শার্লক হোমস বাংলাদেশে

বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস এসেছেন বাংলাদেশে। উদ্দেশ্য, এই দেশের অপরাধীদের দেখিয়ে দিতে তাঁর বুদ্ধির ঝলক, তাক লাগিয়ে দিতে চান সবাইকে। সঙ্গে এসেছেন তাঁর সহকারী ডা. ওয়াটসন। কিছু কেস নিলেন হাতে...। কিন্তু শেষমেশ কেমন হলো তাঁদের বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা? জানাচ্ছেন আশিকুর রহমান


কেস-১: হত্যারহস্য
বিমানবন্দর থেকে নেমেই হাতে পেলেন খুনের কেস। ফুলেল অভ্যর্থনা এড়িয়ে ওয়াটসনকে নিয়ে ছুট লাগালেন লাশ যেখানে পড়ে আছে সেখানে। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই কালক্ষেপণ না করে শুরু করলেন পর্যবেক্ষণ। স্বভাবমতো প্রথমেই হোমস গেলেন লাশের চারপাশে গন্ধ শুঁকতে, নিলেন লম্বা এক শ্বাস। ওয়াটসন নিষেধ করার আগেই দড়াম করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন। কারণ কিছুই না, দূষিত নগরের বিষাক্ত বাতাস আর ধুলাবালি মুহূর্তে ধরাশায়ী করে ফেলেছে বিখ্যাত এই গোয়েন্দাকে। কোনোমতে সুস্থ হয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, ‘পায়ের ছাপ তো নেওয়া হয়নি, চলো, ওয়াটসন!’ পাশ থেকে এক পুলিশ কনস্টেবল বলে উঠল, ‘স্যার, পায়ের ছাপ তো পাইবেন না!’ ‘কেন?’ প্রশ্ন করলেন ওয়াটসন। ‘স্যার, এই দেশে যেখানে খুন হয় সেখানে সব লোক ভিড় করে, আর আমরা তো দুর্ঘটনাস্থলে একটু দেরিতে যেতেই পছন্দ করি, তাই পায়ের ছাপ আর খুঁজে পাওয়া যায় না।’ হতবাক হয়ে পড়লেন হোমস। বললেন, ‘তাহলে ফরেনসিক রিপোর্টটা একটু পাঠিয়ে দেবেন, প্লিজ! এখন সেটাই শেষ ভরসা।’
ফরেনসিক রিপোর্ট দেখে ঠান্ডা মাথার হোমসের পায়ের রক্ত চিড়িক করে মাথায় উঠে গেল। ভুলে ভরা রিপোর্টটাতে শুধু খুনের ধরন বদল করে দেওয়া হয়নি, নিহত ব্যক্তির বয়স, উচ্চতা এমনকি জেন্ডারও বদলে ফেলা হয়েছে। রাগ সামলাতে না পেরে নরম-গরম কিছু শোনানোর জন্য হোমস ফোন দিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে। জবাব এল, ‘দেখেন মি. হোমস, এই দেশে বড় বড় কেসে ফরেনসিক রিপোর্ট আসে না, আপনি যে রিপোর্ট একটা হাতে পেয়েছেন সেটাই তো আপনার সৌভাগ্য, পারলে সেটা নিয়েই কাজ করেন।’ কথাটা শোনার পর অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে প্রথম কেসটা ছেড়ে দিলেন দুর্ধর্ষ এই ব্রিটিশ গোয়েন্দা।

কেস-২: খোঁজ দ্য কালো বিড়াল
হোমস কিছুটা খুশি, সরকারের ওপর মহল থেকে দায়িত্ব পেয়েছেন। বিশেষ এক সরকারি বিভাগের তথাকথিত কালো বিড়াল খুঁজে বের করতে হবে। ‘বুঝলে ওয়াটসন, এই কালো বিড়াল আই মিন ব্ল্যাক ক্যাট খুঁজে বের করতে পারলে এই দেশের যে কী উপকার হবে!’ বলে উঠলেন হোমস। ‘কিন্তু পূর্বঅভিজ্ঞতা তো আমাদের ভালো না!’ ওয়াটসনের যুক্তি। ‘আরে ডাক্তার, চিন্তা নাই, চলো।’ তিন দিন ধরে গরু খোঁজা শুরু করলেন শার্লক হোমস। সব জায়গা তছনছ করলেন তিনি। কিন্তু কালো বিড়াল পেলেন না। সাদা বিড়াল, লাল বিড়াল, নীল বিড়ালসহ নানা রঙের বিড়াল দেখতে পেলেন, কিন্তু কালো বিড়ালের দেখা নেই। ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলেন হোটেল-রুমে। খেয়াল করলেন, তাঁদের অলক্ষে রুমে কে যেন কালো একটা ব্যাগ রেখে গেছে। ‘দেখো তো ওয়াটসন, ব্যাগে কী!’ বললেন হোমস। কিন্তু ওয়াটসন দেখার আগেই একদল লোক ঢুকে পড়ল ঘরে। আমরা ‘আইনের লোক’ বলেই তল্লাশি। প্রথমেই চেক করা হলো কালো ব্যাগ। তার ভেতরে দেখা গেল, টাকার বান্ডিলের ভেতর বসে আছে একটি কালো বিড়াল। দেখেই মূর্ছা গেলেন ডা. ওয়াটসন। ‘হোমস সাহেব, নিজের ঘরে কালো বিড়াল রেখে অযথা অন্য জায়গায় খুঁজবেন না। চলেন আমাদের সাথে।’ বলে উঠল লোকগুলো। ফলাফল—ব্রিটিশ দূতাবাসের ছোটাছুটির কারণে ২৪ ঘণ্টা পর ছাড়া পেলেন গোয়েন্দা শার্লক হোমস।

