ভিসি প্যানেল নির্বাচন নিয়ে নতুন সঙ্কটের মুখে জাবি-একশ্রেণীর শিক্ষক পরিস্থিতি অনিশ্চিত করার কৌশল নিয়েছেন by বিভাষ বাড়ৈ ও আহমেদ রিয়াদ
উপাচার্যের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষক আন্দোলনের অচলাবস্থা কাটলেও এবার নতুন সঙ্কটের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন দায়িত্ব নিয়ে মাত্র ৪০ দিনের মাথায় বহুকাক্সিক্ষত উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে শিক্ষাঙ্গনসহ পুরো জাতিকে আশার আলো দেখালেও উল্টো পথে হাঁটছেন কিছু শিক্ষক।
১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের ভুল ও বিকৃত ব্যাখ্যা দিয়ে আগামী ২০ জুলাইয়ের বহু আকাক্সিক্ষত নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে ফেলার কৌশল নিয়েছেন তাঁরা। দাবি তুলেছেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ডিন, জাকসু, সিন্ডিকেট, সিনেট নির্বাচন দিতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট সদস্যরা এখন আর বৈধ নন। অথচ অধ্যাদেশে ১৯ (২) ধারায় স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘সদস্যদের মেয়াদ তিন বছর/পরবর্তী নির্বাচিত সদস্যদের দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত।’ এখানেই শেষ নয়, রহস্যজনক হলেও সত্য- যাঁরা এখন বাধা দিচ্ছেন গত দেড় মাস আগেও এই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিকে ইস্যু বানিয়ে তারাই ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছেন।
এদিকে কিছু শিক্ষকের প্রশ্নবিদ্ধ এসব কর্মকা-ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ডিন, জাকসু, সিন্ডিকেট, সিনেট নির্বাচন আগে দিতে গেলেই শিক্ষকদের বিরোধসহ নানামুখী জটিলতা সৃষ্টি হবে। সময় নষ্ট হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। এসব বিষয় জেনেই কিছু শিক্ষক এখন সঙ্কট তৈরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি উপাচার্য হতে না পারার হতাশা এবং প্যানেল নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই কিছু শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে জাবিকে সঙ্কটের মুখে ফেলতে চান বলে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ২০ জুলাই আহূত বিশেষ সিনেট সভায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কিছুটা পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছেন। বিষয়টিকে তাৎক্ষণিক সাধুবাদ জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক। অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে এমন ঘোষণা ভাল মনে হলেও শিক্ষক সমাজের মধ্যে থাকা কিছু শিক্ষক বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না। কেউ আছেন এ নির্বাচনের পক্ষে আবার কেউবা আছেন নির্বাচন স্থগিতের পক্ষে। উপাচার্য প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচন বন্ধের দাবিতে ১০ জুলাই পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দিয়েছে ‘সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ’ নামের একটি গ্রুপ। দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচীর ঘোষণা করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন কিছু শিক্ষক। পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক এমএ মতিন বলেছেন, আমরাও ভিসি প্যানেল নির্বাচন চাই। তবে এ নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে পর্যায়ক্রমে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট, ডিন, সিন্ডিকেট ও সিনেট নির্বাচন জরুরী। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। এরপর পরিষদের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সম্প্রতি শিক্ষক আন্দোলনকারী ও শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন, অধ্যাপক শামছুল আলম, অধ্যাপক মানস চৌধুরীসহ আরও কিছু শিক্ষক। এরা প্রত্যেকেই মাত্র কিছুদিন আগেও উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল কবীরের পদত্যাগ ও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছিলেন। নবগঠিত সংগঠনের মধ্যে আওয়ামীপন্থী সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক এমএ মতিনের অনুসারী শিক্ষকরা ও জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর ব্যানারে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সেলিম নেতৃত্বাধীন শিক্ষকদের একটি অংশ আছে। ফলে এ নির্বাচনের জন্য এখন উত্তপ্ত রয়েছে গোটা ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতি। চলছে নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ফের নতুন কোন সঙ্কটের মুখে ফেলে অশান্ত ও অচল করে দেয়ার পাঁয়তারা। অথচ শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত উপাচার্যের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা। বিরোধিতাকারী শিক্ষকদের কথা হচ্ছে, যে ১৫ সিনেট সদস্যের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের স্থানে নতুন সদস্য নির্বাচন না করে নির্বাচন করা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই মনে করেন, নতুন ভিসির পক্ষে সিনেট সদস্য নির্বাচনের মতো কাজ স্বল্প সময়ে করা আদৌ সম্ভব