বাজারে ঘোঁট পাকাতে সক্রিয় 'কালো হাত'
রমজানের পণ্য নিয়ে এখনই বড় ধরনের কারসাজি শুরু করেছেন এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী। বড় আমদানিকারক ও মিল মালিকরা হঠাৎ করেই বিভিন্ন পণ্যের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ের ব্যবসায়ীরাও মজুদ করে দাম বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও সামান্য বৃষ্টির দোহাই দিয়েও কোনো কোনো ব্যবসায়ী নানা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানোর এসব কারসাজিতে এবার এগিয়ে আছেন চট্টগ্রামের বড় ব্যবসায়ীরা। ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির করতে চট্টগ্রামের কয়েকজন বড় আমদানিকারক ও মিল মালিক এক মাস ধরে বোতলজাত তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছেন। সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে অগ্রিম টাকা নিয়ে রাখলেও চট্টগ্রামের কয়েকটি মিল এখনো তেল সরবরাহ করেনি তাঁদের। মসুর ডাল, ছোলা ও রসুনের দাম বাড়াতেও কারসাজি করছেন খাতুনগঞ্জের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী। পাইকারি বাজারে চিনির দামে অস্থিরতার পেছনে রয়েছে ঢাকার মৌলভীবাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ীর তৎপরতা।
সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করা হয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক সফিক উল্লাহ স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদন গত ৫ জুলাই বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল নিয়ে কারসাজিতে জড়িত ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তাদের ওপর সূক্ষ্ম নজরদারি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যবসায়ী রমজানে স্থানীয়ভাবে পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর অপকৌশল নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ৯ জেলার ৬৪ জন ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতার কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
'আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য পরিস্থিতি, সরবরাহ ও মজুদ ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের তৎপরতা সম্পর্কিত প্রতিবেদন' শিরোনামের এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ভোজ্য তেল সম্পর্কে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান নূরজাহান অয়েল মিল, রুবাইয়া অয়েল মিল, ইলিয়াস ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপের মেসার্স এমএম অয়েল মিলস ভোজ্য তেল রিফাইন করে বাজারজাত করলেও এক মাস ধরে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বোতলজাত ভোজ্য তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ফলে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সারা দেশে ভোজ্য তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে এবং খুব শিগগির আরো বাড়বে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। কৌশলে বাজারে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা এসব করছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ভোজ্য তেলের সেলস অর্ডার (এসও) সরবরাহও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোজ্য তেলের বাজার চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আমদানিকারক ও রিফাইনারিদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে বেশ কিছু বড় আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান আমদানি প্রক্রিয়া যেমন-এলসি (ঋণপত্র) খোলা, এলসি নিষ্পত্তি করা, পরিশোধন কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে 'ধীরে চলো' পদ্ধতিতে এগোচ্ছে। বর্তমানে রমজান মাসের চাহিদার চেয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাত- উভয়ের সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ কম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকদের কারসাজির কারণে বাজারে সরবরাহ সংকটে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভোজ্য তেল বিক্রির জন্য খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপের রাসেল ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ ও এসএ গ্রুপের কামাল ভেজিটেবল অয়েল গত ফেব্রুয়ারি মাসে অগ্রিম টাকা নিয়েছে। কিন্তু এখনো কম্পানি দুটি সেই তেল সরবরাহ করেনি। এই অজুহাতে খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন। ভোজ্য তেল নিয়ে এ ধরনের কারসাজি রুখতে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
