স্মরণ-সার্জেন্ট জহুরুল হক by তামান্না ইসলাম অলি

নেশা ছিল ছবি আঁকার। ভালো খেলোয়াড়ও ছিলেন। কিন্তু পেশায় ছিলেন বিমানবাহিনীর কর্মী। সার্জেন্ট জহুরুল হক একজন নির্ভীক দেশপ্রেমিক। এই দেশপ্রেমের কারণে জীবন দিতে হয়েছিল তাঁকে। পাকিস্তানি জান্তার ষড়যন্ত্রে শহীদ হন জহুরুল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ধরা হয় তাঁকেই।


আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিচারাধীন অবস্থায় জেলের মধ্যেই তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানি চক্র। সেদিন ছিল ১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। আজ সার্জেন্ট তাঁর ৪২তম শাহাদাতবার্ষিকী।
জহুরুল হকের জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। জন্মস্থান নোয়াখালীর সুধারামপুর উপজেলার সোনাপুর। নোয়াখালী জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। ১৯৬৫ সালে যোগ দেন বিমানবাহিনীতে। দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল। এ কারণে সহকর্মীদের মধ্যে খ্যাত ছিলেন মার্শাল হিসাবে।
সেনানিবাসে পথশিশুদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছিলেন জহুরুল হক। আর এতেই বিরাগভাজন হন সামরিক জান্তার। ১৯৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসানো হয় তাঁকে। একপর্যায়ে গ্রেপ্তার হয়ে যান। প্রথমে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, পরে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে আটকে রাখা হয় তাঁকে। অবশ্য সেদিন বাংলার দামাল ছেলেরা ঘরে বসে ছিল না। দেশজুড়ে দাবি উঠেছিল এই ষড়যন্ত্রমূলক মামলা প্রত্যাহারের। আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল সারা পূর্ব বাংলা।
অবশ্য সেদিকে কর্ণপাত করেনি পাকিস্তানি জান্তা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের জন্য ১৪ পদাতিক বাহিনীর সদর দপ্তরে বসানো হয় বিশেষ আদালত। শুরু হয় আদালতের কার্যক্রম। অন্যদিকে চলছে ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলন। ১৯৬৯ সালে প্রবল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানি শাসকরা বুঝল এই প্রহসন টিকবে না। তখন তাদের নির্দেশে সামরিক ব্যারাকে বন্দি সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করা হয় অতর্কিতে। গুরুতর আহত হন তিনি। সে রাতেই ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ছাড়লেন জহুরুল হক।
জহুরুল হককে হত্যার অজুহাত হিসেবে বলা হয়েছিল, 'পালিয়ে যাচ্ছিলেন জহুরুল তাই তাঁকে গুলি করা হয়েছে।' তাঁর হত্যার খবরে ফুঁসে উঠেছিল পূর্ব বাংলা। দেশের বহু সরকারি ভবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল ছাত্র-জনতা। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন আরো তীব্র হয়েছিল সারা দেশে। জহুরুল হক হত্যর মাত্র সাত দিনের মাথায় জনতার দাবি মেনে নেয় সরকার। অর্থাৎ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এর মাত্র এক মাস পর ২৫ মার্চ আইয়ুব সরকার মুখ থুবড়ে পড়ে।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের নাম দেওয়া হয় জহুরুল হক হল। বিমানবাহিনীর চট্টগ্রাম বেইজ জহুরুল হকের নামে নামকরণ করা হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা নাম লিখিয়েছিলেন তাঁদের অগ্রসৈনিক জহুরুল হক। তাই সার্জেন্ট জহুরুল হক এ দেশের সূর্যসন্তান। আমাদের গৌরব। আজকে তাঁর শাহাদাতবার্ষিকীতে আমরা তাঁকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধায় স্মরণ করছি।
তামান্না ইসলাম অলি

No comments

Powered by Blogger.