বিশ্বব্যাংক, দুর্নীতি ও পদ্মা সেতু by হায়দার আকবর খান রনো

বিশ্বব্যাংক সম্পর্কে যে কথাগুলো এতকাল বামপন্থীরা বলে এসেছেন, আশ্চর্যজনক মনে হলেও এখন প্রায় সেই ধরনের অভিযোগ উত্থাপন করছেন বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি। অন্যদিকে যে বিশ্বব্যাংক নিজেই হচ্ছে দুর্নীতির আখড়া,


যার প্রতিটি কাজের মধ্যে রয়েছে মতলববাজি এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে মার্কিনসহ সাম্রাজ্যবাদী দেশের বহুজাতিক করপোরেশনের যথেচ্ছ মুনাফার পথ পরিষ্কার করা, সেই বিশ্বব্যাংক হঠাৎ করে সাধু সেজে দুর্নীতির ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠল। বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা যে দুর্নীতি করেন, এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। আবার বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তারাও ধোয়া তুলসীপাতা নন। কিন্তু দুই দুর্নীতিবাজের মধ্যে ঝগড়াটা এই চরম পর্যায়ে পৌঁছাল কেন? সেটা বিস্ময়ের ব্যাপার বৈকি!
বিশ্বব্যাংক জোরের সঙ্গে বলছে যে পদ্মা সেতুর ব্যাপারে বাংলাদেশে দুর্নীতি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী জোরের সঙ্গে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। যাঁকে কেন্দ্র করে এই দুর্নীতির অভিযোগ, সেই মন্ত্রীকে অবশ্য শেখ হাসিনা বাদ দেননি, কিন্তু বিশ্বব্যাংককে সন্তুষ্ট করতে অন্য মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দিয়েছেন। সেই মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন শেখ হাসিনার গতবারের (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে হাফমন্ত্রী অর্থাৎ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু সেবার শেখ হাসিনাই তাঁকে একপর্যায়ে অপসারিত করেছিলেন। এবার তাঁর পদোন্নতি হয়েছে। পূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন। তাঁর রেকর্ড ভালো নয় বলে জনমনে ধারণাটা ভালো নয়। তা ছাড়া জনসাধারণের ধারণায় মন্ত্রী-আমলারা দুর্নীতি করে থাকেন, যদিও দু-একজন মন্ত্রী সম্পর্কে আবার জনমনের ধারণা অন্য রকম। সৎ মন্ত্রী বলে তাঁদের সুখ্যাতি আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা নয়। তাই শেখ হাসিনা যত জোরের সঙ্গে নিজের মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গান না কেন, পাবলিক পারসেপশন তো ভিন্ন। জনসাধারণের কথা, দু-একজন দুর্নীতিবাজকে রক্ষা করতে কেন সরকার এই কলঙ্কের বোঝা কাঁধে নিল, কেন পদ্মা সেতুর বিষয়টিকে এত বড় ঝুঁকির মধ্যে ফেললেন।
বিশ্বব্যাংক দাবি করছে যে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির 'বিশ্বাসযোগ্য' প্রমাণ মিলেছে। তাঁরা বলছেন, যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া হয়েছে। তাতে কী হবে? প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী তো নিজেদের মন্ত্রীর পক্ষে সাফাই গাইবেন আর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিও মানুষের আস্থা নেই। তাঁদের কাজ হয়েছে সরকারের বড় ব্যক্তিদের, যাঁদের সরকার বাঁচাতে চায়, তাঁদের ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে 'ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট' দেওয়া আর সরকার যাদের আটকাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা তৈরি করা। এই সংস্থাটির এখন কোনো স্বাধীন সত্তা ও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী তাঁর আমলের দুর্নীতির কথা অস্বীকার করে চিরাচরিত প্রথানুযায়ী বিগত সরকারের আমলে পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে বলে বক্তব্য দিয়েছিলেন। আবার এ-ও বলেছিলেন যে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধের পেছনে চক্রান্ত আছে। তিনি বলেছেন, 'একজন নোবেল বিজয়ী পদ্মা সেতুর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান।' কয়েক দিন আগে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও কালের কণ্ঠের পাতায় এক লেখায় একই কথা বলেছেন।
বস্তুত এখন এসব কথা বলে বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না সরকার। সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এর জন্য সরকার নিজেই দায়ী। সেদিন অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের অপরাধের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। কিন্তু এসব কথা যখন আমরা বলতাম, তখন সরকারি নেতারা পাত্তা দেননি। এমনকি সদ্য পেশকৃত বাজেট যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের নির্দেশে রচিত হয়েছিল, এই ধারণাও অমূলক নয়। রেন্টাল বিদ্যুতের নামে ব্যক্তি বিশেষকে লাভ করিয়ে দিতে অথবা অপরিণামদর্শিতার কারণে সরকার যে বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার প্রায় ফতুর করে বসেছে, তারা সেই অজুহাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রাভাণ্ডারের কাছে হাত পাততে তাদের বিন্দুমাত্র বাধেনি। কারণ সংবিধানে 'সমাজতন্ত্র' কথাটি আবার যোগ দেওয়ার পরও সরকার যে আগাগোড়া পুঁজিবাদী পথযাত্রী এবং তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, দর্শন ও ভূমিকা বিশ্বব্যাংক আইএমএফের ওপরই নির্ভরশীল। তাদেরই পরামর্শে বা নির্দেশে সরকার কৃষিতে ভর্তুকি হ্রাস করেছে, জ্বালানি তেলের এবং বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো সেবা খাতকে ব্যক্তিমালিকানায় তুলে দিয়েছে। আজ হঠাৎ করে বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মেতে উঠলে তা বড় বেমানান দেখায়।
অবশ্য এই কথার দ্বারা পাঠক নিশ্চয়ই এটা ভেবে নেবেন না যে আমি বিশ্বব্যাংককে দায়মুক্ত করছি। বস্তুত বিশ্বব্যাংককে তার অপরাধ থেকে বাঁচার জন্য দায়মুক্তি লাভের প্রস্তাব করেছিল এবং সে জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপও ছিল। তখন আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয়, একমাত্র বামপন্থীরাই এর বিরোধিতা করেছিলেন। যাই হোক, বিশ্বব্যাংক এবার যে কাজটি করল তাও অন্যায্য ও অন্যায়। এমনকি যে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশকে কয়েকবার দুর্নীতিবাজ দেশ বলে ঘোষণা করেছিল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয় আমলেই) সেই সংস্থা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিল। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের কঠোর সমালোচনা করেছেন।
বিশ্বব্যাংক নিজেই দুর্নীতির আখড়া। তারা বিভিন্ন দেশে বহু দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রনায়ককে সমর্থন ও সহযোগিতা করে এসেছে। নামে বিশ্বব্যাংক হলেও এটি আসলে আমেরিকার ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি ছাড়া আর কেউ এই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হতে পারেন না। এই ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক, সেখানে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার কোনো বিষয় নেই। অথচ তারা আবার অন্য দেশে গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ইত্যাদির সবক দেয়। একে ভণ্ডামি ছাড়া আর কী বলব?
