দাম বাড়ায় সরকার!-সরকারি সংস্থার কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তে বাজারে অস্থিরতা by আবুল কাশেম ও রাজীব আহমেদ

বাজারে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রি করার উদ্দেশ্যই থাকে দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া। আবার ব্যবসায়ীরা যাতে বেশি দরে বিক্রি করতে না পারেন সে জন্য অনেক পণ্যের দামও নির্ধারণ করে দেওয়া হয় সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে।


সাধারণত সরকারি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের দাম বাজারদরের চেয়ে বেশ কিছুটা কম রাখা হয়। আবার নির্ধারিত দামও বাজারদরের চেয়ে কিছুটা কম ধরা হয়। কিন্তু এ বছর দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। সরকারেরই বিভিন্ন সংস্থা দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দিচ্ছে।
বর্তমান বাজারে যেখানে চিনির দাম কেজিপ্রতি ৫২ টাকা, সেখানে শিল্প মন্ত্রণালয় তাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) মাধ্যমে চিনি বিক্রি করছে ৬০ টাকা দরে। আবার বাজারে গরুর মাংসের দাম সর্বোচ্চ ২৭০ টাকা থাকলেও সিটি করপোরেশন দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে কেজিপ্রতি ২৭৫ টাকা। আন্তর্জাতিক বাজারে দর কমে যাওয়ায় ভোজ্য তেলের দাম কমার কথা। কিন্তু বাণিজ্যসচিব মো. গোলাম হোসেন 'রমজানে তেলের দাম বাড়বে না'- এ কথা বারবার বলে প্রকারান্তরে ব্যবসায়ীদের দাম না কমিয়ে বাড়তি মুনাফা করারই সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবেই সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাণ্ডজ্ঞানহীন সিদ্ধান্তের কারণে কমার পরিবর্তে অনেক পণ্যের দাম আরো বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে রমজানের অনেক আগেই জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে নেওয়ার পুরনো কৌশল নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু যখন দাম বাড়ছে, তখন বাজারে পণ্য আনতে পারছে না ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। তাদের পণ্যের দাম বাজারদরের চেয়ে বেশ কিছুটা কম। টিসিবির পণ্য বাজারে থাকলে দাম বাড়ানোর সুযোগ কমে যায়।
বাজার-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশি দামে পণ্য বিক্রির কারণে ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়ানোর সুযোগ পান। এ ছাড়া বাজারদরের চেয়ে বেশি দাম নির্ধারণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রায় তিন মাস আগে দুই লাখ টন চিনি আমদানি করতে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে ব্রাজিল সফর করেন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া। এর মধ্যে ৭০ হাজার টন চিনি আমদানির জন্য ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পাওয়া যায়। কিন্তু সেই চিনি শেষ পর্যন্ত আসেনি। শিল্প মন্ত্রণালয় গত ৪ জুলাই থেকে বাজারে খোলাবাজারে চিনি বিক্রি শুরু করে। ওই দিন বাজারে চিনির দাম ছিল ৫২ টাকা। অথচ শিল্প মন্ত্রণালয়ের চিনির দাম নির্ধারণ করা হয় কেজিপ্রতি ৬০ টাকা।
মন্ত্রণালয় নিজেদের চিনির দাম বেশি নির্ধারণ করায় খুচরা বিক্রেতাদের বেশি দাম নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভোক্তা অধিকার কর্মীরা। রাজধানীর মাত্র তিনটি স্থানে বাড়তি দামে চিনি বিক্রি করে শিল্প মন্ত্রণালয় পুরো দেশের বাজারকেই বাড়তি দামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করেন তাঁরা।
গত শনিবার রাজধানীর কাজিপাড়ার স্বপন স্টোরে প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম চাওয়া হয় ৫৮ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনির দাম চাওয়া হয় ৬০ টাকা। অথচ একটু দূরের 'স্বপ্ন' নামের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ৫২ টাকা দরে চিনি বিক্রি হচ্ছে। এ বিষয়ে স্বপন স্টোরের বিক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, 'সরকারিভাবে চিনির দাম ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা দুই টাকা কমে বিক্রি করছি।'
বাংলাদেশ পাইকারি চিনি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আনোয়ার হাবিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বর্তমানে চিনির বাজারে কোনো সংকট নেই। সরবরাহ ঠিক আছে। দামও স্থিতিশীল। আমরা ৪৮ টাকা দরে চিনি বিক্রি করছি। শিল্প মন্ত্রণালয় যে খোলাবাজারে ৬০ টাকা দরে বিক্রি করছে, আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। এটা খুবই অন্যায়। আমরা চাই শিল্প মন্ত্রণালয় বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে চিনির দাম পুনর্নির্ধারণ করুক।'
