কল্পকথার গল্প-ক্রিকেট-জ্বর পুড়ছে ঘর by আলী হাবিব

নিপাট ভদ্রলোক বলতে যা বোঝায়, তেমনি এক ভদ্রলোকের কথা কল্পনা করা যাক। ঘরে-বাইরে নির্বিবাদী মানুষ। সাত চড়ে রা নেই। সমস্যা একটাই_স্বপ্ন দেখেন তিনি। জীবনে অনেক কিছু হতে চেয়েছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে 'মানি না, মানব না' বলে আকাশের দিকে মুঠো তুলে মিছিলে যাননি। নেতা হতে চাননি।


তবে অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন। স্কুল-কলেজের বার্ষিক নাটকে অভিনয় করতেন। ওই পর্যন্তই। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে আসার পর মঞ্চে ওঠার সুযোগ পাননি। হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়। পারেননি। তাঁর ছেলেবেলায় অভিভাবকরা চাইতেন ছেলেরা লেখাপড়া করবে। লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। তবে মাঠে যেতেন। খেলতে নয়, খেলা দেখতে। বাইরে থেকে তালে তালে তালি বাজাতেন। উপভোগ করতেন খেলা। একসময় স্টেডিয়ামে গিয়ে নিয়মিত খেলা দেখতেন। আজকাল আর যাওয়া হয়ে ওঠে না। আজ তিনি নিতান্তই ছাপোষা মানুষ। অফিস-বাসা, বাসা-অফিস, এর বাইরে কোনো জগৎ নেই তাঁর। একেবারে নেই বলা যাবে না। আছে। স্বপ্নের এক জগৎ আছে। সে জগতে তিনিই অধীশ্বর। সেখানে কারো প্রবেশাধিকার নেই। খেলার মাঠে যাওয়া ছেড়ে দিলেও খেলা দেখা ছাড়েননি তিনি। বাড়িতে বসে টিভির পর্দায় নিয়মিত খেলা দেখেন।
আধুনিক জীবনধারা এই এক সুযোগ এনে দিয়েছে। হাতের মুঠোয় বিশ্বের সব খেলা। সময় জেনে দেখে নিলেই হলো। সময়মতো দেখতে না পারলে পরে রিপ্লে দেখে নেন। এ নিয়ে সংসারে অনেক অশান্তি হয়েছে। তিনি যখন খেলা দেখার জন্য গুছিয়ে বসছেন, তখন হয়তো গিনি্নর পছন্দের কোনো সিরিয়াল চলছে। কখনো আবার ছেলেমেয়েদের কার্টুন দেখার সময়। নিরীহ-নির্বিবাদী ভদ্রলোক টিভিতে খেলা দেখার সময় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন গভীর রাত। সেখানেও বিপত্তি। রাতে স্ত্রী যখন ঘুমোতে যান ক্লান্ত হয়ে। স্বাভাবিকভাবেই ড্রইংরুম থেকে টেলিভিশনের আওয়াজ এলে তিনি আপত্তি করেন। ভদ্রলোক এটাও মানিয়ে নিয়েছেন। টিভির ভলিউম যতটা পারা যায় কমিয়ে রাখেন। একেবারে মিউট করে রাখা যায় না। তাতে খেলার সঙ্গে যোগসূত্রটা ঠিক যেন গড়ে ওঠে না। কেমন যেন ছাড়া-ছাড়া মনে হয়। কাজেই টিভির ভলিউম কমিয়ে তিনি খেলা দেখেন। ক্রিকেট খেলা হলে তো আর কথাই নেই। বাংলাদেশ যেদিন আইসিসি ট্রফি জিতে আনে, সেদিন থেকেই তিনি ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলার ভক্ত। বাংলাদেশ খেলায় হেরে গেলে মনে কষ্ট পান। জিতলে বেশ আমেজে থাকেন। মনে হয়, নিজে খেলার মাঠে ছিলেন। নিজে খেলেছেন। দলকে জিতিয়ে এনেছেন। রাতে খেলা দেখে সকালে স্ত্রীকে বলেন, 'রাতটা তো ঘুমিয়ে কাটালে। দেখলে না। আমাদের