রিপোর্টারের ডায়েরি-শেষবেলায় দিল্লীতে

৭ এপ্রিল, শনিবার। দিনেরবেলায় বিশেষ কোন প্রোগ্রাম না থাকায় রিলাক্স মুডে ঘুম থেকে উঠলাম। সকালের সকল প্রস্তুতি শেষে গোসল করে আমিন ভাই ও মুন্নাকে নিয়ে নাস্তা করতে নিচে এলাম। সন্ধ্যায় আমাদের নাট্যটিম পারফর্ম করবে। টিমের অন্যরা রিহাসেলে যাবে।


আমরা মিডিয়া টিমের চারজন মিলে ঠিক করলাম, দিল্লী বাংলাদেশ হাইকমিশনের অফিসে যাব। কিন্তু এনাম ভাইকে ফোন করে জানলাম শনি ও রবিবার সপ্তাহে এই দুই দিন হাইকমিশনের অফিস বন্ধ থাকে। এনাম ভাই জানালেন, রাতে আপনাদের অনারে প্রেসক্লাবে ডিনারের আয়োজন করা হয়েছে। তাই হাইকমিশন যাওয়া হলো না। ঠিক করলাম, এ সময়ে আমরা দিল্লী ঘুরব। তামান্না তার এক আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল পুরনো দিল্লীতে। আমরা লক্ষ্যহীনভাবে যাত্রা করলাম। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার দরগায় যাব। তিনজনে মিলে একটি অটোরিক্সা নিয়ে চলছি। ছিমছাম-সাজানো-গোছানো রাস্তা দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্যে পৌঁছলাম। একেবারে অপরিচিত হলেও হেঁটে পৌঁছে গেলাম দরগায়। আমাদের জুতা রাখার জন্য রাস্থায় বিভিন্ন ঘর থেকে ডাকছে। জুতা রাখাই তাদের ব্যবসা। টাকার বিনিময়ে তারা জুতা রাখে। পাশাপাশি জিয়ারতের বিভিন্ন সামগ্রীও বিক্রি করে। দরগায় কেউ জুতা নিয়ে প্রবেশ করে না, তাই অনেকে এই দোকানগুলোতে জুতা রাখেন এক প্রকার বাধ্য হয়ে। আমরা কারও ডাকে পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে চলছি। দরগার একেবারে কাছে গিয়ে আমিন ভাই ও মুন্না গেলেন দরগা জিয়ারত করতে। কিছুক্ষণ পরে তাঁরা ফিরে এলেন। প্রতিদিন শত শত লোক আসেন এই দরগায়। চিস্তি সম্প্রদায়ের চতুর্থ গুরু শেখ নিজামুদ্দিন ৯২ বছর বয়সে ১৩২৫ সালে মারা গেলে সমাধিস্থ হয়েছেন এখানে। আর আছে বাইজান্টিয়ান শৈলিতে গড়া আলাউদ্দিন খিলজির মসজিদ, উর্দু কবি মির্জা গালিব, স্থাপতি ঈশা খান ও শাজাহান কন্যা জাহানারার সমাধি রাজকীয় সমাধিভূমিতে। মহাভারতে পঞ্চপা-বের হাতে গড়া তাদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থের ওপর গড়ে উঠেছিল এই মুসলিম পবিত্র তীর্থ। উরস পালিত হয় সাড়ম্বরে। প্রবাদ আছে, আজমেরে দরগা খাজা সাহেব দর্শনান্তে আউলিয়া দরগা দর্শনের বিধি। তিনজনে মিলে এসব দর্শনের পর পবিত্র এই দরগা এলাকা হেটে পরিদর্শন করলাম। ডলার ভাঙ্গিয়ে রুপীও করলাম এখানে। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ায় লান্স সেরে নিলাম দরগার পাশে একটি হোটেলে। মাছ-মাংস সবই পাওয়া যায় এখানকার হোটেলে। তুলনামূলক দামও কম। এমনকি হোটেল ভাড়াও কম। লাঞ্চ সেরে তিনজনে মিলে হোটেলে ফিরলাম। টিমের সঙ্গে যাব দিল্লীর কামানী অডিটরিয়ামে। সেখানেই মঞ্চস্থ হবে রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকটি। হোটেলে ফিরে জানলাম, আর কিছুক্ষণ পর আমরা যাত্রা করব অডিটরিয়ামের উদ্দেশ্যে। আমরা আর রুমে না গিয়ে টিমের অন্যদের সঙ্গে নিচে ওয়েটিং রুমে অবস্থান করছি। আমাদের আগেই তামান্না ফিরে এসেছেন। সেও আমাদের সঙ্গে অপেক্ষা করছে। অল্প সময়ের মধ্যে নাট্যটিমের সকলে এসে হাজির। আমাদের গাড়িতে উঠতে বলা হলো। সকলে মিলে গাড়িতে উঠলাম। বিকেল ৪টা বাজার আগেই আমরা অডিটরিয়ামে চলে এলাম। অডিটরিয়াম ঘুরে দেখে আমরা তিনজন বেরিয়ে এলাম। তামান্না রয়ে গেল। আমরা তিনজন মিলে দিল্লী দূরদর্শন দেখে হেঁটে বিভিন্ন রাজ্যের ভবনগুলো দেখতে লাগলাম। এত আগে আসায় সময় আর কাটছে না। সাড়ে ৬টায় আমাদের প্রোগ্রাম। আমরা অডিটরিয়ামে ফিরে এলাম। এবার নাট্যটিমের