শ্রম আইন সংশোধনে নীরব সরকার by জেসমিন পাঁপড়ি
চূড়ান্ত প্রস্তুতির পরও শেষ পর্যন্ত হিমাগারেই আটকে আছে শ্রম আইন সংশোধনী খসড়া-২০১০। বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার হলেও কেবল মালিকপক্ষের চাপে আইনটির সংশোধন করতে সংশ্লিষ্ট মহল নীরব ভূমিকা পালন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
শ্রমিকনেতারা মনে করেন, ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসে গার্মেন্টস মালিকদের কোনোভাবেই চটাতে চাইছে না সরকার, যাতে করে নির্বাচনের সময় ব্যবসায়ীদের পাশে পাওয়া যায়।
শ্রম আইনের সংশোধনী বাস্তবায়ন না হওয়ার ফলে বেশিরভাগ শ্রমজীবী মানুষ কৃষিখাতে কাজ করলেও তাদের স্বীকৃতি অধরাই থেকে যাবে। গৃহস্থালী কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার খর্ব হবে লাখ লাখ শ্রমিকের। মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অসংখ্য নারীশ্রমিক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সর্বশেষ মালিক, শ্রমিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকেও শ্রম আইন সংশোধনীর ব্যাপারে ফলপ্রসূ কোনো আলোচনা হয়নি। সাত মাস আগের বৈঠকটি হয় মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের অফিসে। এমনকি বৈঠকটির যাবতীয় খরচও বহন করে মালিকপক্ষ।
বৈঠকের আগেই সিদ্ধান্ত হয় সংসদের আগামী কোনো অধিবেশনেই শ্রম আইন সংশোধনের বিষয়টি তোলা হবে না।
শ্রমআইন বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকারকর্মীদের মতে, শ্রমআইনের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে যেসব বিষয় গুরুত্ব পাচ্ছে তা মালিকপক্ষ মেনে নিতে পারছেন না বলেই বার বার তা পিছিয়ে যাচ্ছে।
তারা জানান, শিল্পে শান্তি রক্ষা করতে মালিকের মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহত হলে ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করার প্রস্তাবের মতো বিষয়ে মালিকপক্ষের মূল আপত্তি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমার জানা মতে, প্রস্তাবিত সংশোধনীতে মালিকপক্ষের মূল আপত্তি হচ্ছে মাতৃকালীন ছুটি ছয় মাস করা, ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য নির্বাচনে শ্রমিকদের স্বাধীনতা, সরকারি চাকরিজীবীর ন্যায় পারিতোষিক (গ্রাচুয়িটি) পাওয়ার মতো প্রস্তাবে।”
তিনি বলেন, “বর্তমান সরকারের আমলে শ্রমআইনের সংশোধনীর বাস্তবায়ন অনিশ্চিতই বলা যায়।”
সূত্র জানায়, ২০০৬ সালে প্রণীত শ্রমআইন প্রস্তাবিত সংশোধনী প্রক্রিয়ায় সরকার ও শ্রমিকনেতারা একমত পোষণ করলেও মালিকপক্ষ বেঁকে বসে। নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তার হস্তক্ষেপও কামনা করেন তারা।
ক্ষমতায় আসার পরপরই এই আইন সংশোধনের কাজ শুরু করে বর্তমান সরকার। শ্রমিক, মালিক, বেসরকারি সংগঠন সবাইকে নিয়ে এ আইন সংশোধন প্রক্রিয়ায় যুক্ত রাখা হয়। আইনটিকে যুগোপযোগী করতে ১২১টি ধারার বিভিন্ন অংশ সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
এরপর শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তৈরি আইনটির সংশোধনী প্রস্তাবের খসড়া ৯ ফেব্রুয়ারি টিসিসিতে (ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ কমিটি) উপস্থাপন করা হয়। এতে শ্রমিক, মালিক, সরকারের সমান সংখ্যক প্রতিনিধিত্ব ছিল।
টিসিসিতে উপস্থাপনের পর কোনো ধরনের সময়ক্ষেপণের নিয়ম না থাকলেও মালিকপক্ষের অনুরোধে তাদের প্রথমে একমাস ও পরে দুইমাস সময় দেওয়া হয়। নির্ধারিত সে সময় পার হয়ে গেলেও এ বিষয়ে সরকারের আর কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মালিকদের এ ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া বা আলোচনা করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত আছে সরকার।
শ্রমিকনেতাদের অভিযোগ, কালক্ষেপণ করে মালিকপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান দুটি সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ), বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে শ্রম আইন সংশোধনী প্রক্রিয়াকে হিমাগারে রাখতে বাধ্য করেছে।
শ্রম বিষয়ক সংসদী স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, “বড় বড় রথি-মহারথি, ব্যবসায়ী, বহুজাতিক করপোরেশনের প্রতিনিধি সংসদে ভর্তি। তারা অত্যন্ত ক্ষমতাধর। তাদের কারণেই শ্রম আইন সংশোধনীর বাস্তবায়নের ধীর গতি।”
