ঈদ জানিয়ে গেল দেশ এগিয়ে চলেছে by স্বদেশ রায়
কয়েকটি বিষয়ে এবার রমজান মাস ও ঈদের সময়ে ধন্যবাদ পেয়েছে বর্তমান সরকার। প্রথম ধন্যবাদ পেয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। কারণ, এবার বাজারে জিনিসপত্রের দাম রমজান মাসে করে বাড়েনি। অন্যদিকে চিংড়ি ছাড়া যাবতীয় মাছ রফতানি বন্ধ করে দেবার ফলে বাজারে মাছের দাম কিছুটা কমই ছিল আগের তুলনায়।
সব থেকে কম ছিল ইলিশ মাছের দাম। ঈদের পরের দিন বাজারে ইলিশ মাছের দাম শুনে তো ইতিহাসবিদ ও লেখক মুনতাসীর মামুন লাফিয়ে উঠলেন বাজারে যাবার জন্য। ভাগ্যক্রমে তাঁর সঙ্গে থাকায় একটি ইলিশ গিফট পেয়ে গেলাম। ঈদের আগের দিন রাত অবধি আমরা সকলেই কম বেশি গিফট পাই। কিন্তু ঈদের পরের দিন এভাবে ইলিশ গিফট পাবার পরে নিশ্চয়ই ধন্যবাদ দিতে হবে যিনি দিলেন তাঁকেই আগে, তবে পাশাপাশি বাণিজ্যমন্ত্রী জি এম কাদেরকেও। কারণ, এক কেজির ওপরে একটি ইলিশ ৭শ’ টাকা। অনেক দিন বাজারে এমনটি আশা করা যেত না।
যা হোক, এই ইলিশ কেনার সময় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বললেন, আচ্ছা আমাদের ইলিশ রফতানিটা বন্ধ করলে কী হয়। ইলিশ রফতানি করে আর ক’টা টাকা পাই। বাণিজ্যমন্ত্রীসহ গোটা কেবিনেটকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। কারণ, দিন দিন আমাদের প্রোটিনের পরিমাণ কমছে। সাধারণের বা গরিবের যে প্রোটিন ছিল মসুর ডাল তার এখন পৃথিবীজুড়ে দাম বেশি। এমতাবস্থায় প্রোটিনের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকরা সব থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। তাদের সরকার কম দামে চাল দিচ্ছে। তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবা হচ্ছে। সব কিছু মিলে মনে হচ্ছে, আরো বেতন তাদের বাড়ানো হবে। অন্যদিকে চীন থেকে গার্মেন্টস শিল্পের পুঁজি প্রত্যাহার করছে আমেরিকা। আমরা যদি কোন বড় ধরনের ভুল না করি, যদি দেশ আবার জঙ্গীবাদীদের কবলে না যায় তাহলে এই পুঁজির বড় অংশ বাংলাদেশে আসবে। কারণ, চীনের শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবে এ পুঁজি বাংলাদেশে আসবে। তখন আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরিশ্রম করতে হবে রাতদিন। রাতদিন এই পরিশ্রমের জন্য তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে প্রোটিনের। এ ছাড়াও দেশের সার্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন প্রোটিন। সব মিলিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ভাল থাকলে কত লাভ আর ইলিশ মাছ রফতানি করলে কত লাভ সেটা এখন মনে হয় ভেবে দেখার সুযোগ হয়েছে। এমনকি সবকিছু দেখে মনে হয়, আমরা ইলিশ রফতানি করে যে অর্থ রোজগার করি তার থেকে বেশি অর্থ আমরা চিকিৎসার জন্য ভারতে ব্যয় করে আসি। তাই বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারকে বলব, ইলিশ ব্যবসায়ী, জেলেসহ সবার দিক হিসাব করে, পাশাপাশি দেশের মানুষের মুখের স্বাদ ও প্রোটিনের কথা চিন্তা করে ইলিশ নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরে নিশ্চয়ই এবার ধন্যবাদ পাবে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। এবার রমজানে বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়নি বলা চলে। এমন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ বাংলাদেশে এর আগে কখনও ঘটেনি। টেলিভিশনের পর্দায় বিশেষ করে টকশোতে ওই ভাবে চোখ রাখা হয় না। এটা কোন অবজ্ঞা থেকে নয়। অভ্যাস থেকে। কারণ, দেখার থেকে পড়তে ভাল লাগে। তাই সময় পেলে ওই কাজটি করি। তাই জানি না যে টকশোর বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ এবার এই বিদ্যুত নিয়ে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছেন কিনা? তবে এবারের