লাইফ স্টাইলের ক্রমাবর্তন by তাহমিনা মিলি
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সব কিছুই পাল্টে যায়। জীবনযাপন স্টাইল, মূল্যবোধের ধরন, চিন্তা-ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি, মনমানসিকতা সবই। আমাদের সমাজে, চারপাশে ভালভাবে তাকালে ব্যাপারটি সহজেই চোখে পড়ে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনধারা যেমন পাল্টেছে, তেমনি পাল্টেছে পোশাক-পরিচ্ছদ সম্পর্কে সব মানুষের ধারণাও।
তাই পোশাকের প্রয়োজনীয়তা শুধু জীবন বাঁচাতেই নয় বরং জীবন সাজাতেও। যদিও পোশাক দিয়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলা বা ফ্যাশনবল পোশাকে নিজেকে উপস্থাপন করার ধারাটি খুব বেশি দিনের নয়। আধুনিক জীবনের বহু অনুষঙ্গের মতো পোশাকি ফ্যাশনের ধারার সূত্রপাত ঘটেছিল পাশ্চাত্যে।
ষাটের দশকের আগে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে পোশাক-পরিচ্ছদ বা ফ্যাশন সম্পর্কে মানুষের সুনির্দিষ্ট কোন ভাবনা ছিল না। যে কোন চলনসই পোশাকই ছিল সে সময়কার ফ্যাশন। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মার্জিত ও স্টাইলিশ আউটফিট এবং পিলবক্স হ্যাট সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। ওই দশকের শেষের দিকে মিনি স্কার্ট এবং গো গো বুটের প্রচলন পাল্টে দেয় পুরনো ধারাকে। সেই সঙ্গে হিপ্পিদের বেলবটম জিন্স, টাইডাই শার্ট আর লং স্কার্ট জন্ম দেয় ফ্যাশনের ভিন্ন এক ধারার। তবে মজার বিষয় হলো নব্বইয়ের দশকের বিভিন্ন ফ্যাশন ক্যাটালগ আর ম্যাগাজিনগুলোতেও মডেলদের ষাটের দশকের জনপ্রিয় আর ফ্যাশনেবল পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। আর এ থেকেই প্রমাণ মেলে যে ফ্যাশন শুধু পরিবর্তনশীল নয়, একই সঙ্গে খানিকটা স্থিতিশীলও বটে।
ফ্যাশনের বিভিন্ন ট্রেন্ড আর স্টাইলের সঙ্গে তারকা এবং অভিজাত শ্রেণীর সম্পর্ক সব সময়েই ঘনিষ্ঠ। আর এ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শুরুটাও হয়েছিল ষাটের দশকে। সে সময় টিভি চালু হয়ে যাওয়ায় টিভি তারকা এবং চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারাই হয়ে ওঠেন সমাজের অভিজাত ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আর এ কারণেই সমকালীন ফ্যাশনে এসব অভিজাত ও অনুকরণীয় সামাজিক মূল্য এবং স্টাইলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে পাশ্চাত্যের সামগ্রিক ফ্যাশনে প্রভাব বিস্তারকারীদের তালিকায় যুক্ত হয় সুপার মডেল ও ক্রীড়া তারকাদের নাম। তাছাড়া সামগ্রিক বিচারে বর্তমান সময়ে মিডিয়ায় যে ব্যাপক বিস্তৃতি এর ফলে বর্তমান ফ্যাশনের ধারায় তারকাদের প্রভাবও বেড়েছে অনেকাংশে।
