আলোয় ভূবন ভরাঃ ইতালীয় পুলিশ মুসলমানদের হয়রানি করে by কাজী জহিরুল ইসলাম
নাস্তার টেবিলে কথা হচ্ছিল রোববারটা কে কীভাবে কাটাব। কপাল ভালো আমাদের, অক্টোবরেও ইতালির তাপমাত্রা সামারের মতো একুশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ইরাকি নারী রিম আল ওয়াকিল, যার বর্তমান কর্মস্থল ইসলামাবাদ, টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে উঠে এসে আমার পাশে বসে বললেন, বারিতে চলে যান, অপূর্ব সুন্দর এক বন্দর শহর, সুআবিয়ান ক্যাসেলটা দেখে আসুন, টের পাবেন বারি’র শৌর্য-বীর্য আর সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ইতিহাস।
চমৎকার রোদেলা সকাল। আকাশে গাঢ় নীল ছড়ানো। ব্রিন্ডিসি থেকে আমরা জনপ্রতি ১১ ইউরো দিয়ে রিটার্ন টিকিট কেটে লোকাল ট্রেনে চড়ে বসি। বৈদ্যুতিক রেল ছুটে চলেছে বারি’র পথে। রিম বলেছিল, এক ঘণ্টার পথ, এখন তো দেখি পথ শেষই হতে চায় না। আমরা যখন ‘বারি সেন্ত্রালে’ এসে নামলাম তখন আড়াই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, মাথার ওপর দুপুরের খাড়া সূর্য। বেলা-অবেলার চিন্তা করে লাভ নেই, আমাদের ছুটতে হবে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে বারি’র সভ্যতা, সংস্কৃতি। খুঁজে বের করতে হবে সুআবিয়ান রাজপ্রাসাদ, আর সৈকতে তো যেতেই হবে। কিন্তু স্টেশনে নেমেই আমরা খেই হারিয়ে ফেলি। কোনদিকে যাব? ম্যাপের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। এই গোলাকার ভূ-গোলে অনেক ঘুরপাক খেয়েছি, কিছু অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই হয়েছে। অভিজ্ঞতা বলছে আমাদের সমুদ্রের দিকে যেতে হবে। ১১৩১ সালে যে সুআবিয়ান রাজপ্রাসাদ তৈরি করেছেন সিসিলির রাজা রজার-২, তা কোনোভাবেই সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে হওয়ার কথা নয়। আর এখান থেকে অড্রিয়াটিক সাগর উত্তর-পূর্বদিকে। সাহারের এসব ভূগোল জ্ঞান নেই, ও বলল, কোনদিকে যেতে হবে বলেন, আমি আপনার পেছনে আছি।
সমুদ্র লক্ষ্য করে হাঁটতে হাঁটতে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় এসে পড়েছি। একটি সুপ্রশস্ত হরাইজোন্টাল রাস্তা পেরিয়ে আমরা এক প্রাচীন চুনাপাথরের নগরে ঢুকে পড়লাম। অসংখ্য গলি-ঘুপচি, ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। সুনসান নীরবতা গলির ভেতর। আমাদের কথাগুলো অদ্ভুত এক প্রতিধ্বনি তৈরি করছে। গলিগুলোর দু’পাশে চুনাপাথরের বাড়ি-ঘর, দেখে মনে হচ্ছে পাথর কেটে কেটে এসব বাড়ি-ঘর বানানো হয়েছে। হঠাত্ মনে পড়ল, বারি’র ইতিহাস পড়তে গিয়ে পড়েছিলাম কাসামাসিমা নামক এক ওল্ড টাউনের কথা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৩ মিটার উঁচুতে নির্মিত। এই কি তাহলে সেই কাসামাসিমা? বইয়ে পড়া ইতিহাস পায়ে হেঁটে খুঁজে বের করতে পেরে আমি খানিকটা উত্তেজিত। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া দরকার। একটি সাদা ফিয়াট গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসছে। আমরা গলির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বেচারা অনেক কষ্টে আমাদের সামনে এসে ব্রেক করল। জানালার কাচ নামানোই ছিল। ইতালীয় ভাষায় টেনে টেনে কী বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে যেভাবে মুখ খিঁচতে শুরু করেছে, গালাগাল ছাড়া আর কিছু হবে না। আমি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, বোনাসেরা মসিয়, সিয়ামো দি তুরিস্তি। ইতালিয়ান ভাষা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার মতো, সিলেবলগুলো টেনে টেনে বলতে হয়। আমি তা প্রায় নকল করেই বলতে পারলাম। আমরা টুরিস্ট এ কথা শুনে সে খানিকটা নরম হলো। এই ট্রিক আমি আগেও খাটিয়েছি নানান