বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. প্রফুল্লচন্দ্র সরকার-বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা হওয়া উচিত বৈশ্বিক
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ২০০২ সালে। বর্তমানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ফ্যাকাল্টিতে শতাধিক শিক্ষক রয়েছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে কালের কণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন উপাচার্য প্রফেসর ড. প্রফুল্লচন্দ্র সরকার।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন মহসীন হাবিব
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে দেখতে দেখতে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল। এগুলোর ভূত ও ভবিষ্যৎ আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে কেমন দেখছেন?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আমার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭৪ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটির আমাদের মধ্যে অঙ্কুরোদ্গম হয়, তখন ব্র্যাক একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সেটা হলো আশির দশকের প্রথম দিকে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ব্র্যাকের একটি কমিটি গঠিত হয়। সেখানে দেশি-বিদেশি কয়েকজন এঙ্পার্ট নেওয়া হয়। তাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্চ করেছিলেন। যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন, তখন কয়েকজন শিক্ষককে তাঁরা ডাকলেন। তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয় না করে যুগোপযোগী এবং আমাদের দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা যায়। আলোচনাগুলো বেশ ফলপ্রসূ ছিল এবং আমরা আমাদের অভিমত জ্ঞাপন করেছিলাম। আমরা অভিমত দিয়েছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ রেখে গড়ে তোলা উচিত। এর মধ্যে বিদেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়ানোর সুযোগ হয়। বিশেষ করে পাঁচবার আমি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম- নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। সর্বশেষ দেশে ফিরে আসার আগে আমি সাউথ চায়না হংকংয়ে তিন বছর ছিলাম। বিদেশে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এ রকম কোনো মতভেদ নেই। ইউনিভার্সিটি মানে হচ্ছে Cultivate the knowledge, exchange the knowledge, innovation the knowledge. Irrespective of public and private. যেখানে ভালো শিক্ষা, সেখানে শিক্ষার্থীরা যাবে। আর এত সস্তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কোথাও হয় না, যা গরিব দেশগুলোয় হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তারা হাসে যে ১২ টাকা টিউশন ফি কী করে হয়? ২৫ টাকা টিউশন ফি করে এই গরিব দেশ কী করে চালায়? ইতিমধ্যেই কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ডেভেলপ করেছে। তার মধ্যে আমারই একজন শিক্ষক ড. মজিদ খান। আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তিনি হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি তৈরি করলেন। প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষার জন্য যারা বিদেশে বা উন্নত দেশগুলোয় যাচ্ছে, তারা মাস্টার ডিগ্রি বা পিএইচডির জন্য যাচ্ছে। এরপর তারা কর্মজীবনে চলে যায়। তাদের অধিকাংশই পার্টটাইম স্টুডেন্ট। ফুলটাইম স্টুডেন্ট খুবই কম। যারা ছাত্র হয় মাস্টার্স করার জন্য তারা রিসার্চভিত্তিক স্টুডেন্ট। ওই বিষয়ের মাস্টার হিসেবে তারা দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা যেটা দিচ্ছি সেটা সাময়িকভাবে বেকার সমস্যা ঘোচানোর জন্য আরো দুই বছর। তিন বছর থেকে একটি কাজের মধ্যে থাকা- এই মানসিকতা থেকে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষাকে আমি খারাপ বলব না এ জন্য যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো প্রোডাকশন দিচ্ছে। কিন্তু প্রথম যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল, তখন আমি একটি জিনিস লক্ষ করেছি। ক্রেডিট ট্রান্সফার একটি সিস্টেম। যারা বিদেশে যেতে পারে না, নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী, কিন্তু