তিতাসে বাঁধের প্রভাব বিস্তীর্ণ এলাকায় by জাহাঙ্গীর শাহ ও দুলাল ঘোষ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের প্রভাব পড়েছে বিস্তীর্ণ এলাকায়। সেচের অভাবে অনেক কৃষকের বুকে হাহাকার। নষ্ট হয়েছে মাছের আধার। ইতিমধ্যে বাঁধ-সড়ক কেটে নদীর পানিপ্রবাহ স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এক দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক কাটায় আবার গতি এসেছে।


এক দশক ধরে তিতাসের নাব্যতা কমছে। তবে ভারতের ভারী পণ্য, বিশেষ করে, ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ পরিবহনে এক বছর আগে নদীতে বাঁধ দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের পর নাব্যতা আরও কমেছে। বাঁধের প্রভাবে দক্ষিণে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয় হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার শ্যামনগর, বৈষ্ঠবপুর, চিনাইর, বরিশল ও ঘাটিয়ারা; আখাউড়া উপজেলার খড়মপুর, ভবানীপুর, বনগজ, ধরখার এলাকায় গত বুধবার গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।
তবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোথাও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে না। বাঁধ-সড়ক তৈরির আগে থেকেই এই নদীতে হাঁটুপানি ছিল।’ তিনি জানান, এলাকাবাসীর কেউ কৃষি কিংবা মৎস্য খাতে ক্ষতি হচ্ছে এমন দাবি করেননি। জেলা প্রশাসক বলেন, তিতাস সেতু রক্ষা করতেই মূলত বিকল্প সড়ক তৈরি করা হয়। ভারী পণ্যবাহী ট্রেইলার গেলে সেতুর ক্ষতি হতো।
কমেছে গভীরতা: নদীপারের প্রবীণ লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নদীর গভীরতা ৪০-৫০ ফুটের স্থলে ১০-১২ ফুটে নেমে এসেছে। কোথাও কোথাও এরও কম। প্রশস্ততাও কমে ৪০-৪২ ফুটে এসেছে। তিতাস পরিণত হয়েছে মরা খালে। যেসব স্থানে আগে খেয়া পারাপার ছিল, সেসব স্থানে এখন বাঁশের সাঁকোয় মানুষ পারাপার হচ্ছে। এই দৃশ্য বেশি দেখা গেছে শ্যামনগর গ্রামে।
পরিবেশ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী পরিচালক হাছান আলী প্রথম আলোকে বলেন, নদীর প্রাকৃতিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হলে ক্ষতি হয়। তবে বাঁধটির স্থায়িত্ব কম বলে এখানে খুব ক্ষতি হওয়ার নয়।
মৎস্য আধার বিনষ্ট: এলাকাবাসী জানান, বাঁধের কারণে তিতাসের দক্ষিণ পারের শ্যামনগর, ভবানীপুর, বৈষ্ঠবপুর, বনগজ, ধরখারসহ কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত মাছ পাওয়া যায় না। বাঁধের দক্ষিণে এক কিলোমিটার দূরের শ্যামনগর গ্রামে এক বছর আগেও ৭০টি জেলেপরিবার নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখন এসব পরিবারের অনেকেই পেশা বদলে দিনমজুরি বা মাছের আড়তদারি করছেন। তাঁদের একজন পীযূষ চন্দ্র দাস (৪২) প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক বছর ধইর‌্যা এই গাঙে কোনো মাছ পাই না। তাই অহন আখাউড়া বাজারে আড়তদারি করি। পুঁজির অভাবে হেইডাও পারি না।’ শ্যামনগর দক্ষিণপাড়ার জেলে পিপাস দাস জীবিকার তাগিদে মাঝেমধ্যে চার-পাঁচ কিলোমিটার উজানে গিয়ে মাছ ধরেন। বাকি সময় আখাউড়া বাজারে মুটে-মজুরের কাজ করেন।
তবে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা স্বপন কুমার সরকার বলেন, বাঁধটি স্থায়ী নয়। তাই বাঁধের জন্য খুব একটা ক্ষতি হয়নি।
কৃষকের হাহাকার: বাঁধের দক্ষিণে ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত শত শত একর জমি একফসলি। এসব জমিতে শুকনো মৌসুমে ইরি ধানের চাষ হয়। কৃষকেরা জানান, এক বছর আগে ধানবীজ লাগানোর পর থেকে অমাবস্যা-পূর্ণিমায় জোয়ারের সময় দিন-রাত সেচের কাজ চলত। কিন্তু বাঁধ দেওয়ার ফলে জোয়ার-ভাটার কোনো প্রভাব নেই। ফলে সেচের পানির জন্য গত মৌসুমের মতো চলতি মৌসুমেও কৃষকেরা হাহাকার করছেন। সেচযন্ত্রের ক্ষমতা বাড়িয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না।
বাসুদেব ইউনিয়নের অবস্থাপন্ন কৃষক রুস্তম ভুঁইয়া জানান, গতবারের আগের মৌসুমে সেচ দিতে কষ্ট হয়নি। কিন্তু গত মৌসুমে ১৫ অশ্বক্ষমতার পাম্প দিয়ে সেচেও পানি খুব একটা মেলেনি। এবার ২০ অশ্বক্ষমতার পাম্প দিয়ে সেচ দেওয়া হচ্ছে। বাঁধের কারণে অসংখ্য কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান।
জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক বলাই চন্দ্র দাস বলেন, তাঁর দপ্তরে কোনো কৃষকই এ বিষয়ে অভিযোগ করেননি। এখন সেচকাজ স্বাভাবিক গতিতে চলছে।
পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ পরিবহনে তিতাসে বাঁধ দিয়ে ওই সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ৪৭ কিলোমিটার অংশে আরও ১৭টি বিকল্প সড়ক হয়। এক বছর ধরে এই সড়কগুলোর প্রভাবে বর্ষা মৌসুমে আশুগঞ্জের সোনারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘাটুরা, পৈরতলা, রামরাইল, রাধিকা, সুলতানপুর, ভাতশালা ও কোড্ডা এলাকায় তিতাস থেকে আসা খালগুলোতে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়।
গতি এসেছে সড়ক কাটায়: বালুর বস্তা ও মাটি ফেলে তিতাসের বুকে বাঁধ দিয়ে তৈরি করা ৬০০ ফুট বিকল্প সড়ক সোমবার কাটা শুরু হয়। মঙ্গলবার ঠিকমতো কাটা হলেও বুধবার দেখা যায়, মাত্র তিনজন শ্রমিক কোদাল দিয়ে রাস্তা কাটছেন। এ নিয়ে গতকাল প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে গতকাল আবার রাস্তা কাটায় গতি আসে। কোদালের পরিবর্তে খননযন্ত্র (এক্সক্যাভেটর) দিয়ে রাস্তা কাটা হচ্ছে।
ভারতের পরিবহন সংস্থা আসাম বেঙ্গল কেরিয়ারের (এবিসি) প্রতিনিধি নিমিত সাহা বলেন, তিতাসের ওপর বিকল্প সড়ক দিনে-রাতে কাটা হবে। নদীর নিচ থেকে ১৪ কি ১৫ ফুট উঁচু বাঁধের একাংশের প্রায় অর্ধেক কাটা হয়ে গেছে। বাকিটা শেষ হতে দুই সপ্তাহের মতো লাগবে।

No comments

Powered by Blogger.