৩২ নম্বরের বাড়িটি যদি কথা বলত... by নাদিরা মজুমদার
১৯৮১ সালের জুন মাসের কথা। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ঢাকায় ফিরে এসেছেন ক’দিন আগে। ১৯৭৫ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া নিষ্ঠুর নৃশংসতার পর, নির্ভয়ে দেশে ফিরে আসার গ্যারান্টি দেয়ার মতো কোন সরকার বাংলাদেশে ছিল না। ফলে তিনি দীর্ঘ ছয় বছর বিদেশে অনিচ্ছাকৃত নির্বাসনে থাকতে বাধ্য হন।
এ ধরনের নির্বাসনের মানসিক চাপ যে কত গভীর তা ভুক্তভোগী ও সামান্যতম সংবেদনশীল হলেই যে কেউ অনুভব করতে পারে, বুঝতে পারে। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে মাত্র দু’জন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘটনাক্রমে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান। দীর্ঘ ছয় বছর বাদে শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার মুহূর্তটি স্মরণযোগ্য। তাঁর আগমন প্রতীক্ষায় ঢাকার বিমানবন্দরের অপেক্ষমাণ বিশাল জনতার আগ্রহ আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় যে না, আমরা বিস্মৃত জাতি নই। আমাদের ভেতরকার সেই স্বতঃস্ফূর্ত, ইনট্রিনসিক সত্তাকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে শানিয়ে দিয়ে গেছেন, সেটি ভোঁতা হয়ে যাওয়ার নয়, হয়নিও। সর্বশ্রেষ্ঠ নেতৃত্বের বাহাদুরি তো এখানেই। এই লিডারশিপই তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী করেছে। তাঁর এবং তাঁর পরিবারের বিরাট অংশের মৃত্যু নিষ্ঠুর নৃশংস ছিল, মৃত্যুতে তাঁর আরেক জন্ম হয়েছে; তাঁর পুনর্জন্ম হয়েছেÑতিনি হয়েছেন মৃত্যুঞ্জয়ী।
ঢাকায়, ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছাড়া শেখ হাসিনার আর কিছু নেই তখন। প্রিয় ঘনিষ্ঠরা পার্থিব জগতে আর নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে তাই বাড়িটি খালিই পড়ে রয়েছে। সরকার তার তত্ত্বাবধান করছে। ১৯৮১ সালের জুন মাসের বারো তারিখে সে সময়কার সরকার বাড়িটি শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়। ১৯ জুন সাংবাদিকদের ‘গৃহপ্রবেশের’ আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা। আমাদের সঙ্গে তিনিও ছয় বছরবাদে প্রথমবারের মতো বাড়িটি পরিদর্শন করবেন। আমি তখন সাপ্তাহিক রোববারের স্টাফ রিপোর্টার। কিছুদিন আগে জিয়া হত্যার সফল রিপোর্ট করেছি আমি। আমার পত্রিকা ঠিক করল যে, আমাকেই পাঠাবে ৩২ নম্বরের বাড়িটি দর্শনে। আমার জন্য এটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বড় পারিশ্রমিক, পুরস্কার, পারিতোষিক। আমার জীবনে এই প্রথম আমি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে ঢুকছি। ইট, চুনা, সিমেন্টে তৈরি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আসলে অন্য যে কোন বাড়ি থেকে একেবারেই আলাদা। বাড়িটির প্রতিটি রন্ধ্র, ইট, প্লাস্টার, দরজা-জানালা, দেয়াল, চেয়ার-টেবিল, খাট সবকিছু বাংলাদেশ, বাঙালী জাতির ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য একমাত্র সাক্ষী হয়ে রয়েছে। সব হতাশা, সব নিরাশা, সব আনন্দ, সব সাফল্য এবং সর্বশেষে নিষ্ঠুর নৃশংসতার সাক্ষীও এই বাড়িটি।