ভয়াবহ পানি সংকটের দিকে দেশ: খাইরুল ইসলাম by মনোয়ারুল ইসলাম
ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডা.খাইরুল ইসলাম। তিনি বাংলাদেশের একজন অন্যতম জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের স্বাস্থ বিভাগে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। এরপর তিনি দেশি–বিদেশি এনজিওতে কাজ করেন।
টাঙ্গাইল জেলার ভূঁয়াপূরে তার জন্ম। মোমেনশাহী ক্যাডেট কলেজে (মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজের পূর্বতন নাম) লেখাপড়া শেষে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিপসম এবং যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে জনস্বাস্থ্যে এমফিল করেন।
ওয়াটার ও স্যানিটেশনকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ণ সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের অনেক নীতি নির্ধারণী কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে দেশি-বিদেশি জার্নালে লেখালেখি করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে উন্নয়ণ কাজে নিয়োজিত বর্তমানে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্রিটেনভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ১৯৮৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ওয়াটার এইড মূল আন্তর্জাতিক সংস্থার শুরু ইংল্যান্ডে ১৯৮১ সালের ২১ জুলাই। এটি ইংল্যান্ডের একটি দাতব্য ট্রাস্ট হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যের প্রিন্স অব ওয়েলস ১৯৯১ সাল থেকে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বারবারা ফ্রস্ট। বর্তমানে ওয়াটার এইড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে কাজ করছে। তবে বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম চালানো ওয়াটার এইড প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এইড ইউকে, ওয়াটার এইড আমেরিকা, ওয়াটার এইড অস্ট্রেলিয়া, ওয়াটার এইড সুইডেন উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান ও নেপালেও কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটি মূলত পানি এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে।
সম্প্রতি ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডা. খাইরুল ইসলাম বাংলানিউজের সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মনোয়ারুল ইসলাম। আজ প্রকাশিত হলো এর প্রথম কিস্তি।
বাংলানিউজ: ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক কার্য্ক্রম নিয়ে বলুন।
খাইরুল ইসলাম: ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ১৯৮৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। তবে অফিস নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে । ২০০০ সালের পর থেকে জোরেশোরে কার্য্ক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১৯টি জেলা, বিভিন্ন উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় কাজ করছে। আমরা জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, পানি, খাদ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষাসহ নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করে থাকি। ইংল্যান্ডের পানি সেক্টরের সাহায্য থেকে এই সংস্থাটি চলে। বিশ্বব্যাপী এর সেবামূলক কাজ সমাদৃত হয়েছে। আমরা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, রাজউক, ওয়াসা এবং অন্যান্য এনজিওর সাথে কাজ করে থাকি। বাংলাদেশে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারে ব্যাপক উদ্যোগ ও প্রচারণা চালিয়েছি আমরাই। বিভিন্ন আইন প্রণয়ণ ও সচেতনতা তৈরিতে আমাদের অ্যাডভোকেসি সেকশন অনেক কাজ করছে।
বাংলানিউজ: আপনারা সাধারন মানুষের জন্য কী করছেন?
খাইরুল ইসলাম: ওয়াটার এইডের শুরুটাই জনগণের সেবার জন্য। আমরা বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে এবং বস্তিতে সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, জনসচেতনতামূলক কাজ, প্রচারণা, অ্যাডভোকেসির কাজ করছে।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনস্বার্থে আইন, নীতিমালা প্রণয়ণ, কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছি। ঢাকা ওয়াসা আগে বস্তিবাসীদের পানি সংযোগ দিতো না। আমাদের সহায়তার ফলে এখন তারা পানির সংযোগ পাচ্ছে। আমরা দরিদ্র মানুষের জন্য কমমূল্যে পানি সরবরাহের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাথে পরামর্শ করছি। রাজউকের আইনে আছে বা বিল্ডিং কোডে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার মাধ্যমে পানীয় জলের অপচয় রোধ করা। শীঘ্রই রাজউক এই আইন বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেবে। আইলাবিধ্বস্ত এলাকার পানীয় জলের জন্য পুকুরের পানি সংরক্ষণের জন্য আইনপাশ করার ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। সে আইন মন্ত্রীপরিষদে পাশ হয়েছে। আমরা পানির নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করছি।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশে সানিটেশন এবং পানি সেক্টরে কি কি সমস্যা দেখছেন? এসব সমম্যা সমাধানে কি কি কাজ করতে হবে? এই সেক্টরে সরকারের কাজকে কিভাবে দেখছেন?