পারফরম্যান্স যদি দেখতে। অসাধারণ! হেরেছি, তবে দেখিয়ে দিয়েছি।' ভদ্রলোকের স্ত্রী আবার বিপরীত স্বভাবের। সহজে কোনো কিছুতে উচ্ছ্বাসে ভেসে যান না। স্বামীর কথা শুনে বেশ ঠাণ্ডা চোখে তাকান। আস্তে করে বলেন, 'তুমিও মাঠে ছিলে মনে হয়? কত রান করেছ? কয়টা উইকেট নিয়েছ?' স্ত্রীর অব্যর্থ গুগলিতে খাপ খুলতে গিয়েও নিজেকে গুটিয়ে নেন ভদ্রলোক। লাভ নেই। অফিসে গিয়ে আবার সেই 'আমাদের খেলা' বলতে গিয়ে বিপত্তি। সবাই বলে, 'আপনি খেলেছিলেন মনে হয়'।
সেই থেকে ভদ্রলোক ক্রিকেট খেলা নিয়ে কাউকে কিছু বলতে যান না। নিজে ক্রিকেটের কিছু শব্দ শিখে নিয়েছেন। মাঠে খেলতে না পারলে কী হবে_নিজের জীবনে শব্দগুলো ব্যবহার করেন। দিনের শুরু থেকেই নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। বাংলাদেশে বিশ্বকাপ হবে_এ খবর যেদিন শুনেছেন, সেদিন থেকেই শব্দগুলো আরো ভালো করে প্র্যাকটিস করা শুরু করেছেন। রীতিমতো ক্রিকেট-জ্বরে পেয়ে বসেছে তাঁকে। জেগে তিনি ক্রিকেট নিয়ে ভাবেন। ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেন ক্রিকেট। বাড়িতে ফিরে টিভির সামনে ক্রিকেট দেখতে বসেন। খবরের কাগজে ক্রিকেটের খবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। নিজে খেলোয়াড় হতে পারেননি। ব্যক্তিগত জীবনে খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করেন। ক্রিকেটার ভাবেন নিজেকে। ক্রিকেটের পরিভাষায় কথা বলার চেষ্টা করেন। জীবনটা তাঁর কাছে টেস্ট খেলা। প্রতিটি দিন তাঁর কাছে একেকটা ওয়ান ডে। বাড়িতে বা অফিসে আলাদা আলাদা যেটুকু সময় কাটান, এটা হচ্ছে 'টি-টোয়েন্টি'। সকালে ঘুম থেকে জেগে নিজেই নিজেকে বলেন, 'আরেকটা নতুন ইনিংস শুরু হলো হে। দেখেশুনে ব্যাট কোরো।' নাশতার টেবিলে নাশতা দিতে দেরি হয়ে যায়। রুটি আসে তো ভাজি আসে না। ভদ্রলোক মনে মনে বলেন, একেবারেই 'স্লো ডেলিভারি'। দিনের পর দিন একই খাবার খেতে খেতে নিজের মনে নিজেই ভাবেন, একেবারে ডেড পিচ। কোনো টার্ন নেই। বাড়ির বাইরে কারো সঙ্গে খেলার আলাপ না জমলে মনে মনে বলেন, 'আউটফিল্ড বড্ড স্লো'। অফিসে যাওয়ার সময় বা অফিস ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময় বাস ধরার জন্য রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। প্রতিদিনের যুদ্ধ এটা। ভদ্রলোক বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে ভাবেন, আজ আর বাসটাকে কোনোভাবেই আউট সুইং করে বেরিয়ে যেতে দেব না। গতকাল অল্পের জন্য হ্যান্ডেলটা ক্যাচ করা যায়নি। মিস হয়ে গেছে। আজ আর সেটা হতে দেওয়া যাবে না। যেকোনোভাবেই হোক, ক্যাচ করতে হবেই। হ্যান্ডেল ক্যাচ করার পর যদি ফুট ওয়ার্কটা ঠিকমতো করা যায়, তাহলে আজ আর বাস মিস হবে না। আগে থেকেই ফ্লাইটটা ঠাওরে নিতে হবে। এভাবে রোজ তিনি নিজেকে ক্রিকেটার ভেবে দিন কাটিয়ে দেন। 'ইট ক্রিকেট, ড্রিংক ক্রিকেট' বিজ্ঞাপনের মতো তিনি ক্রিকেটে মজে আছেন। বাস ধরার সঙ্গে ক্রিকেটের মিল নিয়ে গল্প করতে গিয়েছিলেন নিজের বাড়িতে। রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে শুরুও করেছিলেন।