চিনির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ার কোনো তথ্য পায়নি এনএসআই। চিনির সরবরাহ পরিস্থিতি সারা দেশে স্বাভাবিক রয়েছে। রমজান মাসের চাহিদা বিবেচনায় এ বছর সরকারের মজুদও সন্তোষজনক। তবে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী মো. আমিন সম্প্রতি চিনি ও ভোজ্য তেলের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। এর ফলে মৌলভীবাজারে সম্প্রতি চিনির দাম কিছুটা বাড়ে। তবে বাজার কমিটির তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে ওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। রমজানে চিনি নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রোজার আগেই ছোলা, মসুর ডাল ও রসুনের দাম সারা দেশেই বাড়তে শুরু করেছে। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও রমজান মাসে ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অধিক মুনাফা করতে এখনই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব পণ্যের আমদানিকারকরা রমজানে বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াতে কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ী আমদানি করা মসুর ডাল, ছোলা ও রসুন মজুদ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দাম বাড়াচ্ছেন। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হারুন সওদাগরের মালিকানাধীন খাতুনগঞ্জের মেসার্স নিউ বার আউলিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স সততা ট্রেডার্স ও হক সওদাগর।
পেঁয়াজের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা রমজানে পেঁয়াজের মূল্য বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে অতিসম্প্রতি অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়েছেন। ব্যবসায়ীদের এই প্রবণতা এখনই রোধ করতে না পারলে রমজানে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে যাতে পেঁয়াজের দাম বাড়াতে না পারেন, সেজন্য তীক্ষ্ন নজরদারি রাখার পরামর্শ দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তাদের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সম্প্রতি কয়েক দিন ধরে চলা বৃষ্টির অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফালোভী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অথচ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো হওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হওয়ায় বাজারে এর কোনো সংকট নেই।
দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা সদরের বাজারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাজারের বেশ কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে পণ্যের মজুদ ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিম সরবরাহ ঘাটতি সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি মুনাফালোভী এসব ব্যবসায়ী রমজান মাসে পণ্য নিয়ে কারসাজি করে দাম বাড়াতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্থানীয় পর্যায়ের এ ধরনের ব্যবসায়ী ও তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে-
খুলনা : ভৈরব স্ট্যান্ড রোডের বড়বাজারের হাজি মো. আমিনের মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং, এম এ ওহাবের মেসার্স তাজ ট্রেডিং, মুনীর আহমেদের মেসার্স মুনির অ্যান্ড ব্রাদার্স, সিরাজুল ইসলামের মেসার্স আশা স্টোর, শান্তি রঞ্জন কুণ্ডর সন্ধ্যা ভাণ্ডার, আবুল বাশার পাটোয়ারীর মোহাম্মদিয়া ভাণ্ডার, এম এ মতিন পান্নার হেনা বাণিজ্য ভাণ্ডার, অরবিন্দ সাহার সাহা এন্টারপ্রাইজ ও মো. আব্দুল হামিদের মালিকানাধীন নব রূপালী ভাণ্ডার।
