বিশ্ব এইডস দিবসঃ প্রতিরোধই একমাত্র সমাধান by অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম সরকার
আজ ‘বিশ্ব এইডস দিবস’। আমাদের দেশসহ বিশ্বের সব দেশে ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি সারাবিশ্বে পালন করা হয়। এইডস বিশ্ব মানবের স্বাস্থ্য ও উন্নয়নের প্রতি ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। এইচআইভি ও এইডস বাংলাদেশে বহুল পরিচিত দুটি শব্দ। সাধারণ মানুষের এইডস সংক্রান্ত ভাবনা একটাই, তা হলো এটি একটি ভয়ংকর রোগ, এটি দুরারোগ্যও বটে।
আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্লোগান দেয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ের একটি জনপ্রিয় স্লোগান হলো ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’। সত্যিই জানার বিকল্প নেই। কেননা, আজ অবধি এইডস রোগের প্রতিষেধক কোনো টিকা বা চিকিত্সায় ভালো হওয়ার কথা আমাদের জানা নেই। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই, এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে এটা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপযুক্ত কৌশল।
তথ্য আদান-প্রদান ও সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর বিস্তার হ্রাস করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনে এইডস সম্পর্কে প্রচার আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন শহরে এইডস সংক্রান্ত বিলবোর্ড লক্ষ্য করা যায়, যেখানে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এইডস মরণব্যাধি, যার অপর নাম মৃত্যু এ জাতীয় কথা লেখা থাকে। আফ্রিকার নর-নারী উভয়ই এইডসে সমভাবে আক্রান্ত। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত দেশে এইডস পুরুষদের মধ্যে এখনও বেশি দেখা যায়।
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাই এটা যে, এ রোগ নিরূপণের ব্যবস্থা ও চিকিত্সার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা অধিকাংশ নাগরিকের নেই। তাই প্রতিরোধের কৌশলই একমাত্র হাতিয়ার, যা সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম এ রোগ প্রকাশ পায় এবং একই সালের জুন মাসে সর্বপ্রথম প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় জর্জিয়া রাজ্যের আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল থেকে, লসঅ্যাঞ্জেলেসের পাঁচ সমকামী এইডস রোগে আক্রান্ত হয়। যদিও পরে তথ্য প্রকাশ হয়, ১৯৮১ সালের এক দশক আগে থেকেই আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এইডস মহামারি আকার ধারণ করেছে। সমকামীদের মধ্যে এইডস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এইডস রোগ ছড়ানোর উপায় চারটি যথা—১. এইডস ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মিলনের মাধ্যমে ২. দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে ৩. এইডস ভাইরাস আক্রান্ত মায়ের থেকে শিশু জন্মের আগে, জন্মের সময় ও জন্মের পরে ৪. সংক্রমিত সুচ এবং সিরিঞ্জের মাধ্যমে। তাই সব প্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে বলা যায়, এইচআইভি বা এইডস যে কোনো দেশের জন্য উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও ইন্দোনেশিয়ায় এইডস প্রতিহত করার সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় এখনও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অর্থাত্ এটা পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে, এখনও বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে এইডসের করাল গ্রাস থেকে সুরক্ষা দেয়া এবং এদেশে এইচআইভি প্রতিহত করার সুবর্ণ সুযোগ বিদ্যমান।
বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার যদিও কম তবু এইচআইভি বিস্তারের সার্বিক পরিস্থিতি থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের হার দ্রুত কমিয়ে আনতে না পারলে এ জনপদেও এইচআইভি মহামারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের হার ১.৭, যা বাংলাদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণের হারের তুলনায় সর্বোচ্চ, যথা—যৌনপল্লীর মহিলা যৌনকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার প্রায় ০.৫ এবং সমকামী জনগোষ্ঠী, পুরুষ যৌনকর্মী, ডককর্মী, ট্রাক ড্রাইভার অথবা রিকশাচালকদের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় শূন্যের কোটায়। তাছাড়া যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীতে শুধু একজনের রক্তের নমুনায় এইচআইভি সংক্রমণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় অতি নগণ্য। কিন্তু সংক্রমণের এই হার কি প্রমাণ করে বাংলাদেশ ভবিষ্যত্ এইচআইভি মহামারির ঝুঁকি থেকে মুক্ত?