খাইরুল ইসলাম: বাংলাদেশে স্যানিটশন বা পানি সেক্টরই শুধু নয় সবখানেই সমস্যা আছে। তবে সমস্যার সমাধানে কাজ করতে হবে। সরকারিভাবে এসব বিষয় নিয়ে এখন খুব ভালোভাবে কোনো কাজ হচ্ছে না।
সরকারের কাজ কিভাবে হয় এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছিলেন, সরকার নাকি জগদ্দল পাথরের মত। তাঁকে প্রাণপণ ঠেলতে হয়। না ঠেললে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। তবে সুবিধা হচ্ছে, সবাই মিলে ধাক্কা দিলে পাথরটা একটু নড়ানো সম্ভব। আমিও তাই বিশ্বাস করি। সরকারকে যদি চাপ প্রয়োগ করে একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তাহলে সবাই এর সুবিধা ভোগ করে। আমরা বিভিন্ন ব্যাপারে সেই চেষ্টাটাই করি। সরকারি ব্যাপারগুলো সব সরকারের আমলেই মোটামুটি একরকম। পানি নিয়ে কাজ করা লোকের সংখ্যা কম।
আবার সরকার কিছু সমস্যা নিজেরাই তৈরি করেছে। এসব বিষয় বাজেট প্রস্তাব করার সময়ই আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেছি। যেমন ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ কমেছে ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের তুলানায় ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বা ২৯ শতাংশ কম। এ ছাড়া এ খাতের ডিসিসির ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পে ১৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সার্বিকভাবে গত বছর পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ ছিলো মোট উন্নয়ন বাজেটের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এ বছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে শুধূ আমরাই নই, বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এ খাতে অর্থায়ন করতে আগ্রহী। অথচ সরকার এ খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা, ভৌগলিক অসমতা ও বণ্টনের অন্যায্যতার কারণে চলতি বছরের এপ্রিলে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ‘স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার ফর অল’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হুমকিতে পড়েছে। এসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমরা দেখিয়েছি, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন ২০০৯ সালে ৮৮ শতাংশ স্যানিটেশনের কাভারেজ আছে। ২০১০ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২০১১ থেকে ২০১২ সালে দাঁড়িয়েছে ৯১ শতাংশে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ স্যানিটেশন কাভারেজ হতে প্রায় ২২ বছর লাগবে। অথচ সরকার বলছে, এটা সন্তোষজনক। আমার প্রশ্ন এটা সন্তোষজনক কিভাবে হয়? মন্ত্রী আরো বলেছেন, সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ অর্জন করেছে। এটিও সত্য তথ্য নয়। সঠিক তথ্য হলো, শ্রীলংকার অর্জন সর্বোচ্চ। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা এভাবে চললে সম্ভব হবে না।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য পানি ও স্যানিটেশন খাতের বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। নগরে ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে বরাদ্দের বৈষম্য কমাতে হবে।দুর্গম ও প্রান্তিক এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ প্রকল্প নিতে হবে। আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি এ খাতে গবেষণা করতে হবে।
বাংলানিউজ: পানি ও স্যানিটেশন খাতে শহর আর গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আছে বলে আপনারা দাবি করেছেন। এই সমস্যা কিভাবে কমানো যায়? গ্রাম ও শহরের বৈষম্য কি ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
খাইরুল ইসলাম: সমস্যা সমাধানে সরকারকে আগে আন্তরিক হতে হবে। আমরা জানি বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাই বাজেটে কোনো খাতে ১০০ টাকা বরাদ্দ রাখা হলে গ্রামবাসীর জন্য ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাজেটে ৩০০ কোটি টাকা পাচ্ছে গ্রামের মানুষ। আর শহরের জন্য রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এ বৈষম্য উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আপনি আশ্চর্য হবেন শুনে যে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দেশের মোট বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ। আর সারা দেশের মানুষের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ। এ বৈষম্য অমানবিকও বটে। আইলা দুর্গত এলাকার কথা বিবেচনাও করা হয়নি। এমনকি এ খাতে কোনো বিশেষ বরাদ্দও রাখা হয়নি। মাত্র ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে নিরাপদ পানির জন্য। তাই আমরা বলতে চেয়েছি বাজেটের বরাদ্দ শুধুমাত্র ধনীদের জন্য, গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য কিছু নেই। পানি সমস্যা শুধু ঢাকার সমস্যা নয়, এই সমস্যা পুরো বাংলাদেশের। এই সমস্যার সমাধানের জন্য তৃণমূলের মানুষের অংশগ্রহণই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে হবে। পানি সমস্যা নিয়ে শুধু জনসচেতনতাই যথেষ্ট নয়। এর জন্যে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। আর এটা জগদ্দল পাথরের মতো সরকারকেই করতে হবে। কারণ সরকার একটু কাজ করলে এর প্রভাব অনেক।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের পানি সংকট কী অবস্থায় আছে? এই সংকটের সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে? আর এই সমস্যা সমাধানে আপনাদের পরামর্শ কি?
