চৈতন্যের মুক্ত বাতায়ন-কিছু নেতার উল্টোদৌড় by যতীন সরকার
মানুষ চৈতন্যের সব বাতায়ন উন্মুক্ত করে দিতে পারে না। তার ফলেই নানা সময়ে মানুষের মনে নানা ধরনের ভুল ধারণা তথা মানস প্রতিবন্ধ দেখা দেয়। এ রকমটি কেবল আমাদের সাধারণ মানুষের বেলায়ই ঘটে না, অসাধারণ মানুষও অনেক সময়ই কোনো না কোনো মানস প্রতিবন্ধে আক্রান্ত হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে সে ধরনের প্রতিবন্ধ সারা জীবন ধরেই বিদ্যমান থাকে।
আমি এখানে এই মুহূর্তে উনিশ শতকের বাংলার 'সাহিত্য সম্রাট' বঙ্কিমচন্দ্রের কথা স্মরণ করছি। যেসব বিষয়ে তিনি মানস প্রতিবন্ধে আক্রান্ত ছিলেন সেসবের মধ্যে প্রধানটি ছিল 'আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক' বলে কথিত ও বিভিন্ন মহলে স্বীকৃত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে। বিদ্যাসাগরের সার্থক উত্তরসূরি রূপেই যে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যের সমৃদ্ধি সাধন করেছেন, এ বিষয়ে কোনোই সন্দেহ পোষণ করা চলে না। অথচ বঙ্কিমচন্দ্র নিজে বিদ্যাসাগরের কৃতীর স্বীকৃতি জানাতে একান্তই অনীহ ছিলেন এবং তাঁকে পাঠ্যপুস্তক রচয়িতার ঊধর্ে্ব স্থান দিতে মোটেই রাজি ছিলেন না। অনেকেই বলেছেন যে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তথা অখণ্ড ভারতবর্ষের প্রথম গ্র্যাজুয়েট বঙ্কিমচন্দ্রকে নাকি পরীক্ষক বিদ্যাসাগর বাংলায় পাস নম্বর দেননি এবং গ্রেসমার্ক পেয়ে তিনি বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের মানস প্রতিবন্ধের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার আচার্য-সুকুমার সেনও এ রকমই ইঙ্গিত করেছেন। আচার্য সেন কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের অবদানের মূল্যায়নে একান্তই পক্ষপাতহীন দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন, তাঁকে তিনি ঋষি বানিয়ে পূজাও করেননি, কিংবা একজাতের স্বঘোষিত 'প্রগতিশীলে'র মতো বঙ্কিমের মাথায় প্রতিক্রিয়াশীলতার কণ্টক মুকুটও পরিয়ে দেননি। অর্থাৎ প্রকৃত ইতিহাস-বীক্ষার অধিকারী এই গুণী মানুষটি তাঁর চৈতন্যের বাতায়ন খোলা রেখেই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় বস্তুনিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন।
তবে স্বাভাবিকভাবেই আচার্য সেনও তাঁর চৈতন্যের সবগুলো বাতায়ন উন্মুক্ত রাখতে পারেননি। অন্তত একটি বাতায়ন তো সারা জীবনই রুদ্ধ ছিল। আর তারই ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'বাঙাল-বিদ্বেষী'। বাঙালদের (অর্থাৎ পূর্ববাংলার অধিবাসীদের) কোনো গুণই তাঁর চোখে পড়েনি। কী কারণে তাঁর এ রকম মানস প্রতিবন্ধের সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা তা জানতে পারিনি। তবে পূর্ববাংলার অধিবাসী 'বাঙাল'দের যে সাহিত্য সৃষ্টির সামান্য ক্ষমতা ও বিন্দু পরিমাণ সাহিত্যবোধও নেই_এমন ভুল ধারণা সুকুমার সেনের চৈতন্যে যে দৃঢ়ভাবে গ্রথিত ছিল সেটি তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়। 'ময়মনসিংহ গীতিকা' ও 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' এখানকার পল্লীর মানুষের সৃষ্টি_এ কথা তিনি কোনোদিনই মানেননি। তাঁর মতে, এগুলো কৃত্রিমভাবে শিক্ষিত মানুষের হাতে রচিত। পূর্ববাংলার জেলা শহর ময়মনসিংহে বসবাস করে সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনায় ও সাহিত্যের ইতিহাসের উপকরণ সন্ধানে অসাধারণ কৃতীর পরিচয় রেখেছিলেন যে বাঙাল মনীষী কেদারনাথ মজুমদার, তাঁর প্রতিও সুকুমার সেন একান্তই অবজ্ঞা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। এহেন বাঙাল-বিদ্বেষীর কন্যার বিয়ে হচ্ছে এক বাঙাল অধ্যাপকের সঙ্গে_এ খবর শুনে সুকুমার সেনের শিক্ষক আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় উচ্চহাস্য সহকারে বলে উঠেছিলেন_'একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।'