মা-বাবার অর্থ আছে, তাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হবে। দু-তিনটি ক্রেডিট হলে ট্রান্সফার করে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। অর্থাৎ বিদেশে যাওয়ার একটি দিকনির্দেশনা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি দিয়ে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। আমি দুটির মধ্যে খুব পার্থক্য করতে চাই না। আমার একটি প্রশ্ন হলো, সরকার যেভাবে ইউনিভার্সিটির সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, সেই হারে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। কারা এ বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে, কারা পড়াবে? বলতে পারেন, তাহলে কি আমাদের শিক্ষার্থী বের হচ্ছে না? হচ্ছে। কিন্তু আমাদের যেসব ভালো ছাত্র বাইরে যাচ্ছে, তারা আর ফিরে আসছে না।
সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষার মান, প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা এবং শিক্ষার দেশজকরণ। আমার দেশে কী ধরনের শিক্ষা মানুষের জন্য প্রয়োজন, সেটা আগে ঠিক করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা কি বিদ্যমান কারিকুলাম নিয়ে সন্তুষ্ট?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : এই কারিকুলাম একটি সার্টিফিকেটভিত্তিক কারিকুলাম। আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নই। আমি একটি কথা বারবার বলতে চাই, আমাদের এডুকেশনটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলতে হবে। আমি কিছুক্ষণ আগে ছাত্রদের বলেছি, তোমরা বিশেষ ক্লাস অব পিপলের স্টুডেন্ট। তোমরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় করার পরে ছাত্রদের কমিউনিটি সার্ভিসের সঙ্গে নিযুক্ত করেছি। আমার কথা হলো, ইন্টাররকিং করো ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে। এ ছাড়া কিন্তু স্টেবল হবে না। তোমরা অন্তত মাসে একবার ভলান্টারি সার্ভিস দাও।
কালের কণ্ঠ : ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন থেকে আপনারা কী ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন থেকে যা পাই, সেটা হলো তারা একটি তদারকি করে আমাদের ওপর। সে তদারকির প্রকৃতিটা হচ্ছে, আমরা কী পড়াচ্ছি, সিলেবাস ঠিক আছে কি না। শিক্ষকরা ঠিকমতো আসেন কি না- এসব কাগজপত্র দেখেন। জনসংখ্যার স্বল্পতার জন্য তাঁরা আসতে পারেন। সেটা সত্যি কথা। কিন্তু ইউজিসির যে ভূমিকা সেটা সঠিকভাবে পালিত হয় না। বাইরের দেশগুলোয় হয়। অর্থাৎ কোয়ালিটি অব এডুকেশনকে সুনিশ্চিত করতে হলে যে বিষয়গুলো তদারক করা দরকার, সেগুলো কিন্তু পাবলিক অথবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় হয় না। আমি তো মনে করি, প্রাইভেটের চেয়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির অবস্থা করুণ। এ জন্য করুণ যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের তুলনামূলক স্যালারি বেশি দেওয়া হয় এবং ভালো শিক্ষকদের তারা আনার চেষ্টা করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যেটা ছিল সেটা হলো কোয়ালিফিকেশন অব দ্য টিচার্স। একাডেমিক এক্সিলেন্স। কিন্তু এখন জোর দেওয়া হচ্ছে পার্টিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন এবং আত্মীকরণ, আত্মীয়স্বজন। হাজার হাজার ছাত্র এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ বিষয়গুলো আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। শুধু মন্ত্রণালয়ে বসে কোয়ালিটি অব এডুকেশন বলে স্লোগান দিলে হবে না। প্রান্তিক পর্যায়ে যে শিক্ষা দেবেন শিক্ষার্থীদের এবং কী করে সে শিক্ষা মানসম্মত করা যায়, সেগুলো ঠিক করতে হবে। আর দেখুন, বিদেশে যাওয়ার পথ আমাদের কমে গেছে। স্কলারশিপ কমে গেছে, পিএইচডির জন্য এখন আংশিক দেওয়া হয়। যারা যায় তারা ফিরে আসে না। আর আমাদের দেশের মধ্যে যারা রিসোর্সফুল পার্সন আছেন, তাঁদের নিয়ে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত। গবেষণা হবে এ রকম যে আমাদের দেশের একজন মানুষ কচু খেয়ে বা কচুশাক খেয়ে কত ক্যালরি সংগ্রহ করছে এর ওপর তোমরা থিসিস করো। আমেরিকায় কত পার্সেন্ট মানুষ ডেটিং করে সুইসাইড করছে আমার কাছে সেটা মুখ্য নয়। অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক নয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে থিসিস করলে আমাদের দেশে ওই থিসিসের ফলাফল উন্নয়নে কাজে লাগবে এবং সেটা আমাদের দেশের এঙ্পার্ট দিয়েই করাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। কোনোটির হয়তো ফ্যাকাল্টি নিয়ে, কোনোটির চত্বর নিয়ে দুর্নাম আছে। আবার কোনোটি হয়তো বিদেশের মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইন্টার্যাকশন তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে আপনার এই প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায়?