পুরনো বৃত্তে ফিরে যাওয়ার অপচেষ্টা by মমতাজউদ্দীন পাটওয়ারী
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ডাকে দেশব্যাপী হরতাল হলো। বিএনপি প্রথমে আড়িয়াল বিলে সহিংস ঘটনায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার খবর শুনে হরতাল আহ্বান করে। পরে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর না করার সরকারি ঘোষণা এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না হওয়ার কথা শোনার পর সবাই আশা করেছিল, বিএনপি হরতালটি প্রত্যাহার করে নেবে।
কিন্তু বিএনপি তা না করে বরং শেয়ারবাজারের অস্থিরতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগের দাবিতে পূর্ব ঘোষিত হরতাল পালনের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বিএনপি নেতারা হরতালের আগে কয়েক দিন ঢাকা শহরে লিফলেট বিলি করে জনগণকে তাঁদের ডাকা হরতালে অংশ নিতে আহ্বান জানান। খুবই ভালো কথা। বিএনপির নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁদের ডাকা হরতাল হবে শান্তিপূর্ণ, কোনো জবরদস্তি করা হবে না। এটিও খুব ভালো কথা। কিন্তু বাস্তবে কী দেখা গেল? বাস্তবে দেখা গেল, রবিবার সন্ধ্যায় বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের কর্মীরা যাত্রীবেশে বিভিন্ন বাসে উঠে পথিমধ্যে একসঙ্গে নেমে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়। এটি এক ধরনের চোরাগোপ্তা হামলা, যা কোনো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না, এটি অবৈধ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে আইনের কাছে বিবেচিত হতে বাধ্য। জানা গেছে, গত রবিবার ৯টি বাসে এভাবে বিএনপির কর্মীরা আগুন দিয়েছে, বাসে অগি্নসংযোগে লিপ্ত কয়েকজন কর্মী পুলিশের হাতে ধরাও পড়েছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে সবাইকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। এর পরিণতি মোটেও দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক হওয়ার নয়। রাজনীতিকে আবার সেই পুরনো বৃত্তে ফিরিয়ে নেওয়ার যে অপচেষ্টা চলছে তা প্রতিহত করতে হবে।
প্রথমেই যে বিষয়টি ভাবা দরকার তা হচ্ছে, পরের দিনের হরতাল পালনের জন্য আগের দিন সন্ধ্যায় গাড়িতে আগুন দেওয়ার জন্য কর্মীদের এভাবে কারা উদ্বুদ্ধ করছে? সংগঠন করা মানে কি সংগঠনের নামে যেকোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করতে কর্মীদের উদ্বুদ্ধ বা উৎসাহিত করতে হবে? হরতাল ডাকার অধিকার রাজনৈতিক দলের রয়েছে। কিন্তু হরতাল পালন করার বিষয়টি তো সম্পূর্ণরূপে জনগণের ওপর নির্ভর করে। জনগণ যদি রাজনৈতিক দলের হরতাল আহ্বানকে যুক্তিযুক্ত মনে করে, তাহলে তার প্রতি সমর্থন কোনো না কোনোভাবে জানাবেই। রাজনৈতিক দল মুখে বলছে গণতন্ত্রের কথা, কিন্তু বাস্তবে জোর-জবরদস্তিমূলকভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করতে বাধ্য করছে, তা তো কোনো গণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় বহন করে না। কর্মীরা যখন দল থেকে জোর-দবরদস্তি করার 'লাইসেন্স' পেয়ে যায়, গাড়ি পোড়ানো ও ভাঙচুর করার সমর্থন পায়, তাদের কর্মকাণ্ডকে দল থেকে সমর্থন দেওয়া হয়, তখন ওই কর্মীরা আর গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির কর্মী হওয়ার দীক্ষা বা শিক্ষা লাভ করে না, তারা তখন সন্ত্রাসী হওয়ার দীক্ষাই লাভ করে। এর মধ্য দিয়ে কর্মীরা গাড়ি পুড়িয়ে কার প্রতি তাদের জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, তা-ও বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়। এসব দলীয় কর্মী গাড়ি পুড়িয়ে 'বাহাদুর' সাজার যে অবাধ লাইসেন্স পায়, মনোভাব লাভ করে, তা তাদের শেষ বিচারে সন্ত্রাসী গুণ্ডাপাণ্ডা হিসেবে দলে তৈরি হতেই সাহায্য করে। তারা দেশ ও জনগণের প্রতি রাজনৈতিক দায় বা ভালোবাসার কোনো অনুভূতিই লাভ করে না। সেভাবে তারা গড়েও ওঠে না।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করার বিষয়, তা হচ্ছে দেশের পরিবহনকে এভাবে প্রতিটি হরতালের আগে টার্গেট করে হরতাল ডাকা। রাজনৈতিক দল আসলে হরতালকে কী চরিত্র দান করছে তা কি তারা ভেবে দেখেছে? পরিবহন বন্ধ রাখাই কি হরতাল? দোকানপাট জোর-জবরদস্তির মাধ্যমে বন্ধ রাখাই কি হরতাল? কোনো ধরনের জোর-জবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে পালিত 'হরতাল' আসলে কোনো হরতালই নয়। রাজনৈতিক দলকে প্রকৃতই তেমন হরতালই পালন করতে হবে, যে হরতাল ডাকার পর কোনো ধরনের পিকেটিং করতে হবে না, দোকানপাট জোর করে বন্ধ করতে হবে না, বাসে আগুন দিয়ে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বাস চলাচল বন্ধ করতে হবে না। জনগণ রাজনৈতিক দলের আহূত হরতাল আপনা থেকেই সমর্থন দিয়ে সফল করবে।
কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের মনের অনুভূতি বুঝে হরতালের ডাক দিলে জনগণ যথানিয়মে হরতালের প্রতি সমর্থন জানাবেই। এতে ব্যত্যয় ঘটার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সেই পরিস্থিতি দেশে তৈরি হতে হবে, রাজনৈতিক শক্তিকে সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে, তেমন আস্থা জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে দলকেই। তা না করে যখন তখন হরতাল ডাকলে বা মিডিয়ার সামনে মনগড়া সব কথাবার্তা বললেই দেশবাসী তা বিশ্বাস করবে, হরতাল পালন করবে_তা ভাবার কোনো কারণ নেই। জনগণকে অতটা বোকা ভাবা উচিত নয়। এ দেশের মানুষ ১৯৬৯ সালে হরতাল পালন করেছিল, ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন করেছিল, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে হরতাল করেছিল, এমনকি পরবর্তীকালেও বেশ কিছু হরতাল দেশে হয়েছিল, যেগুলো জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছিল। এমনকি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও হরতালসহ বেশ কিছু কর্মসূচিতে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ছিল_যা আন্দোলনকারীদের জোর-জবরদস্তি করে আদায় করতে হয়নি। বাস্তবতাই মানুষকে এসব কর্মসূচি পালনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কোনো ধরনের বাস পুড়িয়ে, ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে বা ককটেল ফাটিয়ে যা করা হয় তা স্বতঃস্ফূর্ত নয় কিছুতেই_এ সত্য কে না বোঝে?