এই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের পরে এটা বলা যায়, স্বল্প সময়ের বিদ্যুত উৎপাদনে সরকার এখন সাফল্য অর্জন করেছে। এখন এই সাফল্য ধরে রেখে এই বিদ্যুত উৎপাদনকারীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কীভাবে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন করা যায় সেটা ভাবতে হবে। কারণ, এটা সত্য যে, সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতে বিদ্যুত উৎপাদন ছাড়া এখন আর উপায় নেই। ব্যবসায়ী নেতা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মঞ্জুর ইলাহীর বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায়, বিদ্যুত কোথা থেকে এলো, বিদ্যুত সাদা কি কালো সেটা আমার দেখার দরকার নেই। আমার কারখানা চলছে। আমি বিদ্যুত পাচ্ছি এটাই যথেষ্ট। তাই অতীতের ধ্যান ধারণা ঝেড়ে ফেলে এখন নতুন করে নতুন পথে বিদ্যুত উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। কারণ, শুধু ওই চীনের গার্মেন্টস থেকে আমেরিকার পুঁজি নয়, আমরা যদি সঠিকভাবে দেশ চালাতে পারি অনেক পুঁজি এখানে আসবে। আর সে সব পুঁজির জন্য প্রয়োজন বিদ্যুত। কারণ, পুঁজিকে উৎপাদনে রূপান্তরিত করতে হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন। তাই আধুনিক চিন্তার ওপর ভর করে সরকারকে বিদ্যুত উৎপাদনের পথে এগুতে হবে।
তবে এই বিদ্যুত আর বাজারদর শহরের এই দুই ঘটনার বাইরে এবার ঈদের দিন ঢাকার বাইরে থেকে টেলিফোন পেলাম কয়েক রাজনৈতিক বন্ধু বান্ধবের। যারা এবার বেশ মুশকিলে পড়েছিল সরকারের দেয়া ঈদের দিনের বিনামূল্যের চাল নিয়ে। কারণ, তারা গ্রামে ওইভাবে গরিব খুঁজে পাচ্ছিল না যাদের ওই চাল দেয়া যায়। সচ্ছলরা কেউই চাল নিতে রাজি নয়। কারণ, তারা সচ্ছল তারা নিজেদের দরিদ্রের কাতারে নামাতে চায় না। এ খবরটি থেকে বোঝা যায়, গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কমার এখন অনেক কারণ আছে। কারণ, বর্তমানের কৃষিমন্ত্রী শুধু চাল উৎপাদনে নজর দিচ্ছেন না। তিনি সবজিসহ ফলমূল উৎপাদনেও নজর দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে এ জন্য তিনি থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের দেশের মানুষ থাইল্যান্ডে যায় শপিং করার জন্য। আপনিই বাংলাদেশে একমাত্র ব্যতিক্রম যার কোন শপিং করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, আপনার সাদাসিধে জীবনের সঙ্গে ওই কালচারের কোন মিল নেই। আপনি কেন থাইল্যান্ড গেলেন। তিনি হেসে বললেন, আমি থাইল্যান্ড গিয়েছি গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে। কারণ, আজ সারা পৃথিবীর ফাইভ স্টার হোটেল থাইল্যান্ডকে চেনে ফলের কারণে। আমি ওদের হর্টিকালচারটি দেখার জন্যই সেখানে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশকেও ধনে পাতা থেকে ফল অবধি উৎপাদনে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিমন্ত্রীর কথা শুনে নিজেরই লোভ হয়েছিল। কিছুদিন পরে থাইল্যান্ড গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছি। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে থাইল্যান্ড যেমন সব ফল ব্যবহার করছে বাংলাদেশের পক্ষেও এটা সম্ভব।
যেমন ঈদের দিন দেখা হলো ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক বেনজির আহমদের সঙ্গেÑ তিনি বললেন, তাঁর পাবনায় এখন এক ব্যক্তির নাম ধনে লতিফ। তিনি নাকি বছরে ৮ লাখ টাকার ধনে পাতা বিক্রি করেন। ঠিক তেমনি আরেকটি খবর দিলেন কলাকুপা বান্দুরার। সেখানে এক ব্যক্তি বিদেশে লটকন রফতানি করেন। যার মোট রফতানি এখন বছরে ১১ লাখ টাকা। কৃষিমন্ত্রী এবার অনেক জায়গায় লিচু মেলা উদ্বোধন করেছেন। স্ট্রবেরি চাষকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। ফলে গ্রামে এখন আর রোজগার শুধু মূল ফসল ধানের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে যাচ্ছে নানান দিকে। তার পরে আধুনিক উপায়ে মাছের চাষ তো আছেই। চিংড়ি পোনার উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্যাচারিতে বাড়িয়ে প্রাকৃতিক পোনা ধরা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে সমুদ্রের মাছের পোনা ধ্বংস হওয়া বন্ধ হবে। এর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ যেভাবে এগুচ্ছে এতে বদলে দেবে গ্রামের অর্থনীতি।