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আমার এখানে আসা প্রায় দেড় বছরের মতো হলো। আসার আগে আমি হংকংয়ে ডিন অব সোশ্যাল সায়েন্সের দায়িত্ব পালন করেছি। এখানে এসেই আমি সরকারের এবং ইউরোপীয় কমিশনের একটি প্রকল্প ছিল 'খাদ্য ও পুষ্টি', সেটির সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে আমাকে তারা নিয়োগ দেয়। প্রথমে আমি বললাম, 'আমাকে ক্ষমা করবেন, খাদ্যপুষ্টির ওপর আমার কোনো জ্ঞান নেই। কোনো লাভ হবে না। তারা তার পরও আমাকে দিল। ওরা আমাকে একটা গাড়ি দিল। আমি অঞ্চলগুলো ঘুরতে শুরু করলাম, প্রথমে সিলেটে গেলাম। দেখতে গেলাম, সিলেটে কত পার্সেন্ট ল্যান্ড ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কত পার্সেন্ট হচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের এলাকা বিয়ানীবাজারে গেলাম। দেখলাম সেখানে কমবেশি ৪৫ শতাংশ জমির কোনো ব্যবহার হচ্ছে না। জানতে চাইলাম জমির মালিক কারা। আমাকে জানানো হলো, বিদেশ থাকে। বিদেশ মানে ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় থাকে। কোনো জমি চাষ হয় না বর্গা দিলে দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে। যেখানে ৭০ শতাংশ কৃষকের চাষ করার জমি নেই, সেখানে কেন ওই জমি পতিত পড়ে থাকবে? খাদ্য ও পুষ্টির জন্য প্রথম কথা হলো, আমার দেশের জমি যে কাউকে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন ওটা নিয়ে আমার সঙ্গে মতবিরোধ হলো এবং আমি চলে এলাম। এখানে আমাকে ডাকা হলো। এখানে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হলো। দায়িত্ব নিয়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। একটা দিক হলো কোয়ালিফাই টিচার (সিনিয়র টিচার) পাওয়া খুব মুশকিল। আমাদের ল ফ্যাকাল্টি খুবই সমৃদ্ধ। এখানে আড়াই থেকে তিন হাজার ছাত্র রয়েছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের নিয়ে আমি এটা ডেভেলপ করছি। এ বিষয়ে তেমন বড় প্রফেসরের সংখ্যা বাংলাদেশে মুষ্টিমেয়। কিন্তু আমাদের ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। আমি এবার তিনজনকে এমফিলে নিয়োজিত করেছি। আমি রিসার্চ ইন্ট্রোডিউস করেছি। মাস্টার্সে প্রত্যেককে থিসিস করতে হবে। নীলক্ষেতে যাওয়া যাবে না। আমি নিজে একটি রিসার্চ মেথোলজি কোর্স করলাম। শিক্ষকদের আগে ট্রেনিং দিলাম। কিন্তু এর পরও আমার জন্য এ কাজ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ঠিক পিওর সায়েন্স নয়। এটি পেরিফেরি সায়েন্স। অর্থাৎ যে সায়েন্স পড়লে চাকরি পাওয়া যাবে। কেমিস্ট্রি নয়, ম্যাথ নয়, ফিজিঙ্ও নয়। এ সায়েন্স হচ্ছে জব ওরিয়েন্টেড সায়েন্স। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্রই এ কথা প্রযোজ্য। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা পড়ানো হয় না, যেটা আমার মাতৃভাষা। খুঁজে দেখুন কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা হতে হবে বৈশ্বিক। মনে রাখতে হবে, আমরা শুধু এ দেশের জন্য শিক্ষার্থী গড়ে তুলছি না। আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র গড়ে তুলব। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, আমাদের কোনো সম্পদ নেই, আমরা মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চাই। আমি মনে করি, এ শিক্ষা দিলে সম্পদের চেয়ে লায়াবিলিটি বেশি।
