বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর আকাশের নীলপাখি রক্তাক্ত ডানায় by আলাউদ্দিন আল আজাদ

আমিই দিয়েছিলাম নামটা যখন জানতে পারি সারগোদায় মিগকন্ভারসন কোর্ড করতে গিয়ে একটি মিগ ১৯ বিমান চালাবার সময় ওটাতে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে অপূর্ব দক্ষতায় প্যারাস্যুটযোগে ভূমিতে অবতরণ করে। নীলপাখি তখন নীলপাখিই ছিল। কোনরকম আঘাত পায়নি এবং জখমও নয়। মাটিতে পড়লেও অক্ষত, সজীব।


আশপাশের গ্রাম থেকে শত শত লোক, নারীপুরুষ আসমান থেকে কে পড়েছে দেখতে, দৌড়াদৌড়ি করে এসে চারপাশটা ঘিরে ধরেছিল। কিন্তু এর প্রায় চার বছর পর আকাশযুদ্ধ হলে দৃশ্যপট অন্যরকম হয়ে যায়, তখন দেখা যায় শুধু সিন্ধুর এক জলাভূমির কাছে একটি ধাতব ধ্বংসস্তূপ। মিগ দুর্ঘটনার দিনটি ছিল ২১ জুলাই ১৯৬৭, আর এ যুদ্ধের দিনটি ২০ আগস্ট ১৯৭১।
মতিউর রহমান তখন ছিলেন নবীন তরতাজা ফ্লাইং অফিসার আর এখন অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও নিপুণ কিন্তু কর্তৃপক্ষ কর্র্তৃক গ্রাউন্ডেড ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট।
২০ আগস্ট একাত্তর এ দিনটি ছিল তার অনেক স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষার, অনেক বিনিদ্ররজনীর খসড়া করা এক বর্ণাঢ্য শিল্পকলা এসপার কি ওসপার ফিফটি ফিফটিও নয়। ঝুঁকি নাইন্টি পারসেন্ট, সাকসেস টেন। তবু এটাই একমাত্র সুযোগ।
অপরাজয় নবজাগ্রত বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধ তখন এগিয়ে চলেছে অগুনের চাকার মতো, সেক্টরে সেক্টরে তার দুঃসাহসী সন্তানদের মরণপণ তৎপরতা চলছে দেশকে শত্রুমুক্ত করবার জন্য। আপন ভূখ-ে নিয়মিত বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অতুলনীয় সামরিক প্রজ্ঞায় অবিরাম আক্রমণ চলছে, সে সময় প্রিয়মাতৃভূমি থেকে হাজার মাইলের অধিক দূরত্বে ঘটছিল সর্বকালীন শীর্ষ বীরত্বের অরেকটি ঘনটা যা রূপকথারই সমান আর কিংবদন্তির চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে সে দিনটি স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছে।
আরেকটি ভোর, পৃথিবীতে। দিনটি ছিল শুক্রবার। সময় সকাল ১০টা ১৭ মিনিট। স্থান, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর মসরুর ঘাঁটি (ইধংব) । নিয়মিত উড্ডয়নের নির্ধারিত সময় এটা। একজন তরুণ ফ্লাইং অফিসার রশিদ মিনহাজ মূল ভবনের উড়াল ইউনিট থেকে বেরিয়ে এলো, সঙ্গে একজন ইনস্ট্রাক্টর। তাঁরা হাঁটতে থাকে এবং টি-৩০ প্রশিক্ষণ বিমানগুলো যেখানে পার্ক করা ছিল, সেদিকে যায়।
ওখানকার একটি ফাইটারের (টি ৩৩ কোডনাম টিবার্ড) ককপিটে রশিদ প্রবেশ করল। নিয়মমাফিক ইনস্ট্রাক্টর তার পিছনে। নিজের পালা এলে রশিদ প্লেন চালিয়ে ছুটে গেল রানওয়ের দিকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
খুব বেশিক্ষণ নয়, বিমানটি আবার মাটিতে নামল। রশিদ ওটাকে ট্যাকসিং করে যথাস্থানে নিয়ে যায়।
ইনস্ট্রাক্টর এগিয়ে গেলেন। তিনি শিক্ষানবিসের উড্ডয়ন কৌশল দেখে খুশি হয়েছেন। রশিদকে তিনি দ্বিতীয়বার আকাশে একক উড়ালে যাবার নির্দেশ দিয়ে অন্যদিকে চলে গেলেন। কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে প্রয়োজনীয় অর্ডারের অপেক্ষায় থাকল রশিদ মিনহাজ।