তিনি আরো বলেন, “শ্রমমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ অন্য কর্মকর্তারা দিনরাত পরিশ্রম করে খসড়া চূড়ান্ত করলেও কেন জানি কোনো অদৃশ্য শক্তির চাপে এর বাস্তবায়ন থেমে আছে।”
শ্রম বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইসরাফিল আলম (এমপি) একই সুরে বলেন, “টিসিসির বৈঠকের পর মালিকপক্ষ সময় চেয়েছিল। তার ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি মন্ত্রিসভায় আসেনি। মন্ত্রণালয়ও চূড়ান্ত করেনি। আর সংসদীয় কমিটির কাছে আসার তো প্রশ্নই আসে না। তবে সংসদীয় কমিটি প্রতি বৈঠকেই তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি বলেন, “অনেকেই আশঙ্কা করছেন মালিকপক্ষের প্রভাবে এটি বাস্তবায়ন নাও হতে পারে।”
“যদি এ সরকারের আমলে এটি বাস্তবায়ন না হয় তবে আগামী ১০ বছরেও এটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
তবে এসব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “শ্রম আইন সংশোধনীর বিষয়টি এখনো প্রক্রিয়াধীন। যেকোনো সময় এটি সংসদে উঠতে পারে।”
তিনি বলেন, “এমনটি নয় যে দেশে শ্রম আইন নেই। ২০০৬ এর আইনটি আমরা বাতিল করিনি।”
মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা থেমে গেছে প্রসঙ্গে বলেন, “মালিকপক্ষ তো আর চাকরি করে না যে তাদের বললেই আমাদের সঙ্গে বসে যাবে। আলাপ আলোচনার জন্য সময় বের করে এরপর বসতে হবে। সংশোধনীটি পাশ করিয়ে দিতে পারতাম। তবে দুই পক্ষ না মানলে পাশ করিয়ে লাভ নেই। এজন্য যেসব বিষয়ে মালিকদের আপত্তি আছে আলোচনার মাধ্যমে সেসব বিষয় সুরাহা করতে চেষ্টা করছি আমরা। আর এজন্যই সময় ক্ষেপণ হচ্ছে।”
মালিকদের ভেন্যুতে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, “মালিক-শ্রমিক মানেই তাদের মধ্যে লাঠি-সোঁঠার সম্পর্ক নয়। এভাবেই তাদের মাঝে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়। বৈঠকটি একটি ভালো উদ্দেশ্যেই করা হয়েছিল। শ্রমিকরাও তাতে আপত্তি করেনি।”
শ্রম আইন ২০০৬ এর সংশোধন প্রস্তাবগুলোর মধ্যে উল্লেখ¬যোগ্য দিকগুলো হচ্ছে- কৃষিশ্রমিকের স্বীকৃতি প্রদান, শ্রমিক তথা কর্মীর সংজ্ঞা আরও ব্যাপক করা, শ্রমিকের অবসর নেওয়ার বয়স বাড়ানো, মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ানো এবং তা ওই নারীর সুবিধাজনক সময়ে ভোগ করার ব্যবস্থা করা, দায়িত্ব পালনের সময় ব্যাধিতে আক্রান্ত শ্রমিকের পরিপূর্ণ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, প্রতিষ্ঠানে সেফটি কমিটি গঠন করা, তিনশ বা ততোধিক কর্মী নিযুক্ত এমন প্রতিষ্ঠানে শ্রমকল্যাণ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া, এক হাজারের বেশি শ্রমিক থাকলে হাসপাতাল স্থাপন, নারী শ্রমিকরা যাতে শিশুদের বুকের দুধ পান করাতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, সব প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক গ্রুপ বিমা চালু করা, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা, শ্রম আদালত ও শ্রম আপিল আদালত বৃদ্ধি করা, ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে পাঁচটি বিভাগে তার সংগঠন পরিচালনা করা, ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী কমিটিতে ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক নেতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, শ্রমআইনের বিভিন্ন ধারা অমান্য করার ক্ষেত্রে সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি।
তবে সংশোধনীর অন্যতম বিষয় হচ্ছে শিল্পে শান্তি রক্ষার্থে মালিকের মুনাফায় শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং কর্মরত শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করা।
প্রসঙ্গত, আশির দশক থেকে দেশে পোশাকশিল্পে উন্নতি সাধনের পর শ্রমআইনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এরপরই এ আইনের ক্রটি ধরা পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে শ্রমআইনের ত্রুটিগুলো পরিমার্জন, পরিবর্ধন করতে শ্রম আইন কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন প্রায় ১২ বছর পর ২০০৩ সালে একটি সুপারিশ করে। সুপারিশ অনুযায়ী ২০০৬ সালে জাতীয় সংসদে তড়িঘড়ি করে বিরোধী দলকে আলোচনার সুযোগ না দিয়ে আইনটি পাশ হয়। সেসময়ই আইনটি অনেক সমালোচিত হয়।
No comments