খাইরুল ইসলাম: বাংলাদেশ ভয়াবহ পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট নানাভাবে তৈরি হয়েছে। আমরা বাবরার বলছি ভয়াবহ পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে এই সংকট প্রকট। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল শুষ্ক। ঐখানকার নদীগুলো গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায়। নিচু অঞ্চল বরিশাল, ভোলা বা খুলনায় লবণাক্ততা সমস্যা। কোনোটাকেই ছোটভাবে দেখা যাবে না। এসব সমস্যার এখনি প্রতিকার বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না করলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ মিঠা পানিশূন্য অবস্থায় পতিত হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র কতৃক নদীতে বাঁধ নির্মাণ, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নদীতে নাব্যতা রক্ষার্থে উদ্যোগ না থাকা এবং সুনির্দিষ্ট নদী নীতিমালার অভাবে এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। আর উজানের দেশগুলো ভাটির দেশের প্রতি অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় করেছে বলে আমরা দেখি। টিপাই বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ, ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প এসব সমস্যাকে জটিল করতে পারে।
আমরা সবাই জানি ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর আশংকাজনকভাবে নিচে নামছে। তাই ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারে জোর দেবার কথা বলছি। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলের পানি নোংরা ও ময়লা এবং পান ও ব্যবহার অযোগ্য।
গরমে ঢাকার কোথাও কোথাও ২/৩ দিন পানি থাকে না। এসব কারণে জনরোষ হয়েছে। সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে। এখন পরিস্তিতি কিছুটা উন্নতি হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ এমপিদের চাপে ওয়াসা কিছু পানির পাম্প বসিয়ে সাময়িক সমাধান করেছে বটে তবে এটি স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। নানাভাবে আরো বেশি পানি উত্তোলনের জন্য কয়েক হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে এই শহরে। শুধু ওয়াসার পানির হিসাব করা হয় কিন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি তুলছে। পানির স্তরতো প্রতিদিনই নামছে। এভাবে কোটি মানুষের ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আগামীতে সমস্যা আরো জটিল হবে তার সমাধানো সহজ হবে না। ভূগর্ভস্থ পানি এখন আর সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে ঢাকা শহরের চাহিদা মেটাতে ভূ-উপরিস্থ পানির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেভাবে ঢাকার পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামছে, এভাবে চলতে থাকলে মহাবিপদ দেখা দেবে। ঢাকায় প্রতিদিনই কয়েক লাখ লোক আসে। তাই পানির অপচয় রোধ করতে হবে।
বাংলাদেশের পানির উৎস মূলত তিনটি- আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ, বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদীর বয়ে আনা পলি লক্ষাধিক বছর ধরে জমে জমে এই দেশটির জন্ম হয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশে পানি সংকট খুব খারাপ পরিস্থিতির তৈরি করবে। আর পানি সংকট এখনই বিদ্যমান থাকলেও ১৫-২০ বছরের মধ্যে তা মহাসংকট হয়ে দেখা দেবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
