'আই অ্যাম মি. লিলি' by আবু এনএম ওয়াহিদ

সেদিন এক নেফ্রোলজিস্টের ওয়েটিং রুমে বসে আছি। হাতের কাছে পেয়ে পুরনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছি। দরজায় আওয়াজ শুনে দেখি দু'জন ঢুকছেন। বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে রোগী একজনই, অন্যজন নিছক সঙ্গ দিচ্ছেন। তারা দু'জনই বৃদ্ধ, দম্পতি, বয়স আশির বেশি বৈ কম হবে না।


ভদ্রমহিলা একেবারে কাবু, আস্তে আস্তে পা ফেলছেন তাও আবার চার চাকার ওয়াকারের ওপর ভর করে। ভদ্রলোক একহাতে স্ত্রীকে আরেক হাতে লাঠি ধরে এক পা এক পা করে এগোচ্ছেন এবং হাঁফাচ্ছেন। এসে দু'জনই চেয়ারে ধপাস করে বসে পড়লেন। ভাবলাম, 'দু'জনই তো রোগী, কে কাকে দেখে!'
পাঁচ মিনিট যেতে না যেতে ফ্রন্টডেস্কে কর্তব্যরত ডাক্তারের নার্স মিসেস লিলি বলে ইন্স্যুরেন্সের কাগজপত্র নিয়ে হাজির হতে ডাক দিলেন। পেসেন্ট শুনতে পেলেন কি-না বুঝলাম না; ভদ্রলোক পড়ি-মরি করে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু'কদম সামনে এগিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন, 'আই অ্যাম মিস্টার লিলি।' স্ত্রীর হয়ে তিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বের করে হাজিরা খাতায় মিসেস লিলির নাম লিখে আবার গিয়ে বসলেন সহধর্মিণীর পাশে।
যেভাবে তারা লিফটে চড়ে তিনতলায় উঠে ওয়াকার ও লাঠির ওপর ভর করে ডাক্তারের অফিসে এসেছেন, তা ঝুঁকিপূর্ণ বৈকি। যে কোনো মুহূর্তে পড়ে গিয়ে তাদের একজনের কিংবা দু'জনেরই হাত-পা ভেঙে যেতে পারত। এ অবস্থায় নিজের ছেলেমেয়ে, অথবা আরও অল্পবয়সী আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব কিংবা প্রতিবেশী কাউকে সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। হাতের কাছে কাউকে পাননি নিশ্চয়ই। জীবনটা বড়ই কঠিন, 'জগতে কে কাহার?'
এমনকি আমার জানামতে নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও এমন বৃদ্ধ নারী-পুরুষ আছেন যাদের নিত্যদিন এভাবে অসহায়ের মতোই কাটছে। দুঃসময়ে প্রিয়জনরা কাছে থাকে না বা থাকতে পারে না। অন্যের কথাইবা বলি কী করে! মাত্র বছর খানেক হলো আমার শ্বশুর মারা গেছেন। তাকে শেষ সময়ে দেখার জন্য না পেরেছি আমি যেতে, না আমার স্ত্রী।
আমার মা এবং শাশুড়ি এখনও বেঁচে আছেন। এই বয়সে সন্তান হিসেবে তাদের প্রতিও আমাদের দায়িত্বটি সঠিকভাবে পালন করতে পারছি না। তারা এক দেশে, আমরা আরেক দেশে। যখন-তখন দেখা-সাক্ষাতের সুযোগ নেই, সম্ভাবনাও নেই। বৈষয়িক দিক থেকে হয়তো তাদের কারোরই অসুবিধা হচ্ছে না, তবুও বয়সকালে মা তো তার সন্তানদের দেখতে চান। তাদের এমন আশা তো আমরা পূরণ করতে পারছি না। এটাইবা কম কম দুঃখের কী। নিজেরা যখন বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা করতে পারছি না, আমরা যখন বুড়ো হবো তখন কীভাবে আমাদের সন্তানদের কাছে দাবি করব আমাদের কাছে থাকার জন্য বা তাদের কাছে আমাদের রাখার জন্য? ডাক্তারের অফিসে বসে এলোপাতাড়ি এসব কথা ভাবতে ভাবতে মনটা খুব খারাপ হয়ে এলো, চোখের কোণগুলো ভিজছিল।
দেহের চোখ মুছে মুছে মনের চোখে পেছন ফিরে তাকালাম। আমি তখন কানাডার ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডির ছাত্র। সে সময় ওই ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টে প্রতি শুক্রবার বিকেলে বিভাগীয় সেমিনার হতো। একেকদিন একেকজন প্রফেসর একেকটি বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করতেন। এসব নিয়ে চুলচেরা বিশেল্গষণ হতো, গভীর আলোচনা হতো, উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক হতো। ওইসব সেমিনারে আমি বিশেষ কিছু বুঝতাম না। তবে প্রফেসরদের চিন্তার প্রসারতা, বুদ্ধির প্রখরতা এবং জ্ঞানের গভীরতা দেখে দারুণভাবে মুগ্ধ হতাম।
একদিনের সেমিনারের বিষয়বস্তু ছিল সিনিয়র সিটিজেনস অর্থাৎ 'বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতার দেখাশোনার দায়িত্ব।' এটা কি সন্তানের, সমাজের, না রাষ্ট্রের এবং কীভাবে কার্যকরভাবে কম খরচে এ গুরুদায়িত্ব পালন করা যায় তা নিয়ে প্রফেসরদের মধ্যে চলছিল তুমুল বিতর্ক।
বিতর্কের খুঁটিনাটি সেদিন বুঝিনি। অবশেষে সবাই যে উপসংহারে একমত হয়ে বিতর্কের অবসান টেনেছিলেন তা পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম। কথাটি ছিল, 'ইন ওল্ড এজ, নাথিং লাইক ওবিডিয়েন্ট চিল্ড্রেন।' অর্থাৎ 'বৃদ্ধ বয়সে সুসন্তানের তুলনা নেই।' কথাটা আমি একটু অন্যভাবে বলতে চাই। আমাদের জীবনের সব ব্যাপারে আল্লাহই চূড়ান্ত ভরসা, বৃদ্ধ বয়সে সুসন্তানের বড়ই প্রয়োজন। এ কথা শুধু ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডাই নয়, সারা পৃথিবীর বেলাই প্রযোজ্য।
সুসন্তান মানুষ হয়ে শুধু মা-বাবার মুখই উজ্জ্বল করে না বরং বিপদে-আপদে তাদের সাহায্যও করে।

ড. আবু এনএম ওয়াহিদ : অধ্যাপক
টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি
Awahid2569@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.