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস যিনি একদা বিশ্বব্যাংকের মুখ্য অর্থনীতিবিদ (১৯৯৭-১৯৯৯) এবং ক্লিনটন প্রশাসনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা (১৯৯৩-১৯৯৭) ছিলেন, তিনি নিজে যে 'অন্দরমহলের অভিজ্ঞতার' কথা জানিয়েছেন, তাতে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেছে। তার লিখিত প্রবন্ধ What I Learned At The World Economic Cricis : The Insider থেকে দু-একটি বাক্য উদ্ধৃত করা যাক।
'আমি প্রত্যক্ষ করেছি। কিভাবে আইএমএফ মার্কিন সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করে।...এই সংস্থার কাজকর্ম গোপনে পরিচালিত হয় এবং সেই কারণে তা গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা থেকে বিচ্ছিন্ন।...তারা উন্নয়নের জন্য যে অর্থনৈতিক দাওয়াইয়ের কথা মুখে বলে, তাতে প্রতিকার তো হয়ই না, উপরন্তু ক্ষতি হয়।' একই কথা বিশ্বব্যাংক সম্পর্কেও প্রযোজ্য।
এসব কথা কি অর্থমন্ত্রী অথবা অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান জানতেন না। তাঁদের তো জানার কথা। কারণ তাঁরা দুজনই ছিলেন আমলা এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমলা হিসেবেও কাজ করেছেন। বর্তমানের অর্থমন্ত্রী তো সামরিক শাসক এরশাদের আমলেও অর্থমন্ত্রী ছিলেন এবং এখন বিশ্বব্যাংকের আজ্ঞাবহ হয়ে বাংলাদেশে Structural Adjustment Policy বাস্তবায়িত করার 'মহান' দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মন্ত্রী ও উপদেষ্টা উভয়ের উদ্যোগেই তো বিশ্বব্যাংককে ডেকে আনা হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে অংশ নেওয়ার জন্য। তাহলে এখন কেন আস্ফালন? অকস্মাৎ প্রচণ্ড বাড়ি খেয়ে এখন বুঝি প্রলাপ বকছেন?
তার পরও এসব ব্যক্তি, যাঁরা চিন্তার জগতে পরনির্ভরশীল, আমলাতান্ত্রিক মানসিকতায় বেড়ে ওঠা এসব ব্যক্তি আত্মনির্ভর ভিন্নপথ গ্রহণের কথা ভাবতেই পারেন না। শুধু তাঁদেরই বা দোষ দেব কেন? একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ বাদে কোনো অর্থমন্ত্রী বা রাষ্ট্রনায়ক স্বাধীনভাবে আত্মনির্ভর অর্থনীতির কথাটা ভেবেছেন? এবং দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো যে ঠিক ভাবনার জন্যই তাকে অপমানজনকভাবে অপসারিত হতে হয়েছিল এবং তা হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর আমলেই।
এখন সরকার মালয়েশিয়ার সাহায্যে পদ্মা সেতু নির্মাণের কথা ভাবছে। এটা হবে আরো ভয়ংকর। যে ধরনের চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে বাংলাদেশের জনগণকে দীর্ঘ সময়ের জন্য বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা টানতে হবে। জাতীয় ক্ষতির পরিমাণ হবে বিশাল।
আমরা কি স্বনির্ভরভাবে কোনো বড় প্রকল্পের কথা ভাবতে পারি না? তাতে হয়তো মুৎসুদ্দি ধনী, দুর্নীতিবাজ আমলা ও এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীর আর্থিক লাভ হবে না, কিন্তু জাতীয় স্বার্থ ও মর্যাদা রক্ষা পাবে।
অর্থনীতির অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ এক প্রবন্ধে বলেছেন, মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় যথাক্রমে ১৯৯৭ সালে ও ২০০৫ সালে (একবার আওয়ামী লীগ আমলে, আরেকবার বিএনপি আমলে) মার্কিন ও কানাডিয়ান কম্পানি আমাদের গ্যাস পুড়িয়ে যে সম্পদ নষ্ট করেছে, তাতে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আমরা ন্যূনতম ৪৫ হাজার কোটি টাকা পেতে পারি। সেটা আদায় করতে পারলেও তো একটা নয়, দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এ ছাড়া অন্যভাবেও সম্ভব। আজকের সংক্ষিপ্ত রচনায় সেই বিকল্প নিয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না। পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা রাখি।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার কি সেই পথে হাঁটবে? তাদের শ্রেণী চরিত্র তা বলে না। অথচ গণমুখী সমাজতন্ত্র অভিমুখী আত্মনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে এবং সততা ও আন্তরিকতা থাকলে বিশ্বব্যাংক বা এ রকম সংস্থার ওপর নির্ভরশীল হওয়ার দরকার হয় না। আর সেটাই হলো প্রকৃত উন্নয়নের জন্য বিকল্প ধারা।
লেখক : রাজনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.