লিখেই প্রমাণ করতে হবে by আল মাহমুদ
কোরবানির ঈদ শেষ। একদা আমাদের দরিদ্র পরিবারে এই দিনটি এলে আমার আব্বা কষ্টেসৃষ্টে কোনোমতে একটি খাসি কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। খাসি না দিতে পারলে কীভাবে যেন একটা ভেড়া তিনি খুঁজে কিনে নিয়ে আসতেন। আমরা এতেই পরমানন্দ পেতাম এবং ভেড়ার গোশত ভাই-বোনেরা মহা আনন্দে আহার করতাম। আমরা গরিব ছিলাম। কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপারে আমরা অসন্তোষ প্রকাশ করিনি।
এখন তো আর ওই অবস্থাটি নেই। ছেলেমেয়েরা মিলে একটা গরু কোরবানি করি এবং মহা আনন্দে এতেই আমাদের পরিতৃপ্তির ব্যবস্থা আল্লাহ রহমানুর রাহীম করে দেন।
ইচ্ছে হয় অতীতে ফিরে যাই। যেখানে জমা হয়ে আছে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার বন্ধন। আমি চাইলেই তো আর আমার মতো করে পুরনো দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু আমার মন উচাটন হয়। আমি কি তবে একটু বেশি অতীতমুখী? অথচ আমি লেখালেখির কাজ করি। ফলে অতীত ভাঙিয়ে চলা সম্ভবপর নয়।
যেভাবেই হোক বর্তমানই লেখার উত্স হওয়া সবদিক থেকে সন্তোষজনক। আমার বর্তমান স্বভাবতই একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এর প্রধান কারণ হলো তেমন কোনো আয়-রোজগার নেই আমার। আর এ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের উপর আমার পক্ষে বাড়তি কোনো বোঝা চাপানো আমার বিবেচনায় সঠিক নয়।
আমি পরিবারে মিশে থাকি এমনভাবে যাতে কেউ আমাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে।
এ সময় লেখার ধারাটি বদলাতে পারলে হয়তোবা আমার উপকার হতো। কিন্তু অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমি সেটা সহসা পেরে উঠছি না। বিষয় থাকলেই যে সব বিষয়ে কলম ধরা যায় এটা ঠিক নয়। আমি পারি না। তবে এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে আমার পরিবারের এককালের অসহনীয় দারিদ্র্যের স্মৃতি মনে পড়ায় আমি স্তম্ভিত হয়ে জানালার দিকে কিছুক্ষণ চোখ মেলে বসে থাকি। চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠতে থাকে কত দুর্দশার চিত্র! হয়তোবা আমাকে লেখক হিসেবে সমৃদ্ধ করার জন্য এই দারিদ্র্যের দুঃখ একান্ত দরকার ছিল, কিংবা হয়তো কিছুই ছিল না। শুধু সময়ের বহমানতা উপলব্ধি করার জন্য আমাকে আমার প্রভু সহ্যগুণ দিয়ে সাজিয়েছিলেন।
আমার পিতার মুখটি আমার খুবই মনে পড়ে, তিনি ছিলেন একজন সজ্জন-সাধু মানুষ। যৌবনে সঙ্গীতেরও চর্চা করতেন। কিন্তু তার সব আয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যর্থ হয়ে গেলে তিনি অসহায়ের মতো দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছিলেন। আজ এতদিন পরে পিতার প্রতি আমার হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে হয় একটু নীরবে কাঁদি। কিন্তু আমি তো প্রকৃতপক্ষে কাঁদতেই জানি না।
তার অনেক গুণ ছিল। তিনি ছিলেন নিগুঢ় আধ্যাত্মিকতায় সাধক। দেশের অনেক দরবেশ, ফকির তার সঙ্গে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখতেন। আমাদের বাড়িতে এলে তাদের খাওয়ার প্রতি তিনি বিশেষ নজর দিতেন। আমার মাকে এজন্য অনেক কষ্ট দিয়েছেন। কিন্তু আমার মা স্বামীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকায় তা কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ করতেন না। কোনো পাগল দরবেশকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমার মা দুপুর রাতে কোরমা-পোলাও রাঁধার চেষ্টা করেছেন এবং সেটা করেছেন আমার পিতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমার পিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল আমার মায়ের। আজ যখন এতদিন পর এসব কথা মনে পড়ছে তখন স্বভাবতই আমার হৃদয়ে দুলুনি দ্রুত হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আমি ছিলাম তাদের প্রথম ভালোবাসার সন্তান!