বাংলাদেশ ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল ২০০১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে একজন ট্রাকচালক ও রিকশাচালকের বছরে ৬ থেকে ১০ জন যৌনসঙ্গী থাকে, পাশাপাশি যৌনপল্লীর একজন মহিলা যৌনকর্মীর সপ্তাহপ্রতি যৌনসঙ্গীর গড় সংখ্যা ১৮.৮ এবং আবাসিক হোটেলে একজন যৌনকর্মীর সপ্তাহপ্রতি যৌনসঙ্গীর গড় সংখ্যা ৪৪ জন, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বরং সমগ্র এশিয়ার অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় অত্যধিক।
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো এইচআইভি দ্বারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। সমগ্র বিশ্বে যত লোক এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে তার ৮০ ভাগের বসবাস দরিদ্রতম দেশগুলোতে। কেননা, গোটা দুনিয়ার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এইচআইভি সংক্রমণ পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী বিদেশে যায় চাকরির জন্য এবং পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও বাংলাদেশে আসেন। তাদের কেউ কেউ এইচআইভি ভাইরাস বহন করে বাংলাদেশে আসেন।
এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই একমাত্র প্রতিষেধক। এ ব্যাপারে ব্যক্তিবিশেষকে সচেতন হতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিরোধই একমাত্র হাতিয়ার আর সহস্রাব্দের (MDG : Millennium Development Goal) লক্ষ্য পূরণের জন্য সে হাতিয়ার আমাদের ব্যবহার করতে হবে সচেতনতা বাড়ানোর মধ্য দিয়েই।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল : advsagar29@gmail.com
তথ্য আদান-প্রদান ও সর্বস্তরে মানুষের মধ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এর বিস্তার হ্রাস করা সম্ভব। বাংলাদেশের সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনে এইডস সম্পর্কে প্রচার আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন শহরে এইডস সংক্রান্ত বিলবোর্ড লক্ষ্য করা যায়, যেখানে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এইডস মরণব্যাধি, যার অপর নাম মৃত্যু এ জাতীয় কথা লেখা থাকে। আফ্রিকার নর-নারী উভয়ই এইডসে সমভাবে আক্রান্ত। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত দেশে এইডস পুরুষদের মধ্যে এখনও বেশি দেখা যায়।
আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাই এটা যে, এ রোগ নিরূপণের ব্যবস্থা ও চিকিত্সার ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা অধিকাংশ নাগরিকের নেই। তাই প্রতিরোধের কৌশলই একমাত্র হাতিয়ার, যা সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম এ রোগ প্রকাশ পায় এবং একই সালের জুন মাসে সর্বপ্রথম প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয় জর্জিয়া রাজ্যের আটলান্টার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল থেকে, লসঅ্যাঞ্জেলেসের পাঁচ সমকামী এইডস রোগে আক্রান্ত হয়। যদিও পরে তথ্য প্রকাশ হয়, ১৯৮১ সালের এক দশক আগে থেকেই আফ্রিকা অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে এইডস মহামারি আকার ধারণ করেছে। সমকামীদের মধ্যে এইডস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এইডস রোগ ছড়ানোর উপায় চারটি যথা—১. এইডস ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে যৌন মিলনের মাধ্যমে ২. দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে ৩. এইডস ভাইরাস আক্রান্ত মায়ের থেকে শিশু জন্মের আগে, জন্মের সময় ও জন্মের পরে ৪. সংক্রমিত সুচ এবং সিরিঞ্জের মাধ্যমে। তাই সব প্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে বলা যায়, এইচআইভি বা এইডস যে কোনো দেশের জন্য উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। যদিও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ও ইন্দোনেশিয়ায় এইডস প্রতিহত করার সময় দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সে তুলনায় এখনও সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অর্থাত্ এটা পরিষ্কারভাবে বলা যেতে পারে, এখনও বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ প্রজন্মকে এইডসের করাল গ্রাস থেকে সুরক্ষা দেয়া এবং এদেশে এইচআইভি প্রতিহত করার সুবর্ণ সুযোগ বিদ্যমান।
বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার যদিও কম তবু এইচআইভি বিস্তারের সার্বিক পরিস্থিতি থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা যায়, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের হার দ্রুত কমিয়ে আনতে না পারলে এ জনপদেও এইচআইভি মহামারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় এইডস/এসটিডি প্রোগ্রাম, স্বাস্থ্য অধিদফতর কর্তৃক প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণের হার ১.৭, যা বাংলাদেশের অন্যান্য জনগোষ্ঠীতে সংক্রমণের হারের তুলনায় সর্বোচ্চ, যথা—যৌনপল্লীর মহিলা যৌনকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের হার প্রায় ০.৫ এবং সমকামী জনগোষ্ঠী, পুরুষ যৌনকর্মী, ডককর্মী, ট্রাক ড্রাইভার অথবা রিকশাচালকদের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় শূন্যের কোটায়। তাছাড়া যৌনবাহিত রোগে আক্রান্ত জনগোষ্ঠীতে শুধু একজনের রক্তের নমুনায় এইচআইভি সংক্রমণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে এইচআইভি সংক্রমণের হার নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়া তথা বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় অতি নগণ্য। কিন্তু সংক্রমণের এই হার কি প্রমাণ করে বাংলাদেশ ভবিষ্যত্ এইচআইভি মহামারির ঝুঁকি থেকে মুক্ত?
বাংলাদেশ ফ্যামিলি হেলথ ইন্টারন্যাশনাল ২০০১ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে একজন ট্রাকচালক ও রিকশাচালকের বছরে ৬ থেকে ১০ জন যৌনসঙ্গী থাকে, পাশাপাশি যৌনপল্লীর একজন মহিলা যৌনকর্মীর সপ্তাহপ্রতি যৌনসঙ্গীর গড় সংখ্যা ১৮.৮ এবং আবাসিক হোটেলে একজন যৌনকর্মীর সপ্তাহপ্রতি যৌনসঙ্গীর গড় সংখ্যা ৪৪ জন, যা শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, বরং সমগ্র এশিয়ার অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় অত্যধিক।
বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলো এইচআইভি দ্বারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছে। সমগ্র বিশ্বে যত লোক এইচআইভি আক্রান্ত হয়েছে তার ৮০ ভাগের বসবাস দরিদ্রতম দেশগুলোতে। কেননা, গোটা দুনিয়ার ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এইচআইভি সংক্রমণ পর্যালোচনা করলে পরিষ্কার দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশে সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর একটা বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী বিদেশে যায় চাকরির জন্য এবং পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকরাও বাংলাদেশে আসেন। তাদের কেউ কেউ এইচআইভি ভাইরাস বহন করে বাংলাদেশে আসেন।
এইচআইভি এইডস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোই একমাত্র প্রতিষেধক। এ ব্যাপারে ব্যক্তিবিশেষকে সচেতন হতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রতিরোধই একমাত্র হাতিয়ার আর সহস্রাব্দের (MDG : Millennium Development Goal) লক্ষ্য পূরণের জন্য সে হাতিয়ার আমাদের ব্যবহার করতে হবে সচেতনতা বাড়ানোর মধ্য দিয়েই।
লেখক : আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী
ই-মেইল : advsagar29@gmail.com
No comments