ওয়াটার ও স্যানিটেশনকে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উন্নয়ণ সংস্থা ও বাংলাদেশ সরকারের অনেক নীতি নির্ধারণী কাজে তিনি যুক্ত ছিলেন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে দেশি-বিদেশি জার্নালে লেখালেখি করেন। ১৯৮৯ সাল থেকে উন্নয়ণ কাজে নিয়োজিত বর্তমানে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ব্রিটেনভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ১৯৮৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। তবে ওয়াটার এইড মূল আন্তর্জাতিক সংস্থার শুরু ইংল্যান্ডে ১৯৮১ সালের ২১ জুলাই। এটি ইংল্যান্ডের একটি দাতব্য ট্রাস্ট হিসেবে নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাজ্যের প্রিন্স অব ওয়েলস ১৯৯১ সাল থেকে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বারবারা ফ্রস্ট। বর্তমানে ওয়াটার এইড ইন্টারন্যাশনাল বিশ্বের প্রায় ১৫টি দেশে কাজ করছে। তবে বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম চালানো ওয়াটার এইড প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এইড ইউকে, ওয়াটার এইড আমেরিকা, ওয়াটার এইড অস্ট্রেলিয়া, ওয়াটার এইড সুইডেন উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান ও নেপালেও কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটি মূলত পানি এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে।
সম্প্রতি ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ডা. খাইরুল ইসলাম বাংলানিউজের সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন স্টাফ করেসপন্ডেন্ট মনোয়ারুল ইসলাম। আজ প্রকাশিত হলো এর প্রথম কিস্তি।
বাংলানিউজ: ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক কার্য্ক্রম নিয়ে বলুন।
খাইরুল ইসলাম: ওয়াটার এইড বাংলাদেশ ১৯৮৬ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। তবে অফিস নেয়া হয় ১৯৯৬ সালে । ২০০০ সালের পর থেকে জোরেশোরে কার্য্ক্রম শুরু করে। বর্তমানে বাংলাদেশের ১৯টি জেলা, বিভিন্ন উপজেলা, সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় কাজ করছে। আমরা জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, পানি, খাদ্য, স্যানিটেশন, শিক্ষাসহ নানা ধরনের সেবামূলক কাজ করে থাকি। ইংল্যান্ডের পানি সেক্টরের সাহায্য থেকে এই সংস্থাটি চলে। বিশ্বব্যাপী এর সেবামূলক কাজ সমাদৃত হয়েছে। আমরা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, রাজউক, ওয়াসা এবং অন্যান্য এনজিওর সাথে কাজ করে থাকি। বাংলাদেশে স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারে ব্যাপক উদ্যোগ ও প্রচারণা চালিয়েছি আমরাই। বিভিন্ন আইন প্রণয়ণ ও সচেতনতা তৈরিতে আমাদের অ্যাডভোকেসি সেকশন অনেক কাজ করছে।
বাংলানিউজ: আপনারা সাধারন মানুষের জন্য কী করছেন?
খাইরুল ইসলাম: ওয়াটার এইডের শুরুটাই জনগণের সেবার জন্য। আমরা বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে এবং বস্তিতে সুপেয় পানি, স্যানিটেশন, জনসচেতনতামূলক কাজ, প্রচারণা, অ্যাডভোকেসির কাজ করছে।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে জনস্বার্থে আইন, নীতিমালা প্রণয়ণ, কারিগরি সহযোগিতা দিয়ে আসছি। ঢাকা ওয়াসা আগে বস্তিবাসীদের পানি সংযোগ দিতো না। আমাদের সহায়তার ফলে এখন তারা পানির সংযোগ পাচ্ছে। আমরা দরিদ্র মানুষের জন্য কমমূল্যে পানি সরবরাহের বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার সাথে পরামর্শ করছি। রাজউকের আইনে আছে বা বিল্ডিং কোডে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার মাধ্যমে পানীয় জলের অপচয় রোধ করা। শীঘ্রই রাজউক এই আইন বাস্তবায়ন করার ঘোষণা দেবে। আইলাবিধ্বস্ত এলাকার পানীয় জলের জন্য পুকুরের পানি সংরক্ষণের জন্য আইনপাশ করার ব্যাপারে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে আমরা প্রস্তাবনা দিয়েছিলাম। সে আইন মন্ত্রীপরিষদে পাশ হয়েছে। আমরা পানির নিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করছি।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশে সানিটেশন এবং পানি সেক্টরে কি কি সমস্যা দেখছেন? এসব সমম্যা সমাধানে কি কি কাজ করতে হবে? এই সেক্টরে সরকারের কাজকে কিভাবে দেখছেন?