কালের কণ্ঠ : বৈশ্বিক শিক্ষার কথা বললেন। সেটা অর্জনে আমরা কতটা এগিয়েছি, কতটা ঘাটতি রয়েছে?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আপনাকে পরিসংখ্যানের হিসাব থেকে দেওয়া যাবে না। কতগুলো বিষয় থাকে আমরা ফ্যাক্ট থেকে অনুধাবন করি। যেমন আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে, আপনি কতটা সন্তুষ্ট হচ্ছেন তা পার্সেন্টেজ দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না। আমি হংকংয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেটি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। সেখানে সিলেবাস প্রণয়ন করা হতো আজকে যে স্টুডেন্ট প্রথম বর্ষে, সে আরো ৫০ বছর পৃথিবীতে বাঁচবে। কোথায় থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে চীনেও থাকতে পারে, ভারতেও থাকতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রেও থাকতে পারে, অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে পারে। গ্লোবাল সিলেবাসকে একসঙ্গে করুন। আগে আমার দেশের, সেই সঙ্গে কিছুটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লেবার ছিল, যাতে ভবিষ্যতে ওইখানে তার জন্য কাজের উপযুক্ত হয়। সেভাবে কারিকুলাম ডেভেলপ করা গেলে আমাদের প্রোডাকশন বাজারেও বেচা যাবে, ক্রেতাও পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন আমরা যা তৈরি করছি তার ক্রেতা নেই।
কালের কণ্ঠ : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া ব্যয়বহুল বলে আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে দেশের ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী দরিদ্র। প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য কিভাবে কনট্রিবিউট করছে?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আপনার আমার কথায় বিশ্বাস করার দরকার নেই। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে কম রেটে পড়ানো হয়। এর পরও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় দিয়ে থাকি। আমরা রেজাল্টের ওপর ছাড় দিই, মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের জন্য ছাড় দিই। তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য ছাড় দিই। যতটুকু পারা যায়। আমার নিজের এ ব্যাপারে দুর্বলতা রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রদের জন্য। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগে চার লাখ টাকা, আমার লাগে দেড়-দুই লাখ টাকা। অবশ্যই আমরা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
কালের কণ্ঠ : বাংলাদেশে দেখতে দেখতে অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেল। এগুলোর ভূত ও ভবিষ্যৎ আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে কেমন দেখছেন?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আমার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭৪ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্য দিয়ে। প্রথম যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণাটির আমাদের মধ্যে অঙ্কুরোদ্গম হয়, তখন ব্র্যাক একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। সেটা হলো আশির দশকের প্রথম দিকে। আমার যতটুকু মনে পড়ে, ব্র্যাকের একটি কমিটি গঠিত হয়। সেখানে দেশি-বিদেশি কয়েকজন এঙ্পার্ট নেওয়া হয়। তাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্চ করেছিলেন। যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলেন, তখন কয়েকজন শিক্ষককে তাঁরা ডাকলেন। তাঁদের মধ্যে আমিও ছিলাম। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল গতানুগতিক বিশ্ববিদ্যালয় না করে যুগোপযোগী এবং আমাদের দেশের উন্নয়নের প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা যায়। আলোচনাগুলো বেশ ফলপ্রসূ ছিল এবং আমরা আমাদের অভিমত জ্ঞাপন করেছিলাম। আমরা অভিমত দিয়েছিলাম যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনীয়তার দিকে লক্ষ রেখে গড়ে তোলা উচিত। এর মধ্যে বিদেশে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়ানোর সুযোগ হয়। বিশেষ করে পাঁচবার আমি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম- নিউজিল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে। সর্বশেষ দেশে ফিরে আসার আগে আমি সাউথ চায়না হংকংয়ে তিন বছর ছিলাম। বিদেশে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে এ রকম কোনো মতভেদ নেই। ইউনিভার্সিটি মানে হচ্ছে Cultivate the knowledge, exchange the