পোশাক, প্রসাধন, চুল, নখ ইত্যাদির বিন্যাসের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য বিবেচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে যুগে যুগে। এই সৌন্দর্য চর্চা তথা সাজগোজের ধারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল যা গড়ে উঠে দেশীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য, রুচিবোধ, পোশাক ভাবনা প্রভৃতির সমন্বয়ে। সৌন্দর্য চর্চায় বাঙালী নারীর পোশাক আর অলঙ্কারের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সাজসজ্জার ধরন। একই ধারাবাহিকতায় কখনও কখনও পুরনো রূপটাই ফিরে আসে নতুন করে নতুন রূপে। এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা যেতে পারে বেলবটম, পলিস্টার, বেনজনাম এবং ব্যাগি প্যান্টের মতো ফ্যাশনের বিভিন্ন ট্রেন্ডের কথা। সুনির্দিষ্টভাবে এই ট্রেন্ডগুলো সত্তর দশকের প্রতিনিধিত্ব করলেও এর কিছু কিছু আবার ওঠে এসেছে নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশনের মূলধারায়। যেমনিভাবে ফ্যাশনের নতুন ধারায় শর্ট কামিজ আবার ফিরে এসেছে। আজকাল মেয়েদের মধ্যে শর্ট কামিজের বেশ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। এখন যে শর্ট কামিজের ট্রেন্ড চলছে তার কিছুটা খুঁজে পাওয়া যায় সত্তরের দশকের শেষ দিকের ফ্যাশনে। পঞ্চাশের দশকে মূলত তাঁতের সুতির শাড়ির আধিপত্য বেশি দেখা যায়। সঙ্গে টিস্যুর ব্যবহারও ছিল। তবে সাদা শাড়ির ব্যবহার বেশি ছিল। এছাড়া বড় বড় সাদা দোপাট্টা ব্যবহারও ছিল। তবে সাদা শাড়ির ব্যবহার বেশি ছিল। এ ছাড়া বড় বড় সাদা দোপাট্টা এবং সাদা সালোয়ারের স্টাইল ছিল। তখন সবাই বিভিন্ন রঙের জামার সঙ্গে সাদা সালোয়ার ব্যবহার করত।
যদিও ষাটের দশকে শাড়ির আঁচল ধরেই বাঙালী সমাজে আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সালোয়ার কামিজ। এ সময় সালোয়ার কামিজটা কিছুটা চাপা ছিল, পরিচিত ছিল টেডি নামে এবং সিনেমার নায়িকাদের অনুকরণে টেডি মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি মাথার চুলটাকে চ্যাপটা করে বেঁধে চোখে বড় করে টেনে কাজল আরেকট নান্দনিকতার ছোঁয়া পায় ষাটের দশকে এসে। কানের দুল কিছুটা বড় এবং ভারি হয়। সে সময় কিছুটা হিন্দী স্টাইল শুরু হয়। মেকআপ ছিল হালকা। আজকাল শর্ট কামিজের সঙ্গে যে ডিভাইডার বেলবটম প্রভৃতি দেখা যাচ্ছে সেটার প্রচলন হয়েছিল সত্তরের দশকে। যদিও সত্তরের দশকে প্রিন্টের সালোয়ার কামিজের স্টাইল শুরু হয়। বস্তুত সত্তরের দশকে অনেকে যেমন খুশি তেমন পোশাক পরার সময় বলে মনে করে। তখন গা সাঁটানো জামা এবং বেলবটম প্যান্ট সঙ্গে হাইহিলের জুতা পরার হিড়িক শুরু হয়েছিল। মাথার এক পাশে সিঁথি করে টেনে চুল বাঁধত মেয়ের লম্বা হাতের ব্লাউজের প্রচলন ছিল। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ কন্ট্রাস্ট এবং গোলগলার লম্বা হাতের ব্লাউজের প্রচলন ছিল। তখন চুল লম্বা রাখার পাশাপাশি শাড়ির সঙ্গে টেনে উঁচু করে খোঁপা বাঁধার প্রচলন দেখা যায়।
আশির দশকে মেয়েদের পোশাকে প্রচলিত ধারার সৃজনশীলতার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় ফ্যাশন সচেতনতা। এ সময় মেকআপ থেকে শুরু করে জামাকাপড় অলঙ্কার সব কিছুতেই মেটালিকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন শেডের কালার এবং ম্যাট লিপস্টিকের প্রচলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকেই। ফতুয়ার ব্যবহারটাও এ সময়েই শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে ফতুয়ার ব্যবহার অল্প করে শুরু হলেও এরপর তা ফতুয়া পরছে এবং সেই সঙ্গে লম্বা ঝুলানো কানের দুলের ব্যবহার খুব দেখা যাচ্ছে। গলায় হাল্কা ঝোলানো গহনা এবং হাতে প্রচুর চুড়ির ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন শাড়ি এবং কামিজের দুটোর সঙ্গেই প্রচুর গহনার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। চুলের ক্ষেত্রে স্ট্রেইট এবং কার্ল দুটোই চলছে পাশাপাশি।
কার্ল চুলের স্টাইলটাই আশির দশকে দেখা যেত কাঁধ অবধি নেমে গেছে কোঁকড়ানো চুল যেন একটু মড ফাংকি টাইপ কার্ল চুলের ফ্যাশন। আজকাল এসবের পাশাপাশি ছোট করে লেয়ার কাট এবং ছোট চুলের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চুলে নানা রঙ কিংবা হাইলাইটের ব্যবহার বেড়েছে। মেকআপে গ্লিটার গ্লাসের প্রচুর ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। এখন সব বয়সীদের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, জরি, চুমকি সিকোয়েন্সের কাজ দেখা যায় সেটা ষাটের দশকের শাড়িতে দেখা যেত। এখন সব বয়সীর মধ্যে সাজের প্রতি আগ্রহ কিংবা কেনাকাটা ব্যাপক হারে দেখা গেলেও এটা মূলত শুরু হয় নব্বইয়ের দশক থেকে। এই সময়ে এসে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ সব কিছুর সঙ্গেই প্রচুর ভারি গহনার ব্যবহার শুরু হয়। পার্টি, বিয়ের দাওয়াত, অনুষ্ঠান ছাড়াও সাধারণভাবে গহনার ব্যাপক ব্যবহার চলছে বর্তমানে। আমাদের দেশের ট্রাডিশনাল গহনাগুলো কখনই আউট অব ফ্যাশন হবে না। বিভিন্ন সময়ের ফ্যাশনের সঙ্গে এগুলো খুব একটা পরিবর্তিত হয় না। আজকাল মেকআপে শাইনি জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে। সত্তর দশকে অবশ্য শাড়ির ব্যবহার ছিল বেশি। সঙ্গে শর্ট হাতা ব্লাউজ এবং টেনে আঁটসাঁট করে ছোট আঁচলের শাড়ির প্রচলন ছিল। আশির দশকে এসে হাই কলার, কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত ফিটিং ব্লাউজ এবং লম্বা আঁচলের শাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তবে বলা যায়, বাঙালী নারীর ঐতিহ্যে শাড়িই আদি। পাশ্চাত্যের পোশাক সংস্কৃতির আগ্রাসন শাড়িকে তার আপন অবস্থান থেকে একটুও সরাতে পারেনি। সব পোশাকই এখানে এসে হয়েছে শাড়ির সহযোগী, বিকল্প নয়। এর পাশাপাশি পোশাকে শার্ট কামিজ, লং কামিজ প্রভৃতি নামে কখনও এসেছে বিচিত্র সব স্টাইল। কখনও হালকা বা ভারি মেকআপের সঙ্গে হয়ত কাজলের ব্যবহার হয়েছে। আবার কাজলের ব্যবহার কমে গিয়ে শেডের প্রচলন দেখা গেছে। চুলটা কখনও ছোট কখনও লম্বা আবার কখনও কালো কিংবা স্ট্রেইট হয়েছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, পুরো সাজগোজের ধারাতেই বিভিন্নভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। স্টাইলগুলো হারিয়ে না গিয়ে বিলোপ না হয়ে ঘুরে ফিরে নতুন আঙ্গিকে বিউটি পার্লারের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ফলে সাজগোজে পেশাদারিত্ব এসেছে সবার জন্য সাজগোজের চমৎকার সুযোগ হয়েছে। এখন কেউ ইচ্ছে করলেই নিজের পছন্দমতো চুলে স্টাইল কিংবা মেকআপটা