‘আল্লাহ্রে আমাদের বাঁচাও’
মহিউদ্দীন জুয়েল, চট্টগ্রাম থেকে: ‘হে আল্লাহ্, দোহাই তোমার। আমাদের বাঁচাও। ভাই কে
কোথায় আছেন। সবাই পুড়ে মারা গেল। আগুন, আগুন! ঘরে ঢুকে পড়লো। ওদের ডেকে তুলুন।’
গভীর রাতে লোকজনের আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা। ঘড়িতে তখন রাত ২ টা ৪৫ মিনিট। গত বুধবার ওই আবাসিক এলাকার এক নম্বর রোডের ‘এ’ ব্লকের চারতলা ভবনটির সব বাসিন্দা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুমে অচেতন।
এমন সময় ভবনটির নিচতলায় থাকা একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যেই তা পাশের একটি গাড়ির গ্যারেজে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গ্যারেজের ভেতর রাখা মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে পুরো ভবনটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এতে আধোঘুমে কেউ কেউ বের হয়ে আসতে পারলেও দম বন্ধ হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাদের লাশ উদ্ধার করেন।
নিহত এই ব্যক্তিরা হলেন- বাড়ির কর্তা জাবের মো. ইকবাল (৩২), স্ত্রী তামান্না সিদ্দিকী (২৫), ভাগ্নে শাওন (৮), ভাই মোদাচ্ছের (২০) ও গৃহকর্মী রুমী। তাদের সবার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়ায়। নিহত জাবের পেশায় একজন ব্যাংকার। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চৌধুরীহাটের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখায় কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী তামান্না ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের দুই জনের বিয়ের প্রথম বছর চলছিল। একইসঙ্গে তামান্না নগরীর সরকারি হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে ভিড় করেন প্রচুর আত্মীয়স্বজন। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার এক নম্বর রোডের ৬/৩ এর ওই ভবনটির মালিক পারভেজ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি। ভবনটির নিচ তলায় ছিল বিউটি পার্লার, গাড়ির গ্যারেজ ও ভাই ভাই নামের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। গত বছরের শুরুর দিকে নিহত জাবের এখানে ৪র্থ তলাটি ভাড়া নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ঘটনার দিন বুধবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে আগুন লাগে। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ভোর পৌনে ৫টায় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুন লাগার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বাসিন্দারা ভবনের কার্নিশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। আগুনের বিষয়টি বুঝতে না পেরে চতুর্থ তলার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হয়েই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে ওই ঘরের দুই বাসিন্দা ভবনের কার্নিশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাকিরা আটকা পড়েন। ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের এক ভাই জুবায়ের ঘটনাটি টের পেয়ে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে আগুনের লেলিহান শিখা আরও তীব্র হলে একপর্যায়ে সে তার ছোটভাই আফরানকে লুঙ্গিতে বেঁধে বাসার ব্যালকনিতে গিয়ে চারতলা থেকে লাফ দেন। এতে দুইজন আঘাত পেলেও প্রাণে বেঁচে যান। নিহত তামান্নার বড় বোনের স্বামী কাজী সিদ্দিক মানবজমিনকে জানান, চার ভাইয়ের মধ্যে নিহত জাবের সবার বড়। ঘটনার সময় তারা দুই ভাই বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু বাকি দুই ভাই একই বাসায় থেকেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।
তিনি আরও জানান, ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের সঙ্গে মারা যান সেজো ভাই মোদাচ্ছির ইকবাল। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি মেট্রোপলিটন কমার্স কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। বড় ভাইয়ের বাসা থেকেই সে পড়ালেখা করতো। বেঁচে যাওয়া একই বাসায় বসবাস করা মেজো ভাই হলেন জুবায়ের ইকবাল (২৪)। তিনি নগরীর আগ্রাবাদে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অপর ছোটভাই আফরান ইকবাল লোহাগড়ায় তাদের গ্রামের বাড়িতে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ওই ভবনের সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন ভাই ভাই মুদি দোকান থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা গ্যারেজে রাখা একটি মাইক্রোর গ্যাস সিলিন্ডারে গিয়ে পড়ে। এরপর তা বিস্ফোরণ হলে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আশপাশের দুই-একজন এই ঘটনা দেখে চিৎকার করতে শুরু করলে ঘুমিয়ে থাকা ভবনের কেউ কেউ তা টের পান। প্রাণে বাঁচতে ভবনের বাসিন্দারা তৃতীয় তলার সবাই একে একে নেমে আসেন। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার কারণে ৪র্থ তলার লোকজনের সবাই উপর থেকে নিচে নামতে পারেননি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাঁচলাইশ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবদুুল মান্নান ঘটনাটি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘আগুন লাগার পর ভবনটির অনেকেই তা টের পেয়ে নিচে নেমে আসেন। কেউ কেউ লাফ দিয়ে প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু ৪র্থ তলার লোকজন গভীর ঘুমে থাকায় তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। এতে দম বন্ধ হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের সবাই মারা গেছেন বলে আমাদের ধারণা।’
ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে তা গাড়ির গ্যারেজে, সেখান থেকে মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। সিলিন্ডারের বিষাক্ত ধোঁয়া বাড়ির সবাইকে আচ্ছন্ন করে। অনেকে বাঁচতে পারলেও ৫ জনের মৃত্যুর বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
মূল ফটক বন্ধ ছিল: এদিকে আগুন লাগার সূত্রপাত ও কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, চারতলা ভবনের নিচতলায় অবস্থিত ভাই ভাই স্টোর নামের দোকান থেকেই আগুন লাগার বিষয়টি তারা নিশ্চিত হয়েছেন। আর মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাড়ির সবাই আক্রান্ত হন। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে নিহতরা একপর্যায়ে চেষ্টা করেও আর হয়তো বের হতে পারেননি। ঘটনার পরপরই ভবনের বাসিন্দাদের দুই-একজন তাদের জানিয়েছেন, রাতের বেলায় নিরাপত্তার কারণে বাড়ির মূল ফটকে তালা দেয়া ছিল। তাই এই সময় প্রাণে বাঁচতে নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত বাসার বাসিন্দারা সবাই ব্যালকনি দিয়ে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু চারতলা থেকে ব্যালকনি দিয়ে গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে নিচে নামতে পারেননি জাবের। সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভাগ্নে শাওনের লাশ পান ওই বাড়ির সিঁড়িতে। ধারণা করা হচ্ছে, শাওন দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে বিষাক্ত ধোঁয়া ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লে সবাই দম আটকে মারা যান। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম উপ-সহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার সময় মূল ফটক বন্ধ ছিল। পাশপাশি ওই বাড়িতে অগ্নিনির্বাপক কোন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
অনাগত সন্তানের মৃত্যু: এদিকে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা জাবের মো. ইকবাল এর স্ত্রী তামান্না সিদ্দিকীর মৃত্যু কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না তার পরিবার। পরিবারের লোকজনেরা জানান, তামান্না সিদ্দিকীর গর্ভে ছিল আট মাসের সন্তান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই এই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তাই প্রথম সন্তানের আগমন নিয়ে খুশির অন্ত ছিল না তামান্নার। গতকাল হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায় অগ্নিকাণ্ডে মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন পরিবারের লোকজন। পিতা আবদুল হান্নান সিদ্দিকীর মেয়ের নাম ধরে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১২ই ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে আদরের তামান্নার সঙ্গে জাবের মোহাম্মদ ইকবালের বিয়ে হয়। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল আমার মেয়ে। এই ফেব্রুয়ারিতে তার সন্তান পৃথিবীর আলোর মুখ দেখার কথা। কিন্তু তার আগেই তো সব শেষ।’
তামান্নার পরিবারের মতো সরকারি হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজের সহপাঠীরাও ছিলেন বাকরুদ্ধ। তানজিনা নাসরিন পান্না ও মারিয়াম ইসলাম ন্যান্সি নামের দুই বান্ধবী বলেন, ‘কি বলবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তিনদিন আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ১০ই জানুয়ারি থেকে আমাদের মাস্টার্সের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তামান্না প্রেগন্যান্ট হওয়ায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। এই নিয়ে খানিক দুঃখবোধ থাকলেও সন্তান আসার খবরে সে তা যেন ভুলে যেতে চেয়েছিল। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে তার প্রায়ই কথা হতো।’
বেড়াতে এসে লাশ: নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের ভাগ্নে শাওনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। আর তাই সে বায়না ধরেছিল মামার বাড়িতে বেড়াতে আসবে। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় চান্দগাঁওয়ের এই ভবনে। শাওন লোহাগড়ায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তো। আফসোস, মামার বাসায় বেড়াতে এসে লাশ হয়ে ফিরলো ছোট্ট ছেলেটি!
