আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৪৬)-ছাত্ররাজনীতিতে আমার দীক্ষা by আলী যাকের
পরীক্ষা হয়ে গেল। হঠাৎ অবসাদে ছেয়ে গেল মন। বাড়িতে ফিরতে মন আর চায় না। কেউ তো নেই_মা-বাবা, দিদি_যাঁদের কাছে ফিরে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করতাম সব সময়। কত রাতে বন্ধুদের আমন্ত্রণ, রাতভর মজা করব_এমন প্রলোভন অবলীলায় কাটিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছি। আমাদের জাতীয় সংগীতে রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গানের একটা অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ওই অনুচ্ছেদটি আমার সবচেয়ে প্রিয়, 'ও মা দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে, তখন খেলাধুলা সকল ফেলে তোমার কোলে ছুটে আসি।' আমি চিরকাল সন্ধ্যাকালের দীপ জ্বললেই বাড়ি ফেরার তাগিদ অনুভব করেছি। সেই আমি এখন কোথায় যাব? তবে একটি ব্যাপার; আমাদের এই পারিবারিক বন্ধন কেবল যে আমাদের পরিবারমুখী করেছিল তা নয়। আমাদের ঘরমুখীও করেছিল। পরিবার, পিতা, মাতা_সব একই সূত্রে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। আমি অনেক পরে আমার কোনো একটি লেখায় উল্লেখও করেছিলাম যে সব পরবে আপামর বাঙালি ঘরে ফেরে। আমার ফেরার মতো ঘর নেই। অবশ্য আমি তখনো ঘর বাঁধিনি। তবে আমার নিজের ঘর হওয়ার পরও আমি ঘরের অভাব বোধ করেছি।
এই অভাব বোধ থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক মানসিকতার উদ্ভবও হয়েছে আমার মধ্যে। মা ছাড়া যেমন একটি পরিবারকে ভাবা যায় না, তেমনি নিজের অস্তিত্বের জন্য 'দেশ' নামের এক মায়ের প্রয়োজন যে আছে, সে উপলব্ধি আমি সেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় থেকেই অনুভব করেছি। তাই আমার বাবার রাজনীতির সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি কোনো কালেই। বাবারা পাকিস্তান চেয়েছিলেন। আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রনীতির সারবত্তাহীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছি সেই ১৭-১৮ বছর বয়স থেকেই। আমার মনে পড়ে, এ নিয়ে বাবার সঙ্গে একবার তুমুল তর্ক হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি, বাবা মুসলিম লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। আমি বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তাঁর রাজনীতি ভ্রান্ত ছিল। শেষে আমাদের মধ্যে এমন একটা সন্ধি হলো যে তাঁর রাজনীতি তাঁর, আর আমার বিশ্বাস আমার। আমরা সমান্তরাল রেখায় পথ চলব। সেসব দিনের কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীরা সাধারণত বামপন্থী অথবা বামঘেঁষা ছিলেন। তাঁরাই বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছিলেন। ওই সময় বিশ্ব অর্থনীতির ওপর যা কিছু পড়াশোনা, আমাদের অর্থনীতির ওপরে চিন্তা-ভাবনা_সবই ওই বাম রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অবদান। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাও সম্যক বুঝেছি আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বাম রাজনীতির দীক্ষারই ফলশ্রুতিতে। আমার স্কুল এবং কলেজজীবন এমন শৃঙ্খলার মধ্যে কেটেছে যে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে রাজনীতির সংস্পর্শে এসে প্রথমে একটু সংকোচই লাগত। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এক ছাত্ররাজনীতিবিদ খুব সহজে একটি উপমার মাধ্যমে আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাজনীতি কাকে বলে। তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকলে এটাই স্বাভাবিক যে ক্ষুধার্ত মানুষ খাবারের জন্য চিৎকার করে তার চিরায়ত দাবির প্রকাশ করবে। সে কিন্তু বুঝতেও পারল না যে সে একটা বিরাট রাজনীতি করে বসল। এইভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে দীক্ষিত হয়েছিলাম। অবশ্য রাজনীতির সঙ্গে আমার সরাসরি যোগ খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ঘর ও তার প্রতি আমার টান এবং ছাত্ররাজনীতিতে আমার দীক্ষা_আমায় বাঙালির স্বাধিকার সম্পর্কে সরব করে তুলেছিল।