কেস-৩: নির্দোষ প্রমাণ
এত কিছুর পরও হোমস এই দেশ ছাড়েননি। এত সহজে দমার পাত্র নন তিনি। এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যক্তিগত কেস নেবেন। কালাম সাহেব বলে একজন এসেছেন। তিনি বললেন, ‘স্যার, আপনার কথা অনেক শুনেছি, পুলিশ আমাকে এক কেসে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে, আপনি আমাকে নির্দোষ প্রমাণ করুন, স্যার!’ হোমস লোকটাকে অভয় দিলেন, ‘আহা, এ তো সহজ কেস, আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান। আমি দেখছি।’ যাওয়ার সময় কালাম সাহেব বলে গেলেন, ‘স্যার, যা করার তাড়াতাড়ি করেন!’ দুই দিনের মধ্যে অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে কালাম সাহেবকে নির্দোষ প্রমাণের সব আলামত সংগ্রহ করে হোমস যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, তখন ওয়াটসনের কাছে শুনলেন ‘সন্ত্রাসী কালাম গ্রেপ্তার’! দৌড় দিলেন থানায়। গিয়ে দেখেন, কালাম সাহেব বিমর্ষ মুখে বসে আছেন। হোমস কাছে গিয়ে বললেন, ‘কালাম, আপনি নির্দোষ, আমি প্রমাণ এনেছি।’ ‘না না! আমি দোষী! আমি দোষী!’ বলে উঠলেন কালাম সাহেব। পাশ থেকে পুলিশ বলে উঠল, ‘হে হে! হোমস সাহেব, আমাদের কাছে যাকে পাঠাবেন সে-ই নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করবে।’ ‘কিন্তু আমি যে প্রমাণ নিয়ে এসেছি!’ হোমসের যুক্তি। ‘রাখেন আপনার প্রমাণ, ইচ্ছা করলে আপনাকেও দোষী বানাতে পারি, বানাব? দেখতে চান?’ পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে হোমস কিছু না বলেই কেটে পড়লেন সেখান থেকে। বের হয়ে এসে একটা কথাই বললেন এই ঝানু গোয়েন্দা, ‘মাই ডিয়ার ওয়াটসন, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের লোকজন এদের কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু মাত্র!’

ফাইনাল কেস: গুম
রাজনৈতিক কেস আর নেবেন না বলেই ভেবেছিলেন শার্লক হোমস। কিন্তু অনেকের অনুরোধে ঢেঁকিটা গিলেই ফেললেন। তাঁর এবারের কেস বাংলাদেশের আলোচিত ঘটনা—গুম হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজে বের করা। জান বাজি রেখে নেমে পড়লেন তিনি। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ওই মানুষটির অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন ইতিহাসের এই শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা। একদল বলে অমুকের কাছে খোঁজ আছে, আরেক দল বলে তমুকের কাছে খোঁজ আছে। কিন্তু শার্লক যার কাছে যান, সে-ই বলে, ‘আমি কিসসু জানি না!’ এদিকে আকাশ-পাতাল এক করে, নিজের বুদ্ধির শেষ কণাটুকু খরচ করেও গুম হয়ে যাওয়া মানুষটির চিহ্ন পর্যন্ত পেলেন না হোমস। উল্টো স্পর্শকাতর কিছু বিষয়ে গলিয়ে ফেললেন নাকটা। ভাবলেন, কিছুটা হলেও এবার তিনি সফল। কিন্তু ভাগ্যদেবী আড়ালে থেকে হাসলেন। নাক গলানোর মতো এহেন কর্মকাণ্ডের জন্য এবার গুম হয়ে গেলেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সুযোগ্য সহকারী ডা. ওয়াটসন। উদ্ভ্রান্তের মতো ডিবির কাছে ছুটে গেলেন। ডিবি অফিস থেকে বলা হলো, ‘হোমস ভাই, বন্দুক থেকে ছোড়া গুলি এই দেশে ফিরে আসে কিন্তু গুম হওয়া ব্যক্তি ফিরে আসে না। এইবারের মতো আপনি অফ যান!’ হতাশ হয়ে বের হয়ে এলেন হোমস। বুঝতে পারছেন না কোন দিকে যাবেন, কী করবেন। তার ওপর গরমে কাহিল অবস্থা। উদ্ভ্রান্তের মতো চারদিকে তাকাচ্ছেন। একজন তাঁর অবস্থা দেখে ডাবের পানি নিয়ে এগিয়ে এল। চোখ বন্ধ করে আরামে চুমুক দিলেন হোমস। চোখ খুলে দেখেন, অচেনা পরিবেশ, একটা বিছানায় শুয়ে আছেন, নিজেকে আবিষ্কার করলেন হাসপাতালে। ডাক্তার তাঁর জ্ঞান ফেরা দেখেই ভর্ৎসনার সুরে বলে উঠলেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এত বড় গোয়েন্দা হয়ে আপনি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন, এখন দেখেন, সব তো হারালেন!’ কিছুক্ষণ থেমে গোটা ব্যাপারটা বোঝার পর ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললেন হোমস, বললেন, ‘আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক মাই হোম!’

No comments

Powered by Blogger.