পার্লার থেকে করে নিতে পারছে। পুরুষদের জন্যও সৌন্দর্যচর্চার চমৎকার সুযাগ সৃষ্টি পার্লার ও উন্নতমানের সেলুনের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এখন সবকিছুর পরেও প্রতিটি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টির প্রতিরূপ হিসাবে গড়ে ওঠে সেই জাতির কিছু মৌলিক ফ্যাশন কিংবা সাজসজ্জার রীতি যা সময়ের ধারাবাহিকতাতেও টিকে থাকে চিরন্তন রূপে, মেযন পহেলা বৈশাখে বাঙালীর চিরন্তন সাজের অপূর্ব প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় চারদিকে। এদিন শাড়ি ছাড়া বাঙালী নারীকে কল্পনা করা যায় না। লালপাড়ের সাদা শাড়ির সঙ্গে হাতভর্তি নানা রঙের রিনিঝিনি চুড়ি, কারও বা পিঠে ছড়ানো চুলের অনেকেই এই দিনে আল্পনা, উল্কি আঁকা অঙ্গ নিয়ে চন্দন-সিঁদুরের তিলক মেখে বর্ষবরণের আয়নায় আপন দেশ, জাতি, সংস্কৃতি আর সত্তাকে খুঁজে ফিরে। সময়ের ডানায় ভর করে ফ্যাশন, সাজগোজ আর স্টাইলের ধরন বদলায়। আর সংস্কৃতি-ঐতিহ্য যুগের আবর্তনে ঘুরপাক খায়। ফ্যাশন আর স্টাইল অনেকটাই চক্রের মতো। সময়ের আবর্তে যেমন বদলে যায় ফ্যাশন, তেমনি সাজসজ্জায়ও আসে ভিন্নতা। তবে এমন কিছু স্টাইল আছে যা সনাতন কিন্তু চিরন্তন। এগুলো কোন দিন পুরনো হয় না, ফ্যাশন ও স্টাইলের পালাবদলে এগুলো থাকে আবহমান। এসব সাজসজ্জাকেই বলা হয় ক্ল্যাসিক সাজ। যেমন লাল টিপ কিংবা লাল লিপস্টিক আগেও যেমন ছিল আকর্ষণীয়, বর্তমানেও তেমনিই রয়েছে এবং এর ব্যবহার গতানুগতিক লুককে বদলে দেয় এবং একটা ক্ল্যাসিক লুক তৈরি করে। ছোট বা বড় সিঁদুর বা লাল টিপ সব বয়সী বাঙালী রমণীর সাজে চিরন্তন। লাল লিপস্টিক একজন অতি আধুনিকা তরুণী তার আধুনিক সাজসজ্জার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করতে পারে সঠিক তেমনি বিয়ের সাজে কিংবা ষাট-সত্তর দশকের সাজের সাথেও দিব্যি মানিয়ে যায়। হালকা বা গাঢ় লাল লিপস্টিকের ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি নিয়ে আসতে পারেন আপনার চেহারায় ক্ল্যাসিক লুক।
ছবি : আরিফ আহমেদ
মডেল : নায়লা
ষাটের দশকের আগে দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার কারণে পোশাক-পরিচ্ছদ বা ফ্যাশন সম্পর্কে মানুষের সুনির্দিষ্ট কোন ভাবনা ছিল না। যে কোন চলনসই পোশাকই ছিল সে সময়কার ফ্যাশন। ষাটের দশকের শুরুর দিকে মার্জিত ও স্টাইলিশ আউটফিট এবং পিলবক্স হ্যাট সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। ওই দশকের শেষের দিকে মিনি স্কার্ট এবং গো গো বুটের প্রচলন পাল্টে দেয় পুরনো ধারাকে। সেই সঙ্গে হিপ্পিদের বেলবটম জিন্স, টাইডাই শার্ট আর লং স্কার্ট জন্ম দেয় ফ্যাশনের ভিন্ন এক ধারার। তবে মজার বিষয় হলো নব্বইয়ের দশকের বিভিন্ন ফ্যাশন ক্যাটালগ আর ম্যাগাজিনগুলোতেও মডেলদের ষাটের দশকের জনপ্রিয় আর ফ্যাশনেবল পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। আর এ থেকেই প্রমাণ মেলে যে ফ্যাশন শুধু পরিবর্তনশীল নয়, একই সঙ্গে খানিকটা স্থিতিশীলও বটে।