নয়। আর এটা করতে গিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি আবার চরম আকার ধারণ করলে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনও অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। শিক্ষক সমাজের শিক্ষকদের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে তফসিল স্থগিত রাখার নেপথ্যে রয়েছে তাদের প্রতিনিধিদের সিনেটে থেকে সিন্ডিকেটে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচনে হেরে যাওয়া। এখন উপাচার্য প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচনে নিজের প্রার্থীদের জয়ের বিষয়ে আস্থাহীনতায় শিক্ষকদের এ অংশটি এখন নির্বাচনী তফসিল স্থগিত করতে চাইছে। আর এ সিনেট পুনর্গঠনসহ নিছক কিছু দাবি উত্থাপন করে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে শিক্ষকদের একটি গ্রুপ প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচন বন্ধ রাখতে ফের অচলের আন্দোলনে যাচ্ছে। তবে সাধারণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মনে করছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্নময় শিক্ষাজীবনকে জিম্মি করে একটি শিক্ষক গ্রুপ নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমানকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর আর কোন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে সর্োচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিনজনের প্যানেল মনোনয়ন শেষে তা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর জিল্লুর রহমানের নিকট প্রেরণ করা হবে।
রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতাবলে প্যানেলের যে কাউকে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য মনোনয়ন দেবেন। নির্বাচন হওয়ার পক্ষে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদুর রশিদ বলেন, ২০ জুলাই সিনেটের বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়েছে। এই সভায় ‘তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল’ মনোনয়নের জন্য নির্বাচন একটি ভাল সিদ্ধান্ত। আমরা এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি। তার সঙ্গে থাকার কথা জানিয়েছি। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্তের চর্চা শুরু হবে। তবে নির্বাচন বন্ধের অধ্যাদেশের ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আদেশের ১৯ নম্বর ধারায় মোট ১১টি ক্যাটাগরির সিনেট সদস্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সিনেটে সদস্য হওয়ার কথা ৯১ জন। এর মধ্যে কেবল নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ৫ সদস্য নেই। নেই একজন উপ-উপাচার্য। এছাড়া প্রত্যেকেই অধ্যাদেশ অনুসারে বৈধ ভোটার। অথচ প্রচার করা হচ্ছে, তারা বৈধ নয়। এদিকে শিক্ষার্থীরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নির্বাচনের জন্য। আশা করছেন বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রথম উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ভাগীদার হবেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, যথাসময়ে বিশেষ সিনেট ও উপাচার্য মনোনয়ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষকদের একাংশের নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে তিনি বলেন, উপাচার্য বিষয়টি নিজে দেখছেন। আমি এ ব্যাপারে এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমান ভিসি আসার পর ক্যাম্পাসের নানামুখী সঙ্কট কেটে যেতে শুরু করেছে। রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে দিয়েছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সাগুফতা বৃষ্টি মনে করেন, এ নির্বাচন ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশকে সমুন্নত রাখা, গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার মূলমন্ত্র। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথে এ নির্বাচন এখন সময়ে দাবি। ছাত্র রাহাত মিনহাজ মনে করে, এ নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে সাহায্যে করবে। আর যারা এ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তারা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে চায় না। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও ’৭৩-এর অধ্যাদেশের আশু বাস্তবায়ন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সঙ্কটকালে মুহূর্তে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মতো দুরূহ কর্ম সম্পাদনেও তার দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য অনুসরণীয়। কারণ এখনও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন ছাড়াই বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ব্যতিক্রম। আশা করা যায়, জাবিতে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পথ অনুসরণ করবে। অবস্থা সম্পর্কে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মেনেই মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট সদস্যদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে সকলে নির্বাচন নিয়ে একাট্টা হবেনÑ এটাই প্রত্যাশিত। সবার সম্মিলিত দাবির বিষয়টি বিবেচনা করেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছি। তিনি বলেন, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, শীঘ্রই ডিন, সিন্ডিকেট নির্বাচনও আমি শেষ করতে চাই। আর আমি মনে করি একজন নির্বাচিত উপাচার্য এসেই কেবল ছাত্র সংসদ নির্বাচন করবে। এটাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