কুষ্টিয়া : জেলার বড়বাজারে বিকাশ পাল, বিশ্বনাথ সাহা, বিজয় কুমার আগারওয়াল, নিমাই, শিব বাবু ও সুবল চন্দ্র পাল নামের ব্যবসায়ীসহ দৌলতপুরের আব্দুল শুকুর বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নড়াইল : নড়াইল সদরের হাসানুজ্জামান, আয়ুব খান বুলু, রজিবুল ইসলাম, অশোক কুমার ঘোষ এবং এস এম ওহিদুজ্জামানও মজুদের মাধ্যমে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা এনএসআইয়ের।
সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার বড়বাজারে হাজরা সাধুর সাহা স্টোর, জুনায়েদ হোসেন বায়রনের লস্কর ট্রেডার্স, সিরাজুল ইসলামের ইসলাম ট্রেডার্স ও সততা স্টোর।
সুনামগঞ্জ : নতুন বাজারে অসিত রায়ের অসীম স্টোর, কালীবাড়ি রোডে রঞ্জিত কুমার দাসের দাস ট্রেডার্স, জগন্নাথবাড়ী রোডে গোপাল আচার্য্যর মেসার্স গোপাল আচার্য্য, ষোলঘরের বিমলাল রায়, জগন্নাথবাড়ী রোডের মো. জমিরুল ইসলামের ইসলাম ট্রেডার্স, মুক্তারপাড়ার কানু লাল রায় ও স্টেশন রোডের গৌরাঙ্গ দেব।
রাঙামাটি : তবলছড়ি বাজারে হাজি জহির আহমেদের সওদাগর স্টোর, রিজার্ভ বাজারে ধীমান কান্তি সাহার মেসার্স শ্রীকৃষ্ণ স্টোর, দূরছড়ি বাজারের জাহাঙ্গীর সওদাগর, আবদুল কাদের সওদাগর, মসজিদ মার্কেটের মেসার্স শাহ আলম স্টোর ও কাপ্তাই জেটিঘাটে তোফাজ্জল হোসেনের লালমিয়া স্টোর।
খাগড়াছড়ি : কোর্ট রোডের স্বপন দেবনাথ ট্রেডার্স, মসজিদ রোডের নির্মল দেব ট্রেডার্স, আরামবাগের বি এস ইঞ্জিনিয়ারিং, খাগড়াছড়ি শহরের রণজিৎ অ্যান্ড ব্রাদার্স, শাহজাহান ট্রেডার্স, মামুন স্টোর, নূর আহম্মদ ট্রেডার্স, এজিডি ট্রেডার্স, এন কে স্টোর, রামগড় বাজারের মেসার্স খালেক ট্রেডার্স, শহীদ কাদের সড়কের মেসার্স গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী ট্রেডার্স, পানখাইয়া পাড়ার মেসার্স মো. রফিকুল আলম, খাগড়াছড়ি বাজারের জি এম পপুলার স্টোর, মেসার্স সৈয়দুল হক, মেসার্স মো. গিয়াসউদ্দিন, মেসার্স মো. আল ওসমানী বিবিধ বিতান, সদর উপজেলার মেসার্স হাজী মোহাম্মদ মোজহার ট্রেডার্স ও পানছড়ির মেসার্স মো. মোক্তার হোসেন।
রাজশাহী : সাহেববাজারের ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, শাহাদাৎ ভাণ্ডার, রাজু ট্রেডার্স, বাটার মোড়ের আমান ট্রেডিং ও আসাদুল্লাহ অ্যান্ড ব্রার্দাস।
নাটোর : স্টেশন বাজারের মিতালী স্টোর, হাফরাস্তায় মদন ডাল মিল ও নাটোর শহরের ঘোল অয়েল মিল।
বেপরোয়া ঢাকার ব্যবসায়ীরা
সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে কারসাজির সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের শনাক্ত করা হয়েছে। সংস্থাটির পরিচালক সফিক উল্লাহ স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদন গত ৫ জুলাই বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেনের কাছে পাঠানো হয়েছে। এতে ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, মসুর ডাল নিয়ে কারসাজিতে জড়িত ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে তাদের ওপর সূক্ষ্ম নজরদারি রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলার কিছু ব্যবসায়ী ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব ব্যবসায়ী রমজানে স্থানীয়ভাবে পণ্য মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সরবরাহ সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে দাম বাড়ানোর অপকৌশল নিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ৯ জেলার ৬৪ জন ব্যবসায়ীর সংশ্লিষ্টতার কথাও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে।
'আসন্ন রমজানকে সামনে রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য পরিস্থিতি, সরবরাহ ও মজুদ ব্যবস্থায় ব্যবসায়ীদের তৎপরতা সম্পর্কিত প্রতিবেদন' শিরোনামের এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে ভোজ্য তেল সম্পর্কে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামের ভোজ্য তেল আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান নূরজাহান অয়েল মিল, রুবাইয়া অয়েল মিল, ইলিয়াস ব্রাদার্স, মোস্তফা গ্রুপের মেসার্স এমএম অয়েল মিলস ভোজ্য তেল রিফাইন করে বাজারজাত করলেও এক মাস ধরে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই বোতলজাত ভোজ্য তেল সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ফলে বাজারে বোতলজাত সয়াবিনের সরবরাহে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এর ফলে সারা দেশে ভোজ্য তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে এবং খুব শিগগির আরো বাড়বে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। কৌশলে বাজারে ভোজ্য তেলের কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে অধিক মুনাফা লাভের আশায় তারা এসব করছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে ভোজ্য তেলের সেলস অর্ডার (এসও) সরবরাহও আশঙ্কাজনক হারে কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ভোজ্য তেলের বাজার চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আমদানিকারক ও রিফাইনারিদের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তবে বেশ কিছু বড় আমদানিকারক ও রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান আমদানি প্রক্রিয়া যেমন-এলসি (ঋণপত্র) খোলা, এলসি নিষ্পত্তি করা, পরিশোধন কাজ সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে 'ধীরে চলো' পদ্ধতিতে এগোচ্ছে। বর্তমানে রমজান মাসের চাহিদার চেয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাত- উভয়ের সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ কম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকদের কারসাজির কারণে বাজারে সরবরাহ সংকটে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ভোজ্য তেল বিক্রির জন্য খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চট্টগ্রামের নুরজাহান গ্রুপের রাসেল ভেজিটেবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ ও এসএ গ্রুপের কামাল ভেজিটেবল অয়েল গত ফেব্রুয়ারি মাসে অগ্রিম টাকা নিয়েছে। কিন্তু এখনো কম্পানি দুটি সেই তেল সরবরাহ করেনি। এই অজুহাতে খুলনার পাইকারি ব্যবসায়ীরা ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন। ভোজ্য তেল নিয়ে এ ধরনের কারসাজি রুখতে নজরদারি বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।
চিনির দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ার কোনো তথ্য পায়নি এনএসআই। চিনির সরবরাহ পরিস্থিতি সারা দেশে স্বাভাবিক রয়েছে। রমজান মাসের চাহিদা বিবেচনায় এ বছর সরকারের মজুদও সন্তোষজনক। তবে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী মো. আমিন সম্প্রতি চিনি ও ভোজ্য তেলের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নেওয়া মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছেন। এর ফলে মৌলভীবাজারে সম্প্রতি চিনির দাম কিছুটা বাড়ে। তবে বাজার কমিটির তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপে ওই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। রমজানে চিনি নিয়ে অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আশঙ্কা নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রোজার আগেই ছোলা, মসুর ডাল ও রসুনের দাম সারা দেশেই বাড়তে শুরু করেছে। বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও রমজান মাসে ভোক্তাদের বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে অধিক মুনাফা করতে এখনই দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব পণ্যের আমদানিকারকরা রমজানে বাড়তি চাহিদার সুযোগ নিয়ে দাম বাড়াতে কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছেন। চট্টগ্রামের কয়েকজন আমদানিকারক ও পাইকারি ব্যবসায়ী আমদানি করা মসুর ডাল, ছোলা ও রসুন মজুদ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে দাম বাড়াচ্ছেন। এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে হারুন সওদাগরের মালিকানাধীন খাতুনগঞ্জের মেসার্স নিউ বার আউলিয়া ট্রেডার্স, মেসার্স সততা ট্রেডার্স ও হক সওদাগর।