আমার কাছে বাঙালির স্বাধীনতা আর আমার ঘরে ফেরা প্রায় সমার্থক ছিল। সেসব দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে একটা তুমুল আন্দোলন শুরু করবেন, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ই ছয় দফা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তো বটেই, এমনকি তার নিজের দেশেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের একটা পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আমরা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বাঙালির স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি ছাত্ররাজনীতিতে অবশ্য কখনোই সক্রিয় হতে পারিনি। কেননা আমাদের পরিবারে তখন একের পর এক দুর্যোগ আমাদের দিশেহারা করে রেখেছিল। তবে ইউনিভার্সিটিতে গেলে সভা-সমাবেশ থেকে দূরে থাকিনি কখনো। আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম। আমাদের সময়ই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ছিল কমিউনিস্ট বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি। এই বিষয়টি আমাদের এই উপমহাদেশেও এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলে। এটি বড়ই দুঃখজনক এবং আমি মনে করি, এই বিভক্তি আমাদের বাম রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। যা হোক, ছাত্র ইউনিয়ন ভাগাভাগি হওয়ার পর আমি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে যে ছাত্র ইউনিয়ন, তার সঙ্গে একাত্ম হলাম। মতিয়া আপাকে আমার সেই থেকেই একজন অত্যন্ত সৎ এবং আপসহীন মানুষ বলে মনে হতো। একটি বিষয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করছি প্রসঙ্গত। আমাদের সময় ছাত্ররাজনীতির চেহারা ছিল ভিন্ন। আমরা শত মতবিরোধ সত্ত্বেও শত্রু ভাবাপন্ন ছিলাম না। এই বিষয়টি পাকিস্তানের শেষ সময়ে আইয়ুব খানের প্রতিনিধিরা প্রথম শুরু করে। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সন্ত্রাস আমদানি করে ষাটের দশকের শুরুর দিকে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হানাহানির শুরু। ওই অছাত্রজনক অভদ্র আচরণ আজও দিব্যি কায়েম রয়েছে আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
এই অভাব বোধ থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক মানসিকতার উদ্ভবও হয়েছে আমার মধ্যে। মা ছাড়া যেমন একটি পরিবারকে ভাবা যায় না, তেমনি নিজের অস্তিত্বের জন্য 'দেশ' নামের এক মায়ের প্রয়োজন যে আছে, সে উপলব্ধি আমি সেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় থেকেই অনুভব করেছি। তাই আমার বাবার রাজনীতির সঙ্গে আমি একমত হতে পারিনি কোনো কালেই। বাবারা পাকিস্তান চেয়েছিলেন। আমি পাকিস্তান রাষ্ট্রনীতির সারবত্তাহীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছি সেই ১৭-১৮ বছর বয়স থেকেই। আমার মনে পড়ে, এ নিয়ে বাবার সঙ্গে একবার তুমুল তর্ক হয়েছিল। আমি আগেই বলেছি, বাবা মুসলিম লীগের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। আমি বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম তাঁর রাজনীতি ভ্রান্ত ছিল। শেষে আমাদের মধ্যে এমন একটা সন্ধি হলো যে তাঁর রাজনীতি তাঁর, আর আমার বিশ্বাস আমার। আমরা সমান্তরাল রেখায় পথ চলব। সেসব দিনের কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পীরা সাধারণত বামপন্থী অথবা বামঘেঁষা ছিলেন। তাঁরাই বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাতন্ত্র্য এবং অর্থনৈতিক মুক্তি সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছিলেন। ওই সময় বিশ্ব অর্থনীতির ওপর যা কিছু পড়াশোনা, আমাদের অর্থনীতির ওপরে চিন্তা-ভাবনা_সবই ওই বাম রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অবদান। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাও সম্যক বুঝেছি আমার ইউনিভার্সিটি জীবনের বাম রাজনীতির দীক্ষারই ফলশ্রুতিতে। আমার স্কুল এবং কলেজজীবন এমন শৃঙ্খলার মধ্যে কেটেছে যে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে রাজনীতির সংস্পর্শে এসে প্রথমে একটু সংকোচই লাগত। আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ এক ছাত্ররাজনীতিবিদ খুব সহজে একটি উপমার মাধ্যমে আমাকে বুঝিয়েছিলেন রাজনীতি কাকে বলে। তিনি বলেছিলেন, দীর্ঘদিন না খেয়ে থাকলে এটাই স্বাভাবিক যে ক্ষুধার্ত মানুষ খাবারের জন্য চিৎকার করে তার চিরায়ত দাবির প্রকাশ করবে। সে কিন্তু বুঝতেও পারল না যে সে একটা বিরাট রাজনীতি করে বসল। এইভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে দীক্ষিত হয়েছিলাম। অবশ্য রাজনীতির সঙ্গে আমার সরাসরি যোগ খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ঘর ও তার প্রতি আমার টান এবং ছাত্ররাজনীতিতে আমার দীক্ষা_আমায় বাঙালির স্বাধিকার সম্পর্কে সরব করে তুলেছিল।
আমার কাছে বাঙালির স্বাধীনতা আর আমার ঘরে ফেরা প্রায় সমার্থক ছিল। সেসব দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অদূর ভবিষ্যতে বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে একটা তুমুল আন্দোলন শুরু করবেন, তা বোঝা যাচ্ছিল। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময়ই ছয় দফা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছিল। আইয়ুব খানের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তো বটেই, এমনকি তার নিজের দেশেও প্রতিবাদ, প্রতিরোধের একটা পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল। আমরা তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, বাঙালির স্বাধীনতা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি ছাত্ররাজনীতিতে অবশ্য কখনোই সক্রিয় হতে পারিনি। কেননা আমাদের পরিবারে তখন একের পর এক দুর্যোগ আমাদের দিশেহারা করে রেখেছিল। তবে ইউনিভার্সিটিতে গেলে সভা-সমাবেশ থেকে দূরে থাকিনি কখনো। আমি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলাম। আমাদের সময়ই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ছাত্র ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ ছিল কমিউনিস্ট বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চীনের মধ্যে রাজনৈতিক বিভক্তি। এই বিষয়টি আমাদের এই উপমহাদেশেও এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রভাব ফেলে। এটি বড়ই দুঃখজনক এবং আমি মনে করি, এই বিভক্তি আমাদের বাম রাজনীতির দেউলিয়াত্ব প্রমাণ করে। যা হোক, ছাত্র ইউনিয়ন ভাগাভাগি হওয়ার পর আমি মতিয়া চৌধুরীর নেতৃত্বে যে ছাত্র ইউনিয়ন, তার সঙ্গে একাত্ম হলাম। মতিয়া আপাকে আমার সেই থেকেই একজন অত্যন্ত সৎ এবং আপসহীন মানুষ বলে মনে হতো। একটি বিষয়ে বলার প্রয়োজন বোধ করছি প্রসঙ্গত। আমাদের সময় ছাত্ররাজনীতির চেহারা ছিল ভিন্ন। আমরা শত মতবিরোধ সত্ত্বেও শত্রু ভাবাপন্ন ছিলাম না। এই বিষয়টি পাকিস্তানের শেষ সময়ে আইয়ুব খানের প্রতিনিধিরা প্রথম শুরু করে। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন বা এনএসএফ বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক সন্ত্রাস আমদানি করে ষাটের দশকের শুরুর দিকে। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক হানাহানির শুরু। ওই অছাত্রজনক অভদ্র আচরণ আজও দিব্যি কায়েম রয়েছে আমাদের ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments