোনা করেছে। শিক্ষার্থীটি মেধাবী ও সৃজনশীল। কিন্তু পরীক্ষার সময় কোনো না কোনো কারণে পরীক্ষা একটু খারাপ হওয়ায় জিপিএ ৫ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। জিপিএ ৫ না পাওয়ার কারণে আমি কি বলব শিক্ষার্থীটি মেধাবী নয়! তার দুর্ঘটনার জন্য আমি কি তার সৃজনশীলতাকে মূল্যায়ন করব না? তাকে তার মেধা যাচাইয়ের জন্য ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেব না? যদি না দিই, তাহলে আমি কি মেধাবী শিক্ষার্থীটিকে বঞ্চিত করছি না? একমাত্র জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাই মেধাবী, অন্যরা নয়_এমন লেভেল দেওয়া কি সঠিক? পাবলিক পরীক্ষায় ড্রপ দিলে এক বছর পিছিয়ে যাবে এ মানসে শিক্ষার্থীটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। যেহেতু লেখাপড়ায় সে ভালো, সেহেতু ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেকআপ দেওয়া তার পক্ষে হয়তো সম্ভব হয়। এ কারণে শিক্ষার্থী হয়তো তার সৃজনশীলতার গুণে মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পেতে পারে। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিলে শিক্ষার্থীটি এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে আর জিপিএর গুণে অন্য একজন ভর্তির সুযোগ পাবে_এমনটি হওয়া সঠিক নয়।
প্রতিবছরের পরীক্ষার পাসের হারের দিকে তাকালে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, এক বোর্ডের পাসের হার অন্য বোর্ডের পাসের হারের চেয়ে কম বা বেশি। কখনো কখনো এ কম-বেশি ১০ শতাংশকেও ছাড়িয়ে যায়। আবার জিপিএ ৫ পাওয়ার সংখ্যার ক্ষেত্রেও ব্যবধান বিভিন্ন বোর্ডে লক্ষণীয়। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা কিংবা মানের জন্য এ ব্যবধান হলে আমরা মেনে নিতে পারি; কিন্তু অন্য কোনো কারণে এ ব্যবধান হলে আমাদের মেনে নেওয়া সহজ নয়। কোনো বোর্ড উত্তরপত্র মূল্যায়নের ব্যাপারে উদার হলে সেই বোর্ডের পাসের হার ও জিপিএ ৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে_এমনটি স্বাভাবিক। তখন অন্য বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা ভালো করবে। আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার এ স্তরে উত্তরপত্রগুলো দ্বিতীয় পরীক্ষকের দ্বারা মূল্যায়নের সুযোগ নেই। কাজেই পরীক্ষক যে নম্বরটি প্রদান করবেন সেটিই শিরোধার্য। আবার উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের নিজস্ব মতামত ও চিন্তাধারার প্রতিফলনও থাকতে পারে। সাধারণত মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় এর প্রতিফলন বেশ দেখা যায়। যখন আমরা শুধু ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির ব্যবস্থা করব তখন মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য এক ধরনের নগ্ন প্রতিযোগিতা আরো বেশি মাত্রায় শুরু হবে। কেননা যত বেশি সিজিপিএ পাওয়া যাবে তত বেশি লাভ। শুধু মৌখিক ও প্রাকটিক্যাল পরীক্ষা নয়, থিওরি পরীক্ষায়ও বেশি নম্বর পাওয়ার জন্য অভিভাবকরা বোর্ডে গিয়ে ধরনা দিতেও দ্বিধা করবেন না। সিজিপিএ বাড়ানোর এক অশুভ প্রতিযোগিতা সর্বত্র শুরু হবে।
আমরা তিন ঘণ্টার সিলেবাসযুক্ত পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে একটি বিষয়ের ওপর একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাই করি। আমি এ পদ্ধতিকে পরিপূর্ণ বলছি না এ কারণে খুুঁটিনাটি অনেক কিছু না জেনেও একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করতে পারে। আবার মূল্যায়ন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও সঠিক না হলে কেউ কেউ বঞ্চিত, কেউ কেউ লাভবান হতে পারে। প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য বোর্ডে আবেদন করে। তাদের মধ্যে অনেকের গ্রেডও পরিবর্তন হয়। তখন আমরা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলি। মূল্যায়নের বিষয়ে যখন পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে তখন শুধু ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তি করানো কতটুকু যুক্তিযুক্ত। শিক্ষার্থীদের খুঁটিনাটি বিষয়ের ওপর দখল ও সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ একমাত্র হতে পারে দ্বিতীয়বার পরীক্ষার সুযোগ, যাকে আমরা ভর্তি পরীক্ষা বলছি। এটি বাদ দিলে সত্যিকার মেধা যাচাই অপূর্ণ থেকে যাবে বৈকি।
কোচিং বর্তমানে একটি বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন আগে সরকার কোচিং বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করলেও পরোক্ষভাবে কোচিং করার অনুমতি দিয়েছে। কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে 'ভর্তি পরীক্ষা' বাদ দিয়ে মেধা যাচাই কতটুকু ফল দেবে তা ভেবে দেখতে হবে। সরকার সব জায়গায় ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিতে পারবে না। কোচিং এখন শুধু মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে নয়, প্রাইমারি ও হাই স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষ, বিসিএস পরীক্ষা, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা, বিদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি পরীক্ষা, এমনকি ব্যক্তিগত, পারিবারিক, ও সামাজিক জীবনে নিজেকে সুন্দর ও সঠিকভাবে উপস্থাপন ও বিকশিত করার জন্যও এখন অনেকে কোচিংয়ের আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন পূরণ যখন বিদ্যমান ব্যবস্থায় সম্ভব হয় না, তখন বিকল্প হিসেবে কোচিংয়ের সাহায্য গ্রহণ করতে বাধা কোথায়। রাতারাতি এ ব্যবস্থা ও ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়। কাজেই কোচিংয়ের দোহাই দিয়ে মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা বাদ দেওয়াকে আমরা সঠিক বলে মনে করি না।
তবে হ্যাঁ, মাত্র একটি কারণে নীতিনির্ধারকদের এ সিদ্ধান্তকে আমরা সঠিক বলে মনে করতে পারি। তাদেরকে তথ্য দিয়ে বলতে হবে ইতিপূর্বে যারা মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছে তারা সবাই সর্বোচ্চ জিপিএর অধিকারী। অর্থাৎ দুটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে যারা এগিয়ে ছিল তারাই মেডিক্যালে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। তাহলে আমি ধরেই নেব, একমাত্র জিপিএ ৫ যারা পেয়েছে তারাই সর্বোচ্চ মেধাবী। তাদের মেধা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু মেডিক্যালে নয়, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি দেখা যায় একমাত্র জিপিএ ৫ পাওয়া ছেলেমেয়েরাই এর আগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তাহলে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ভর্তি পরীক্ষা বাদ দিয়ে একমাত্র ফলাফলের ভিত্তিতে ভর্তির কাজটি সম্পন্ন করতে পারি।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
neazahmed_2002@yahoo.com
No comments