knowledge, innovation the knowledge. Irrespective of public and private. যেখানে ভালো শিক্ষা, সেখানে শিক্ষার্থীরা যাবে। আর এত সস্তা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কোথাও হয় না, যা গরিব দেশগুলোয় হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তারা হাসে যে ১২ টাকা টিউশন ফি কী করে হয়? ২৫ টাকা টিউশন ফি করে এই গরিব দেশ কী করে চালায়? ইতিমধ্যেই কয়েকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা ডেভেলপ করেছে। তার মধ্যে আমারই একজন শিক্ষক ড. মজিদ খান। আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তিনি হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্ট। তিনি ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি তৈরি করলেন। প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষার জন্য যারা বিদেশে বা উন্নত দেশগুলোয় যাচ্ছে, তারা মাস্টার ডিগ্রি বা পিএইচডির জন্য যাচ্ছে। এরপর তারা কর্মজীবনে চলে যায়। তাদের অধিকাংশই পার্টটাইম স্টুডেন্ট। ফুলটাইম স্টুডেন্ট খুবই কম। যারা ছাত্র হয় মাস্টার্স করার জন্য তারা রিসার্চভিত্তিক স্টুডেন্ট। ওই বিষয়ের মাস্টার হিসেবে তারা দাবি করতে পারে। কিন্তু আমরা যেটা দিচ্ছি সেটা সাময়িকভাবে বেকার সমস্যা ঘোচানোর জন্য আরো দুই বছর। তিন বছর থেকে একটি কাজের মধ্যে থাকা- এই মানসিকতা থেকে। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষাকে আমি খারাপ বলব না এ জন্য যে কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ভালো প্রোডাকশন দিচ্ছে। কিন্তু প্রথম যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছিল, তখন আমি একটি জিনিস লক্ষ করেছি। ক্রেডিট ট্রান্সফার একটি সিস্টেম। যারা বিদেশে যেতে পারে না, নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী, কিন্তু মা-বাবার অর্থ আছে, তাদের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে হবে। দু-তিনটি ক্রেডিট হলে ট্রান্সফার করে অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। অর্থাৎ বিদেশে যাওয়ার একটি দিকনির্দেশনা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি দিয়ে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসে প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। আমি দুটির মধ্যে খুব পার্থক্য করতে চাই না। আমার একটি প্রশ্ন হলো, সরকার যেভাবে ইউনিভার্সিটির সংখ্যা বৃদ্ধি করছে, সেই হারে মানসম্পন্ন শিক্ষক নেই। কারা এ বিশ্ববিদ্যালয় চালাবে, কারা পড়াবে? বলতে পারেন, তাহলে কি আমাদের শিক্ষার্থী বের হচ্ছে না? হচ্ছে। কিন্তু আমাদের যেসব ভালো ছাত্র বাইরে যাচ্ছে, তারা আর ফিরে আসছে না।
সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষার মান, প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা এবং শিক্ষার দেশজকরণ। আমার দেশে কী ধরনের শিক্ষা মানুষের জন্য প্রয়োজন, সেটা আগে ঠিক করতে হবে।
কালের কণ্ঠ : আপনারা কি বিদ্যমান কারিকুলাম নিয়ে সন্তুষ্ট?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : এই কারিকুলাম একটি সার্টিফিকেটভিত্তিক কারিকুলাম। আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নই। আমি একটি কথা বারবার বলতে চাই, আমাদের এডুকেশনটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলতে হবে। আমি কিছুক্ষণ আগে ছাত্রদের বলেছি, তোমরা বিশেষ ক্লাস অব পিপলের স্টুডেন্ট। তোমরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় করার পরে ছাত্রদের কমিউনিটি সার্ভিসের সঙ্গে নিযুক্ত করেছি। আমার কথা হলো, ইন্টাররকিং করো ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে। এ ছাড়া কিন্তু স্টেবল হবে না। তোমরা অন্তত মাসে একবার ভলান্টারি সার্ভিস দাও।