গ্রামের অর্থনীতি যে বদলে গেছে তা এবার ঈদের বাজারের খোঁজ খবর যারা রাখেন তারা সকলে জানেন জেলা শহর এমনকি উপজেলায়ও এবার পৌঁছে গেছে হাল ফ্যাশনের পোষাকটি। কম দামেও বিক্রি হয়নি সেখানে।
অন্যদিকে আরো একটি বিষয় দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি চিত্র পাওয়া যায়। এখান থেকে মাত্র কিছুদিন আগেও ঢাকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তানরা পড়তেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এখন প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় প্রায় অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে আসছে গ্রাম থেকে।
তাছাড়া এবার ঈদ বাজারের কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলেও বোঝা যায়, গ্রামের অর্থনীতির পরিবর্তন। যেমন এবার ঈদে ১৬শ’ কোটি টাকা বোনাস পেয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায় সবাই গ্রামের। তাহলে এই ষোলো শ’ কোটি টাকার বড় অংশ ব্যয় হয়েছে গ্রামে। অন্যদিকে ১২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকরা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদেই ব্যয় হয়েছে। আর যেহেতু এই শ্রমিকদের পরিবার সবাই গ্রামে থাকেন তাই এ অর্থের বড় অংশ গ্রামে ব্যয় হয়েছে।
সব মিলে গ্রামের অর্থনীতি বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে শহরের অর্থনীতি। এবং এই বদলে যাওয়াকে আরও বেশি গতি দেবে যদি এই সঙ্গে সমান তালে বিদেশী সাহায্য আসে। কারণ বিদেশী দাতাগোষ্ঠী এখন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোকে মিলিনিয়াম গোলে পৌঁছে দেবার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করছে। তাই যেখানে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রণী সৈনিক। সেখানে বাংলাদেশের নিশ্চয়ই কোন বাধা থাকার কথা নয়, বিদেশী দাতা গোষ্ঠীর এই সাহায্য নিয়ে মিলিনিয়াম গোলে পৌঁছে যাওয়া। এ কথা সত্য, পদ্মা সেতু নিয়ে মূল দাতা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু সমস্যা হয়েছে। বাংলাদেশের কয়েক মন্ত্রী মুখে রাজনৈতিক বক্তব্য যাই দিক না কেন, সরকারের যাবতীয় কর্মকা- কিন্তু বলছে, বাংলাদেশ এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এবং সার্বিক পরিস্থিতি বলছে সেটা সম্ভবও হবে।
তাছাড়া বর্তমান নেতৃত্বকে এই সত্য বুঝতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান যে উন্নয়ন শুরু হয়েছে এর গতি কোনমতে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে বাড়ানো বা ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের গার্মেন্টসের মার্কেট হবে আমেরিকা। আমাদের জুতোর মার্কেট হবে ইউরোপ। আমাদের তৈরি খেলনার মার্কেট হবে গোটা পৃথিবী। সে দিকেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এমতাবস্থায় আমাদের সব থেকে বেশি দরকার অর্থনৈতিক ও কানেকটিভিটি। দুর্ভাগ্য হলো আমাদের এখানে এক শ্রেণীর মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের কানেকটিভিটি মানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি বুঝছে। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করে শুনছেন না যে, মার্কিন এ্যাম্বেসেডর বলছেন, পদ্মা সেতু এই এলাকার সিল্ক রুট। এ রুট যে ইউরোপে পৌঁছে যাবে তুরস্ক হয়ে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে।
