শেকড়ের ডাক-দেশ কি আবার মহাদুর্যোগের পথে? by ফরহাদ মাহমুদ

হাজোট সরকারের বয়স প্রায় তিন বছর। এর মধ্যে কিছু সাফল্য যেমন আছে, তেমনি কিছু ব্যর্থতাও আছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। সাফল্য-ব্যর্থতার সেই খতিয়ানে না গিয়েও বলা যায়, এই সরকারের এমন কিছু ব্যর্থতা আছে, যা অনেক বড় সাফল্যকেও ম্লান করে দেয়। সেগুলো সম্পর্কে সরকারকে সজাগ থাকতে হবে। তা না হলে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেওয়াটাই স্বাভাবিক। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে এখনো সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রচলন হয়নি।


না সরকারি দলে, না বিরোধী দলে। ফলে জনমনে থাকা ক্ষোভ ও হতাশাকে পুঁজি করে বিরোধী দলগুলো সচরাচর যেসব প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মাঠ গরম করতে চায়_তা আমাদের মনে কেবল আশঙ্কারই জন্ম দেয়। বিরোধী দলকে সরকারি দলের একেবারে আমলেই না নেওয়া কিংবা বিরোধী দল থেকে একাত্তরের যুদ্ধের মতো আরেকটি যুদ্ধে নামার আহ্বান_আমাদের মনে তেমন আশঙ্কারই জন্ম দেয়। কারণ ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়।
অভিযোগ আছে, আওয়ামী লীগ ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতিতে ফিরে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে সরকারের কিছু মন্ত্রণালয় এবং কিছু মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অকর্মণ্যতার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে মানুষ রাস্তায়ও নেমেছে। গণমাধ্যমেও বিষয়গুলো ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সংস্থাও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কাগজ-কলমে দুর্নীতির অভিযোগ করেছে। এর ফলে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন স্থগিত রেখেছে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থাগুলো। অথচ এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট নয়। বরং তাদের আচরণে এক ধরনের রহস্যময়তা, এক ধরনের একগুঁয়ে মনোভাবই প্রতিফলিত হয়। অথচ দেশের শিক্ষিত ও সচেতন প্রতিটি মানুষ প্রকৃত অবস্থাটি জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং প্রকৃত তথ্য না পেয়ে তারা কেবল হতাশই হচ্ছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, শুধু পদ্মা সেতুর অর্থায়নই স্থগিত হয়নি, বিদেশি ঋণ-অনুদানের পরিমাণও ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বিদেশি সাহায্যের প্রতিশ্রুতি যেমন কমছে, তেমনি কমছে অর্থ ছাড়ের পরিমাণও। অন্যদিকে বাড়ছে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ। অবশ্য বিশ্বব্যাংক ও দাতা সংস্থাগুলোর এ ধরনের পদক্ষেপ নতুন নয়। বিএনপির নেতৃত্বাধীন আগের সরকারের সময় বিশ্বব্যাংক তিনটি এবং ডিএফআইডি একটি প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত করেছিল। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড়ে বিলম্বের কারণে পাইপলাইনে এখন যে পরিমাণ অর্থ আছে, তা আমাদের কয়েকটি বাজেটের সমান। তা সত্ত্বেও হিসাবটি এখন বড় বেশি গোলমেলে হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বা ইআরডির হিসাব মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে বা প্রথম প্রান্তিকে বিভিন্ন দাতা সংস্থা মোট ২৪ কোটি ৬২ লাখ ডলারের বৈদেশিক সাহায্য ছাড় করেছে। অথচ আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছাড় করা হয়েছিল ৩১ কোটি ৫৯ লাখ ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যেখানে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৯ কোটি ৪৪ লাখ ডলার, সেখানে চলতি বছরের একই প্রান্তিকে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২ কোটি ৩৩ লাখ ডলারে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ঋণ পরিশোধের পরও সরকারের নিট প্রাপ্তি ছিল ১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা নেমে এসেছে মাত্র সাত কোটি ৫৮ লাখ ডলারে। আবার বছরের প্রথমদিকে রাজস্ব আদায়ও অপেক্ষাকৃত কম থাকে। তাই উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন_উভয় খাতের অর্থের চাহিদা মেটাতে গিয়ে সরকারকে হাত বাড়াতে হচ্ছে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার দিকে। নতুন অর্থবছরের প্রথম তিন মাস ১০ দিনে বা ১০ অক্টোবর পর্যন্ত সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা, যার অধিকাংশের জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ছাপানোর মাধ্যমে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে নিট ঋণ নিয়েছিল মাত্র ২৮৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। তার পরও গত বছর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ বছর সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা কমিয়ে নির্ধারণ করেছিল ১৮ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা। কিন্তু বাস্তবে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ মুহূর্তে তা বলা কঠিন।
দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার তো ঋণ নিতেই পারে এবং বরাবরই তা নেওয়া হয়। কিন্তু এই নেওয়াটি যদি অতিরিক্ত হয়ে যায়, তাহলেই এর প্রভাব পড়ে মুদ্রাবাজারে। পণ্যমূল্যেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি পরিমাণে ঋণ নিলে দেশের শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে ঋণপ্রবাহের ঘাটতি দেখা দেয়। এর ফলে শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। একদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের শিল্পখাত গতি পাচ্ছে না, তার ওপর ঋণপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে সেটি হবে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো। এ কারণেই ব্যাংক খাত থেকে সরকারের অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ নিয়ে দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদরা সরকারকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছেন এবং দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সরকার যেন নিরুপায়। তাদের হাত-পা যেন ক্রমেই এক অদৃশ্য জালে জড়িয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে বেরিয়ে আসাটা হয়ে পড়ছে খুবই কষ্টকর।