খাইরুল ইসলাম: বাংলাদেশে স্যানিটশন বা পানি সেক্টরই শুধু নয় সবখানেই সমস্যা আছে। তবে সমস্যার সমাধানে কাজ করতে হবে। সরকারিভাবে এসব বিষয় নিয়ে এখন খুব ভালোভাবে কোনো কাজ হচ্ছে না।
সরকারের কাজ কিভাবে হয় এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাই। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছিলেন, সরকার নাকি জগদ্দল পাথরের মত। তাঁকে প্রাণপণ ঠেলতে হয়। না ঠেললে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। তবে সুবিধা হচ্ছে, সবাই মিলে ধাক্কা দিলে পাথরটা একটু নড়ানো সম্ভব। আমিও তাই বিশ্বাস করি। সরকারকে যদি চাপ প্রয়োগ করে একটি ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া যায় তাহলে সবাই এর সুবিধা ভোগ করে। আমরা বিভিন্ন ব্যাপারে সেই চেষ্টাটাই করি। সরকারি ব্যাপারগুলো সব সরকারের আমলেই মোটামুটি একরকম। পানি নিয়ে কাজ করা লোকের সংখ্যা কম।
আবার সরকার কিছু সমস্যা নিজেরাই তৈরি করেছে। এসব বিষয় বাজেট প্রস্তাব করার সময়ই আমরা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তুলে ধরেছি। যেমন ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ কমেছে ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের তুলানায় ১ হাজার ৫৮ কোটি টাকা বা ২৯ শতাংশ কম। এ ছাড়া এ খাতের ডিসিসির ম্যানেজমেন্ট প্রকল্পে ১৫৯ কোটি টাকা বরাদ্দ কমানো হয়েছে। সার্বিকভাবে গত বছর পানি ও স্যানিটেশন খাতে বরাদ্দ ছিলো মোট উন্নয়ন বাজেটের ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এ বছরের বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ।
এ বিষয়ে শুধূ আমরাই নই, বিশেষজ্ঞরা বলছেন। বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান এ খাতে অর্থায়ন করতে আগ্রহী। অথচ সরকার এ খাতে বরাদ্দ কমিয়েছে। সরকারি বরাদ্দের অপ্রতুলতা, ভৌগলিক অসমতা ও বণ্টনের অন্যায্যতার কারণে চলতি বছরের এপ্রিলে ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ‘স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার ফর অল’ শীর্ষক সম্মেলনে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হুমকিতে পড়েছে। এসব বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে।
আমরা দেখিয়েছি, অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন ২০০৯ সালে ৮৮ শতাংশ স্যানিটেশনের কাভারেজ আছে। ২০১০ সালে ছিল ৯০ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ২০১১ থেকে ২০১২ সালে দাঁড়িয়েছে ৯১ শতাংশে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ স্যানিটেশন কাভারেজ হতে প্রায় ২২ বছর লাগবে। অথচ সরকার বলছে, এটা সন্তোষজনক। আমার প্রশ্ন এটা সন্তোষজনক কিভাবে হয়? মন্ত্রী আরো বলেছেন, সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ অর্জন করেছে। এটিও সত্য তথ্য নয়। সঠিক তথ্য হলো, শ্রীলংকার অর্জন সর্বোচ্চ। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন নিশ্চিত করা এভাবে চললে সম্ভব হবে না।
এসব সমস্যা সমাধানের জন্য পানি ও স্যানিটেশন খাতের বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। নগরে ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যে বরাদ্দের বৈষম্য কমাতে হবে।দুর্গম ও প্রান্তিক এলাকাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিশেষ প্রকল্প নিতে হবে। আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। সর্বোপরি এ খাতে গবেষণা করতে হবে।
বাংলানিউজ: পানি ও স্যানিটেশন খাতে শহর আর গ্রামের মধ্যে বৈষম্য আছে বলে আপনারা দাবি করেছেন। এই সমস্যা কিভাবে কমানো যায়? গ্রাম ও শহরের বৈষম্য কি ধরনের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
খাইরুল ইসলাম: সমস্যা সমাধানে সরকারকে আগে আন্তরিক হতে হবে। আমরা জানি বাংলাদেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাই বাজেটে কোনো খাতে ১০০ টাকা বরাদ্দ রাখা হলে গ্রামবাসীর জন্য ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। কিন্তু ২০১২-১৩ অর্থবছরে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বাজেটে ৩০০ কোটি টাকা পাচ্ছে গ্রামের মানুষ। আর শহরের জন্য রাখা হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকা। এ বৈষম্য উন্নয়নের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে।
আপনি আশ্চর্য হবেন শুনে যে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দেশের মোট বাজেটের প্রায় ৯০ শতাংশ। আর সারা দেশের মানুষের জন্য মাত্র ১০ শতাংশ। এ বৈষম্য অমানবিকও বটে। আইলা দুর্গত এলাকার কথা বিবেচনাও করা হয়নি। এমনকি এ খাতে কোনো বিশেষ বরাদ্দও রাখা হয়নি। মাত্র ২০ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে নিরাপদ পানির জন্য। তাই আমরা বলতে চেয়েছি বাজেটের বরাদ্দ শুধুমাত্র ধনীদের জন্য, গরিব ও প্রান্তিক মানুষের জন্য কিছু নেই। পানি সমস্যা শুধু ঢাকার সমস্যা নয়, এই সমস্যা পুরো বাংলাদেশের। এই সমস্যার সমাধানের জন্য তৃণমূলের মানুষের অংশগ্রহণই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন আনতে হবে। পানি সমস্যা নিয়ে শুধু জনসচেতনতাই যথেষ্ট নয়। এর জন্যে প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। আর এটা জগদ্দল পাথরের মতো সরকারকেই করতে হবে। কারণ সরকার একটু কাজ করলে এর প্রভাব অনেক।
বাংলানিউজ: বাংলাদেশের পানি সংকট কী অবস্থায় আছে? এই সংকটের সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে? আর এই সমস্যা সমাধানে আপনাদের পরামর্শ কি?