চমৎকার একটি ঈদ উৎসব শেষে হয়ত অনেক আশার কথাই লিখলাম। তবে মনে হয় না কোনটাই অমূলক। বরং এটাই সত্য যে আমরা এগিয়ে চলেছি। এখন প্রয়োজন শুধু গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক আর দেশের ভিতরের মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ নির্মূল করা।
swadeshroy@gmail.com
যা হোক, এই ইলিশ কেনার সময় অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বললেন, আচ্ছা আমাদের ইলিশ রফতানিটা বন্ধ করলে কী হয়। ইলিশ রফতানি করে আর ক’টা টাকা পাই। বাণিজ্যমন্ত্রীসহ গোটা কেবিনেটকে বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। কারণ, দিন দিন আমাদের প্রোটিনের পরিমাণ কমছে। সাধারণের বা গরিবের যে প্রোটিন ছিল মসুর ডাল তার এখন পৃথিবীজুড়ে দাম বেশি। এমতাবস্থায় প্রোটিনের বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকরা সব থেকে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। তাদের সরকার কম দামে চাল দিচ্ছে। তাদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আরো ভাবা হচ্ছে। সব কিছু মিলে মনে হচ্ছে, আরো বেতন তাদের বাড়ানো হবে। অন্যদিকে চীন থেকে গার্মেন্টস শিল্পের পুঁজি প্রত্যাহার করছে আমেরিকা। আমরা যদি কোন বড় ধরনের ভুল না করি, যদি দেশ আবার জঙ্গীবাদীদের কবলে না যায় তাহলে এই পুঁজির বড় অংশ বাংলাদেশে আসবে। কারণ, চীনের শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাচ্ছে। তাই স্বাভাবিকভাবে এ পুঁজি বাংলাদেশে আসবে। তখন আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকদের পরিশ্রম করতে হবে রাতদিন। রাতদিন এই পরিশ্রমের জন্য তাদের স্বাস্থ্য ঠিক রাখার প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে প্রোটিনের। এ ছাড়াও দেশের সার্বিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন প্রোটিন। সব মিলিয়ে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ভাল থাকলে কত লাভ আর ইলিশ মাছ রফতানি করলে কত লাভ সেটা এখন মনে হয় ভেবে দেখার সুযোগ হয়েছে। এমনকি সবকিছু দেখে মনে হয়, আমরা ইলিশ রফতানি করে যে অর্থ রোজগার করি তার থেকে বেশি অর্থ আমরা চিকিৎসার জন্য ভারতে ব্যয় করে আসি। তাই বাণিজ্যমন্ত্রীসহ সরকারকে বলব, ইলিশ ব্যবসায়ী, জেলেসহ সবার দিক হিসাব করে, পাশাপাশি দেশের মানুষের মুখের স্বাদ ও প্রোটিনের কথা চিন্তা করে ইলিশ নিয়ে দ্বিতীয় চিন্তা করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরে নিশ্চয়ই এবার ধন্যবাদ পাবে বিদ্যুত মন্ত্রণালয়। এবার রমজানে বিদ্যুতের লোডশেডিং হয়নি বলা চলে। এমন নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহ বাংলাদেশে এর আগে কখনও ঘটেনি। টেলিভিশনের পর্দায় বিশেষ করে টকশোতে ওই ভাবে চোখ রাখা হয় না। এটা কোন অবজ্ঞা থেকে নয়। অভ্যাস থেকে। কারণ, দেখার থেকে পড়তে ভাল লাগে। তাই সময় পেলে ওই কাজটি করি। তাই জানি না যে টকশোর বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ এবার এই বিদ্যুত নিয়ে সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছেন কিনা? তবে এবারের এই নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত সরবরাহের পরে এটা বলা যায়, স্বল্প সময়ের বিদ্যুত উৎপাদনে সরকার এখন সাফল্য অর্জন করেছে। এখন এই সাফল্য ধরে রেখে এই বিদ্যুত উৎপাদনকারীদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কীভাবে ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী বিদ্যুত উৎপাদন করা যায় সেটা ভাবতে হবে। কারণ, এটা সত্য