রমজান শেষ, এবার কি উত্তপ্ত হবে রাজনীতি!

রমজান মাসজুড়েই ছিল নিস্তরঙ্গ রাজনীতি। ঈদও শেষ। এবার জমবে মাঠের রাজনীতি। দু’দলই কৌশলী রাজনীতি নিয়ে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছে। ‘অন্তর্বর্তী নাকি নির্দলীয়’Ñ কোন্্ পদ্ধতির সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে আগামী নির্বাচন- এ ইস্যুতে জমে উঠবে মাঠের রাজনীতি।


এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চলছে উত্তপ্ত বাহাস। অন্তবর্তী সরকারের রূপরেখা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংলাপের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।
তবে নির্বাচনীকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এখনো বহু দূরে। এ কারণে পরস্পরকে চাপের মুখে রাখতে কঠোর অবস্থানে থাকারও ঘোষণা দিয়েছে সরকার ও বিরোধী দল। উভয় পক্ষের এহেন বৈপরীত্য অবস্থানে দেশের রাজনীতি যে আবার সংঘাত ও সহিংসতার পথে হাঁটতে পারে- এমন আশঙ্কা এখন সর্বত্র।
আন্দোলনের হুমকি-ধমকি এবং তা মোকাবেলার হুঁশিয়ারি শুধু নেতাদের মুখ থেকে এলেও রাজপথে এর বাস্তবায়ন ও সাফল্যে নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটেনি দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে। প্রান্ত থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দু’পক্ষেরই ভঙ্গুর রাজনৈতিক শক্তিই এ উদ্বেগের কারণ। সংগঠনকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে জনমত গঠনে সহসাই তৃণমূল অভিযান শুরু করবে দু’দলই।
জানা গেছে, আগামী মাসের শুরুতেই বড় দুই দল অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে এক ধরনের সংলাপে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অনুষ্ঠানিকভাবে না বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে প্রধান এই দুই দলের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের অঘোষিত সমঝোতা। তবে সেটি নির্দলীয় নাকি নির্বাচিতদের নিয়ে গঠিত হবে, ওই সরকারের প্রধান কে হবেন, তিন মাসের ওই অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যপরিধিই বা কী হবে- এ নিয়ে রাজনৈতিক সংলাপের সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে ঈদের পর। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে একটি বিকল্প প্রস্তাব দেয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন দলটির ক’জন শীর্ষ নেতা।
ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বলছে, তত্ত্বাবধায়ক নয়, আগামী নির্বাচন হবে সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই। তবে এর গঠন প্রক্রিয়া কী হবে বিএনপি রাজি থাকলে তারা এ ব্যাপারে সংলাপে বসতে রাজি। উপরন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে ইতোমধ্যে ওই অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপি চাইলে অংশগ্রহণ করতে পারে বলেও প্রস্তাব দিয়েছেন। বিএনপি বলছে, তারা সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসতে প্রস্তুত রয়েছে। তবে তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রয়োজনে সংলাপ এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলন চলবে।
এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাব। সেই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যে নির্দলীয় সরকার প্রয়োজন তা নিয়েও জনমত তৈরি করব। আমরা সংলাপে রাজি, তবে সর্বাগ্রে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে হবে যে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার হবে অবশ্যই নির্দলীয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুব-উল আলম হানিফ বিএনপির এমন অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা ঠিক করতে বিএনপি আলোচনার ব্যাপারে ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে এলে আওয়ামী লীগ অবশ্যই আলোচনার উদ্যোগ নেবে। আওয়ামী লীগ সংলাপে বসতে প্রস্তুত। এ বিষয়ে তারা (বিএনপি) সংসদে যৌক্তিক দাবি নিয়ে এলে দেশ ও জনগণের কল্যাণে তা মেনে নেয়া হবে। তবে আগামী নির্বাচন সংবিধান অনুসারেই হবে। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের তত্ত্বাবধায়ক দাবি থেকে সরে আসা উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর নির্বাচনীকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মুখোমুখি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আগামী নির্বাচন হবে কার অধীনে; নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নাকি নির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারÑ এ বিতর্কেই ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের রাজনীতি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, দাতাগোষ্ঠীসহ সকল মহলই চাইছে সরকার ও বিরোধী দল এ নিয়ে একটি সমঝোতায় উপনীত হোক।
বিরোধী দলের সমন্বয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক প্রস্তাব সমঝোতার একটি সম্ভাবনাও তৈরি করেছিল। কিন্তু বিরোধীদলীয় নেত্রীর তাৎক্ষণিক সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান সেই সম্ভাবনা কিছুটা হলেও হোঁচট খায়। এ অবস্থায় নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে সমঝোতার সম্ভাবনা এখনও অনেক দূর বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবে সব মহলই একমত, দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের বর্তমান অবস্থান এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনার কারণে আগামীতে দেশের রাজনীতির মূল আলোচনার বিষয়ে পরিণত হবে নির্বাচনীকালীন সরকার কোন্্ ধরনের হবে তা নিয়ে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা কেমন হবে সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগের তরফে বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে, শরিক দল এবং বিএনপির সঙ্গে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেয়া হতে পারে। বিরোধী দল আলোচনায় রাজি না হলে তাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও হতে পারে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সবার চাহিদা জানার চেষ্টা করবে। দলটির নেতাদের মতে, বিএনপিকে অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছেন। আর এভাবে সমাধান হলে তাতে জনসমর্থনও থাকবে।
সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় মন্ত্রী ও নেতাদের বিভিন্ন ফোরামে অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক দিকগুলো বিএনপিকে বোঝানোর নির্দেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি ঈদের পর সারাদেশে ঝটিকা সফরের মাধ্যমে জনগণের সামনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুফল এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে যুক্তি জোরালোভাবে তুলে ধরে জনসমর্থন সৃষ্টিরও নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ এ নিয়ে মহাজোটভুক্ত দলগুলোর সঙ্গেও বৈঠক করবে। এরপর দলটির পক্ষ থেকে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে সংলাপ করা হবে। সেই সংলাপের ভিত্তিতে সম্মানজনক সমাধান আসবে বলে মনে করছেন দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
অন্যদিকে বিএনপিও আন্দোলনের পাশাপাশি নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা কী হতে পারে তা নিয়ে শীঘ্রই শরিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করবে। দলটির একাধিক সূত্র জানায়, বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে আলোচনা হয়, আওয়ামী লীগ সংলাপের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিলে অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা, সেই সরকারের প্রধান কে হবেন এবং অন্য কে কে থাকবেন, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলোইবা কার হাতে থাকবেÑ সে ব্যাপারে তারা আলোচনার জন্য প্রস্তুত। ইতোমধ্যে দলটির সমমনা কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আইনজীবীকে নিয়ে বিএনপি এ ব্যাপারে একটি বিকল্প প্রস্তাবও তৈরি করছেন বলে সূত্রগুলো জানায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সভা-সমাবেশে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচীর হুমকি দিলেও বিএনপির বিশৃঙ্খল সাংগঠনিক শক্তি আর প্রধান শরিক জামায়াতের নাজুক অবস্থার কারণে রাজপথের কর্মসূচী বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তিও অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় নড়বড়ে। সর্বত্র দ্বন্দ্ব-কোন্দল, বিবাদে নাজুক অবস্থা দলটির। রাজপথে বিরোধী দলকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার পরিবর্তে শুধু প্রশাসন দিয়ে আন্দোলন কতটুকু মোকাবেলা সম্ভব হবে, তা নিয়েও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতাদের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফুটে উঠেছে।
নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকারের দাবিতে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলটির প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও ঈদের পর আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন দল ও শরিক জোটের নেতাদের। সে লক্ষ্যে দলীয় সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি জোটের পরিধি বৃদ্ধিরও উদ্যোগ নিয়েছে চারদলীয় জোটের প্রধান শরিক বিএনপি। তবে বর্তমান দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল-দ্বন্দ্ব, সিনিয়র নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় কিছুটা সঙ্কটে রয়েছে বিএনপি। জানা গেছে, আগামী মাসের শুরুতেই বিএনপির কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা সারাদেশে সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে দেশব্যাপী জনমত সৃষ্টির জন্য মাঠে নামবেন।
অপরদিকে বসে নেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও। বিরোধী দলের আন্দোলনের হুমকি হাল্কাভাবে নিচ্ছে না তারা। তাই ঈদের পর পরই গঠিত ১৮টি টিম নিয়ে আওয়ামী লীগ সকল জেলা সদরে সমাবেশের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা করে তুলবে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে শুরু করবে তৃণমূল মিশন। বিরামহীনভাবে সারাদেশে সাংগঠনিক তৎপরতা পরিচালনার মাধ্যমে দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব, বিবাদ নিরসনের পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে জনমত সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু সংগঠনকেই শক্তিশালী নয়, দলের পাশাপাশি মহাজোটকেও সারাদেশে সক্রিয় ও চাঙ্গা করে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে চৌদ্দ দল ও মহাজোটের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠকের মাধ্যমে নির্বাচনী জোটকে সক্রিয় করার প্রক্রিয়ায় নামবে দলটির হাইকমান্ড। শীঘ্রই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক ডেকে সেখানে এসব পরিকল্পনার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে দলটি।

No comments

Powered by Blogger.