পেঁয়াজের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়ীরা রমজানে পেঁয়াজের মূল্য বাড়ানোর অপকৌশল হিসেবে পরীক্ষামূলকভাবে অতিসম্প্রতি অযৌক্তিকভাবে দাম বাড়িয়েছেন। ব্যবসায়ীদের এই প্রবণতা এখনই রোধ করতে না পারলে রমজানে পেঁয়াজের দাম আরো বাড়তে পারে। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে যাতে পেঁয়াজের দাম বাড়াতে না পারেন, সেজন্য তীক্ষ্ন নজরদারি রাখার পরামর্শ দিয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাটি। তাদের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, সম্প্রতি কয়েক দিন ধরে চলা বৃষ্টির অজুহাতে ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফালোভী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। অথচ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো হওয়ার পাশাপাশি ভারত থেকে বিপুল পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি হওয়ায় বাজারে এর কোনো সংকট নেই।
দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা সদরের বাজারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাজারের বেশ কিছু পাইকারি ব্যবসায়ী স্থানীয়ভাবে পণ্যের মজুদ ও বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিম সরবরাহ ঘাটতি সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি মুনাফালোভী এসব ব্যবসায়ী রমজান মাসে পণ্য নিয়ে কারসাজি করে দাম বাড়াতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে স্থানীয় পর্যায়ের এ ধরনের ব্যবসায়ী ও তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামও উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছে-
খুলনা : ভৈরব স্ট্যান্ড রোডের বড়বাজারের হাজি মো. আমিনের মেসার্স বাগদাদ ট্রেডিং, এম এ ওহাবের মেসার্স তাজ ট্রেডিং, মুনীর আহমেদের মেসার্স মুনির অ্যান্ড ব্রাদার্স, সিরাজুল ইসলামের মেসার্স আশা স্টোর, শান্তি রঞ্জন কুণ্ডর সন্ধ্যা ভাণ্ডার, আবুল বাশার পাটোয়ারীর মোহাম্মদিয়া ভাণ্ডার, এম এ মতিন পান্নার হেনা বাণিজ্য ভাণ্ডার, অরবিন্দ সাহার সাহা এন্টারপ্রাইজ ও মো. আব্দুল হামিদের মালিকানাধীন নব রূপালী ভাণ্ডার।
কুষ্টিয়া : জেলার বড়বাজারে বিকাশ পাল, বিশ্বনাথ সাহা, বিজয় কুমার আগারওয়াল, নিমাই, শিব বাবু ও সুবল চন্দ্র পাল নামের ব্যবসায়ীসহ দৌলতপুরের আব্দুল শুকুর বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
নড়াইল : নড়াইল সদরের হাসানুজ্জামান, আয়ুব খান বুলু, রজিবুল ইসলাম, অশোক কুমার ঘোষ এবং এস এম ওহিদুজ্জামানও মজুদের মাধ্যমে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা এনএসআইয়ের।
সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরার বড়বাজারে হাজরা সাধুর সাহা স্টোর, জুনায়েদ হোসেন বায়রনের লস্কর ট্রেডার্স, সিরাজুল ইসলামের ইসলাম ট্রেডার্স ও সততা স্টোর।
সুনামগঞ্জ : নতুন বাজারে অসিত রায়ের অসীম স্টোর, কালীবাড়ি রোডে রঞ্জিত কুমার দাসের দাস ট্রেডার্স, জগন্নাথবাড়ী রোডে গোপাল আচার্য্যর মেসার্স গোপাল আচার্য্য, ষোলঘরের বিমলাল রায়, জগন্নাথবাড়ী রোডের মো. জমিরুল ইসলামের ইসলাম ট্রেডার্স, মুক্তারপাড়ার কানু লাল রায় ও স্টেশন রোডের গৌরাঙ্গ দেব।
রাঙামাটি : তবলছড়ি বাজারে হাজি জহির আহমেদের সওদাগর স্টোর, রিজার্ভ বাজারে ধীমান কান্তি সাহার মেসার্স শ্রীকৃষ্ণ স্টোর, দূরছড়ি বাজারের জাহাঙ্গীর সওদাগর, আবদুল কাদের সওদাগর, মসজিদ মার্কেটের মেসার্স শাহ আলম স্টোর ও কাপ্তাই জেটিঘাটে তোফাজ্জল হোসেনের লালমিয়া স্টোর।
খাগড়াছড়ি : কোর্ট রোডের স্বপন দেবনাথ ট্রেডার্স, মসজিদ রোডের নির্মল দেব ট্রেডার্স, আরামবাগের বি এস ইঞ্জিনিয়ারিং, খাগড়াছড়ি শহরের রণজিৎ অ্যান্ড ব্রাদার্স, শাহজাহান ট্রেডার্স, মামুন স্টোর, নূর আহম্মদ ট্রেডার্স, এজিডি ট্রেডার্স, এন কে স্টোর, রামগড় বাজারের মেসার্স খালেক ট্রেডার্স, শহীদ কাদের সড়কের মেসার্স গোলাম মোহাম্মদ চৌধুরী ট্রেডার্স, পানখাইয়া পাড়ার মেসার্স মো. রফিকুল আলম, খাগড়াছড়ি বাজারের জি এম পপুলার স্টোর, মেসার্স সৈয়দুল হক, মেসার্স মো. গিয়াসউদ্দিন, মেসার্স মো. আল ওসমানী বিবিধ বিতান, সদর উপজেলার মেসার্স হাজী মোহাম্মদ মোজহার ট্রেডার্স ও পানছড়ির মেসার্স মো. মোক্তার হোসেন।
রাজশাহী : সাহেববাজারের ফুল মোহাম্মদ ট্রেডার্স, শাহাদাৎ ভাণ্ডার, রাজু ট্রেডার্স, বাটার মোড়ের আমান ট্রেডিং ও আসাদুল্লাহ অ্যান্ড ব্রার্দাস।
নাটোর : স্টেশন বাজারের মিতালী স্টোর, হাফরাস্তায় মদন ডাল মিল ও নাটোর শহরের ঘোল অয়েল মিল।
বেপরোয়া ঢাকার ব্যবসায়ীরা
No comments