সময়ের কথা-দেবে তো দাও... কেজির দরে মণ? by অজয় দাশগুপ্ত
কুড়িয়ানা কিংবা গুপ্তের হাটের মতো এলাকা রয়েছে অনেক। কোথাও কোথাও তাদের মেলে পৃষ্ঠপোষকতা। কোথাও তারা থাকে উপেক্ষিত। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কোথাও সম্ভাবনা থাকলে তার খবর আরও অনেকের কাছে পেঁৗছানো এখন কঠিন কিছু নয়।
কুড়িয়ানার জন্য কিছু করতে সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব ছুটে গেছেন। তার উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসুক উদ্যোক্তা, ব্যাংকার ও বিজ্ঞানীরা। গুপ্তের হাটের মাছচাষিরা এভাবে পেয়ে যাক পৃষ্ঠপোষক। তাদের পাশে থাকুক প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের সব অংশের মানুষ
কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানসংলগ্ন খালে প্রতি মণ পাকা পেয়ারা বিক্রি হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে_ ঢাকা কিংবা অন্য বড় শহরে যারা ইফতারির জন্য রমজান মাসে ৮০ থেকে ১০০ টাকা প্রতি কেজি কিনেছেন তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে। আমাদের দেশে কৃষি অর্থনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকের কাছে অবশ্য এ তথ্য জানা। শুধু পেয়ারা নয়, আরও অনেক ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা বাম্পার ধান ফলিয়ে ভালো দাম পায় না, সোনালি আঁশ পাট সময়ে সময়ে হয়ে ওঠে গলার ফাঁস। যেন তাদের কাজ করে চলা কেবল ব্যবসায়ীদের মুনাফা ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য! আমাদের রাজনীতির যারা কর্ণধার_ তাদের অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে তেমন মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায় না। রাজনীতির অনেক এজেন্ডা তাদের সামনে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের সর্বক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলে। বিরোধী পক্ষ হরতাল-অবরোধ ডাকে, সরকার পক্ষ তার প্রতিরোধে আস্ফালন দেখায়। কিন্তু পেয়ারা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী? এটা আবার কোনো ইস্যু নাকি?
আমড়া-পেয়ারার বাগানে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল ১৬ আগস্ট। ঢাকা থেকে সাত সকালে রওনা হয়ে মোটর গাড়িতে মাওয়া ফেরিঘাট দিয়ে নির্বিঘ্নে পদ্মা নদী পার হয়ে যাই। নদী অতিক্রম করতে প্রয়োজন পড়ে ঘণ্টা দেড়েক। ছোট ফেরিতে সময় খানিকটা কম লাগে। কোনো কোনো ফেরিতে গাড়ি পার হয় তিন ঘণ্টায়। ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়। পদ্মায় সেতু নির্মাণ হলে ৬-৭ মিনিটেই গাড়ি চলে যাবে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে। কবে নির্মাণ শুরু হবে স্বপ্নের এ সেতুর, কে জানে। এ কার পাপ!