দেশে। টুরিস্ট বললে ছোট-খাটো আইন ভঙ্গের অপরাধ খোদ পুলিশও মাফ করে দেয়। ফিয়াটের মালিকও মাফ করে দিল। কিন্তু যে কথা জানতে ওকে আটকেছি তা কমিউনিকেট করি কীভাবে? আমার ইতালীয় ভাষাজ্ঞান তো ওই পর্যন্তই। ইংরেজিতেই বলে ফেললাম, এটা কি কাসামাসিমা? ইয়েসে, ইত ই ইজে কাসামাসিইমা... ওকে জাপানিদের মতো মাথা নুইয়ে গ্রাতজিয়া বলে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলাম, সুয়াবিয়ান রাজপ্রাসাদ কোনদিকে? ওরও ইংরেজিজ্ঞান আমার ইতালিয়ানের মতোই। সে আর ইংরেজির ধারে-কাছেও গেল না। অনেকক্ষণ ধরে হাত নেড়ে নেড়ে কি সব বলল। বুঝলাম সে ডানে-বায়ে, বায়ে-ডানে করে অনেক টার্নের কথা বলল। সঙ্গে হয়তো দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য ইতালীয় ভাষায় কিছু গালাগালও দিয়ে থাকবে। টুরিস্টদের এসব গালাগাল গায়ে মাখতে হয় না। আমরা গায়ে মাখলাম না, মাথায়ও রাখলাম না। ওর গালিগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে সামনে পা বাড়ালাম।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর শুভ্র চুনাপাথরের গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম এক প্রশস্ত স্কয়ারে। আর তখনই একটি উটকো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হলো। আরেক আরবীয় নারীর দেখা পেয়ে গেল সাহার। আমরা তিনজন যখন দাঁড়িয়ে গল্প করছি তখন একটি মার্সিডিস এসে থামল আমাদের সামনে। লোকটি মধ্যবয়স্ক, আমাকে কাছে ডাকল। আমিও এগিয়ে গেলাম। পরিপাটি পোশাক পরা ইতালীয় ভদ্রলোক। আমাকে বলে, তোমার কাছে কী ধরনের ড্রাগ আছে? হেরোইন না হাসিস? আমি তো প্রশ্ন শুনে অবাক। বলে কি এই লোকটি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা, তুমি এসব কি বলছ? এরপর সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বলল তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। বলে তোমার ওই দু’জন স্ত্রীর কেউ কি ইতালিয়ান জানে? এবার আমি ভীষণ ক্ষেপে গেলাম। সাহারের নতুন বন্ধু, লেবানিজ মেয়েটি বুঝতে পেরেছে আমি কোনো ঝামেলায় পড়েছি, দৌড়ে এসেই আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটি তখন গাড়ি ব্যাকগিয়ারে দিয়ে আমাদের কাছে এসে তার আইডি দেখাল, আমি পুলিশ। তোমাদের কাছে আইডি বা পাসপোর্ট আছে? আমরা আইডি-পাসপোর্ট সব হোটেলে রেখে এসেছি কিন্তু আমার কাছে জাতিসংঘের মনোগ্রামখচিত ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। সেটাই বের করে দেখালাম। এরপর ইতালীয় পুলিশ ভেজা বেড়ালের মতো হুশ করে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
লেবানিজ মেয়েটির নাম নাদা, এখানে থাকে অনেক বছর। ওরও মাথায় স্কার্ফ। নাদা বলল, মুসলমান দেখলেই ইদানীং এই এরা নানানভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
সমুদ্র লক্ষ্য করে হাঁটতে হাঁটতে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় এসে পড়েছি। একটি সুপ্রশস্ত হরাইজোন্টাল রাস্তা পেরিয়ে আমরা এক প্রাচীন চুনাপাথরের নগরে ঢুকে পড়লাম। অসংখ্য গলি-ঘুপচি, ডানে-বাঁয়ে, সামনে-পেছনে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে। সুনসান নীরবতা গলির ভেতর। আমাদের কথাগুলো অদ্ভুত এক প্রতিধ্বনি তৈরি করছে। গলিগুলোর দু’পাশে চুনাপাথরের বাড়ি-ঘর, দেখে মনে হচ্ছে পাথর কেটে কেটে এসব বাড়ি-ঘর বানানো হয়েছে। হঠাত্ মনে পড়ল, বারি’র ইতিহাস পড়তে গিয়ে পড়েছিলাম কাসামাসিমা নামক এক ওল্ড টাউনের কথা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২৩ মিটার উঁচুতে নির্মিত। এই কি তাহলে সেই কাসামাসিমা? বইয়ে পড়া ইতিহাস পায়ে হেঁটে খুঁজে বের করতে পেরে আমি খানিকটা উত্তেজিত। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়া দরকার। একটি সাদা ফিয়াট গড়াতে গড়াতে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসছে। আমরা গলির ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বেচারা অনেক কষ্টে আমাদের সামনে এসে ব্রেক করল। জানালার কাচ নামানোই ছিল। ইতালীয় ভাষায় টেনে টেনে কী বলল, কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে যেভাবে মুখ খিঁচতে শুরু করেছে, গালাগাল ছাড়া আর কিছু হবে না। আমি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, বোনাসেরা মসিয়, সিয়ামো দি তুরিস্তি। ইতালিয়ান ভাষা বরিশালের আঞ্চলিক ভাষার মতো, সিলেবলগুলো টেনে টেনে বলতে হয়। আমি তা প্রায় নকল করেই বলতে পারলাম। আমরা টুরিস্ট এ কথা শুনে সে খানিকটা নরম হলো। এই ট্রিক আমি আগেও খাটিয়েছি নানান দেশে। টুরিস্ট বললে ছোট-খাটো আইন ভঙ্গের অপরাধ খোদ পুলিশও মাফ করে দেয়। ফিয়াটের মালিকও মাফ করে দিল। কিন্তু যে কথা জানতে ওকে আটকেছি তা কমিউনিকেট করি কীভাবে? আমার ইতালীয় ভাষাজ্ঞান তো ওই পর্যন্তই। ইংরেজিতেই বলে ফেললাম, এটা কি কাসামাসিমা? ইয়েসে, ইত ই ইজে কাসামাসিইমা... ওকে জাপানিদের মতো মাথা নুইয়ে গ্রাতজিয়া বলে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করলাম, সুয়াবিয়ান রাজপ্রাসাদ কোনদিকে? ওরও ইংরেজিজ্ঞান আমার ইতালিয়ানের মতোই। সে আর ইংরেজির ধারে-কাছেও গেল না। অনেকক্ষণ ধরে হাত নেড়ে নেড়ে কি সব বলল। বুঝলাম সে ডানে-বায়ে, বায়ে-ডানে করে অনেক টার্নের কথা বলল। সঙ্গে হয়তো দেরি করিয়ে দেয়ার জন্য ইতালীয় ভাষায় কিছু গালাগালও দিয়ে থাকবে। টুরিস্টদের এসব গালাগাল গায়ে মাখতে হয় না। আমরা গায়ে মাখলাম না, মাথায়ও রাখলাম না। ওর গালিগুলো মাটিতে ফেলে দিয়ে সামনে পা বাড়ালাম।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর শুভ্র চুনাপাথরের গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম এক প্রশস্ত স্কয়ারে। আর তখনই একটি উটকো ঝামেলার মুখোমুখি হতে হলো। আরেক আরবীয় নারীর দেখা পেয়ে গেল সাহার। আমরা তিনজন যখন দাঁড়িয়ে গল্প করছি তখন একটি মার্সিডিস এসে থামল আমাদের সামনে। লোকটি মধ্যবয়স্ক, আমাকে কাছে ডাকল। আমিও এগিয়ে গেলাম। পরিপাটি পোশাক পরা ইতালীয় ভদ্রলোক। আমাকে বলে, তোমার কাছে কী ধরনের ড্রাগ আছে? হেরোইন না হাসিস? আমি তো প্রশ্ন শুনে অবাক। বলে কি এই লোকটি। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমি জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা, তুমি এসব কি বলছ? এরপর সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে যা বলল তা শোনার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না মোটেও। বলে তোমার ওই দু’জন স্ত্রীর কেউ কি ইতালিয়ান জানে? এবার আমি ভীষণ ক্ষেপে গেলাম। সাহারের নতুন বন্ধু, লেবানিজ মেয়েটি বুঝতে পেরেছে আমি কোনো ঝামেলায় পড়েছি, দৌড়ে এসেই আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল। লোকটি তখন গাড়ি ব্যাকগিয়ারে দিয়ে আমাদের কাছে এসে তার আইডি দেখাল, আমি পুলিশ। তোমাদের কাছে আইডি বা পাসপোর্ট আছে? আমরা আইডি-পাসপোর্ট সব হোটেলে রেখে এসেছি কিন্তু আমার কাছে জাতিসংঘের মনোগ্রামখচিত ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। সেটাই বের করে দেখালাম। এরপর ইতালীয় পুলিশ ভেজা বেড়ালের মতো হুশ করে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।
লেবানিজ মেয়েটির নাম নাদা, এখানে থাকে অনেক বছর। ওরও মাথায় স্কার্ফ। নাদা বলল, মুসলমান দেখলেই ইদানীং এই এরা নানানভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে।
লেখক : কবি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক কর্মকর্তা
No comments