এ বিষয়ে শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমাদের চিনির মান অনেক ভালো। বাজারে দুই কেজি চিনিতে যে কাজ হয়, আমাদের এক কেজিতে সেই কাজ হয়। উৎপাদন, পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ যুক্ত করে খাদ্য শিল্প করপোরেশনের চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কম দামে কিভাবে বিক্রি করে, এটা তাদের ব্যাপার। তারা অনেক সময় সরকারি কারখানা ধ্বংস করার জন্য লোকসান দিয়ে বিক্রি করে।' শিল্প মন্ত্রণালয়ের দামের কারণে বাজারে চিনির দাম বাড়বে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আমরা কী দামে বিক্রি করছি, সেটা ব্যবসায়ীদের দেখার বিষয় নয়। আর ক্রেতারা যেটা কম মনে করবে, সেটাই কিনবে।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, চিনির দর বেশ কয়েক মাস ধরেই ৫০ থেকে ৫২ টাকায় স্থিতিশীল আছে। কারখানাগুলোতেও বিপুল পরিমাণ চিনি মজুদ আছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের কাছে চিনি আছে এক লাখ টনেরও বেশি। আর টিসিবি রমজানে চিনি বিক্রি করবে প্রায় ৫৬ হাজার টন। অর্থাৎ রমজানে চিনির যে চাহিদা, এর চেয়ে বেশি চিনি এ সরকারি দুটি সংস্থার হাতেই রয়েছে। ফলে এবারের রমজান মাসে চিনির বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিন্তই ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। টিসিবি মেঘনা গ্রুপ থেকে নেওয়া চিনি ৫০ টাকা ও ভারত থেকে আমদানি করা চিনি ৪৮ টাকা দরে বিক্রির জন্য অনুমোদন চায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে। গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবিকে ৫০ টাকা দরে দেশি ও আমদানি- উভয় ধরনের চিনি বিক্রির নির্দেশনা দিয়েছে; যদিও এর আগেই একতরফাভাবে শিল্প মন্ত্রণালয় ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কিছু জানায়নি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তকে দৃষ্টান্ত হিসেবে ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরাও দাম বাড়াতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।
গত ১ জুলাই আসন্ন রমজান উপলক্ষে রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের মাংসের দর নির্ধারণ করে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দেশি গরুর মাংস প্রতি কেজি ২৭৫ টাকা, বিদেশি বড় গরুর মাংস ২৬০ টাকা, মহিষ ২৫০ টাকা, খাসি ৪২৫ টাকা ও ভেড়া-ছাগীর মাংস প্রতি কেজি ৩৬০ টাকা দরে বিক্রি করতে হবে। এই দর ২৬ রমজান পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।
অভিযোগ রয়েছে, এ দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বিক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষা করে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, রাজধানীর অলিগলির বাজারে প্রতি কেজি ছোট গরুর মাংস সর্বোচ্চ ২৭০ টাকা দরে বিক্রি হতো। কিন্তু সিটি করপোরেশন নির্ধারণ করে দিয়েছে ২৭৫ টাকা। দাম নির্ধারণ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে তারা। কোথাও গরুর বদলে মহিষ ও খাসির বদলে ভেড়া বিক্রি হচ্ছে কি না, তা তদারকি করছে না। জবাই করা গরুর রোগ পরীক্ষারও কোনো ব্যবস্থা নেই। আবার এই দাম কার্যকর থাকবে ২৬ রমজান পর্যন্ত। এরপর ইচ্ছামতো দাম নেওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কর্মকর্তা উদয় চট্টোপাধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাজারে গরুর মাংস ২৪৫ থেকে ২৬০ টাকায় পাওয়া যেত। ২৭৫ টাকা দাম নির্ধারণ করায় খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে দাম বাড়ানোর প্রবণতা তৈরি হবেই। এত দিন যারা কম নিত, তারা এখন বেশি দামে বিক্রি করবে।' তিনি বলেন, 'কোন গরুর মাংসের কত দাম রাখা হচ্ছে, তা তদারকি করার চেষ্টা দেখা যায় না। ফলে সব গরুর মাংসই এখন ২৭৫ টাকা রাখার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।'
ছোলাসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলেও এখনো টিসিবির পণ্য বাজারে আসেনি। তবে তাদের পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। টিসিবি ভোক্তা পর্যায়ে কেজিপ্রতি ৫০ টাকা দরে চিনি, তুরস্ক, কানাডা ও নেপালি মসুর ডাল ৭০ টাকা, ছোলা ৬৬ টাকা, খেজুর ৮০ টাকা, খোলা সয়াবিন ১১৫ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিন ১২১ টাকা দরে বিক্রি করবে। এই দরে বিক্রি করার জন্য টিসিবি তাদের প্রত্যেক ডিলারকে চলতি সপ্তাহেই পাঁচ হাজার কেজি করে চিনি, ৪০০ কেজি তুরস্কের ডাল ও নেপালি ডাল ডিলারের চাহিদা অনুযায়ী, ছোলা এক হাজার কেজি, খেজুর ২৫০ কেজি ও সয়াবিন তেল ৮০০ কেজি করে বরাদ্দ দেবে।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সারওয়ার জাহান তালুকদার জানান, টিসিবি ৭ রমজান থেকে ঢাকায় প্রতিদিন ২৫টি খোলা ট্রাকে ও চট্টগ্রাম মহানগরে পাঁচটি খোলা ট্রাকে করে সহনীয় মূল্যে ভোজ্য তেল, চিনি, মসুর ডাল, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করবে। রমজান মাসে টিসিবি মোট ৫৫ হাজার ৭৮৮ টন চিনি, ১৬ হাজার ২১৯ টন ভোজ্য তেল, ১৯ হাজার ৩১৯ টন মসুর ডাল, পাঁচ হাজার টন ছোলা ও এক হাজার টন খেজুর বিক্রি করবে।

No comments

Powered by Blogger.