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির ডাকা হরতাল নিয়ে বিএনপির নেতারা যেসব কথা মিডিয়ার সম্মুখে বলেছেন_তা জনগণ শুনেছে। কিন্তু আমাদের কাছে মনে হয়নি যে মানুষ হরতাল করার মতো কোনো ইস্যু হিসেবে এগুলোকে বিবেচনা করেছে বা দেখেছে। বিএনপি যেসব দাবিতে হরতাল ডেকেছে, এগুলো নিয়ে বড়জোর দু-চারটি সভা-সমাবেশ করা যেত, জনমতও সৃষ্টি করা যেত, কিন্তু এগুলো হরতাল পালন করার মতো কোনো ইস্যু এ মুহূর্তে ছিল না। তা ছাড়া হরতাল পালন করলেই দেশে দ্রব্যমূল্য কমবে না, শেয়ারবাজার শান্ত হয়ে যাবে না_এ কথা সবাই বোঝে। এ সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে রাজনৈতিকভাবে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজিয়েই। কোনো হরতাল ডেকে এগুলোর একটিরও সমাধান হবে না। বরং যে সময় বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট উৎসব আয়োজনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে, দেশে এখন গুরুত্বপূর্ণ এসএসসি পরীক্ষা চলছে, কৃষকদের নানা ব্যস্ততা রয়েছে, শহুরে মানুষের হাজার রকম কাজের ব্যস্ততা রয়েছে, ঢাকায় একুশের বইমেলা চলছে_এত সব ব্যস্ততার মধ্যে হরতাল ডেকে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনে, চলাফেরা ও কর্মকাণ্ডে বাধা সৃষ্টি করা, বাসে আগুন ধরিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত করা, ভোগান্তি ও দুর্ঘটনায় ফেলা সত্যিই দুর্ভাগ্যের বিষয়। সত্যি কথা বলতে কী, মানুষের মধ্যে সরকারের কাজেকর্মে নানা রকম হতাশা আছে, ক্ষোভ আছে, এমনকি বিক্ষোভ করারও কিছু কিছু চিন্তাভাবনা থাকতে পারে। কিন্তু বিএনপি এসবকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগানোর মতো দক্ষতাই দেখাতে পারেনি, মানুষের আস্থা সৃষ্টি করতে পারেনি। অধিকন্তু মানুষ দেখছে বিএনপি এমন সব ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দলকে নিয়ে হরতাল সফল করতে বৈঠক করেছে, রাজনৈতিক বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করছে, যাদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা সমাজে নেই। এ ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসন এমন সব ঢালাও কথাবার্তা গুলশান অফিসে বসে বলেন, যা কোনো জাতীয় নেতার মুখে খুব একটা মানায় না, কোনো ব্যাখ্যাও খুঁজে পাওয়া যায় না। মিডিয়ার কল্যাণে মানুষ এখন অনেক কিছুই জানতে পারছে, বুঝতে পারছে। সে কারণেই এখন জনগণকে নিয়ে যা খুশি তা বললেই জনগণ রাস্তায় নেমে সমর্থন জানাবে, হরতাল করে ফেলবে, তা ভাবার কোনোই কারণ নেই। বিএনপি নিজস্ব বিবেচনা থেকে হরতাল ডেকেছে, বিএনপির মতো করেই তা পালন করেছে। সাধারণ মানুষ এই হরতালের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে, এমন কোনো আলামত বোঝা যায়নি। তাতে বিএনপির লাভ কী হয়েছে, তা কেবল বিএনপিই ভালো বলতে পারবে। তবে আমরা শহরের কিছু মানুষ হরতালের দিন ঘরে অলসভাবে বসে থাকলেও বেশির ভাগ মানুষকেই নানা কষ্ট, বিড়ম্বনা ও দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়েছিল, রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। গ্রাম বা ছোট-বড় অনেক শহরেই জীবন চলেছে অনেকটাই স্বাভাবিক, কিছুটা অস্বাভাবিক, ছন্দহীনভাবে। এ হচ্ছে ৭ ফেব্রুয়ারির হরতালের বাস্তব চিত্র।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও রাজনীতির বিশ্লেষক
No comments