যে, সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতে বিদ্যুত উৎপাদন ছাড়া এখন আর উপায় নেই। ব্যবসায়ী নেতা ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মঞ্জুর ইলাহীর বক্তব্য অনুযায়ী বলা যায়, বিদ্যুত কোথা থেকে এলো, বিদ্যুত সাদা কি কালো সেটা আমার দেখার দরকার নেই। আমার কারখানা চলছে। আমি বিদ্যুত পাচ্ছি এটাই যথেষ্ট। তাই অতীতের ধ্যান ধারণা ঝেড়ে ফেলে এখন নতুন করে নতুন পথে বিদ্যুত উৎপাদনের কথা ভাবতে হবে। কারণ, শুধু ওই চীনের গার্মেন্টস থেকে আমেরিকার পুঁজি নয়, আমরা যদি সঠিকভাবে দেশ চালাতে পারি অনেক পুঁজি এখানে আসবে। আর সে সব পুঁজির জন্য প্রয়োজন বিদ্যুত। কারণ, পুঁজিকে উৎপাদনে রূপান্তরিত করতে হলে বিদ্যুতের প্রয়োজন। তাই আধুনিক চিন্তার ওপর ভর করে সরকারকে বিদ্যুত উৎপাদনের পথে এগুতে হবে।
তবে এই বিদ্যুত আর বাজারদর শহরের এই দুই ঘটনার বাইরে এবার ঈদের দিন ঢাকার বাইরে থেকে টেলিফোন পেলাম কয়েক রাজনৈতিক বন্ধু বান্ধবের। যারা এবার বেশ মুশকিলে পড়েছিল সরকারের দেয়া ঈদের দিনের বিনামূল্যের চাল নিয়ে। কারণ, তারা গ্রামে ওইভাবে গরিব খুঁজে পাচ্ছিল না যাদের ওই চাল দেয়া যায়। সচ্ছলরা কেউই চাল নিতে রাজি নয়। কারণ, তারা সচ্ছল তারা নিজেদের দরিদ্রের কাতারে নামাতে চায় না। এ খবরটি থেকে বোঝা যায়, গ্রামীণ দারিদ্র্য কমেছে। গ্রামীণ দারিদ্র্য কমার এখন অনেক কারণ আছে। কারণ, বর্তমানের কৃষিমন্ত্রী শুধু চাল উৎপাদনে নজর দিচ্ছেন না। তিনি সবজিসহ ফলমূল উৎপাদনেও নজর দিচ্ছেন। বছরখানেক আগে এ জন্য তিনি থাইল্যান্ড গিয়েছিলেন। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের দেশের মানুষ থাইল্যান্ডে যায় শপিং করার জন্য। আপনিই বাংলাদেশে একমাত্র ব্যতিক্রম যার কোন শপিং করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ, আপনার সাদাসিধে জীবনের সঙ্গে ওই কালচারের কোন মিল নেই। আপনি কেন থাইল্যান্ড গেলেন। তিনি হেসে বললেন, আমি থাইল্যান্ড গিয়েছি গ্রামের পর গ্রাম হাঁটতে। কারণ, আজ সারা পৃথিবীর ফাইভ স্টার হোটেল থাইল্যান্ডকে চেনে ফলের কারণে। আমি ওদের হর্টিকালচারটি দেখার জন্যই সেখানে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশকেও ধনে পাতা থেকে ফল অবধি উৎপাদনে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিমন্ত্রীর কথা শুনে নিজেরই লোভ হয়েছিল। কিছুদিন পরে থাইল্যান্ড গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরেছি। ওদের বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলেছি। ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে হয়েছে থাইল্যান্ড যেমন সব ফল ব্যবহার করছে বাংলাদেশের পক্ষেও এটা সম্ভব।
যেমন ঈদের দিন দেখা হলো ভোরের কাগজের সাবেক সম্পাদক বেনজির আহমদের সঙ্গেÑ তিনি বললেন, তাঁর পাবনায় এখন এক ব্যক্তির নাম ধনে লতিফ। তিনি নাকি বছরে ৮ লাখ টাকার ধনে পাতা বিক্রি করেন। ঠিক তেমনি আরেকটি খবর দিলেন কলাকুপা বান্দুরার। সেখানে এক ব্যক্তি বিদেশে লটকন রফতানি করেন। যার মোট রফতানি এখন বছরে ১১ লাখ টাকা। কৃষিমন্ত্রী এবার অনেক জায়গায় লিচু মেলা উদ্বোধন করেছেন। স্ট্রবেরি চাষকে সহযোগিতা দিচ্ছেন। ফলে গ্রামে এখন আর রোজগার শুধু মূল ফসল ধানের ভিতর সীমাবদ্ধ নেই। ছড়িয়ে যাচ্ছে নানান দিকে। তার পরে আধুনিক উপায়ে মাছের চাষ তো আছেই। চিংড়ি পোনার উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্যাচারিতে বাড়িয়ে প্রাকৃতিক পোনা ধরা যদি বন্ধ করা যায় তাহলে সমুদ্রের মাছের পোনা ধ্বংস হওয়া বন্ধ হবে। এর পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিতে মাছ চাষ যেভাবে এগুচ্ছে এতে বদলে দেবে গ্রামের অর্থনীতি।
গ্রামের অর্থনীতি যে বদলে গেছে তা এবার ঈদের বাজারের খোঁজ খবর যারা রাখেন তারা সকলে জানেন জেলা শহর এমনকি উপজেলায়ও এবার পৌঁছে গেছে হাল ফ্যাশনের পোষাকটি। কম দামেও বিক্রি হয়নি সেখানে।