বাংলা সাহিত্যের মূল্যায়নে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের মানস প্রতিবন্ধের কথা স্মরণ করলাম আমাদের রাজনীতির মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রকৃত অবদানের ব্যাপারে কিছু মানুষের মানস প্রতিবন্ধের বিষয়টি স্লট করে তোলার জন্য। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও যে নানা কারণে বিভিন্নজনের চৈতন্যের কোনো না কোনো বাতায়ন কখনো কখনো রুদ্ধ হয়ে যায়, সে ব্যাপারের প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যেই আমার এত কথার অবতারণা।
বর্তমানে প্রায় বিস্মৃত এখানকার দুজন রাজনৈতিক নেতার নাম আমি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। একজন অলি আহাদ ও অপরজন মাহমুদ আলী। পাক জামানায় প্রগতিশীল রাজনীতিতে এ দুজনেরই ছিল অসাধারণ ভূমিকা। অলি আহাদ 'পূর্ববাংলা শ্মশান কেন?' এই শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থনীতিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের যে বয়ান এই পুস্তিকাটিতে তুলে ধরা হয়েছিল, তেমনটি এর আগে আর কোথাও হয়নি। (পরবর্তীকালে স্বাধিকার আন্দোলনের তুঙ্গ অবস্থায়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' নাম দিয়ে যা প্রচার করা হয়েছিল, তার ভিত্তিটি কিন্তু অনেক আগে অলি আহাদই তৈরি করে দিয়েছিলেন।)
মাহমুদ আলী আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন ও ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের পর গঠিত 'যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন। কিন্তু সে সময়কার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অনুসৃত নীতিমালার সঙ্গে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় তিনি মন্ত্রিত্ব পরিত্যাগ করেন এবং পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ন্যাপ গঠনে অলি আহাদের অবদানও স্মরণযোগ্য। সে সময়কার আওয়ামী লীগের মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি ও পাকিস্তানের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসননীতির বিপরীতে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের সুস্পষ্ট স্বায়ত্তশাসনই ছিল ন্যাপের মূল রাজনৈতিক দর্শন। আর অর্থনীতিতে এ দলটি ছিল সমাজতন্ত্র সমর্থক।
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তাঁর হাতে আওয়ামী লীগের খোলনলচেই পাল্টে যায়। পররাষ্ট্রনীতিতে ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ এবং মুজিবের আওয়ামী লীগের ব্যবধান হয়ে পড়ে একেবারে মেরুপ্রতিম। তখনকার দুটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচির ব্যবধানও প্রায় ঘুচে যায়, 'এগারো দফা' উত্থাপনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলন র্যাডিকেল ভাবনার স্রোতধারায় প্রবেশ করে, সমগ্র পূর্ববাংলা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে।
অথচ এ সময় থেকেই অলি আহাদ ও মাহমুদ আলীর ভাবনায় লাগে উল্টোরথের টান, তাঁদের র্যাডিকেল চিন্তা-চেতনা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উন্মার্গগামী মাহমুদ আলী তো বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানে অবস্থান করে স্বাধীনতা-বিরোধিতা করেনই, স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানের মন্ত্রীরূপে এ দেশটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার অপপ্রয়াসে একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অলি আহাদ সে রকমটি না করলেও বাংলাদেশের নাগরিক রূপেই এমন সব ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন যাতে তাঁকে আগেকার প্রগতিশীল অলি আহাদ বলে চিনে নিতে কষ্ট হয়।