কোথায় আছেন। সবাই পুড়ে মারা গেল। আগুন, আগুন! ঘরে ঢুকে পড়লো। ওদের ডেকে তুলুন।’
গভীর রাতে লোকজনের আর্তচিৎকারে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা। ঘড়িতে তখন রাত ২ টা ৪৫ মিনিট। গত বুধবার ওই আবাসিক এলাকার এক নম্বর রোডের ‘এ’ ব্লকের চারতলা ভবনটির সব বাসিন্দা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঘুমে অচেতন।
এমন সময় ভবনটির নিচতলায় থাকা একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বৈদ্যুতিক সংযোগ থেকে আগুন লাগে। মুহূর্তের মধ্যেই তা পাশের একটি গাড়ির গ্যারেজে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গ্যারেজের ভেতর রাখা মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে পুরো ভবনটি ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। এতে আধোঘুমে কেউ কেউ বের হয়ে আসতে পারলেও দম বন্ধ হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস ও আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাদের লাশ উদ্ধার করেন।
নিহত এই ব্যক্তিরা হলেন- বাড়ির কর্তা জাবের মো. ইকবাল (৩২), স্ত্রী তামান্না সিদ্দিকী (২৫), ভাগ্নে শাওন (৮), ভাই মোদাচ্ছের (২০) ও গৃহকর্মী রুমী। তাদের সবার বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগড়ায়। নিহত জাবের পেশায় একজন ব্যাংকার। তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারীর চৌধুরীহাটের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক শাখায় কর্মরত ছিলেন। তার স্ত্রী তামান্না ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাদের দুই জনের বিয়ের প্রথম বছর চলছিল। একইসঙ্গে তামান্না নগরীর সরকারি হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নিহত ব্যক্তিদের খোঁজ নিতে ভিড় করেন প্রচুর আত্মীয়স্বজন। এ সময় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার এক নম্বর রোডের ৬/৩ এর ওই ভবনটির মালিক পারভেজ মোল্লা নামের এক ব্যক্তি। ভবনটির নিচ তলায় ছিল বিউটি পার্লার, গাড়ির গ্যারেজ ও ভাই ভাই নামের একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। গত বছরের শুরুর দিকে নিহত জাবের এখানে ৪র্থ তলাটি ভাড়া নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ঘটনার দিন বুধবার রাত ২টা ৪৫ মিনিটে আগুন লাগে। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যান। ভোর পৌনে ৫টায় তারা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। আগুন লাগার পর দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বাসিন্দারা ভবনের কার্নিশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। আগুনের বিষয়টি বুঝতে না পেরে চতুর্থ তলার বাসিন্দারা ঘর থেকে বের হয়েই ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে ওই ঘরের দুই বাসিন্দা ভবনের কার্নিশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারলেও বাকিরা আটকা পড়েন। ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের এক ভাই জুবায়ের ঘটনাটি টের পেয়ে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে আগুনের লেলিহান শিখা আরও তীব্র হলে একপর্যায়ে সে তার ছোটভাই আফরানকে লুঙ্গিতে বেঁধে বাসার ব্যালকনিতে গিয়ে চারতলা থেকে লাফ দেন। এতে দুইজন আঘাত পেলেও প্রাণে বেঁচে যান। নিহত তামান্নার বড় বোনের স্বামী কাজী সিদ্দিক মানবজমিনকে জানান, চার ভাইয়ের মধ্যে নিহত জাবের সবার বড়। ঘটনার সময় তারা দুই ভাই বিষাক্ত ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। কিন্তু বাকি দুই ভাই একই বাসায় থেকেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন।
তিনি আরও জানান, ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের সঙ্গে মারা যান সেজো ভাই মোদাচ্ছির ইকবাল। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর বেসরকারি মেট্রোপলিটন কমার্স কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। বড় ভাইয়ের বাসা থেকেই সে পড়ালেখা করতো। বেঁচে যাওয়া একই বাসায় বসবাস করা মেজো ভাই হলেন জুবায়ের ইকবাল (২৪)। তিনি নগরীর আগ্রাবাদে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অপর ছোটভাই আফরান ইকবাল লোহাগড়ায় তাদের গ্রামের বাড়িতে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ওই ভবনের সাইফুল ইসলামের মালিকানাধীন ভাই ভাই মুদি দোকান থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। পরে তা গ্যারেজে রাখা একটি মাইক্রোর গ্যাস সিলিন্ডারে গিয়ে পড়ে। এরপর তা বিস্ফোরণ হলে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। আশপাশের দুই-একজন এই ঘটনা দেখে চিৎকার করতে শুরু করলে ঘুমিয়ে থাকা ভবনের কেউ কেউ তা টের পান। প্রাণে বাঁচতে ভবনের বাসিন্দারা তৃতীয় তলার সবাই একে একে নেমে আসেন। কিন্তু ঘুমিয়ে থাকার কারণে ৪র্থ তলার লোকজনের সবাই উপর থেকে নিচে নামতে পারেননি। জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পাঁচলাইশ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আবদুুল মান্নান ঘটনাটি দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি মানবজমিনকে বলেন, ‘আগুন লাগার পর ভবনটির অনেকেই তা টের পেয়ে নিচে নেমে আসেন। কেউ কেউ লাফ দিয়ে প্রাণে বাঁচেন। কিন্তু ৪র্থ তলার লোকজন গভীর ঘুমে থাকায় তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি। এতে দম বন্ধ হয়ে একই পরিবারের ৫ জনের সবাই মারা গেছেন বলে আমাদের ধারণা।’