ফ্যাশনের বিভিন্ন ট্রেন্ড আর স্টাইলের সঙ্গে তারকা এবং অভিজাত শ্রেণীর সম্পর্ক সব সময়েই ঘনিষ্ঠ। আর এ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শুরুটাও হয়েছিল ষাটের দশকে। সে সময় টিভি চালু হয়ে যাওয়ায় টিভি তারকা এবং চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকারাই হয়ে ওঠেন সমাজের অভিজাত ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আর এ কারণেই সমকালীন ফ্যাশনে এসব অভিজাত ও অনুকরণীয় সামাজিক মূল্য এবং স্টাইলের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। পরবর্তীতে নব্বইয়ের দশকে পাশ্চাত্যের সামগ্রিক ফ্যাশনে প্রভাব বিস্তারকারীদের তালিকায় যুক্ত হয় সুপার মডেল ও ক্রীড়া তারকাদের নাম। তাছাড়া সামগ্রিক বিচারে বর্তমান সময়ে মিডিয়ায় যে ব্যাপক বিস্তৃতি এর ফলে বর্তমান ফ্যাশনের ধারায় তারকাদের প্রভাবও বেড়েছে অনেকাংশে।
পোশাক, প্রসাধন, চুল, নখ ইত্যাদির বিন্যাসের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য বিবেচনার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে যুগে যুগে। এই সৌন্দর্য চর্চা তথা সাজগোজের ধারা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল যা গড়ে উঠে দেশীয় কৃষ্টি, ঐতিহ্য, রুচিবোধ, পোশাক ভাবনা প্রভৃতির সমন্বয়ে। সৌন্দর্য চর্চায় বাঙালী নারীর পোশাক আর অলঙ্কারের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সাজসজ্জার ধরন। একই ধারাবাহিকতায় কখনও কখনও পুরনো রূপটাই ফিরে আসে নতুন করে নতুন রূপে। এই প্রেক্ষাপটে উল্লেখ করা যেতে পারে বেলবটম, পলিস্টার, বেনজনাম এবং ব্যাগি প্যান্টের মতো ফ্যাশনের বিভিন্ন ট্রেন্ডের কথা। সুনির্দিষ্টভাবে এই ট্রেন্ডগুলো সত্তর দশকের প্রতিনিধিত্ব করলেও এর কিছু কিছু আবার ওঠে এসেছে নব্বইয়ের দশকের ফ্যাশনের মূলধারায়। যেমনিভাবে ফ্যাশনের নতুন ধারায় শর্ট কামিজ আবার ফিরে এসেছে। আজকাল মেয়েদের মধ্যে শর্ট কামিজের বেশ জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। এখন যে শর্ট কামিজের ট্রেন্ড চলছে তার কিছুটা খুঁজে পাওয়া যায় সত্তরের দশকের শেষ দিকের ফ্যাশনে। পঞ্চাশের দশকে মূলত তাঁতের সুতির শাড়ির আধিপত্য বেশি দেখা যায়। সঙ্গে টিস্যুর ব্যবহারও ছিল। তবে সাদা শাড়ির ব্যবহার বেশি ছিল। এছাড়া বড় বড় সাদা দোপাট্টা ব্যবহারও ছিল। তবে সাদা শাড়ির ব্যবহার বেশি ছিল। এ ছাড়া বড় বড় সাদা দোপাট্টা এবং সাদা সালোয়ারের স্টাইল ছিল। তখন সবাই বিভিন্ন রঙের জামার সঙ্গে সাদা সালোয়ার ব্যবহার করত।
যদিও ষাটের দশকে শাড়ির আঁচল ধরেই বাঙালী সমাজে আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে সালোয়ার কামিজ। এ সময় সালোয়ার কামিজটা কিছুটা চাপা ছিল, পরিচিত ছিল টেডি নামে এবং সিনেমার নায়িকাদের অনুকরণে টেডি মোটামুটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। পাশাপাশি মাথার চুলটাকে চ্যাপটা করে বেঁধে চোখে বড় করে টেনে কাজল আরেকট নান্দনিকতার ছোঁয়া পায় ষাটের দশকে এসে। কানের দুল কিছুটা বড় এবং ভারি হয়। সে সময় কিছুটা হিন্দী স্টাইল শুরু হয়। মেকআপ ছিল হালকা। আজকাল শর্ট কামিজের সঙ্গে যে ডিভাইডার বেলবটম প্রভৃতি