এঁদের চৈতন্যের বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার প্রকৃত হেতু বা হেতুগুলো চিহ্নিত করা খুবই কঠিন বৈকি। তবে আমার মনে হয় : শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র বিরূপতাই তাঁদের মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ। শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন। শেখ মুজিব যখন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ও অনুগামীরূপে কিছুটা হলেও ছিলেন রক্ষণশীলতার ধারক, তখন অলি আহাদ ও মাহমুদ আলী রাজনীতির র্যাডিকেল ধারাটিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ পরে একপর্যায়ে শেখ মুজিবই রাজনীতিতে অনেক বেশি র্যাডিকেল ও গণনন্দিত হয়ে উঠলেন, বাঙালির জাতীয় স্বার্থের প্রধান বাহকরূপে 'বঙ্গবন্ধু' আখ্যায় ভূষিত হলেন। যদি বলি অলি আহাদ বা মাহমুদ আলীই নন শুধু, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের সমবয়সী বা কিঞ্চিৎ অগ্রজ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার পক্ষেও তাঁকে সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাহলে কি ভুল করা হবে?
এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধী অবস্থানে চলে যাওয়া কিছু মানুষের চৈতন্য বাতায়ন রুদ্ধ হওয়ার ব্যাখ্যা যেমন দেওয়া চলে, তেমনই ব্যাখ্যা চলে বঙ্গবন্ধুর বিপুলসংখ্যক ভক্তেরও মানস প্রতিবন্ধের। সে রকম প্রতিবন্ধই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের বিচার-বিবেচনাহীন অন্ধ করে রাখে। অন্ধতা সর্বক্ষেত্রেই সত্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে পাচিল তুলে দেয়। মুজিবের অপক্ষপাত মূল্যায়নে তাঁর ভক্তদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে।
আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, কোনো মানুষই চৈতন্যের সব বাতায়ন সব সময় উন্মুক্ত রাখতে পারে না। তবে বাতায়ন উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রয়াসে কখনো ক্ষান্ত থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার জন্য এ বিষয়ে সচেতন সতর্কতা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত। সে রকম কাঙ্ক্ষিত সচেতনতার অভাবেই মানুষ উগ্র বামপন্থী বা উগ্র দক্ষিণপন্থীর খপ্পরে পড়ে যায়। বাংলাদেশের উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মতো কোনো কোনো উগ্র বামপন্থী গোষ্ঠীও পাকিস্তানের ভূতের আছরে আক্রান্ত থেকে দেশটিকে পুনঃ পাকিস্তানিকরণের অপপ্রয়াসে নিরত হয়।
অন্যদিকে ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তানেও কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের চৈতন্যের বাতায়ন উন্মুক্ত। এ রকমই একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের বক্তব্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর সাম্প্রতিক একটি লেখায় (যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১১) উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানি ওই সাংবাদিক লন্ডনে গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন_'তোমরা বড় ভাগ্যবান তাই শেখ মুজিবের মতো নেতা পেয়েছিলে। তিনি সময়মতো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের জংলি ফৌজি শাসন থেকে মুক্ত করে আলাদা স্বাধীন দেশ না করলে এখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে তোমরাও একদিকে তালেবানি সন্ত্রাসে জর্জরিত এবং অন্যদিকে মার্কিনি ড্রোন হামলার শিকার হতে। তোমরা এখন এই গ্রেট লিডারের সামান্য ভুলত্রুটির যতই সমালোচনা কর, এ কথা ভুললে চলবে না, তিনি তোমাদের স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং স্বাধীন নেশন স্টেট উপহার দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সহমরণে তোমাদের যেতে হয়নি।'
