বীর মুক্তিযোদ্ধা-তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না
৪৪৯ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। মোহাম্মেদ দিদারুল আলম, বীর প্রতীক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লা জেলার সদর উপজেলার পাঁচথুড়ি ইউনিয়নের অন্তর্গত দুই গ্রাম আমড়াতলী-কৃষ্ণপুর। গোমতী নদীর উত্তর পারে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে। ওপারে ভারতের মতিনগর ও কোণাবন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মতিনগরে ছিল মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টরের একটি সাব-সেক্টর। ওই ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই সীমান্ত অতিক্রম করে আমড়াতলী-কৃষ্ণপুর গ্রামে এসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টহল দলের ওপর আক্রমণ চালাতেন।
১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। সকালে মতিনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মোহাম্মেদ দিদারুল আলম খবর পেলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল আমড়াতলী-কৃষ্ণপুরে এসেছে। তাদের সঙ্গে আছে স্থানীয় দোসর ও রাজাকার। সেনারা পাঞ্জাব রেজিমেন্টের, তারা সংখ্যায় সব মিলে আনুমানিক ৪০০ জন।
সেদিন শিবিরে খুব বেশি মুক্তিযোদ্ধা নেই। সব মিলে ১০০ জনের মতো। তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন পেশাদার। বাকি সবাই স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এতে মোহাম্মেদ দিদারুল আলম দমে গেলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে শক্তি আছে তা নিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণের। সহযোদ্ধাদের তিনি দ্রুত তৈরি হতে বললেন। তাঁরা দ্রুতই তৈরি হলেন।
তারপর সীমান্ত অতিক্রম করে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ওপর আক্রমণ চালালেন। তখন সকাল আনুমানিক ১০টা। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা হকচকিত। সেটা অবশ্য কিছু সময়ের জন্য। তারা যে যেভাবে পারল পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাম্মেদ দিদারুল আলমের নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকলেন।
যুদ্ধ চলল সারা দিন। সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের ওপারে চলে গেলেন। কারণ, তাঁদের গোলাগুলি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য বাধ্য হয়েই তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
পাকিস্তানি সেনারা ফিরে যাওয়ার সময় রাতে পাশের একটি গ্রামে হামলা চালায়। গ্রামে কেউ ছিল না। তবে একটি বাড়িতে অনেক শরণার্থী ভারতে যাওয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। সেনাদের নির্বিচার গুলিতে প্রায় ৪০-৪২ জন নিরপরাধ নারী-পুরুষ শরণার্থী শহীদ হন।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকায়। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে চাঁদপুরে গিয়ে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। চাঁদপুর ও লাকসামের কাছে বাগমারাসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।
পরে ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি ২ নম্বর সেক্টরের মতিনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ দল ‘মুজিব ব্যাটারি’-তে অন্তর্ভুক্ত হন। অনেক গেরিলা এবং খণ্ডযুদ্ধ, অ্যাম্বুশ, ডিমলিশন, আর্টিলারি যুদ্ধ তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কুমিল্লা জেলার কোটেশ্বর ও চট্টগ্রাম জেলার নাজিরহাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত কোটেশ্বরের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মেদ দিদারুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৬। গেজেটে নাম দিদারুল আলম।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮০ সালে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলমের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার মুছাপুর গ্রামে। বর্তমানে ঢাকায় (অ্যাপার্টমেন্ট এ৪, প্লট বি৪২, সড়ক ১এ, বনানী) বাস করেন। তাঁর বাবার নাম ফজলুল হক, মা হালিমা খাতুন। স্ত্রী পারভিন সুলতানা। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: মোহাম্মেদ দিদারুল আলম বীর প্রতীক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। সকালে মতিনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মোহাম্মেদ দিদারুল আলম খবর পেলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল আমড়াতলী-কৃষ্ণপুরে এসেছে। তাদের সঙ্গে আছে স্থানীয় দোসর ও রাজাকার। সেনারা পাঞ্জাব রেজিমেন্টের, তারা সংখ্যায় সব মিলে আনুমানিক ৪০০ জন।
সেদিন শিবিরে খুব বেশি মুক্তিযোদ্ধা নেই। সব মিলে ১০০ জনের মতো। তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন পেশাদার। বাকি সবাই স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এতে মোহাম্মেদ দিদারুল আলম দমে গেলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, যে শক্তি আছে তা নিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণের। সহযোদ্ধাদের তিনি দ্রুত তৈরি হতে বললেন। তাঁরা দ্রুতই তৈরি হলেন।
তারপর সীমান্ত অতিক্রম করে তাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ওপর আক্রমণ চালালেন। তখন সকাল আনুমানিক ১০টা। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা হকচকিত। সেটা অবশ্য কিছু সময়ের জন্য। তারা যে যেভাবে পারল পজিশন নিয়ে পাল্টা আক্রমণ শুরু করল। মুক্তিযোদ্ধারা মোহাম্মেদ দিদারুল আলমের নেতৃত্বে সাহসিকতার সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ মোকাবিলা করতে থাকলেন।
যুদ্ধ চলল সারা দিন। সন্ধ্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের ওপারে চলে গেলেন। কারণ, তাঁদের গোলাগুলি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ জন্য বাধ্য হয়েই তাঁরা পশ্চাদপসরণ করেন। সেদিন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েকজন নিহত ও অনেকে আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ হতাহত হননি।
পাকিস্তানি সেনারা ফিরে যাওয়ার সময় রাতে পাশের একটি গ্রামে হামলা চালায়। গ্রামে কেউ ছিল না। তবে একটি বাড়িতে অনেক শরণার্থী ভারতে যাওয়ার জন্য আশ্রয় নিয়েছিল। সেনাদের নির্বিচার গুলিতে প্রায় ৪০-৪২ জন নিরপরাধ নারী-পুরুষ শরণার্থী শহীদ হন।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলম চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকায়। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঢাকা থেকে পালিয়ে চাঁদপুরে গিয়ে স্থানীয় প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। চাঁদপুর ও লাকসামের কাছে বাগমারাসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তান সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন।
পরে ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি ২ নম্বর সেক্টরের মতিনগর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মুক্তিবাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ দল ‘মুজিব ব্যাটারি’-তে অন্তর্ভুক্ত হন। অনেক গেরিলা এবং খণ্ডযুদ্ধ, অ্যাম্বুশ, ডিমলিশন, আর্টিলারি যুদ্ধ তাঁর নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে কুমিল্লা জেলার কোটেশ্বর ও চট্টগ্রাম জেলার নাজিরহাটের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য।
মুক্তিযুদ্ধে বিশেষত কোটেশ্বরের যুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য মোহাম্মেদ দিদারুল আলমকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ সনদ নম্বর ১৬। গেজেটে নাম দিদারুল আলম।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলম স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৮০ সালে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হন। তখন তাঁর পদবি ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল।
মোহাম্মেদ দিদারুল আলমের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার মুছাপুর গ্রামে। বর্তমানে ঢাকায় (অ্যাপার্টমেন্ট এ৪, প্লট বি৪২, সড়ক ১এ, বনানী) বাস করেন। তাঁর বাবার নাম ফজলুল হক, মা হালিমা খাতুন। স্ত্রী পারভিন সুলতানা। তাঁদের এক মেয়ে ও এক ছেলে।
সূত্র: মোহাম্মেদ দিদারুল আলম বীর প্রতীক, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২ এবং মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান বীর প্রতীক।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
trrashed@gmail.com
No comments