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের নৃশংসতার পর বাড়িটিতে কাকপক্ষীকেও তো বসতে দেয়া হতো না। ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই, সব কালের সভ্যতায়ই মৃতের মঙ্গল কামনা করে শোকগ্রস্তরা যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে, বিগত ছয় বছরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে সেসব কিছু হতে পারেনি। ১৯ জুন লোহার গেট দিয়ে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম, বাড়ির ফাঁকা জায়গাটি শামিয়ানা ঘেরা; সেখানে কোরান তেলাওয়াত হচ্ছে, চল্লিশ দিন ধরে তা চলবে। আমাদেরকে গাড়িবারান্দা দিয়ে নেয়া হল; গাড়ি বারান্দার ছাদে বুলেটের ক্ষতগুলো চুন-সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা, তবে ক্ষতের চিহ্ন রয়ে গেছে তখনও। ১৯৭১ সালের পর অনেক দিনবাদে আবার বুলেটের চিহ্ন দেখলাম। বাড়ির পেছনের দিকের রান্নাঘর, ভাঙা চুলা, কবুতরের খোপ, মুরগির খোপ, গোয়ালঘর সবই আছে। তবে সবই শূন্য, ফাঁকা, কিছু নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর উদ্বাস্তু জীবন শেষে ঘরে ফেরার দল এই ফাঁকা শূন্যতার সঙ্গেও কমবেশি পরিচিত হয়েছিলেন। বাড়ির পেছনের প্রবেশদ্বার দিয়ে নিচের তলার তিনটে ঘরের মধ্যে, যেটি ছিল বসার ঘর, প্রথমে আমরা ঢুকলাম সেই ঘরটিতে। এই ঘরের দেয়ালে টাঙানো কবি নজরুল, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো কেউ খুলে নেয়নি। তবে প্রায় শূন্য শোকেস দেখে বলা যায়, শোকেসের সামগ্রীগুলো ছিল অধিকতর আকর্ষণীয়। ছিল বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জনের দেয়া রূপার নৌকার সংগ্রহ। তবে শোকেসের ওপরে কাচের বাক্সে রাখা রূপার নৌকাটি বুলেটে চূর্ণবিচূর্ণ করলেও সেটি কেউ সরিয়ে নেয়নি। বঙ্গবন্ধুর বইয়ে ঠাসা আলমারিগুলোর অমূল্য সম্পদের প্রতিও কারও লোভ বা ক্ষোভ ছিল বলে মনে হয় না। বইগুলো স্বস্থানেই থেকে যায়। ওরা কি বঙ্গবন্ধুর খোঁজ প্রথমে বসার ঘরে, তারপরে তাঁর পড়ার ঘরে করেছিল? কারণ, তাঁর পড়ার ঘরের ছবিটি গুলির আঘাতে যেমন ছিল বিদীর্ণ, তেমনি ডানদিকের আলমারির কাচও বুলেট থেকে রেহাই পায়নি।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সরু সিঁড়িটি রয়েছে, এবারে সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে আমাদের সবাইকে। এটি কি সেই সিঁড়ি, যেটি দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিচের তলায় খেতে যেতেন, খাওয়া শেষে আবার দোতলায় ফিরে আসতেন? যদি তাই হয় তবে আমার বন্ধু ড. ইসমাত মির্যা মহুয়ার কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বলে নিই। সকাল দুপুর যখনই হোক, বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেন, তাঁর প্রতিবেশী বাড়ির বছর চারেক বয়সের শিশুকন্যাটি যেন তাঁর আশায় অপেক্ষা করতÑসঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্ন : শেখ সাহেব, শেখ সাহেব, তুমি কোথায় যাচ্ছ? বঙ্গবন্ধু ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে পড়তেন, বলতেন : খেতে যাচ্ছি। খাওয়া শেষে তিনি যখন আবার উপরে উঠে আসতেন, আবার প্রশ্ন : শেখ সাহেব, শেখ সাহেব, কোথায় গিয়েছিলে? সামান্যক্ষণের জন্য থেমে বঙ্গবন্ধু বলতেন : খেতে গিয়েছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে, ছোট্ট এই ঘটনাটি ঘটে বাংলাদেশ পূর্বকালে। এই সিঁড়ি বেয়ে আমরা সবাই উঠতে শুরু করলাম।