হ্যাঁ, বাংলাদেশকে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সহমরণে যেতে হয়নি, সে কথা ঠিক। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যে একটি স্বাধীন স্টেট আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, সে কথাও দিবালোকের মতোই সত্য। আবার সেই সত্যকে উল্টিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে সক্রিয় অপশক্তিও যে এ দেশে বিদ্যমান, সেই বেদনাদায়ক সত্যকেও তো অস্বীকার করতে পারছি না। এই অপশক্তির ধারক প্রতিটি মানুষের অন্তরেই পাকিস্তানের জন্য সীমাহীন দরদ, সেই দরদই 'স্বাধীন নেশন স্টেট'-এর স্থপতি শেখ মুজিবের প্রতি এদের ভেতর তীব্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে এবং সেই ঘৃণাতেই তাদের চৈতন্যের বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে গেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
তবে স্বাভাবিকভাবেই আচার্য সেনও তাঁর চৈতন্যের সবগুলো বাতায়ন উন্মুক্ত রাখতে পারেননি। অন্তত একটি বাতায়ন তো সারা জীবনই রুদ্ধ ছিল। আর তারই ফলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'বাঙাল-বিদ্বেষী'। বাঙালদের (অর্থাৎ পূর্ববাংলার অধিবাসীদের) কোনো গুণই তাঁর চোখে পড়েনি। কী কারণে তাঁর এ রকম মানস প্রতিবন্ধের সৃষ্টি হয়েছিল, আমরা তা জানতে পারিনি। তবে পূর্ববাংলার অধিবাসী 'বাঙাল'দের যে সাহিত্য সৃষ্টির সামান্য ক্ষমতা ও বিন্দু পরিমাণ সাহিত্যবোধও নেই_এমন ভুল ধারণা সুকুমার সেনের চৈতন্যে যে দৃঢ়ভাবে গ্রথিত ছিল সেটি তাঁর সাহিত্যের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়। 'ময়মনসিংহ গীতিকা' ও 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা' এখানকার পল্লীর মানুষের সৃষ্টি_এ কথা তিনি কোনোদিনই মানেননি। তাঁর মতে, এগুলো কৃত্রিমভাবে শিক্ষিত মানুষের হাতে রচিত। পূর্ববাংলার জেলা শহর ময়মনসিংহে বসবাস করে সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনায় ও সাহিত্যের ইতিহাসের উপকরণ সন্ধানে অসাধারণ কৃতীর পরিচয় রেখেছিলেন যে বাঙাল মনীষী কেদারনাথ মজুমদার, তাঁর প্রতিও সুকুমার সেন একান্তই অবজ্ঞা ও উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। এহেন বাঙাল-বিদ্বেষীর কন্যার বিয়ে হচ্ছে এক বাঙাল অধ্যাপকের সঙ্গে_এ খবর শুনে সুকুমার সেনের শিক্ষক আচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় উচ্চহাস্য সহকারে বলে উঠেছিলেন_'একেই বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ।'
বাংলা সাহিত্যের মূল্যায়নে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুকুমার সেনের মানস প্রতিবন্ধের কথা স্মরণ করলাম আমাদের রাজনীতির মূল্যায়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রকৃত অবদানের ব্যাপারে কিছু মানুষের মানস প্রতিবন্ধের বিষয়টি স্লট করে তোলার জন্য। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো রাজনীতিতেও যে নানা কারণে বিভিন্নজনের চৈতন্যের কোনো না কোনো বাতায়ন কখনো কখনো রুদ্ধ হয়ে যায়, সে ব্যাপারের প্রতি সহৃদয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যেই আমার এত কথার অবতারণা।
বর্তমানে প্রায় বিস্মৃত এখানকার দুজন রাজনৈতিক নেতার নাম আমি পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। একজন অলি আহাদ ও অপরজন মাহমুদ আলী। পাক জামানায় প্রগতিশীল রাজনীতিতে এ দুজনেরই ছিল অসাধারণ ভূমিকা। অলি আহাদ 'পূর্ববাংলা শ্মশান কেন?' এই শিরোনামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলেন। অর্থনীতিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের পর্বতপ্রমাণ বৈষম্যের যে বয়ান এই পুস্তিকাটিতে তুলে ধরা হয়েছিল, তেমনটি এর আগে আর কোথাও হয়নি। (পরবর্তীকালে স্বাধিকার আন্দোলনের তুঙ্গ অবস্থায়, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে 'সোনার বাংলা শ্মশান কেন?' নাম দিয়ে যা প্রচার করা হয়েছিল, তার ভিত্তিটি কিন্তু অনেক আগে অলি আহাদই তৈরি করে দিয়েছিলেন।)