এদিকে কিছু শিক্ষকের প্রশ্নবিদ্ধ এসব কর্মকা-ে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্ষুব্ধ সাধারণ শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাঁরা অভিযোগ করেছেন, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, ডিন, জাকসু, সিন্ডিকেট, সিনেট নির্বাচন আগে দিতে গেলেই শিক্ষকদের বিরোধসহ নানামুখী জটিলতা সৃষ্টি হবে। সময় নষ্ট হবে এবং স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। এসব বিষয় জেনেই কিছু শিক্ষক এখন সঙ্কট তৈরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি উপাচার্য হতে না পারার হতাশা এবং প্যানেল নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেই কিছু শিক্ষক ও শিক্ষক নেতা উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে জাবিকে সঙ্কটের মুখে ফেলতে চান বলে অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। জানা গেছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আগামী ২০ জুলাই আহূত বিশেষ সিনেট সভায় উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা কিছুটা পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছেন। বিষয়টিকে তাৎক্ষণিক সাধুবাদ জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক। অধিকাংশ শিক্ষকের কাছে এমন ঘোষণা ভাল মনে হলেও শিক্ষক সমাজের মধ্যে থাকা কিছু শিক্ষক বিষয়টিকে মেনে নিতে পারছেন না। কেউ আছেন এ নির্বাচনের পক্ষে আবার কেউবা আছেন নির্বাচন স্থগিতের পক্ষে। উপাচার্য প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচন বন্ধের দাবিতে ১০ জুলাই পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দিয়েছে ‘সম্মিলিত শিক্ষক পরিষদ’ নামের একটি গ্রুপ। দাবি মানা না হলে কঠোর কর্মসূচীর ঘোষণা করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছেন কিছু শিক্ষক। পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক এমএ মতিন বলেছেন, আমরাও ভিসি প্যানেল নির্বাচন চাই। তবে এ নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে পর্যায়ক্রমে রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট, ডিন, সিন্ডিকেট ও সিনেট নির্বাচন জরুরী। এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। এরপর পরিষদের অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সম্প্রতি শিক্ষক আন্দোলনকারী ও শিক্ষক সমাজের আহ্বায়ক অধ্যাপক নাসিম আখতার হোসাইন, অধ্যাপক শামছুল আলম, অধ্যাপক মানস চৌধুরীসহ আরও কিছু শিক্ষক। এরা প্রত্যেকেই মাত্র কিছুদিন আগেও উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল কবীরের পদত্যাগ ও উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করেছিলেন। নবগঠিত সংগঠনের মধ্যে আওয়ামীপন্থী সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল বায়েস, পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক এমএ মতিনের অনুসারী শিক্ষকরা ও জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর ব্যানারে সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সেলিম নেতৃত্বাধীন শিক্ষকদের একটি অংশ আছে। ফলে এ নির্বাচনের জন্য এখন উত্তপ্ত রয়েছে গোটা ক্যাম্পাসের শিক্ষক রাজনীতি। চলছে নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয়কে ফের নতুন কোন সঙ্কটের মুখে ফেলে অশান্ত ও অচল করে দেয়ার পাঁয়তারা। অথচ শিক্ষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত উপাচার্যের অধীনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা। বিরোধিতাকারী শিক্ষকদের কথা হচ্ছে, যে ১৫ সিনেট সদস্যের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে তাদের স্থানে নতুন সদস্য নির্বাচন না করে নির্বাচন করা যাবে না। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষকই মনে করেন, নতুন ভিসির পক্ষে সিনেট সদস্য নির্বাচনের মতো কাজ স্বল্প সময়ে করা আদৌ সম্ভব নয়। আর এটা করতে গিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি আবার চরম আকার ধারণ করলে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনও অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। শিক্ষক সমাজের শিক্ষকদের উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে তফসিল স্থগিত রাখার নেপথ্যে রয়েছে তাদের প্রতিনিধিদের সিনেটে থেকে সিন্ডিকেটে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নির্বাচনে হেরে যাওয়া। এখন উপাচার্য প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচনে নিজের প্রার্থীদের জয়ের বিষয়ে আস্থাহীনতায় শিক্ষকদের এ অংশটি এখন নির্বাচনী তফসিল স্থগিত করতে চাইছে। আর এ সিনেট পুনর্গঠনসহ নিছক কিছু দাবি উত্থাপন করে শিক্ষক সমাজের ব্যানারে শিক্ষকদের একটি গ্রুপ প্যানেল মনোনয়ন নির্বাচন বন্ধ রাখতে ফের অচলের আন্দোলনে যাচ্ছে। তবে সাধারণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা মনে করছে মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্নময় শিক্ষাজীবনকে জিম্মি করে একটি শিক্ষক গ্রুপ নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৪ সালে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যাতে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমানকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। এরপর আর কোন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনে সর্োচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিনজনের প্যানেল মনোনয়ন শেষে তা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর জিল্লুর রহমানের নিকট প্রেরণ করা হবে।
রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতাবলে প্যানেলের যে কাউকে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য মনোনয়ন দেবেন। নির্বাচন হওয়ার পক্ষে আওয়ামীপন্থী শিক্ষক ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহেদুর রশিদ বলেন, ২০ জুলাই সিনেটের বিশেষ সভা আহ্বান করা হয়েছে। এই সভায় ‘তিন সদস্যের উপাচার্য প্যানেল’ মনোনয়নের জন্য নির্বাচন একটি ভাল সিদ্ধান্ত। আমরা এমন সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছি। তার সঙ্গে থাকার কথা জানিয়েছি। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্তের চর্চা শুরু হবে। তবে নির্বাচন বন্ধের অধ্যাদেশের ভুল ব্যাখ্যা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। আদেশের ১৯ নম্বর ধারায় মোট ১১টি ক্যাটাগরির সিনেট সদস্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বর্তমানে সিনেটে সদস্য হওয়ার কথা ৯১ জন। এর মধ্যে কেবল নির্বাচিত ছাত্র সংসদের ৫ সদস্য নেই। নেই একজন উপ-উপাচার্য। এছাড়া প্রত্যেকেই অধ্যাদেশ অনুসারে বৈধ ভোটার। অথচ প্রচার করা হচ্ছে, তারা বৈধ নয়। এদিকে শিক্ষার্থীরাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন নির্বাচনের জন্য। আশা করছেন বর্তমান সরকারের মেয়াদে প্রথম উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ভাগীদার হবেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, যথাসময়ে বিশেষ সিনেট ও উপাচার্য মনোনয়ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। শিক্ষকদের একাংশের নির্বাচন স্থগিতের বিষয়ে তিনি বলেন, উপাচার্য বিষয়টি নিজে দেখছেন। আমি এ ব্যাপারে এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বলছেন, বর্তমান ভিসি আসার পর ক্যাম্পাসের নানামুখী সঙ্কট কেটে যেতে শুরু করেছে। রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক গতি ফিরিয়ে দিয়েছেন। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী সাগুফতা বৃষ্টি মনে করেন, এ নির্বাচন ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশকে সমুন্নত রাখা, গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রাখা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার মূলমন্ত্র। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথে এ নির্বাচন এখন সময়ে দাবি। ছাত্র রাহাত মিনহাজ মনে করে, এ নির্বাচন বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন করে স্বপ্ন বুনতে সাহায্যে করবে। আর যারা এ নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে তারা আসলে বিশ্ববিদ্যালয়কে সামনে স্বাধীনভাবে চলতে দিতে চায় না। আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও ’৭৩-এর অধ্যাদেশের আশু বাস্তবায়ন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সঙ্কটকালে মুহূর্তে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের মতো দুরূহ কর্ম সম্পাদনেও তার দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের জন্য অনুসরণীয়। কারণ এখনও কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচন ছাড়াই বছরের পর বছর ক্ষমতা আঁকড়ে আছেন। এ ক্ষেত্রে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ব্যতিক্রম। আশা করা যায়, জাবিতে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের পর অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পথ অনুসরণ করবে। অবস্থা সম্পর্কে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মেনেই মেয়াদোত্তীর্ণ সিনেট সদস্যদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। এতে কারও আপত্তি থাকা উচিত নয়। বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহত্তর স্বার্থে সকলে নির্বাচন নিয়ে একাট্টা হবেনÑ এটাই প্রত্যাশিত। সবার সম্মিলিত দাবির বিষয়টি বিবেচনা করেই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছি। তিনি বলেন, ’৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুসারেই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। এক প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, শীঘ্রই ডিন, সিন্ডিকেট নির্বাচনও আমি শেষ করতে চাই। আর আমি মনে করি একজন নির্বাচিত উপাচার্য এসেই কেবল ছাত্র সংসদ নির্বাচন করবে। এটাই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
No comments