বাড়ির দোতলা আর তিন তলা হল খাস অন্দর মহল। ভেতরে ঢোকার আগে আমরা সবাই জুতো খুলে ফেললাম। ঘরের ভেতরে প্রথম স্টেপটি দিতে না দিতেই ধুলোর ঝড় উঠল একটা। যদ্দূর চোখ যায়, কেবল ধুলো আর ধুলো; ধূলিময় ধুলোর এক জগত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত, একদিনের জন্যও ঝাড়ু পড়েনি; ছয় বছরে ধুলার পাহাড় জমেছে তাই। ঘরটিতে এক সময়ে শখের একোয়ারিয়াম ছিল একটা, জলশূন্য সেটি। টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে যা কিছু ছিল, অনাদরে সবই এলোমেলো, ধুলায় ধূসরিত; ওয়াশ বেসিনটিও তাই। বেসিনের তাকে রাখা ওষুধের দু’তিনটি শিশি, ফুলদানিতে শুকনো বিবর্ণ ফুল ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরটি কার্পেটবিহীন; এসি নেই তো তাই ছাদে ফ্যান ঝুলছে। এই ঘরে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা আরও জিনিসের মধ্যে ইমপেরিয়াল লেদার সাবান, জনসন বেবি পাউডারের কৌটা, মলির গুঁড়ো দুধের টিনও রয়েছে। আর টিপয়টিতে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে কয়েকটি পাইপ, এরিনমোর তামাকের কৌটা, গহনার শৌখিন বাক্স, জল খাওয়ার গ্লাসটি। ডবল বেডের বিছানায় পড়ে থাকা জামাকাপড় আর লেডিস ব্যাগের মধ্য থেকেও পাতলা তোষকটির উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছিল। বিছানার পার্শ্ব টেবিলে কমলা, সবুজ ও ধূসর রঙের ফোন তিনটি তার ছেঁড়া হয়ে পড়ে আছে। অন্য আরেকটি টেবিলে কিছু ফাইলপত্র, কাগজ। সংলগ্ন ড্রেসিংরুম ও বাথরুমও ল-ভ- হয়ে রয়েছে। বাথরুমের কলের নিচে কয়েকটি কাপড় পড়ে রয়েছে; গুলির চিহ্ন নজরে পড়ে। মাঝখানের স্পেসটিতে টাঙানো দড়িতে পেটিকোট, তোয়ালে, ব্লাউজ ঝুলছে। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের পাশে যে স্টোররুমটি রয়েছে, সেখানকার অর্ধেকটা ল-ভ-কে আরও গাঢ় আর তীব্র করে তুলেছে কাটা বালিশ ও তোষক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তমাখা তুলার ডাঁই। শেখ রেহানার ঘরও তো দোতলায়। তার ঘরেও কাটা বালিশ, তোষক থেকে বেরিয়ে আসা তুলার ডাঁই আর সেই সঙ্গে ল-ভ- অন্যান্য জিনিস মিলেমিশে এক তেলেসমাতির জগৎ সৃষ্টি করেছে। শেখ জামালের ঘরেও অবস্থার অন্যথা হয়নি। অন্য অনেকের মতো শেখ জামালও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তরুণ জামালের ঘর তাঁর বয়সী অন্যসব তরুণের মতো করেই সজ্জিত; টেবিলের বইটি খোলা, টেবিল টেনিসের র্যাকেট, হকিস্টিক, তার ছেঁড়া ফোন, মিউজিক সিস্টেম ইত্যাদি। শিশু শেখ রাসেলের আলাদা কোন ঘর দেখিনি। তারপরে তিন তলায়ও গেলাম আমরা। তিন তলায় দুটো ঘর মাত্র। একটি ঘরে বঙ্গবন্ধু এসে বসতেন। অন্য ঘরটি ছিল শেখ কামালের। আহামরি ইনটেরিয়র নজরে পড়ল না। স্পোর্টস ম্যাগাজিন, ফটো-এ্যালবাম, স্টিরিয়ো মিউজিক সিস্টেম, লংপ্লেয়িং রেকর্ডার ইত্যাদি। এবং বুলেটের আঘাতে বিচূর্ণ জানালার কাচ।