মাহমুদ আলী আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন ও ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের পর গঠিত 'যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন। কিন্তু সে সময়কার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ অনুসৃত নীতিমালার সঙ্গে মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় তিনি মন্ত্রিত্ব পরিত্যাগ করেন এবং পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। ন্যাপ গঠনে অলি আহাদের অবদানও স্মরণযোগ্য। সে সময়কার আওয়ামী লীগের মার্কিনঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি ও পাকিস্তানের শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসননীতির বিপরীতে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশের সুস্পষ্ট স্বায়ত্তশাসনই ছিল ন্যাপের মূল রাজনৈতিক দর্শন। আর অর্থনীতিতে এ দলটি ছিল সমাজতন্ত্র সমর্থক।
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে, সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তাঁর হাতে আওয়ামী লীগের খোলনলচেই পাল্টে যায়। পররাষ্ট্রনীতিতে ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ এবং মুজিবের আওয়ামী লীগের ব্যবধান হয়ে পড়ে একেবারে মেরুপ্রতিম। তখনকার দুটি বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মসূচির ব্যবধানও প্রায় ঘুচে যায়, 'এগারো দফা' উত্থাপনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলন র্যাডিকেল ভাবনার স্রোতধারায় প্রবেশ করে, সমগ্র পূর্ববাংলা স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতার অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে।
অথচ এ সময় থেকেই অলি আহাদ ও মাহমুদ আলীর ভাবনায় লাগে উল্টোরথের টান, তাঁদের র্যাডিকেল চিন্তা-চেতনা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। উন্মার্গগামী মাহমুদ আলী তো বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানে অবস্থান করে স্বাধীনতা-বিরোধিতা করেনই, স্বাধীনতার পরও পাকিস্তানের মন্ত্রীরূপে এ দেশটিকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার অপপ্রয়াসে একেবারে মরিয়া হয়ে ওঠেন। অলি আহাদ সে রকমটি না করলেও বাংলাদেশের নাগরিক রূপেই এমন সব ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে থাকেন যাতে তাঁকে আগেকার প্রগতিশীল অলি আহাদ বলে চিনে নিতে কষ্ট হয়।
এঁদের চৈতন্যের বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার প্রকৃত হেতু বা হেতুগুলো চিহ্নিত করা খুবই কঠিন বৈকি। তবে আমার মনে হয় : শেখ মুজিবের প্রতি তীব্র বিরূপতাই তাঁদের মানস প্রতিবন্ধ সৃষ্টি হওয়ার প্রধান কারণ। শেখ মুজিবের সঙ্গে প্রায় একই সময়ে তাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় হন। শেখ মুজিব যখন সোহরাওয়ার্দীর অনুসারী ও অনুগামীরূপে কিছুটা হলেও ছিলেন রক্ষণশীলতার ধারক, তখন অলি আহাদ ও মাহমুদ আলী রাজনীতির র্যাডিকেল ধারাটিকেই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অথচ পরে একপর্যায়ে শেখ মুজিবই রাজনীতিতে অনেক বেশি র্যাডিকেল ও গণনন্দিত হয়ে উঠলেন, বাঙালির জাতীয় স্বার্থের প্রধান বাহকরূপে 'বঙ্গবন্ধু' আখ্যায় ভূষিত হলেন। যদি বলি অলি আহাদ বা মাহমুদ আলীই নন শুধু, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের সমবয়সী বা কিঞ্চিৎ অগ্রজ বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতার পক্ষেও তাঁকে সহ্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাহলে কি ভুল করা হবে?
এভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধী অবস্থানে চলে যাওয়া কিছু মানুষের চৈতন্য বাতায়ন রুদ্ধ হওয়ার ব্যাখ্যা যেমন দেওয়া চলে, তেমনই ব্যাখ্যা চলে বঙ্গবন্ধুর বিপুলসংখ্যক ভক্তেরও মানস প্রতিবন্ধের। সে রকম প্রতিবন্ধই বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁদের বিচার-বিবেচনাহীন অন্ধ করে রাখে। অন্ধতা সর্বক্ষেত্রেই সত্য অনুধাবনের ক্ষেত্রে পাচিল তুলে দেয়। মুজিবের অপক্ষপাত মূল্যায়নে তাঁর ভক্তদের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে।
আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, কোনো মানুষই চৈতন্যের সব বাতায়ন সব সময় উন্মুক্ত রাখতে পারে না। তবে বাতায়ন উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রয়াসে কখনো ক্ষান্ত থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার জন্য এ বিষয়ে সচেতন সতর্কতা অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত। সে রকম কাঙ্ক্ষিত সচেতনতার অভাবেই মানুষ উগ্র বামপন্থী বা উগ্র দক্ষিণপন্থীর খপ্পরে পড়ে যায়। বাংলাদেশের উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মতো কোনো কোনো উগ্র বামপন্থী গোষ্ঠীও পাকিস্তানের ভূতের আছরে আক্রান্ত থেকে দেশটিকে পুনঃ পাকিস্তানিকরণের অপপ্রয়াসে নিরত হয়।
অন্যদিকে ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্র পাকিস্তানেও কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের চৈতন্যের বাতায়ন উন্মুক্ত। এ রকমই একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের বক্তব্য আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর সাম্প্রতিক একটি লেখায় (যুগান্তর, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১১) উল্লেখ করেছেন। পাকিস্তানি ওই সাংবাদিক লন্ডনে গাফ্ফার চৌধুরীকে বলেছিলেন_'তোমরা বড় ভাগ্যবান তাই শেখ মুজিবের মতো নেতা পেয়েছিলে। তিনি সময়মতো বাংলাদেশকে পাকিস্তানের জংলি ফৌজি শাসন থেকে মুক্ত করে আলাদা স্বাধীন দেশ না করলে এখন পাকিস্তানের পূর্বাংশ হিসেবে তোমরাও একদিকে তালেবানি সন্ত্রাসে জর্জরিত এবং অন্যদিকে মার্কিনি ড্রোন হামলার শিকার হতে। তোমরা এখন এই গ্রেট লিডারের সামান্য ভুলত্রুটির যতই সমালোচনা কর, এ কথা ভুললে চলবে না, তিনি তোমাদের স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং স্বাধীন নেশন স্টেট উপহার দিয়ে গেছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে সহমরণে তোমাদের যেতে হয়নি।'
হ্যাঁ, বাংলাদেশকে যে পাকিস্তানের সঙ্গে সহমরণে যেতে হয়নি, সে কথা ঠিক। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু যে একটি স্বাধীন স্টেট আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন, সে কথাও দিবালোকের মতোই সত্য। আবার সেই সত্যকে উল্টিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে সক্রিয় অপশক্তিও যে এ দেশে বিদ্যমান, সেই বেদনাদায়ক সত্যকেও তো অস্বীকার করতে পারছি না। এই অপশক্তির ধারক প্রতিটি মানুষের অন্তরেই পাকিস্তানের জন্য সীমাহীন দরদ, সেই দরদই 'স্বাধীন নেশন স্টেট'-এর স্থপতি শেখ মুজিবের প্রতি এদের ভেতর তীব্র ঘৃণার জন্ম দিয়েছে এবং সেই ঘৃণাতেই তাদের চৈতন্যের বাতায়ন রুদ্ধ হয়ে গেছে।
লেখক : শিক্ষাবিদ
No comments