'আজকে যা হলো না, কী বলব। বাসটা ছাড়বে ছাড়বে করছে। দেখছি, অনেক লোকের ভিড়। সবাই ওঠার চেষ্টা করছে। আমি ঠিকমতো টার্গেট করেছি। হ্যান্ডেলটা ক্যাচ করব। তারপর নিপুণ ফুটওয়ার্কে ফুট বোর্ডে পা রাখতে পারলেই হলো। ব্যস, আর ভাবতে হবে না। আস্তে করে উঠে যাব। একটুর জন্য মিস হয়ে গেল। না, হ্যান্ডেল ক্যাচ করেছিলাম। কিন্তু ফুটওয়ার্কের ফিনিশিংটা ঠিকমতো হলো না। হাত ফসকে বেরিয়ে গেল। মিস।' ভদ্রলোক বেশ গুছিয়ে বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ স্ত্রীর চোখে চোখ পড়ে যেতেই চুপসে গেলেন। এরপর আর ফ্রন্ট ফুটে যাওয়া ঠিক হবে না। স্টাম্পড হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি। কেন যে ক্রিকেটের স্পিরিট এই ভদ্রমহিলা ঠিক ধরতে পারেন না, বুঝতে পারেন না তিনি। নিজেকে গুটিয়ে নেন। এখানে হাত খুলে খেলা যাবে না। তাড়াতাড়ি খাওয়ার ইনিংস শেষ করে তিনি চলে যান ড্রইংরুমে। খেলা দেখতে বসে যান। এটার নাম তিনি দিয়েছেন 'নেট প্র্যাকটিস'। কাল সকালের ইনিংসটা যেন নতুন করে শুরু করা যায়, তার জন্য প্রস্তুত করেন নিজেকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধোয়াটা হচ্ছে তাঁর কাছে ওয়ার্ম-আপ করা। বিছানা ছাড়ার পর এক কাপ গরম চা জুটলে সেটা তার জন্য টসে জেতা। টসে জিতলে মেজাজটা বেশ ফুরফুরে থাকে। সেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চা পেলেন হাতের কাছে। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবেন, টস ফেভার করেছে, এখন দিনটা ভালো গেলেই হলো। দিনটা ছিল ছুটির দিন। খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিলেন ভদ্রলোক। প্রথম পাতার হেডিংগুলোতে চোখ বুলিয়ে চলে গেলেন খেলার পাতায়। বিশ্বকাপ আসতে আর দেরি নেই। কোন কোন দল ঢাকায় এল, প্রস্তুতি ম্যাচে কোন দল কেমন খেলল_বিস্তারিত জানা চাই তাঁর। আগের রাতে টেলিভিশনের খবরে খেলার ফল শুনেছেন। কিন্তু কয়েক মিনিটের খবরে তাঁর তো আর চলে না। বিস্তারিত জানার জন্য তাই তাঁর চাই খবরের কাগজ।
খেলার পাতা মাত্রই খুলে বসেছেন, তখনই সেখানে তাঁর স্ত্রীর উপস্থিতি। ভদ্রলোক স্ত্রীকে দেখে নিজেকে তৈরি করতে শুরু করলেন। মনে মনে বললেন, এমন বোলার আমি জীবনে দেখিনি। একেবারে নিখুঁত নিশানা। লাইন-লেন্থে কোথাও একচুল এদিক-সেদিক হবে না। সব সময় ওভার দ্য উইকেট। মিডল স্টাম্পে ইনসুইং। মাঝেমধ্যে ইয়র্কার থাকে। ছেড়ে দিলে বোল্ড। ব্লক করতে গেলে এলবিডবি্লউ। মাঝেমধ্যে আবার গুগলি থাকে। ঠিকমতো ব্যাট চালাতে না পারলে বোলারের হাতেই ক্যাচ-আউট হওয়ার