দোতলায় শেখ জামালের ঘরে আসার পথে পড়ে বাড়ির উপর-নিচ করার প্রধান সিঁড়িটি। সিঁড়ির তিন ধাপ নিচে বাংলাদেশের পতাকাটি বিছানো, গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু ঠিক যেখানটায় পড়েছিলেন, সেখানটায়। তবে অনাবৃত অংশে রক্তের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল।
দোতলায় ও তিন তলায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনাও রইলেন। তিনিও ছয় বছরবাদে এই প্রথম দোতলা-তিন তলা করলেন। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে একসময় আমরা আবার নিচে নেমে এলাম। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০১২ সালের আগস্ট পর্যন্ত, সময়ের ব্যবধান ৩১ বছর। ৩১ বছর আগের ১৯ জুনের শেখ হাসিনা স্মৃতিপটে এখনও স্পষ্ট হয়ে রয়েছেন। আমাদের সঙ্গে একতলায় নেমে এলেন তিনি। এতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে বেশ ধরে রেখেছিলেন; কিন্তু সবকিছুরই তো সীমা রয়েছে আর কত? কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। সেই দুর্লভ মুহূর্তের একটি ছবি এখনও আমার এ্যালবামে আছে। শেখ হাসিনার সেই মুহূর্তের ব্যক্তিগত কষ্ট আমাদের প্রত্যেকের জাতীয় কষ্টের সঙ্গে একাকার হয়ে এক বৃহৎ কষ্টে পরিণত হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চেকোসেভাকিয়ার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়, বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ৩২ নম্বরের বাড়ি হস্তান্তরের কয়েক বছরবাদে, শেখ হাসিনা চেকোসেøাভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে আসেন বিশ্বশান্তি সম্মেলনের অতিথি হয়ে। একটা সময় নামীদামী ব্যক্তিত্বদের অটোগ্রাফ যোগাড় করতাম। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার আমাদের এলাকায় আসেন, কিন্তু পুরুষের বিশাল ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। আমার ছোট ভাই প্রফেসর আল-সাফি মজুমদার তখন স্কুলে পড়ে; ওকে আমি পাঠাই আমার জন্য বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে। সে কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে হাজির হয় এক টুকরো কাগজ নিয়ে। বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ লিখে সই করেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফটি শেখ হাসিনাকে দেখালাম; তিনি দেখলেন, পড়লেন, তারপরে বললেন, বাবার লেখা কোন স্মৃতি আমার কাছে নেই।
nadirahmajumdar@gmail.com
ঢাকায়, ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ছাড়া শেখ হাসিনার আর কিছু নেই তখন। প্রিয় ঘনিষ্ঠরা পার্থিব জগতে আর নেই। ১৯৭৫ সাল থেকে তাই বাড়িটি খালিই পড়ে রয়েছে। সরকার তার তত্ত্বাবধান করছে। ১৯৮১ সালের জুন মাসের বারো তারিখে সে সময়কার সরকার বাড়িটি শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেয়। ১৯ জুন সাংবাদিকদের ‘গৃহপ্রবেশের’ আমন্ত্রণ জানান শেখ হাসিনা। আমাদের সঙ্গে তিনিও ছয় বছরবাদে