ঘটনার বিষয়ে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক মো. আবদুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, ‘ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে তা গাড়ির গ্যারেজে, সেখান থেকে মাইক্রোবাসের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। সিলিন্ডারের বিষাক্ত ধোঁয়া বাড়ির সবাইকে আচ্ছন্ন করে। অনেকে বাঁচতে পারলেও ৫ জনের মৃত্যুর বিষয়টি আমরা নিশ্চিত হয়েছি।’
মূল ফটক বন্ধ ছিল: এদিকে আগুন লাগার সূত্রপাত ও কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জানান, চারতলা ভবনের নিচতলায় অবস্থিত ভাই ভাই স্টোর নামের দোকান থেকেই আগুন লাগার বিষয়টি তারা নিশ্চিত হয়েছেন। আর মাইক্রোবাসের গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটলে এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় বাড়ির সবাই আক্রান্ত হন। ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে নিহতরা একপর্যায়ে চেষ্টা করেও আর হয়তো বের হতে পারেননি। ঘটনার পরপরই ভবনের বাসিন্দাদের দুই-একজন তাদের জানিয়েছেন, রাতের বেলায় নিরাপত্তার কারণে বাড়ির মূল ফটকে তালা দেয়া ছিল। তাই এই সময় প্রাণে বাঁচতে নিচতলা থেকে তিনতলা পর্যন্ত বাসার বাসিন্দারা সবাই ব্যালকনি দিয়ে বের হয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু চারতলা থেকে ব্যালকনি দিয়ে গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে নিচে নামতে পারেননি জাবের। সকালে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভাগ্নে শাওনের লাশ পান ওই বাড়ির সিঁড়িতে। ধারণা করা হচ্ছে, শাওন দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করে। এতে বিষাক্ত ধোঁয়া ঘরের ভেতর ঢুকে পড়লে সবাই দম আটকে মারা যান। জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম উপ-সহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার সময় মূল ফটক বন্ধ ছিল। পাশপাশি ওই বাড়িতে অগ্নিনির্বাপক কোন কিছু আমাদের চোখে পড়েনি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না।’
অনাগত সন্তানের মৃত্যু: এদিকে দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা জাবের মো. ইকবাল এর স্ত্রী তামান্না সিদ্দিকীর মৃত্যু কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না তার পরিবার। পরিবারের লোকজনেরা জানান, তামান্না সিদ্দিকীর গর্ভে ছিল আট মাসের সন্তান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই এই সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসকরা। তাই প্রথম সন্তানের আগমন নিয়ে খুশির অন্ত ছিল না তামান্নার। গতকাল হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখা যায় অগ্নিকাণ্ডে মেয়ের মৃত্যুর খবর শুনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাজালিয়া গ্রাম থেকে ছুটে এসেছেন পরিবারের লোকজন। পিতা আবদুল হান্নান সিদ্দিকীর মেয়ের নাম ধরে কাঁদছিলেন। তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১২ই ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে আদরের তামান্নার সঙ্গে জাবের মোহাম্মদ ইকবালের বিয়ে হয়। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল আমার মেয়ে। এই ফেব্রুয়ারিতে তার সন্তান পৃথিবীর আলোর মুখ দেখার কথা। কিন্তু তার আগেই তো সব শেষ।’
তামান্নার পরিবারের মতো সরকারি হাজী মুহম্মদ মুহসীন কলেজের সহপাঠীরাও ছিলেন বাকরুদ্ধ। তানজিনা নাসরিন পান্না ও মারিয়াম ইসলাম ন্যান্সি নামের দুই বান্ধবী বলেন, ‘কি বলবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তিনদিন আগেও তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। ১০ই জানুয়ারি থেকে আমাদের মাস্টার্সের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তামান্না প্রেগন্যান্ট হওয়ায় পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। এই নিয়ে খানিক দুঃখবোধ থাকলেও সন্তান আসার খবরে সে তা যেন ভুলে যেতে চেয়েছিল। এ নিয়ে আমাদের সঙ্গে তার প্রায়ই কথা হতো।’
বেড়াতে এসে লাশ: নিহত ব্যাংক কর্মকর্তা জাবেরের ভাগ্নে শাওনের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছিল। আর তাই সে বায়না ধরেছিল মামার বাড়িতে বেড়াতে আসবে। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে আসা হয় চান্দগাঁওয়ের এই ভবনে। শাওন লোহাগড়ায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীতে পড়তো। আফসোস, মামার বাসায় বেড়াতে এসে লাশ হয়ে ফিরলো ছোট্ট ছেলেটি!
No comments