এর উপর আমার মনের বাসনা হলো একটি উপন্যাস রচনা করার। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। পারব কি-না জানি না। পাঠকদের কোনো প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি না। শুধু বলতে চাই সম্ভব হলে আমি লিখব এক অসাধারণ ভালোবাসার কাহিনী যা আমি আমার শৈশবে আমার পিতা-মাতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আমার পিতাকে নিয়ে বেশি কিছু এ পর্যন্ত লিখিনি। ভয়ে লিখিনি। কারণ, লিখতে গিয়ে যদি আমি সঠিকভাবে তার চরিত্রকে মহিমান্বিত না করতে পারি তাহলে আমার মনে হবে আমার লেখক জীবনী অসার্থক হয়েছে। তবে ভয়মিশ্রিত কল্পনায় আমি তাকে খুবই স্মরণ করি এবং মনে মনে আমার লেখার কাঠামোটা কেমন হবে তা কল্পনা করি। আর কেবল প্রতিজ্ঞা করি আমি লিখব অসাধারণ কিছু। যে লেখা পাঠ করে সবাই শিহরিত হবেন আনন্দ-বেদনায় এবং স্বপ্ন কল্পনায়।
আমাদের দেশে এ ধরনের লেখা সাধারণত কেউ কষ্ট করে লিখতে চায় না। আমি মনে করি আমি পারব। এখন লিখেই সেটা প্রমাণ করতে হবে।
লেখক : কবি
ইচ্ছে হয় অতীতে ফিরে যাই। যেখানে জমা হয়ে আছে স্নেহ-মমতা-ভালোবাসার বন্ধন। আমি চাইলেই তো আর আমার মতো করে পুরনো দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনা যায় না। কিন্তু আমার মন উচাটন হয়। আমি কি তবে একটু বেশি অতীতমুখী? অথচ আমি লেখালেখির কাজ করি। ফলে অতীত ভাঙিয়ে চলা সম্ভবপর নয়।
যেভাবেই হোক বর্তমানই লেখার উত্স হওয়া সবদিক থেকে সন্তোষজনক। আমার বর্তমান স্বভাবতই একটু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এর প্রধান কারণ হলো তেমন কোনো আয়-রোজগার নেই আমার। আর এ অবস্থায় ছেলেমেয়েদের উপর আমার পক্ষে বাড়তি কোনো বোঝা চাপানো আমার বিবেচনায় সঠিক নয়।
আমি পরিবারে মিশে থাকি এমনভাবে যাতে কেউ আমাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনা-চিন্তা না করে।
এ সময় লেখার ধারাটি বদলাতে পারলে হয়তোবা আমার উপকার হতো। কিন্তু অস্বীকার করে লাভ নেই যে, আমি সেটা সহসা পেরে উঠছি না। বিষয় থাকলেই যে সব বিষয়ে কলম ধরা যায় এটা ঠিক নয়। আমি পারি না। তবে এই নিবন্ধটি লিখতে গিয়ে আমার পরিবারের এককালের অসহনীয় দারিদ্র্যের স্মৃতি মনে পড়ায় আমি স্তম্ভিত হয়ে জানালার দিকে কিছুক্ষণ চোখ মেলে বসে থাকি। চলচ্চিত্রের মতো ভেসে উঠতে থাকে কত দুর্দশার চিত্র! হয়তোবা আমাকে লেখক হিসেবে সমৃদ্ধ করার জন্য এই দারিদ্র্যের দুঃখ একান্ত দরকার ছিল, কিংবা হয়তো কিছুই ছিল না। শুধু সময়ের বহমানতা উপলব্ধি করার জন্য আমাকে আমার প্রভু সহ্যগুণ দিয়ে সাজিয়েছিলেন।
আমার পিতার মুখটি আমার খুবই মনে পড়ে, তিনি ছিলেন একজন সজ্জন-সাধু মানুষ। যৌবনে সঙ্গীতেরও চর্চা করতেন। কিন্তু তার সব আয়োজন, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যর্থ হয়ে গেলে তিনি অসহায়ের মতো দারিদ্র্যকে মেনে নিয়েছিলেন। আজ এতদিন পরে পিতার প্রতি আমার হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে হয় একটু নীরবে কাঁদি। কিন্তু আমি তো প্রকৃতপক্ষে কাঁদতেই জানি না।
তার অনেক গুণ ছিল। তিনি ছিলেন নিগুঢ় আধ্যাত্মিকতায় সাধক। দেশের অনেক দরবেশ, ফকির তার সঙ্গে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখতেন। আমাদের বাড়িতে এলে তাদের খাওয়ার প্রতি তিনি বিশেষ নজর দিতেন। আমার মাকে এজন্য অনেক কষ্ট দিয়েছেন। কিন্তু আমার মা স্বামীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকায় তা কোনো অবস্থাতেই প্রকাশ করতেন না। কোনো পাগল দরবেশকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমার মা দুপুর রাতে কোরমা-পোলাও রাঁধার চেষ্টা করেছেন এবং সেটা করেছেন আমার পিতাকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য। আমার পিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল আমার মায়ের। আজ যখন এতদিন পর এসব কথা মনে পড়ছে তখন স্বভাবতই আমার হৃদয়ে দুলুনি দ্রুত হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আমি ছিলাম তাদের প্রথম ভালোবাসার সন্তান!
এর উপর আমার মনের বাসনা হলো একটি উপন্যাস রচনা করার। আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। পারব কি-না জানি না। পাঠকদের কোনো প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি না। শুধু বলতে চাই সম্ভব হলে আমি লিখব এক অসাধারণ ভালোবাসার কাহিনী যা আমি আমার শৈশবে আমার পিতা-মাতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আমার পিতাকে নিয়ে বেশি কিছু এ পর্যন্ত লিখিনি। ভয়ে লিখিনি। কারণ, লিখতে গিয়ে যদি আমি সঠিকভাবে তার চরিত্রকে মহিমান্বিত না করতে পারি তাহলে আমার মনে হবে আমার লেখক জীবনী অসার্থক হয়েছে। তবে ভয়মিশ্রিত কল্পনায় আমি তাকে খুবই স্মরণ করি এবং মনে মনে আমার লেখার কাঠামোটা কেমন হবে তা কল্পনা করি। আর কেবল প্রতিজ্ঞা করি আমি লিখব অসাধারণ কিছু। যে লেখা পাঠ করে সবাই শিহরিত হবেন আনন্দ-বেদনায় এবং স্বপ্ন কল্পনায়।
আমাদের দেশে এ ধরনের লেখা সাধারণত কেউ কষ্ট করে লিখতে চায় না। আমি মনে করি আমি পারব। এখন লিখেই সেটা প্রমাণ করতে হবে।
লেখক : কবি
No comments