প্রথমবারের মতো বাড়িটি পরিদর্শন করবেন। আমি তখন সাপ্তাহিক রোববারের স্টাফ রিপোর্টার। কিছুদিন আগে জিয়া হত্যার সফল রিপোর্ট করেছি আমি। আমার পত্রিকা ঠিক করল যে, আমাকেই পাঠাবে ৩২ নম্বরের বাড়িটি দর্শনে। আমার জন্য এটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বড় পারিশ্রমিক, পুরস্কার, পারিতোষিক। আমার জীবনে এই প্রথম আমি ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে ঢুকছি। ইট, চুনা, সিমেন্টে তৈরি ৩২ নম্বরের বাড়িটি আসলে অন্য যে কোন বাড়ি থেকে একেবারেই আলাদা। বাড়িটির প্রতিটি রন্ধ্র, ইট, প্লাস্টার, দরজা-জানালা, দেয়াল, চেয়ার-টেবিল, খাট সবকিছু বাংলাদেশ, বাঙালী জাতির ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য একমাত্র সাক্ষী হয়ে রয়েছে। সব হতাশা, সব নিরাশা, সব আনন্দ, সব সাফল্য এবং সর্বশেষে নিষ্ঠুর নৃশংসতার সাক্ষীও এই বাড়িটি।
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের নৃশংসতার পর বাড়িটিতে কাকপক্ষীকেও তো বসতে দেয়া হতো না। ফলে পৃথিবীর সর্বত্রই, সব কালের সভ্যতায়ই মৃতের মঙ্গল কামনা করে শোকগ্রস্তরা যে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির আয়োজন করে থাকে, বিগত ছয় বছরে ৩২ নম্বরের বাড়িটিতে সেসব কিছু হতে পারেনি। ১৯ জুন লোহার গেট দিয়ে ঢোকার সময় খেয়াল করলাম, বাড়ির ফাঁকা জায়গাটি শামিয়ানা ঘেরা; সেখানে কোরান তেলাওয়াত হচ্ছে, চল্লিশ দিন ধরে তা চলবে। আমাদেরকে গাড়িবারান্দা দিয়ে নেয়া হল; গাড়ি বারান্দার ছাদে বুলেটের ক্ষতগুলো চুন-সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করা, তবে ক্ষতের চিহ্ন রয়ে গেছে তখনও। ১৯৭১ সালের পর অনেক দিনবাদে আবার বুলেটের চিহ্ন দেখলাম। বাড়ির পেছনের দিকের রান্নাঘর, ভাঙা চুলা, কবুতরের খোপ, মুরগির খোপ, গোয়ালঘর সবই আছে। তবে সবই শূন্য, ফাঁকা, কিছু নেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর উদ্বাস্তু জীবন শেষে ঘরে ফেরার দল এই ফাঁকা শূন্যতার সঙ্গেও কমবেশি পরিচিত হয়েছিলেন। বাড়ির পেছনের প্রবেশদ্বার দিয়ে নিচের তলার তিনটে ঘরের মধ্যে, যেটি ছিল বসার ঘর, প্রথমে আমরা ঢুকলাম সেই ঘরটিতে। এই ঘরের দেয়ালে টাঙানো কবি নজরুল, শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর ফ্রেমে বাঁধানো ছবিগুলো কেউ খুলে নেয়নি। তবে প্রায় শূন্য শোকেস দেখে বলা যায়, শোকেসের সামগ্রীগুলো ছিল অধিকতর আকর্ষণীয়। ছিল বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জনের দেয়া রূপার নৌকার সংগ্রহ। তবে শোকেসের ওপরে কাচের বাক্সে রাখা রূপার নৌকাটি বুলেটে চূর্ণবিচূর্ণ করলেও সেটি কেউ সরিয়ে নেয়নি। বঙ্গবন্ধুর বইয়ে ঠাসা আলমারিগুলোর অমূল্য সম্পদের প্রতিও কারও লোভ বা ক্ষোভ ছিল বলে মনে হয় না। বইগুলো স্বস্থানেই থেকে যায়। ওরা কি বঙ্গবন্ধুর খোঁজ প্রথমে বসার ঘরে, তারপরে তাঁর পড়ার ঘরে করেছিল? কারণ, তাঁর পড়ার ঘরের ছবিটি গুলির আঘাতে যেমন ছিল বিদীর্ণ, তেমনি ডানদিকের আলমারির কাচও বুলেট থেকে রেহাই পায়নি।