দেখা যাচ্ছে সেটার প্রচলন হয়েছিল সত্তরের দশকে। যদিও সত্তরের দশকে প্রিন্টের সালোয়ার কামিজের স্টাইল শুরু হয়। বস্তুত সত্তরের দশকে অনেকে যেমন খুশি তেমন পোশাক পরার সময় বলে মনে করে। তখন গা সাঁটানো জামা এবং বেলবটম প্যান্ট সঙ্গে হাইহিলের জুতা পরার হিড়িক শুরু হয়েছিল। মাথার এক পাশে সিঁথি করে টেনে চুল বাঁধত মেয়ের লম্বা হাতের ব্লাউজের প্রচলন ছিল। শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজ কন্ট্রাস্ট এবং গোলগলার লম্বা হাতের ব্লাউজের প্রচলন ছিল। তখন চুল লম্বা রাখার পাশাপাশি শাড়ির সঙ্গে টেনে উঁচু করে খোঁপা বাঁধার প্রচলন দেখা যায়।
আশির দশকে মেয়েদের পোশাকে প্রচলিত ধারার সৃজনশীলতার প্রতিফলন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সর্বস্তরের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় ফ্যাশন সচেতনতা। এ সময় মেকআপ থেকে শুরু করে জামাকাপড় অলঙ্কার সব কিছুতেই মেটালিকের ব্যবহার বাড়তে শুরু করে। বিভিন্ন শেডের কালার এবং ম্যাট লিপস্টিকের প্রচলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকেই। ফতুয়ার ব্যবহারটাও এ সময়েই শুরু হয়। নব্বইয়ের দশকে ফতুয়ার ব্যবহার অল্প করে শুরু হলেও এরপর তা ফতুয়া পরছে এবং সেই সঙ্গে লম্বা ঝুলানো কানের দুলের ব্যবহার খুব দেখা যাচ্ছে। গলায় হাল্কা ঝোলানো গহনা এবং হাতে প্রচুর চুড়ির ব্যবহার লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন শাড়ি এবং কামিজের দুটোর সঙ্গেই প্রচুর গহনার ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। চুলের ক্ষেত্রে স্ট্রেইট এবং কার্ল দুটোই চলছে পাশাপাশি।
কার্ল চুলের স্টাইলটাই আশির দশকে দেখা যেত কাঁধ অবধি নেমে গেছে কোঁকড়ানো চুল যেন একটু মড ফাংকি টাইপ কার্ল চুলের ফ্যাশন। আজকাল এসবের পাশাপাশি ছোট করে লেয়ার কাট এবং ছোট চুলের প্রচলন দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চুলে নানা রঙ কিংবা হাইলাইটের ব্যবহার বেড়েছে। মেকআপে গ্লিটার গ্লাসের প্রচুর ব্যবহারও দেখা যাচ্ছে। এখন সব বয়সীদের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, জরি, চুমকি সিকোয়েন্সের কাজ দেখা যায় সেটা ষাটের দশকের শাড়িতে দেখা যেত। এখন সব বয়সীর মধ্যে সাজের প্রতি আগ্রহ কিংবা কেনাকাটা ব্যাপক হারে দেখা গেলেও এটা মূলত শুরু হয় নব্বইয়ের দশক থেকে। এই সময়ে এসে শাড়ি, সালোয়ার কামিজ সব কিছুর সঙ্গেই প্রচুর ভারি গহনার ব্যবহার শুরু হয়। পার্টি, বিয়ের দাওয়াত, অনুষ্ঠান ছাড়াও সাধারণভাবে গহনার ব্যাপক ব্যবহার চলছে বর্তমানে। আমাদের দেশের ট্রাডিশনাল গহনাগুলো কখনই আউট অব ফ্যাশন হবে না। বিভিন্ন সময়ের ফ্যাশনের সঙ্গে এগুলো খুব একটা পরিবর্তিত হয় না। আজকাল মেকআপে শাইনি জিনিসের ব্যবহার বেড়েছে। সত্তর দশকে অবশ্য শাড়ির ব্যবহার ছিল বেশি। সঙ্গে শর্ট হাতা ব্লাউজ এবং টেনে আঁটসাঁট করে ছোট আঁচলের শাড়ির প্রচলন ছিল। আশির দশকে এসে হাই কলার, কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত ফিটিং ব্লাউজ এবং লম্বা আঁচলের শাড়ির প্রচলন শুরু হয়। তবে