খাইরুল ইসলাম: বাংলাদেশ ভয়াবহ পানি সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট নানাভাবে তৈরি হয়েছে। আমরা বাবরার বলছি ভয়াবহ পানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাতে এই সংকট প্রকট। রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল শুষ্ক। ঐখানকার নদীগুলো গ্রীষ্মকালে শুকিয়ে যায়। নিচু অঞ্চল বরিশাল, ভোলা বা খুলনায় লবণাক্ততা সমস্যা। কোনোটাকেই ছোটভাবে দেখা যাবে না। এসব সমস্যার এখনি প্রতিকার বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা না করলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ মিঠা পানিশূন্য অবস্থায় পতিত হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র কতৃক নদীতে বাঁধ নির্মাণ, স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন নদীতে নাব্যতা রক্ষার্থে উদ্যোগ না থাকা এবং সুনির্দিষ্ট নদী নীতিমালার অভাবে এ পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। আর উজানের দেশগুলো ভাটির দেশের প্রতি অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় করেছে বলে আমরা দেখি। টিপাই বাঁধ, ফারাক্কা বাঁধ, ভারতীয় আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প এসব সমস্যাকে জটিল করতে পারে।
আমরা সবাই জানি ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর আশংকাজনকভাবে নিচে নামছে। তাই ভূ-উপরিভাগের পানি ব্যবহারে জোর দেবার কথা বলছি। ঢাকার অধিকাংশ অঞ্চলের পানি নোংরা ও ময়লা এবং পান ও ব্যবহার অযোগ্য।
গরমে ঢাকার কোথাও কোথাও ২/৩ দিন পানি থাকে না। এসব কারণে জনরোষ হয়েছে। সেনাবাহিনী নামাতে হয়েছে। এখন পরিস্তিতি কিছুটা উন্নতি হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি। কারণ এমপিদের চাপে ওয়াসা কিছু পানির পাম্প বসিয়ে সাময়িক সমাধান করেছে বটে তবে এটি স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। নানাভাবে আরো বেশি পানি উত্তোলনের জন্য কয়েক হাজার গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে এই শহরে। শুধু ওয়াসার পানির হিসাব করা হয় কিন্ত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকার বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ, বড় বড় প্রতিষ্ঠান নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পানি তুলছে। পানির স্তরতো প্রতিদিনই নামছে। এভাবে কোটি মানুষের ঢাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। আগামীতে সমস্যা আরো জটিল হবে তার সমাধানো সহজ হবে না। ভূগর্ভস্থ পানি এখন আর সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। আমাদেরকে ঢাকা শহরের চাহিদা মেটাতে ভূ-উপরিস্থ পানির দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেভাবে ঢাকার পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নামছে, এভাবে চলতে থাকলে মহাবিপদ দেখা দেবে। ঢাকায় প্রতিদিনই কয়েক লাখ লোক আসে। তাই পানির অপচয় রোধ করতে হবে।
বাংলাদেশের পানির উৎস মূলত তিনটি- আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহ, বৃষ্টি এবং ভূগর্ভস্থ পানি। বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনাসহ প্রায় ৭০০টি নদী-উপনদীর বয়ে আনা পলি লক্ষাধিক বছর ধরে জমে জমে এই দেশটির জন্ম হয়েছে। তারপরেও বাংলাদেশে পানি সংকট খুব খারাপ পরিস্থিতির তৈরি করবে। আর পানি সংকট এখনই বিদ্যমান থাকলেও ১৫-২০ বছরের মধ্যে তা মহাসংকট হয়ে দেখা দেবে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়তে পারে।
No comments