বাড়ির পেছন দিক দিয়ে দোতলায় ওঠার যে সরু সিঁড়িটি রয়েছে, এবারে সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হবে আমাদের সবাইকে। এটি কি সেই সিঁড়ি, যেটি দিয়ে বঙ্গবন্ধু নিচের তলায় খেতে যেতেন, খাওয়া শেষে আবার দোতলায় ফিরে আসতেন? যদি তাই হয় তবে আমার বন্ধু ড. ইসমাত মির্যা মহুয়ার কাছ থেকে শোনা একটি ঘটনার কথা বলে নিই। সকাল দুপুর যখনই হোক, বঙ্গবন্ধু যখন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেন, তাঁর প্রতিবেশী বাড়ির বছর চারেক বয়সের শিশুকন্যাটি যেন তাঁর আশায় অপেক্ষা করতÑসঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্ন : শেখ সাহেব, শেখ সাহেব, তুমি কোথায় যাচ্ছ? বঙ্গবন্ধু ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে পড়তেন, বলতেন : খেতে যাচ্ছি। খাওয়া শেষে তিনি যখন আবার উপরে উঠে আসতেন, আবার প্রশ্ন : শেখ সাহেব, শেখ সাহেব, কোথায় গিয়েছিলে? সামান্যক্ষণের জন্য থেমে বঙ্গবন্ধু বলতেন : খেতে গিয়েছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে, ছোট্ট এই ঘটনাটি ঘটে বাংলাদেশ পূর্বকালে। এই সিঁড়ি বেয়ে আমরা সবাই উঠতে শুরু করলাম।
বাড়ির দোতলা আর তিন তলা হল খাস অন্দর মহল। ভেতরে ঢোকার আগে আমরা সবাই জুতো খুলে ফেললাম। ঘরের ভেতরে প্রথম স্টেপটি দিতে না দিতেই ধুলোর ঝড় উঠল একটা। যদ্দূর চোখ যায়, কেবল ধুলো আর ধুলো; ধূলিময় ধুলোর এক জগত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে আজ পর্যন্ত, একদিনের জন্যও ঝাড়ু পড়েনি; ছয় বছরে ধুলার পাহাড় জমেছে তাই। ঘরটিতে এক সময়ে শখের একোয়ারিয়াম ছিল একটা, জলশূন্য সেটি। টেবিল ক্লথ থেকে শুরু করে যা কিছু ছিল, অনাদরে সবই এলোমেলো, ধুলায় ধূসরিত; ওয়াশ বেসিনটিও তাই। বেসিনের তাকে রাখা ওষুধের দু’তিনটি শিশি, ফুলদানিতে শুকনো বিবর্ণ ফুল ইত্যাদি। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরটি কার্পেটবিহীন; এসি নেই তো তাই ছাদে ফ্যান ঝুলছে। এই ঘরে এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকা আরও জিনিসের মধ্যে ইমপেরিয়াল লেদার সাবান, জনসন বেবি পাউডারের কৌটা, মলির গুঁড়ো দুধের টিনও রয়েছে। আর টিপয়টিতে এলোমেলো হয়ে পড়ে রয়েছে কয়েকটি পাইপ, এরিনমোর তামাকের কৌটা, গহনার শৌখিন বাক্স, জল খাওয়ার গ্লাসটি। ডবল বেডের বিছানায় পড়ে থাকা জামাকাপড় আর লেডিস ব্যাগের মধ্য থেকেও পাতলা তোষকটির উঁকিঝুঁকি দেখা যাচ্ছিল। বিছানার পার্শ্ব টেবিলে কমলা, সবুজ ও ধূসর রঙের ফোন তিনটি তার ছেঁড়া হয়ে পড়ে আছে। অন্য আরেকটি টেবিলে কিছু ফাইলপত্র, কাগজ। সংলগ্ন ড্রেসিংরুম ও বাথরুমও ল-ভ- হয়ে রয়েছে। বাথরুমের কলের নিচে কয়েকটি কাপড় পড়ে রয়েছে; গুলির চিহ্ন নজরে পড়ে। মাঝখানের স্পেসটিতে টাঙানো দড়িতে পেটিকোট, তোয়ালে, ব্লাউজ ঝুলছে। বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরের পাশে যে স্টোররুমটি রয়েছে, সেখানকার অর্ধেকটা ল-ভ-কে আরও গাঢ় আর তীব্র করে তুলেছে কাটা বালিশ ও তোষক থেকে বেরিয়ে আসা রক্তমাখা তুলার ডাঁই। শেখ রেহানার ঘরও তো দোতলায়। তার ঘরেও কাটা বালিশ, তোষক থেকে বেরিয়ে আসা তুলার ডাঁই আর সেই সঙ্গে ল-ভ- অন্যান্য জিনিস মিলেমিশে এক তেলেসমাতির