বলা যায়, বাঙালী নারীর ঐতিহ্যে শাড়িই আদি। পাশ্চাত্যের পোশাক সংস্কৃতির আগ্রাসন শাড়িকে তার আপন অবস্থান থেকে একটুও সরাতে পারেনি। সব পোশাকই এখানে এসে হয়েছে শাড়ির সহযোগী, বিকল্প নয়। এর পাশাপাশি পোশাকে শার্ট কামিজ, লং কামিজ প্রভৃতি নামে কখনও এসেছে বিচিত্র সব স্টাইল। কখনও হালকা বা ভারি মেকআপের সঙ্গে হয়ত কাজলের ব্যবহার হয়েছে। আবার কাজলের ব্যবহার কমে গিয়ে শেডের প্রচলন দেখা গেছে। চুলটা কখনও ছোট কখনও লম্বা আবার কখনও কালো কিংবা স্ট্রেইট হয়েছে। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, পুরো সাজগোজের ধারাতেই বিভিন্নভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। স্টাইলগুলো হারিয়ে না গিয়ে বিলোপ না হয়ে ঘুরে ফিরে নতুন আঙ্গিকে বিউটি পার্লারের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। ফলে সাজগোজে পেশাদারিত্ব এসেছে সবার জন্য সাজগোজের চমৎকার সুযোগ হয়েছে। এখন কেউ ইচ্ছে করলেই নিজের পছন্দমতো চুলে স্টাইল কিংবা মেকআপটা পার্লার থেকে করে নিতে পারছে। পুরুষদের জন্যও সৌন্দর্যচর্চার চমৎকার সুযাগ সৃষ্টি পার্লার ও উন্নতমানের সেলুনের ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। এখন সবকিছুর পরেও প্রতিটি জাতির নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সৃষ্টির প্রতিরূপ হিসাবে গড়ে ওঠে সেই জাতির কিছু মৌলিক ফ্যাশন কিংবা সাজসজ্জার রীতি যা সময়ের ধারাবাহিকতাতেও টিকে থাকে চিরন্তন রূপে, মেযন পহেলা বৈশাখে বাঙালীর চিরন্তন সাজের অপূর্ব প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় চারদিকে। এদিন শাড়ি ছাড়া বাঙালী নারীকে কল্পনা করা যায় না। লালপাড়ের সাদা শাড়ির সঙ্গে হাতভর্তি নানা রঙের রিনিঝিনি চুড়ি, কারও বা পিঠে ছড়ানো চুলের অনেকেই এই দিনে আল্পনা, উল্কি আঁকা অঙ্গ নিয়ে চন্দন-সিঁদুরের তিলক মেখে বর্ষবরণের আয়নায় আপন দেশ, জাতি, সংস্কৃতি আর সত্তাকে খুঁজে ফিরে। সময়ের ডানায় ভর করে ফ্যাশন, সাজগোজ আর স্টাইলের ধরন বদলায়। আর সংস্কৃতি-ঐতিহ্য যুগের আবর্তনে ঘুরপাক খায়। ফ্যাশন আর স্টাইল অনেকটাই চক্রের মতো। সময়ের আবর্তে যেমন বদলে যায় ফ্যাশন, তেমনি সাজসজ্জায়ও আসে ভিন্নতা। তবে এমন কিছু স্টাইল আছে যা সনাতন কিন্তু চিরন্তন। এগুলো কোন দিন পুরনো হয় না, ফ্যাশন ও স্টাইলের পালাবদলে এগুলো থাকে আবহমান। এসব সাজসজ্জাকেই বলা হয় ক্ল্যাসিক সাজ। যেমন লাল টিপ কিংবা লাল লিপস্টিক আগেও যেমন ছিল আকর্ষণীয়, বর্তমানেও তেমনিই রয়েছে এবং এর ব্যবহার গতানুগতিক লুককে বদলে দেয় এবং একটা ক্ল্যাসিক লুক তৈরি করে। ছোট বা বড় সিঁদুর বা লাল টিপ সব বয়সী বাঙালী রমণীর সাজে চিরন্তন। লাল লিপস্টিক একজন অতি আধুনিকা তরুণী তার আধুনিক সাজসজ্জার সঙ্গে যেমন ব্যবহার করতে পারে সঠিক তেমনি বিয়ের সাজে কিংবা ষাট-সত্তর দশকের সাজের সাথেও দিব্যি মানিয়ে যায়। হালকা বা গাঢ় লাল লিপস্টিকের ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি নিয়ে আসতে পারেন আপনার চেহারায় ক্ল্যাসিক লুক।
ছবি : আরিফ আহমেদ
মডেল : নায়লা
No comments