একজন বলল, চলেন পাশেই বাঙালী মার্কেটে ঘুরে আসি। বাইরে কোথাও গেলে বাঙালী শব্দটি শুনলেই তা দেখার আগ্রহ জন্মায়। তাই আমরাও গেলাম বাঙালী মার্কেটে। এবার তামান্নাও আমাদের সঙ্গে গেলেন। অটোরিক্সায় সকলের জায়গা না হওয়ায় আমি ও মুন্না একটিতে উঠলাম এবং আমিন ভাই ও তামান্না অন্য একটিতে উঠে এলেন। বাঙালী মার্কেটে আমরা ঘুরছি। মুন্না তার ভাগ্নের জন্য একটি গিফট কিনবে শুনছি কলকাতা থেকে। এখানেও এসে একই কথা শুনছি। শুধু শুনেই চলেছি, কিন্তু কিনতে দেখছি না। বিশেষ করে সে কোন কিছু কেনার আগে বাংলাদেশী টাকায় এর মূল্য কত হবে এটার হিসেবে কষছে। আর দাম হিসাব করে তা কিনতে পারছে না। আমি ও মুন্না এক দোকান থেকে অন্য দোকানে পণ্য দেখছি। এরই মধ্যে আমিন ভাই ও তামান্না এসে হাজির। আমি এবং আমিন ভাই বাইরে দাঁড়িয়ে গল্প করছি আর ওরা দু’জনে দোকানে মালামাল দেখছেন। মনে করলাম মালামাল দেখতে দেখতে সফরের শেষ দিনে হয়ত তাদের দূরত্ব কিছুটা কমবে। কলকাতা থেকে কি কারণে যে তাদের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা মুন্না বলেনি। তবে তামান্নার ওপর সে বিরক্ত এমন কথা আমাকে এবং আমিন ভাইকে কলকাতাতেই বলেছে। দোকান থেকে বেরিয়ে আমিনভাই আমাদের বিকেলের নাশতা করালেন। নাশতা সেরে আমরা হেঁটে অডিটরিয়ামে পৌঁছে গেলাম। অডিটরিয়ামের ভেতরে বসে রয়েছি এমন সময় বাসসের বাদলদা (সুভাস চন্দ্র বাদল) এনাম ভাইয়ের ফোনে আমাকে ফোন দিলেন। তিনি আসছেন এবং যথাসময় এসে পৌঁছলেন। যথাসময়ে আমাদের নাটকটি মঞ্চস্থও হলো। হলভর্তি দর্শক মুগ্ধ হলেন প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের থিয়েটারের অভিনয় দেখে। হল থেকে বের হতেই শুনতে পেলাম অনেকে বলছেন অনেকদিন পর একটি সুন্দর নাটক দেখলাম। আমরা বেরিয়ে ইন্ডিয়া প্রেসক্লাবের দিকে রওনা হলাম। সমকালের দিল্লী প্রতিনিধি গৌতম লাহেড়ী দাদাও এসেছেন। তিনি মুন্নাসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে ক্লাবে আসবেন। আমি বাদলদার গাড়িতে করে যাচ্ছি। রাতে বাদলদার গাড়ি চালক প্রেসক্লাবে যাওয়ার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছ। বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে ঘুরছে আবার একই স্থানে আসছে। বাদলদা গাড়ি চালকের ওপর প্রচ- ক্ষোভ প্রকাশ করল। অবশেষে আমরা ক্লাবে এসে হাজির হলাম। কিছুক্ষণ পর আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন দিল্লীর এক খ্যাতনামা সাংবাদিক টেলিগ্রাফ পত্রিকার বিজনেস এডিটর জয়ন্ত রায় চৌধুরী। রাতের ক্লাবে জমজমাট আড্ডা দিয়ে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরব। এবার আমাদের সঙ্গে এলেন জয়ন্তদা। রাতে তিনি হোটেলে এসে সেখানেও আমাদের সঙ্গে দিলেন আর এক আড্ডা। রামেন্দুদা, তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসি মজুমদার এবং তাঁদের একমাত্র কন্যা ত্রপা মজুমদারের সঙ্গে পরিচিত হলেন এবং নানান বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এমন সময় ত্রপা সম্পর্কে একটি নতুন তথ্যও জানতে পারলাম আমরা সকলে জয়ন্তদার সৌজন্যে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট-টাইম শিক্ষকতা করেন। রাতে জয়ন্তদাকে বিদায় জানাতে আবার হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম গাড়ি পর্যন্ত। পরের দিন দুপুরে আমাদের ফ্লাইট। তাই জয়ন্তদাও বলতে লাগলেন, আরও দুই-একদিন থেকে যান। দিল্লীটা ভাল করে দেখে যান। হাতে সময় না থাকায় তা আর সম্ভব হলো না। পরে আবার আসব বলে তাকে বিদায় দিয়ে হোটেলে ফিরলাম।
-তপন বিশ্বাস

No comments

Powered by Blogger.