বিগত জোট সরকারের সময় দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সাময়িক উদ্যোগ হিসেবে ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ওপর জোর দেয় এবং এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিও পেয়েছে। কিন্তু এসব কেন্দ্রে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়ে অনেক বেশি। তাই এই বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত করার জন্য সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলভিত্তিক এসব কেন্দ্রে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে গিয়েও সরকারকে অনেক ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এখন এসব ভর্তুকি চালিয়ে যাওয়াটাই সরকারের জন্য বড় বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবার এই ভর্তুকি তুলে নিলেও সাধারণ মানুষের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হবে। বিদ্যুতের দাম যে পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছাবে, তা সাধারণ মানুষের বহনক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। শিল্প-কারখানাগুলোতেও উৎপাদন খরচ যথেষ্ট পরিমাণে বেড়ে যাবে। আবার ডিজেলের ভর্তুকি কমিয়ে দিলে শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচই বাড়বে না, কৃষি, পণ্য পরিবহনসহ অনেক খাতেই খরচ বেড়ে যাবে। সেটিও চূড়ান্ত বিচারে অর্থনীতিতে বড় ধরনের অস্থিরতার জন্ম দেবে। পণ্যমূল্য আরো বেশি বেড়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, তা হলো, বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সে ক্ষেত্রে বাস্তব বা ভৌত অগ্রগতি প্রায় নেই বললেই চলে।
অর্থের অভাবে এবং অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ব্যর্থতার কারণে গত বর্ষায় দেশের সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখনো তা থেকে খুব একটা উত্তরণ ঘটেনি। কবে উত্তরণ ঘটবে তা-ও বলা কঠিন। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বা বাজার পরিস্থিতিতে নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে। অবশ্য তার জন্য বিশ্বমন্দা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম বেড়ে যাওয়াটাও একটি বড় কারণ। সেখানেও সরকারকে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। দেশের শেয়ারবাজারে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ধস নেমেছে এই সরকারের আমলেই। কয়েক লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী তাদের সর্বস্ব হারিয়েছে। যদিও শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির ভাষায় 'ফটকা বাজার' বলা হয় এবং কোনো দেশেই বেসরকারি শেয়ারবাজারে দরপতনের জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করা হয় না, সেখানে কিছু ব্যক্তি বা সিন্ডিকেট যদি অতিরিক্ত কারসাজি করে দেশের মানুষকে প্রতারিত করে, তাহলে রাষ্ট্রকেই তা নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় সরকারকে উদ্যোগী হতেই হবে। রাষ্ট্র সে চেষ্টা যে একেবারেই করছে না, তা নয়। কিন্তু তা এখনো কার্যকর কোনো ফল বয়ে আনতে পারেনি। আর এ ক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে, তাদেরই নিয়োগ করা তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বাজারে কারসাজি করার জন্য কিছু ব্যক্তিকে সরাসরি দায়ী করা হলেও আজ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দেশের অধিকাংশ মানুষ সরকারের এই নমনীয়তায় হতাশ হয়েছে। সরকারকে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, সুশাসন এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বাড়িয়েই কেবল বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিরসন করা যেতে পারে। হুটহাট কোনো সিদ্ধান্ত লাভের পরিবর্তে ক্ষতিরই কারণ হতে পারে। আমাদেরও মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বের ছোট্ট এই দেশটিতে সমস্যার কোনো অন্ত নেই। চাহিদা আকাশছোঁয়া, অথচ চাহিদা পূরণের সংগতি নিতান্তই কম। কাজেই ধৈর্যের সঙ্গেই আমাদের যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। অধৈর্য হলে সমস্যা কেবল বাড়তেই থাকবে।
অপরদিকে এটাও সত্য, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দেশের উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকারি ও বিরোধী দল উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আমরা বিপরীত চিত্রটিই দেখে আসছি। সরকারি দল কখনোই বিরোধী দলকে আমলে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়নি। আর বিরোধী দলও সব সময় সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও ধরনের কর্মসূচি দিয়ে যায়। এতে জনগণের ভোগান্তিই কেবল বাড়ে, খাদ্যপণ্যসহ জিনিসপত্রের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের ক্রমবিকাশমান শিল্প-কারখানা। তাই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি অনুরোধ, দেশের স্বার্থে আপনারা রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনুন। জাতীয় সংসদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করুন, যা গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রথম ধাপ। রাজপথের আন্দোলনও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিরই অংশ, কিন্তু তাতে লগি-বৈঠা প্রদর্শন কিংবা 'যুদ্ধ ঘোষণা' থেকে বিরত থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.