মোটর গাড়িতে বরিশাল শহরের প্রায় কাছ দিয়ে দুর্গাসাগর ও স্বরূপকাঠি হয়ে কুড়িয়ানা পেঁৗছাই দুপুর ১টার মধ্যেই। সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদারের বিশেষ আগ্রহ ছিল পেয়ারা বাগানে যাওয়ার। কুড়িয়ানার পেয়ারা খুব মিষ্টি। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বাগানে তা ফলে প্রচুর। তবে সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় উৎপাদকরা দাম কম পায়। তিনি ওই এলাকায় থাই জাতের পেয়ারা চাষ করা যায় কিনা, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাইছিলেন। ১৬ আগস্ট দুপুরে স্থানীয় স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এ বিষয়টি আলোচনা করেন। তিনি দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন_ কুড়িয়ানায় যে পেয়ারা উৎপাদন হয়, তা বছরে মাত্র মাসতিনেকের জন্য মেলে। এমন জাতের চাষ করতে হবে, যা বছরের সবসময় ফলে। দ্বিতীয়ত, ফলের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ।
এমনটি করা সম্ভব হলে সেখানের চাষিদের জীবনেই কেবল সচ্ছলতা আসবে না, আমাদের ফলের চাহিদা পূরণেও চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইঞ্জিনের নৌকা বা সাধারণ নৌকা করে যেতে হয় পেয়ারা বাগানে। পেয়ারা গাছ রয়েছে সারি সারি করে লাগানো। প্রতি সারির পাশে নালার মতো খাল। এ খালেই ছোট ছোট নৌকা নিয়ে চলে যায় মজুররা বাগানে। পাকা বা প্রায় পাকা 'দেশি' পেয়ারা গাছ থেকে ছিঁড়ে রাখা হয় নৌকায়। মজুরি এখন দিনে ৩০০ টাকা। মজুররা বছরের অন্য সময়ে গাছের পরিচর্যা করে। পেয়ারা বাগানে আমাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শেখর শিকদার। তিনি জানালেন জমির মালিকদের দুর্দশার কথা_ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় বড় শহর থেকে পাইকাররা আসে পেয়ারা কেনার জন্য। বাগানের ভেতরেই মৌসুমের সময় কয়েকটি স্থানে নদী-খালের পাশে বা ভেতরে প্রতি সকালে হাট বসে। ফলন ভালো হলে প্রতি মণে দাম মেলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এরপর পেয়ারা সুন্দর মোড়কে তুলে দেওয়া হয় ঢাকা বা চট্টগ্রামগামী ট্রাকে। বাগান এলাকায় যাওয়ার জন্য একটি আধপাকা সড়ক আছে, যেখানে আসে ট্রাক। কোনো কারণে পেয়ারার মৌসুমে ট্রাক না এলে প্রতি মণের দাম রাতারাতি নেমে আসে ৪০-৫০ টাকায়। তিনি ২২ আগস্ট এ লেখার সময় আমাকে টেলিফোনে জানালেন, ২১ আগস্ট (ঈদের পর দিন) প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকায়। কারণ একটাই_ দূরের পাইকাররা আসেনি। ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি দিয়ে পেরে আনা পেয়ারার দাম ৩০ টাকা!
যাবেন নাকি সবাই, কুড়িয়ানার বাগানে পেয়ারা খেতে? চাষিরা এ জন্য আপনার কাছ থেকে কোনো পয়সা নেবে না। যত খুশি খেয়ে আসুন পেয়ারা এবং দেখে ও বুঝে আসুন চাষিদের জীবন এবং ফলের পচন। উৎপাদকদের দাবি দুটি_ পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার এবং জেলি তৈরির কারখানা। সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার এবং পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান মনে করেন যে, এটা পূরণ সম্ভব। ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুড়িয়ানার পেয়ারাচাষিদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পেয়ারাচাষিদের হিমাগার তৈরি এবং জেলি ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য ঋণ প্রদানে প্রস্তুত। উদ্যোক্তারা যত অর্থ বিনিয়োগ করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সমপরিমাণ অর্থ তাদের দেবে এবং প্রথম কয়েকটি বছর এ জন্য কোনো সুদও দিতে হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান গ্রামের খবর জানতে চেয়েছেন। তার আবেদন ঈদের ছুটিতে হাজার হাজার গ্রামে শিকড়ের টানে যাওয়া নারী-পুরুষের কাছে। গ্রাম সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যমের কর্মী_ সবার পর্যবেক্ষণ তিনি জানতে চেয়েছেন। কুড়িয়ানার পেয়ারাচাষিদের জীবন ও জীবিকা নিশ্চয়ই তাকে এবং তার সহকর্মীদের আকৃষ্ট করবে।
জোয়ার-ভাটার কুড়িয়ানা ও আশপাশের অঞ্চলের মাটিতে সোনা ফলে। পেয়ারা, আমড়া, কলা, পেঁপে, লেবু, করলা, কাঁকরোল_ যা লাগাবেন ফলন মিলবে অঢেল। সুপারি-নারকেলও জন্মায় প্রচুর। পেয়ারা বাগানে এক সচ্ছল চাষি জানালেন, এ বছর ১০ লাখ টাকার আমড়া তিনি বিক্রি করেছেন। তার পেয়ারা বাগানে আমড়া ও পেয়ারার গাছ পাশাপাশি লাগানো। আমড়া গাছ বড় হয় এবং সে তুলনায় পেয়ারা গাছ ছোট। আমড়া গাছ থেকে সাধারণত বছরে দু'বার ফলন মেলে। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার ফলন কম হয়। তবে চাষিরা ধরে নেয়_ দ্বিতীয়টা ফাও।
ওই এলাকা উদ্ভিদের চারার জন্যও সুপরিচিত। দক্ষিণাঞ্চলের নানা জাতের গাছের চারার বড় জোগান আসে স্বরূপকাঠি থেকে। কুড়িয়ানা এ উপজেলাতেই অবস্থিত। এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে স্বরূপকাঠির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নেছারাবাদ। তবে স্বরূপকাঠিকে ভোলেনি জনগণ। মিহির কান্তি মজুমদার সারা বছর ফলন মেলে এবং দ্রুত নরম হয় না কিংবা পচে যায় না, এমন জাতের পেয়ারার চাষ করতে বাগান মালিকদের উৎসাহিত করছেন। এতে মুখরোচক ফল মিলবে। চাষিরাও পাবে ভালো দাম। এ জন্য গবেষণা দরকার। আমাদের একাধিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে আগ্রহীরা এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। আমড়া, পেঁপে. কলা, নারকেল ও সুপারির আকার যাতে বড় হয়, ওই এলাকার কোন জাত সবচেয়ে উপযোগী_ এসব নিয়ে কাজ করলে শুধু স্থানীয় কৃষকদের নয়, সার্বিকভাবে গোটা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে।
কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। এখানের জলাভূমিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এর প্রতিশোধ হিসেবে বাগান কেটে সাফ করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা। এখন যে পেয়ারা-আমড়া বাগান, তা স্বাধীনতার পর নতুন করে গড়ে তোলা। পেয়ারা-আমড়াচাষিদের পাশে দাঁড়াতে হলে একদিকে যেমন গবেষণার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, তেমনি বিনিয়োগে আগ্রহীদের পাশে দাঁড়াতে হবে ব্যাংকগুলোকে। সরকার ও বেসরকারি সব ধরনের ব্যাংকেরই এ ইস্যু নিয়ে ভাবতে হবে।
একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। মূল বাগানে যেতে হলে ছোট-বড় খাল-নালাই ভরসা। এ অবস্থার পরিবর্তন কাম্য হয়। কিন্তু বাগানের কাছাকাছি যে সড়ক, তা যেন সারা বছর ট্রাক ও ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী থাকে, তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই যোগাযোগের প্রসঙ্গেই আরেকটি এলাকার কথা বলব_ বরিশালের আগৈলঝাড়ার গুপ্তের হাট। সাবেক মন্ত্রী সুনীল গুপ্তের নামে এ হাটের নাম। শুরুতে সপ্তাহে একদিন বিকেলে হাট বসত। এখন প্রতি সকালে বিক্রি হয় মাছের পোনা। পোনা মাছ কেনা ও বিক্রির জন্য সমবেত হয় হাজার পাঁচেক লোক। সংশ্লিষ্টরা জানান, যশোর অঞ্চল থেকে রেণু সংগ্রহ করে এনে তা ফোটানো হয় গুপ্তের হাটের আশপাশের বিভিন্ন পুকুরে। এখানের পুকুরগুলোতে এমন কিছু গুণ রয়েছে, যে কারণে মাছের পোনার মান হয় উৎকৃষ্ট। আশপাশের অনেক এলাকার পুকুরে এ পোনা ফেলে মাছচাষিরা লাভবান হচ্ছেন। যদি গুপ্তের হাটের এলাকায় যাতায়াত সহজ করার জন্য ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কার ও চওড়া করে মোটরযান চলার উপযুক্ত করা হয়, যদি আশপাশের খালগুলোতে সারা বছর পানি থাকে (এ জন্য নিকটবর্তী পালরদী বা গৌরনদী নদীর খনন অপরিহার্য) তাহলে বরিশাল-মাদারীপুর-বাগেরহাট-গোপালগঞ্জের মাছচাষিরাও গুপ্তের হাটে আসবেন উন্নত মানের মাছের পোনার জন্য। এ ধরনের সমস্যা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়। কেবল প্রশাসন এ নিয়ে ভাববে, সেটাও ঠিক নয়। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য 'অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি' উপযুক্ত। কুড়িয়ানা কিংবা গুপ্তের হাটের মতো এলাকা রয়েছে অনেক। কোথাও কোথাও তাদের মেলে পৃষ্ঠপোষকতা। কোথাও তারা থাকে উপেক্ষিত। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কোথাও সম্ভাবনা থাকলে তার খবর আরও অনেকের কাছে পেঁৗছানো এখন কঠিন কিছু নয়। কুড়িয়ানার জন্য কিছু করতে সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব ছুটে গেছেন। তার উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসুক উদ্যোক্তা, ব্যাংকার ও বিজ্ঞানীরা। গুপ্তের হাটের মাছচাষিরা এভাবে পেয়ে যাক পৃষ্ঠপোষক। তাদের পাশে থাকুক প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের সব অংশের মানুষ। আমাদের একটু ভালো থাকার জন্য এরই যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানসংলগ্ন খালে প্রতি মণ পাকা পেয়ারা বিক্রি হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে_ ঢাকা কিংবা অন্য বড় শহরে যারা ইফতারির জন্য রমজান মাসে ৮০ থেকে ১০০ টাকা প্রতি কেজি কিনেছেন তাদের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতেই পারে। আমাদের দেশে কৃষি অর্থনীতি নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অনেকের কাছে অবশ্য এ তথ্য জানা। শুধু পেয়ারা নয়, আরও অনেক ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত থাকে। তারা বাম্পার ধান ফলিয়ে ভালো দাম পায় না, সোনালি আঁশ পাট সময়ে সময়ে হয়ে ওঠে গলার ফাঁস। যেন তাদের কাজ করে চলা কেবল ব্যবসায়ীদের মুনাফা ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য! আমাদের রাজনীতির যারা কর্ণধার_ তাদের অবশ্য এসব বিষয় নিয়ে তেমন মাথাব্যথা লক্ষ্য করা যায় না। রাজনীতির অনেক এজেন্ডা তাদের সামনে। প্রতিপক্ষের সঙ্গে তাদের সর্বক্ষণ বাকবিতণ্ডা চলে। বিরোধী পক্ষ হরতাল-অবরোধ ডাকে, সরকার পক্ষ তার প্রতিরোধে আস্ফালন দেখায়। কিন্তু পেয়ারা নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী? এটা আবার কোনো ইস্যু নাকি?
আমড়া-পেয়ারার বাগানে যাওয়ার সুযোগ ঘটেছিল ১৬ আগস্ট। ঢাকা থেকে সাত সকালে রওনা হয়ে মোটর গাড়িতে মাওয়া ফেরিঘাট দিয়ে নির্বিঘ্নে পদ্মা নদী পার হয়ে যাই। নদী অতিক্রম করতে প্রয়োজন পড়ে ঘণ্টা দেড়েক। ছোট ফেরিতে সময় খানিকটা কম লাগে। কোনো কোনো ফেরিতে গাড়ি পার হয় তিন ঘণ্টায়। ঘাটে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় অনেক সময়। পদ্মায় সেতু নির্মাণ হলে ৬-৭ মিনিটেই গাড়ি চলে যাবে এপার থেকে ওপারে, ওপার থেকে এপারে। কবে নির্মাণ শুরু হবে স্বপ্নের এ সেতুর, কে জানে। এ কার পাপ!
মোটর গাড়িতে বরিশাল শহরের প্রায় কাছ দিয়ে দুর্গাসাগর ও স্বরূপকাঠি হয়ে কুড়িয়ানা পেঁৗছাই দুপুর ১টার মধ্যেই। সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদারের বিশেষ আগ্রহ ছিল পেয়ারা বাগানে যাওয়ার। কুড়িয়ানার পেয়ারা খুব মিষ্টি। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা বাগানে তা ফলে প্রচুর। তবে সংরক্ষণ সুবিধা না থাকায় উৎপাদকরা দাম কম পায়। তিনি ওই এলাকায় থাই জাতের পেয়ারা চাষ করা যায় কিনা, তার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে চাইছিলেন। ১৬ আগস্ট দুপুরে স্থানীয় স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক সমাবেশে তিনি এ বিষয়টি আলোচনা করেন। তিনি দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন_ কুড়িয়ানায় যে পেয়ারা উৎপাদন হয়, তা বছরে মাত্র মাসতিনেকের জন্য মেলে। এমন জাতের চাষ করতে হবে, যা বছরের সবসময় ফলে। দ্বিতীয়ত, ফলের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ।
এমনটি করা সম্ভব হলে সেখানের চাষিদের জীবনেই কেবল সচ্ছলতা আসবে না, আমাদের ফলের চাহিদা পূরণেও চমৎকার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইঞ্জিনের নৌকা বা সাধারণ নৌকা করে যেতে হয় পেয়ারা বাগানে। পেয়ারা গাছ রয়েছে সারি সারি করে লাগানো। প্রতি সারির পাশে নালার মতো খাল। এ খালেই ছোট ছোট নৌকা নিয়ে চলে যায় মজুররা বাগানে। পাকা বা প্রায় পাকা 'দেশি' পেয়ারা গাছ থেকে ছিঁড়ে রাখা হয় নৌকায়। মজুরি এখন দিনে ৩০০ টাকা। মজুররা বছরের অন্য সময়ে গাছের পরিচর্যা করে। পেয়ারা বাগানে আমাদের সহযাত্রী হয়েছিলেন আটঘর-কুড়িয়ানা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শেখর শিকদার। তিনি জানালেন জমির মালিকদের দুর্দশার কথা_ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় বড় শহর থেকে পাইকাররা আসে পেয়ারা কেনার জন্য। বাগানের ভেতরেই মৌসুমের সময় কয়েকটি স্থানে নদী-খালের পাশে বা ভেতরে প্রতি সকালে হাট বসে। ফলন ভালো হলে প্রতি মণে দাম মেলে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এরপর পেয়ারা সুন্দর মোড়কে তুলে দেওয়া হয় ঢাকা বা চট্টগ্রামগামী ট্রাকে। বাগান এলাকায় যাওয়ার জন্য একটি আধপাকা সড়ক আছে, যেখানে আসে ট্রাক। কোনো কারণে পেয়ারার মৌসুমে ট্রাক না এলে প্রতি মণের দাম রাতারাতি নেমে আসে ৪০-৫০ টাকায়। তিনি ২২ আগস্ট এ লেখার সময় আমাকে টেলিফোনে জানালেন, ২১ আগস্ট (ঈদের পর দিন) প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকায়। কারণ একটাই_ দূরের পাইকাররা আসেনি। ৩০০-৪০০ টাকা মজুরি দিয়ে পেরে আনা পেয়ারার দাম ৩০ টাকা!
যাবেন নাকি সবাই, কুড়িয়ানার বাগানে পেয়ারা খেতে? চাষিরা এ জন্য আপনার কাছ থেকে কোনো পয়সা নেবে না। যত খুশি খেয়ে আসুন পেয়ারা এবং দেখে ও বুঝে আসুন চাষিদের জীবন এবং ফলের পচন। উৎপাদকদের দাবি দুটি_ পেয়ারা সংরক্ষণের জন্য হিমাগার এবং জেলি তৈরির কারখানা। সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার এবং পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহবুবুর রহমান মনে করেন যে, এটা পূরণ সম্ভব। ১৬ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক দাশগুপ্ত অসীম কুড়িয়ানার পেয়ারাচাষিদের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পেয়ারাচাষিদের হিমাগার তৈরি এবং জেলি ফ্যাক্টরি স্থাপনের জন্য ঋণ প্রদানে প্রস্তুত। উদ্যোক্তারা যত অর্থ বিনিয়োগ করবেন, বাংলাদেশ ব্যাংক সমপরিমাণ অর্থ তাদের দেবে এবং প্রথম কয়েকটি বছর এ জন্য কোনো সুদও দিতে হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান গ্রামের খবর জানতে চেয়েছেন। তার আবেদন ঈদের ছুটিতে হাজার হাজার গ্রামে শিকড়ের টানে যাওয়া নারী-পুরুষের কাছে। গ্রাম সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ, শিক্ষার্থী, পেশাজীবী, সংবাদমাধ্যমের কর্মী_ সবার পর্যবেক্ষণ তিনি জানতে চেয়েছেন। কুড়িয়ানার পেয়ারাচাষিদের জীবন ও জীবিকা নিশ্চয়ই তাকে এবং তার সহকর্মীদের আকৃষ্ট করবে।
জোয়ার-ভাটার কুড়িয়ানা ও আশপাশের অঞ্চলের মাটিতে সোনা ফলে। পেয়ারা, আমড়া, কলা, পেঁপে, লেবু, করলা, কাঁকরোল_ যা লাগাবেন ফলন মিলবে অঢেল। সুপারি-নারকেলও জন্মায় প্রচুর। পেয়ারা বাগানে এক সচ্ছল চাষি জানালেন, এ বছর ১০ লাখ টাকার আমড়া তিনি বিক্রি করেছেন। তার পেয়ারা বাগানে আমড়া ও পেয়ারার গাছ পাশাপাশি লাগানো। আমড়া গাছ বড় হয় এবং সে তুলনায় পেয়ারা গাছ ছোট। আমড়া গাছ থেকে সাধারণত বছরে দু'বার ফলন মেলে। প্রথমবারের চেয়ে দ্বিতীয়বার ফলন কম হয়। তবে চাষিরা ধরে নেয়_ দ্বিতীয়টা ফাও।
ওই এলাকা উদ্ভিদের চারার জন্যও সুপরিচিত। দক্ষিণাঞ্চলের নানা জাতের গাছের চারার বড় জোগান আসে স্বরূপকাঠি থেকে। কুড়িয়ানা এ উপজেলাতেই অবস্থিত। এইচএম এরশাদের সামরিক শাসনামলে স্বরূপকাঠির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নেছারাবাদ। তবে স্বরূপকাঠিকে ভোলেনি জনগণ। মিহির কান্তি মজুমদার সারা বছর ফলন মেলে এবং দ্রুত নরম হয় না কিংবা পচে যায় না, এমন জাতের পেয়ারার চাষ করতে বাগান মালিকদের উৎসাহিত করছেন। এতে মুখরোচক ফল মিলবে। চাষিরাও পাবে ভালো দাম। এ জন্য গবেষণা দরকার। আমাদের একাধিক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে এ বিষয়ে গবেষণা হতে পারে। কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনে আগ্রহীরা এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারেন। আমড়া, পেঁপে. কলা, নারকেল ও সুপারির আকার যাতে বড় হয়, ওই এলাকার কোন জাত সবচেয়ে উপযোগী_ এসব নিয়ে কাজ করলে শুধু স্থানীয় কৃষকদের নয়, সার্বিকভাবে গোটা দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে অবদান রাখা সম্ভব হবে।
কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগান আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবের অধ্যায় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত। এখানের জলাভূমিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এর প্রতিশোধ হিসেবে বাগান কেটে সাফ করে দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসররা। এখন যে পেয়ারা-আমড়া বাগান, তা স্বাধীনতার পর নতুন করে গড়ে তোলা। পেয়ারা-আমড়াচাষিদের পাশে দাঁড়াতে হলে একদিকে যেমন গবেষণার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে, তেমনি বিনিয়োগে আগ্রহীদের পাশে দাঁড়াতে হবে ব্যাংকগুলোকে। সরকার ও বেসরকারি সব ধরনের ব্যাংকেরই এ ইস্যু নিয়ে ভাবতে হবে।
একই সঙ্গে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ_ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। মূল বাগানে যেতে হলে ছোট-বড় খাল-নালাই ভরসা। এ অবস্থার পরিবর্তন কাম্য হয়। কিন্তু বাগানের কাছাকাছি যে সড়ক, তা যেন সারা বছর ট্রাক ও ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী থাকে, তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
এই যোগাযোগের প্রসঙ্গেই আরেকটি এলাকার কথা বলব_ বরিশালের আগৈলঝাড়ার গুপ্তের হাট। সাবেক মন্ত্রী সুনীল গুপ্তের নামে এ হাটের নাম। শুরুতে সপ্তাহে একদিন বিকেলে হাট বসত। এখন প্রতি সকালে বিক্রি হয় মাছের পোনা। পোনা মাছ কেনা ও বিক্রির জন্য সমবেত হয় হাজার পাঁচেক লোক। সংশ্লিষ্টরা জানান, যশোর অঞ্চল থেকে রেণু সংগ্রহ করে এনে তা ফোটানো হয় গুপ্তের হাটের আশপাশের বিভিন্ন পুকুরে। এখানের পুকুরগুলোতে এমন কিছু গুণ রয়েছে, যে কারণে মাছের পোনার মান হয় উৎকৃষ্ট। আশপাশের অনেক এলাকার পুকুরে এ পোনা ফেলে মাছচাষিরা লাভবান হচ্ছেন। যদি গুপ্তের হাটের এলাকায় যাতায়াত সহজ করার জন্য ভাঙাচোরা রাস্তা সংস্কার ও চওড়া করে মোটরযান চলার উপযুক্ত করা হয়, যদি আশপাশের খালগুলোতে সারা বছর পানি থাকে (এ জন্য নিকটবর্তী পালরদী বা গৌরনদী নদীর খনন অপরিহার্য) তাহলে বরিশাল-মাদারীপুর-বাগেরহাট-গোপালগঞ্জের মাছচাষিরাও গুপ্তের হাটে আসবেন উন্নত মানের মাছের পোনার জন্য। এ ধরনের সমস্যা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের নয়। কেবল প্রশাসন এ নিয়ে ভাববে, সেটাও ঠিক নয়। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য 'অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি' উপযুক্ত। কুড়িয়ানা কিংবা গুপ্তের হাটের মতো এলাকা রয়েছে অনেক। কোথাও কোথাও তাদের মেলে পৃষ্ঠপোষকতা। কোথাও তারা থাকে উপেক্ষিত। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে কোথাও সম্ভাবনা থাকলে তার খবর আরও অনেকের কাছে পেঁৗছানো এখন কঠিন কিছু নয়। কুড়িয়ানার জন্য কিছু করতে সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব ছুটে গেছেন। তার উদ্যোগের পাশাপাশি এগিয়ে আসুক উদ্যোক্তা, ব্যাংকার ও বিজ্ঞানীরা। গুপ্তের হাটের মাছচাষিরা এভাবে পেয়ে যাক পৃষ্ঠপোষক। তাদের পাশে থাকুক প্রশাসক, জনপ্রতিনিধি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সমাজের সব অংশের মানুষ। আমাদের একটু ভালো থাকার জন্য এরই যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
অজয় দাশগুপ্ত :সাংবাদিক
ajoydg@gmail.com
No comments