অন্যদিকে আরো একটি বিষয় দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতির একটি চিত্র পাওয়া যায়। এখান থেকে মাত্র কিছুদিন আগেও ঢাকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শহরের মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের সন্তানরা পড়তেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি এখন প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা যায় প্রায় অর্ধেকের বেশি ছেলেমেয়ে আসছে গ্রাম থেকে।
তাছাড়া এবার ঈদ বাজারের কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলেও বোঝা যায়, গ্রামের অর্থনীতির পরিবর্তন। যেমন এবার ঈদে ১৬শ’ কোটি টাকা বোনাস পেয়েছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা। গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায় সবাই গ্রামের। তাহলে এই ষোলো শ’ কোটি টাকার বড় অংশ ব্যয় হয়েছে গ্রামে। অন্যদিকে ১২ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিদেশে অবস্থানরত শ্রমিকরা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ঈদেই ব্যয় হয়েছে। আর যেহেতু এই শ্রমিকদের পরিবার সবাই গ্রামে থাকেন তাই এ অর্থের বড় অংশ গ্রামে ব্যয় হয়েছে।
সব মিলে গ্রামের অর্থনীতি বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে শহরের অর্থনীতি। এবং এই বদলে যাওয়াকে আরও বেশি গতি দেবে যদি এই সঙ্গে সমান তালে বিদেশী সাহায্য আসে। কারণ বিদেশী দাতাগোষ্ঠী এখন বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোকে মিলিনিয়াম গোলে পৌঁছে দেবার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করছে। তাই যেখানে বাংলাদেশ উঠে দাঁড়াচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশ মৌলবাদবিরোধী আন্দোলনের এক অগ্রণী সৈনিক। সেখানে বাংলাদেশের নিশ্চয়ই কোন বাধা থাকার কথা নয়, বিদেশী দাতা গোষ্ঠীর এই সাহায্য নিয়ে মিলিনিয়াম গোলে পৌঁছে যাওয়া। এ কথা সত্য, পদ্মা সেতু নিয়ে মূল দাতা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু সমস্যা হয়েছে। বাংলাদেশের কয়েক মন্ত্রী মুখে রাজনৈতিক বক্তব্য যাই দিক না কেন, সরকারের যাবতীয় কর্মকা- কিন্তু বলছে, বাংলাদেশ এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। এবং সার্বিক পরিস্থিতি বলছে সেটা সম্ভবও হবে।
তাছাড়া বর্তমান নেতৃত্বকে এই সত্য বুঝতে হবে, বাংলাদেশের বর্তমান যে উন্নয়ন শুরু হয়েছে এর গতি কোনমতে কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বসে বাড়ানো বা ধরে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, আমাদের গার্মেন্টসের মার্কেট হবে আমেরিকা। আমাদের জুতোর মার্কেট হবে ইউরোপ। আমাদের তৈরি খেলনার মার্কেট হবে গোটা পৃথিবী। সে দিকেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এমতাবস্থায় আমাদের সব থেকে বেশি দরকার অর্থনৈতিক ও কানেকটিভিটি। দুর্ভাগ্য হলো আমাদের এখানে এক শ্রেণীর মিডিয়ার কল্যাণে আমাদের কানেকটিভিটি মানে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কানেকটিভিটি বুঝছে। কিন্তু কেউ লক্ষ্য করে শুনছেন না যে, মার্কিন এ্যাম্বেসেডর বলছেন, পদ্মা সেতু এই এলাকার সিল্ক রুট। এ রুট যে ইউরোপে পৌঁছে যাবে তুরস্ক হয়ে সেটাও আমাদের ভাবতে হবে।
চমৎকার একটি ঈদ উৎসব শেষে হয়ত অনেক আশার কথাই লিখলাম। তবে মনে হয় না কোনটাই অমূলক। বরং এটাই সত্য যে আমরা এগিয়ে চলেছি। এখন প্রয়োজন শুধু গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক আর দেশের ভিতরের মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ নির্মূল করা।
swadeshroy@gmail.com
No comments