আশঙ্কা। ভদ্রলোক নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বসলেন। অনেকটা ফিল্ডিং দেখে ব্যাটসম্যানের প্রস্তুত হওয়ার মতো। ভদ্রলোক বুঝলেন, টস পেলেও দিনের শুরুটা ভালো হবে না তাঁর। স্ত্রী তাঁর হাতে বাজারের ব্যাগ আর ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, বাজারে যেতে হবে। ভদ্রলোক বুঝলেন_এড়ানো যাবে না। ব্লক করা যাবে না। সপাটে কাভার দিয়ে বাউন্ডারি হাঁকাবেন_এটা তেমন বল নয়। বাজার করতে যাওয়া মানে ফুলটস নয় যে ওভার বাউন্ডারি হবে। বাজার করতে যাওয়া মানে হচ্ছে, সোজা বাউন্সারের মুখে পড়া। আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই। কোনো দিকে না তাকিয়ে তিনি গেলেন বাজারে। ভেবেছিলেন, বাজারে গিয়ে নিজে সপাটে ব্যাট করবেন। চার-ছয় মারবেন। মানে থলে ভরে বাজার করবেন। বাজারে যাওয়া মানে তো ক্রিজে চলে যাওয়া। টিকে থাকাটাই সেখানে আসল কথা। আজকের দিনে বাজার নামের ক্রিজে কয়জন বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে? বাজারের দোকানিরা যেন একেকজন দক্ষ ফিল্ডার। খদ্দেরকে ক্যাচ করার জন্য বসে আছে। জিনিসপত্রের দাম তো চাওয়া নয়, যেন একেকটা বল যেন আগুনের গোলা হয়ে ছুটে আসছে। গেলেন সবজির দোকানে। যা ছুঁতে যান, তা-ই হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। অনেকটা ব্যাট ফসকে বেরিয়ে যাওয়ার মতো। দাম তো নয় যেন মুরালির দুসরা। কোনোভাবেই ব্যাটে-বলে হয় না। আবার ব্যাট ছোঁয়ানোর আগে অর্থাৎ কেনার আগে ভাবতে হয়, শেষে কট বিহাইন্ড হয়ে যেতে হবে না তো।
সাত-পাঁচ ভাবনা ছেড়ে তিনি ব্যাট করা, অর্থাৎ কেনা শুরু করেন। একের পর এক উইকেট চলে যাচ্ছে, অর্থাৎ পকেট থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোক দ্রুত কাঁচাবাজার থেকে মাছের বাজারে গেলেন। ততক্ষণে তাঁর ব্যাটসম্যানরা টেল-এন্ডে। অর্থাৎ গাঁটের টাকা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। ভদ্রলোক শেষ উইকেটটি খুইয়ে অর্থাৎ মানিব্যাগের শেষ কড়িটি ফেলে মাছ কিনে প্যাভিলিয়ন অর্থাৎ বাড়িমুখো হলেন। ততক্ষণে তিনি বিধ্বস্তপ্রায়। কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মনে মনে বলেন, ওহ, এমন বাজে পিচে কেউ ব্যাট করতে নামে!
বাড়িতে ফিরে যেন বদরাগি কোচের মুখে পড়ে যান তিনি। এক কেজি আলু কিনতে বলা হয়েছিল, কিনেছেন আধা কেজি। কেন? মাছ পচা মনে হচ্ছে কেন। মাংস কেনা উচিত ছিল, কেনা হয়নি কেন? অনেকগুলো 'কেন'-র জবাব না দিয়ে ভদ্রলোক ঢুকে যান নিজের ঘরে। বিছানার ওপর সঁপে দেন নিজেকে। চোখ বন্ধ করে ভাবেন_না, আজকের ইনিংসটা একেবারেই ভালো গেল না। কালকের ইনিংসের শুরুটা হিসাব করেই করতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
habib.alihabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.