জগৎ সৃষ্টি করেছে। শেখ জামালের ঘরেও অবস্থার অন্যথা হয়নি। অন্য অনেকের মতো শেখ জামালও ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তরুণ জামালের ঘর তাঁর বয়সী অন্যসব তরুণের মতো করেই সজ্জিত; টেবিলের বইটি খোলা, টেবিল টেনিসের র্যাকেট, হকিস্টিক, তার ছেঁড়া ফোন, মিউজিক সিস্টেম ইত্যাদি। শিশু শেখ রাসেলের আলাদা কোন ঘর দেখিনি। তারপরে তিন তলায়ও গেলাম আমরা। তিন তলায় দুটো ঘর মাত্র। একটি ঘরে বঙ্গবন্ধু এসে বসতেন। অন্য ঘরটি ছিল শেখ কামালের। আহামরি ইনটেরিয়র নজরে পড়ল না। স্পোর্টস ম্যাগাজিন, ফটো-এ্যালবাম, স্টিরিয়ো মিউজিক সিস্টেম, লংপ্লেয়িং রেকর্ডার ইত্যাদি। এবং বুলেটের আঘাতে বিচূর্ণ জানালার কাচ।
দোতলায় শেখ জামালের ঘরে আসার পথে পড়ে বাড়ির উপর-নিচ করার প্রধান সিঁড়িটি। সিঁড়ির তিন ধাপ নিচে বাংলাদেশের পতাকাটি বিছানো, গুলিবিদ্ধ বঙ্গবন্ধু ঠিক যেখানটায় পড়েছিলেন, সেখানটায়। তবে অনাবৃত অংশে রক্তের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল।
দোতলায় ও তিন তলায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে শেখ হাসিনাও রইলেন। তিনিও ছয় বছরবাদে এই প্রথম দোতলা-তিন তলা করলেন। পেছনের সিঁড়ি বেয়ে একসময় আমরা আবার নিচে নেমে এলাম। ১৯৮১ সালের আগস্ট মাস থেকে ২০১২ সালের আগস্ট পর্যন্ত, সময়ের ব্যবধান ৩১ বছর। ৩১ বছর আগের ১৯ জুনের শেখ হাসিনা স্মৃতিপটে এখনও স্পষ্ট হয়ে রয়েছেন। আমাদের সঙ্গে একতলায় নেমে এলেন তিনি। এতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে বেশ ধরে রেখেছিলেন; কিন্তু সবকিছুরই তো সীমা রয়েছে আর কত? কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি। সেই দুর্লভ মুহূর্তের একটি ছবি এখনও আমার এ্যালবামে আছে। শেখ হাসিনার সেই মুহূর্তের ব্যক্তিগত কষ্ট আমাদের প্রত্যেকের জাতীয় কষ্টের সঙ্গে একাকার হয়ে এক বৃহৎ কষ্টে পরিণত হয়।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চেকোসেভাকিয়ার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়, বিশেষভাবে স্মরণযোগ্য। ৩২ নম্বরের বাড়ি হস্তান্তরের কয়েক বছরবাদে, শেখ হাসিনা চেকোসেøাভাকিয়ার রাজধানী প্রাগে আসেন বিশ্বশান্তি সম্মেলনের অতিথি হয়ে। একটা সময় নামীদামী ব্যক্তিত্বদের অটোগ্রাফ যোগাড় করতাম। সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফও রয়েছে। বঙ্গবন্ধু একবার আমাদের এলাকায় আসেন, কিন্তু পুরুষের বিশাল ভিড় ঠেলে তাঁর কাছে যাওয়া প্রায় অসম্ভবই ছিল। আমার ছোট ভাই প্রফেসর আল-সাফি মজুমদার তখন স্কুলে পড়ে; ওকে আমি পাঠাই আমার জন্য বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফ নিয়ে আসতে। সে কোনভাবে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে হাজির হয় এক টুকরো কাগজ নিয়ে। বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ লিখে সই করেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। বঙ্গবন্ধুর অটোগ্রাফটি শেখ হাসিনাকে দেখালাম; তিনি দেখলেন, পড়লেন, তারপরে বললেন, বাবার লেখা কোন স্মৃতি আমার কাছে নেই।
nadirahmajumdar@gmail.com
No comments