কালের কণ্ঠ : ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন থেকে আপনারা কী ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশন থেকে যা পাই, সেটা হলো তারা একটি তদারকি করে আমাদের ওপর। সে তদারকির প্রকৃতিটা হচ্ছে, আমরা কী পড়াচ্ছি, সিলেবাস ঠিক আছে কি না। শিক্ষকরা ঠিকমতো আসেন কি না- এসব কাগজপত্র দেখেন। জনসংখ্যার স্বল্পতার জন্য তাঁরা আসতে পারেন। সেটা সত্যি কথা। কিন্তু ইউজিসির যে ভূমিকা সেটা সঠিকভাবে পালিত হয় না। বাইরের দেশগুলোয় হয়। অর্থাৎ কোয়ালিটি অব এডুকেশনকে সুনিশ্চিত করতে হলে যে বিষয়গুলো তদারক করা দরকার, সেগুলো কিন্তু পাবলিক অথবা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোয় হয় না। আমি তো মনে করি, প্রাইভেটের চেয়ে পাবলিক ইউনিভার্সিটির অবস্থা করুণ। এ জন্য করুণ যে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে যে শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হয়, তাদের তুলনামূলক স্যালারি বেশি দেওয়া হয় এবং ভালো শিক্ষকদের তারা আনার চেষ্টা করছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যেটা ছিল সেটা হলো কোয়ালিফিকেশন অব দ্য টিচার্স। একাডেমিক এক্সিলেন্স। কিন্তু এখন জোর দেওয়া হচ্ছে পার্টিক্যাল অ্যাপ্লিকেশন এবং আত্মীকরণ, আত্মীয়স্বজন। হাজার হাজার ছাত্র এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এ বিষয়গুলো আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। শুধু মন্ত্রণালয়ে বসে কোয়ালিটি অব এডুকেশন বলে স্লোগান দিলে হবে না। প্রান্তিক পর্যায়ে যে শিক্ষা দেবেন শিক্ষার্থীদের এবং কী করে সে শিক্ষা মানসম্মত করা যায়, সেগুলো ঠিক করতে হবে। আর দেখুন, বিদেশে যাওয়ার পথ আমাদের কমে গেছে। স্কলারশিপ কমে গেছে, পিএইচডির জন্য এখন আংশিক দেওয়া হয়। যারা যায় তারা ফিরে আসে না। আর আমাদের দেশের মধ্যে যারা রিসোর্সফুল পার্সন আছেন, তাঁদের নিয়ে একটি কার্যকর প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত। গবেষণা হবে এ রকম যে আমাদের দেশের একজন মানুষ কচু খেয়ে বা কচুশাক খেয়ে কত ক্যালরি সংগ্রহ করছে এর ওপর তোমরা থিসিস করো। আমেরিকায় কত পার্সেন্ট মানুষ ডেটিং করে সুইসাইড করছে আমার কাছে সেটা মুখ্য নয়। অর্থাৎ অপ্রাসঙ্গিক নয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে থিসিস করলে আমাদের দেশে ওই থিসিসের ফলাফল উন্নয়নে কাজে লাগবে এবং সেটা আমাদের দেশের এঙ্পার্ট দিয়েই করাতে হবে।
কালের কণ্ঠ : দেশে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ব্যাপক তারতম্য রয়েছে। কোনোটির হয়তো ফ্যাকাল্টি নিয়ে, কোনোটির চত্বর নিয়ে দুর্নাম আছে। আবার কোনোটি হয়তো বিদেশের মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইন্টার্যাকশন তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে আপনার এই প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান কোথায়?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আমার এখানে আসা প্রায় দেড় বছরের মতো হলো। আসার আগে আমি হংকংয়ে ডিন অব সোশ্যাল সায়েন্সের দায়িত্ব পালন করেছি। এখানে এসেই আমি সরকারের এবং ইউরোপীয় কমিশনের একটি প্রকল্প ছিল 'খাদ্য ও পুষ্টি', সেটির সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে আমাকে তারা নিয়োগ দেয়। প্রথমে আমি বললাম, 'আমাকে ক্ষমা করবেন, খাদ্যপুষ্টির ওপর আমার কোনো জ্ঞান নেই। কোনো লাভ হবে না। তারা তার পরও আমাকে দিল। ওরা আমাকে একটা গাড়ি দিল। আমি অঞ্চলগুলো ঘুরতে শুরু করলাম, প্রথমে সিলেটে গেলাম। দেখতে গেলাম, সিলেটে কত পার্সেন্ট ল্যান্ড ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কত পার্সেন্ট হচ্ছে না। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের এলাকা বিয়ানীবাজারে গেলাম। দেখলাম সেখানে কমবেশি ৪৫ শতাংশ জমির কোনো ব্যবহার হচ্ছে না। জানতে চাইলাম জমির মালিক কারা। আমাকে জানানো হলো, বিদেশ থাকে। বিদেশ মানে ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় থাকে। কোনো জমি চাষ হয় না বর্গা দিলে দখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে। যেখানে ৭০ শতাংশ কৃষকের চাষ করার জমি নেই, সেখানে কেন ওই জমি পতিত পড়ে থাকবে? খাদ্য ও পুষ্টির জন্য প্রথম কথা হলো, আমার দেশের জমি যে কাউকে চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। তখন ওটা নিয়ে আমার সঙ্গে মতবিরোধ হলো এবং আমি চলে এলাম। এখানে আমাকে ডাকা হলো। এখানে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করা হলো। দায়িত্ব নিয়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। একটা দিক হলো কোয়ালিফাই টিচার (সিনিয়র টিচার) পাওয়া খুব মুশকিল। আমাদের ল ফ্যাকাল্টি খুবই সমৃদ্ধ। এখানে আড়াই থেকে তিন হাজার ছাত্র রয়েছে। অপেক্ষাকৃত তরুণ শিক্ষকদের নিয়ে আমি এটা ডেভেলপ করছি। এ বিষয়ে তেমন বড় প্রফেসরের সংখ্যা বাংলাদেশে মুষ্টিমেয়। কিন্তু আমাদের ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করতে হবে। আমি এবার তিনজনকে এমফিলে নিয়োজিত করেছি। আমি রিসার্চ ইন্ট্রোডিউস করেছি। মাস্টার্সে প্রত্যেককে থিসিস করতে হবে। নীলক্ষেতে যাওয়া যাবে না। আমি নিজে একটি রিসার্চ মেথোলজি কোর্স করলাম। শিক্ষকদের আগে ট্রেনিং দিলাম। কিন্তু এর পরও আমার জন্য এ কাজ যথেষ্ট কষ্টসাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সায়েন্স ঠিক পিওর সায়েন্স নয়। এটি পেরিফেরি সায়েন্স। অর্থাৎ যে সায়েন্স পড়লে চাকরি পাওয়া যাবে। কেমিস্ট্রি নয়, ম্যাথ নয়, ফিজিঙ্ও নয়। এ সায়েন্স হচ্ছে জব ওরিয়েন্টেড সায়েন্স। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বত্রই এ কথা প্রযোজ্য। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বাংলা পড়ানো হয় না, যেটা আমার মাতৃভাষা। খুঁজে দেখুন কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ানো হয়। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা হতে হবে বৈশ্বিক। মনে রাখতে হবে, আমরা শুধু এ দেশের জন্য শিক্ষার্থী গড়ে তুলছি না। আমরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ছাত্র গড়ে তুলব। আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রায়ই বলেন, আমাদের কোনো সম্পদ নেই, আমরা মানবসম্পদ গড়ে তুলতে চাই। আমি মনে করি, এ শিক্ষা দিলে সম্পদের চেয়ে লায়াবিলিটি বেশি।
কালের কণ্ঠ : বৈশ্বিক শিক্ষার কথা বললেন। সেটা অর্জনে আমরা কতটা এগিয়েছি, কতটা ঘাটতি রয়েছে?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : এ প্রশ্নের জবাব দিতে হলে আপনাকে পরিসংখ্যানের হিসাব থেকে দেওয়া যাবে না। কতগুলো বিষয় থাকে আমরা ফ্যাক্ট থেকে অনুধাবন করি। যেমন আপনার সঙ্গে কথা হচ্ছে, আপনি কতটা সন্তুষ্ট হচ্ছেন তা পার্সেন্টেজ দিয়ে নিরূপণ করা যাবে না। আমি হংকংয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম সেটি ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। সেখানে সিলেবাস প্রণয়ন করা হতো আজকে যে স্টুডেন্ট প্রথম বর্ষে, সে আরো ৫০ বছর পৃথিবীতে বাঁচবে। কোথায় থাকবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সে চীনেও থাকতে পারে, ভারতেও থাকতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রেও থাকতে পারে, অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে পারে। গ্লোবাল সিলেবাসকে একসঙ্গে করুন। আগে আমার দেশের, সেই সঙ্গে কিছুটা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লেবার ছিল, যাতে ভবিষ্যতে ওইখানে তার জন্য কাজের উপযুক্ত হয়। সেভাবে কারিকুলাম ডেভেলপ করা গেলে আমাদের প্রোডাকশন বাজারেও বেচা যাবে, ক্রেতাও পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন আমরা যা তৈরি করছি তার ক্রেতা নেই।
কালের কণ্ঠ : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া ব্যয়বহুল বলে আমরা জানি। এ ক্ষেত্রে দেশের ৬০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী দরিদ্র। প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয় দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য কিভাবে কনট্রিবিউট করছে?
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আপনার আমার কথায় বিশ্বাস করার দরকার নেই। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে কম রেটে পড়ানো হয়। এর পরও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ছাড় দিয়ে থাকি। আমরা রেজাল্টের ওপর ছাড় দিই, মুক্তিযোদ্ধা পোষ্যদের জন্য ছাড় দিই। তালাকপ্রাপ্তা নারীদের জন্য ছাড় দিই। যতটুকু পারা যায়। আমার নিজের এ ব্যাপারে দুর্বলতা রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রদের জন্য। অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগে চার লাখ টাকা, আমার লাগে দেড়-দুই লাখ টাকা। অবশ্যই আমরা দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কথা মাথায় রেখেছি।
কালের কণ্ঠ : আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রফুল্লচন্দ্র সরকার : আপনাদেরও ধন্যবাদ।
No comments