কন্টোল টাওয়ার অনুমতি দিল। ওদিকে তখন অপর ইনস্ট্রাক্টর গ্রাউন্ড সিকিউরিটিতে কর্তব্য পালনরত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর তাঁর ব্যক্তিগত গাড়িতে (ঙঢ়বষ ঈধফবঃ) উঠলেন এবং এগিয়ে এলেন।
টেক অকের জন্য রানওয়েতে যাবার আগে দশ গজের মতো একফালি জায়গা পেরিয়ে যেতে হয়। যার কিছুটা ছোট্ট পাহাড়ের আড়ালে পড়ায় কন্ট্রোল টাওয়ারের দৃষ্টিগোচর হয় না।
অনুমতি পেয়ে রশিদ মিনহাজ এগুতে লাগল প্রধান রানওয়ের দিকে। মতিউরের গাড়ি এলো ট্যাক্সিং ট্র্যাক দিয়ে ঘুরে ঘুরে রশিদের বিমানকে ছাড়িয়ে গেল। তারপর একটা নিপুণ ইউটান্ নিয়ে ক্রিচ্ক্রিচ্ শব্দে থামল। টি বার্ডের পুচ্ছের দিকে সঙ্কেত করেন এবং বুড়ো আঙুল নিচু করে রশিদকে দেখান মতিউর যার অর্থ বিমানের পিছন দিকে কিছু গোলমান আছে।
মতিকে চিনল রশিদ। কারণ এককালে ইনি তার উড়াল শিক্ষক ছিলেন। বিমানটি থামাল রশিদ। মতি উড়ালীকে বিমানের অসুবিধে সম্পর্কে অবহিত করার ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ মতিউর লাফিয়ে উঠলেন পাখায়, মুখটা বাড়িয়ে দিলেন রশিদের কানের কাছে : ইঞ্জিনে কি গোলমাল আছে সে সম্পর্কে যেন কি জানাবেন, কিন্তু শেষমেশ দু’আসনবিশিষ্ট প্লেনটির পিছনের আসনে লাফ দিয়ে পড়লেন।
১১.২৯ মিনিট। মতি, রশিদের স্পিকার ও হেডফোন থেকে রেডিওর টেলিফোন সূত্র বিচ্ছিন্ন করতে লাগলেন, অক্সিজেনের নলেও ছক্কা মারেন। হতচকিত রশিদ জলছি আবার রেডিও টেলিফোন সূত্র সংযুক্ত করেন। এবং বায়ুতরঙ্গে কঁকিয়ে ওঠে তার কণ্ঠস্বর : টিবার্ডকে হাইজ্যাক করা হচ্ছে! অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের সঙ্গে তার কথা রেকর্ড করে কন্ট্রোল টাওয়ার। ১১.৩০ মিনিট। টিবার্ড সগর্জনে ট্যাক্সিং ট্র্যাক ছাড়িয়ে তীব্রবেগে প্রধান রানওয়েতে গিয়ে পড়ল এবং টেকঅফ করতে গেল।
কন্ট্রোল টাওয়ার : টিবার্ড থামো। টিবার্ড থামো। টিবার্ড থামো। কিন্তু বিমানটি রানওয়ে জর্জরিত করে ছুটে গেল এবং পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে উড়ল আকাশে।
১১.৩১ মিনিট। রেডিও- টেলিফোনে আবার রশিদের মরিয়া কণ্ঠস্বর : টিবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে।
পাঁচ মিনিট পরে, এই বার্তা আবার রেকর্ড করল কন্ট্রোল টাওয়ার : টিবার্ড হাইজ্যাক হয়েছে। এরপরে সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন : চিরকালের জন্য।
মতিউরের মৃতদেহ ঘনটাস্থল থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়; কিন্তু মিনহাজের কোন চিহ্ন মেলেনি। নীলপাখির রক্তাক্ত ডানা দৃশ্যমান না হলেও সেজন্যই তার উড়াল শেষ হয়েছিল। যে কারণেই বিমানটি ধ্বংস হয়ে থাক তা এক মরণপণ যুদ্ধেরই ফল এবং মতিউর জীবিত নেই এটাই নির্মম সত্য তাঁর ছাত্র রশিদ মিনহাজও মৃত। মুজিবের পরে ইনিই দ্বিতীয় ব্যক্তি যাঁকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ সরকারীভাবে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছে।
প্রফেসর ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মৃতি পরিষদ’-এর সভাপতি হিসেবে ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন। লেখাটি অপ্রকাশিত।

No comments

Powered by Blogger.