স্মরণে মননেঃ ডাকনাম আসল নাম by কে জি মোস্তফা
জীবন আর সাহিত্যের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্টা নিছক কল্পনাপ্রসূত নয়। জীবন যখন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, সাহিত্য তখন সেরা আশ্রয়। দুঃখের প্রলেপ বিদীর্ণ করে সত্যান্বেষণ করার একমাত্র উপায় সাহিত্যচর্চা।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৫। দীর্ঘ ২০ বছর ডিএফপি’র বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার কাজে ব্যাপৃত ছিলাম।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৫। দীর্ঘ ২০ বছর ডিএফপি’র বিভিন্ন পত্রিকা সম্পাদনার কাজে ব্যাপৃত ছিলাম।
ঈর্ষণীয় আমার লেখকসূচি। সাহিত্যজগতে সমীহজাগানো অনেক দুর্লভ ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানচর্চায় তারা অতুলনীয়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য কয়েকজন যেমন—জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, যিনি অনবদ্য অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের কাছে বিশ্বসাহিত্যের দ্বার খুলে দিচ্ছেন। ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের পণ্ডিত মনির উদ্দীন ইউসুফ, যিনি ইরানের জাতীয় মহাকবি ফেরদৌসীর মহাকাব্য ‘শাহনামা’র সার্থক অনুবাদক। দেওয়ান মুহম্মদ আজরফ, এক বিবেকী পথিকৃত্। যার লেখনীতে একদিকে জীবনের বাস্তবতা অন্যদিকে দর্শনের গভীরতা এবং দুয়ের বিস্ময়কর সামঞ্জম্য সাধনের ব্যাখ্যা ও বিশেষণ। আ ন ম বজলুর রশীদ, যার গদ্য-পদ্য সমান সৃষ্টিতে বিস্ময়করভাবে রসের সঙ্গে রূপের মিলন। অধ্যাপক মনসূর উদ্দীন আহমদ, লোকসাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার ‘হারামনি’ আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। ড.আশরাফ সিদ্দিকী লোকসাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি চর্চায় আজীবন নিবেদিতপ্রাণ। সব্যসাচী লেখক ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ পাঠক মহলে এক স্বতোচ্চারিত নাম। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দুর্লভ স্নিগ্ধতা ও ঋজুতার অধিকারী, অপূর্ব যার প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনা। ড. রফিকুল ইসলাম নজরুল সাহিত্যে অতুলনীয় অবদান যার। ড. মোস্তফা নুরুল ইসলাম, মননশীল সাহিত্যে তার অবাধ বিচরণ। কাব্যজগতের শিরোমণি শামসুর রাহমান, কিংবদন্তি কবি আল মাহমুদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, ফজল শাহাবুদ্দিন, আবু হেনা মোস্তফা কামাল প্রমুখ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি লেখক আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন। রবীন্দ্রসাহিত্য গবেষক ডা. আহমদ রফিক, আইন বিশেষজ্ঞ গাজী শামছুর রহমান, বিশিষ্ট কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন ও রিজিয়া রহমান, শামস্ রাশীদ, রাজিয়া মজিদ, রাজিয়া মাহবুব প্রমুখ।
বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও এদের কারও কারও সঙ্গে আমার আন্তরিক প্রীতি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অধ্যাপক মুহম্মদ মনসূর উদ্দীন কেন জানি আমাকে দেখলেই ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। শ্রদ্ধেয় আ ন ম বজলুর রশীদ আমার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য একদা তার স্ত্রীকে চেম্বারে নিয়ে আসেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফ আমাকে একটি দুর্লভ হোমিও গ্রন্থ উপহার দেন, যার প্রথম পৃষ্ঠায় জ্বলজ্বলে তার হাতের লেখা—‘হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সার সাধক কবি কে. জি. মোস্তফা সাহেবকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে—মনিরউদ্দীন ইউসুফ, ২৮/১২/৮২’ আমাকে উদ্বেলিত করে তোলে।
বিশিষ্ট কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, শামস্ রাশীদ ও রাজিয়া মজিদের আন্তরিক আতিথেয়তা ‘ভুলি কেমনে আজও যে মনে’।
সহকর্মীদের মধ্যে বেশ ক’জন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য পেয়েছি কবি তালিম হোসেন ও কথাশিল্পী আহমদ মীরকে। এছাড়া সুসাহিত্যিক আতোয়ার রহমান, কবি আবদুস সাত্তার, গল্পকার হুমায়ুন কাদির, কবি খালেদা এদিব চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক মনওয়ার হোসেন, অনুবাদক জাফর আলম এবং খ্যতিমান তরুণ কবি গাজী রফিক।
সৃজনশীল আরও দু’জনের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। একজন প্রখ্যাত চরিত্রাভিনেতা সিরাজুল ইসলাম, অপরজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ, আপাদমস্তক পরিপাটি অমায়িক এক মানুষ। প্রথমে উপ-পরিচালক, পরে পরিচালক, সর্বশেষ মহাপরিচালক ছিলেন। সম্পাদক হিসেবে আমার যতটুকু কৃতিত্ব বা সুনাম অর্জন, আড়ালে ছিল কালাম মাহমুদের বীজমন্ত্র তথা আন্তরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬। দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরিজীবনে ১২ জন বিভাগীয় প্রধানকে পেয়েছিলাম। প্রথমজন সুসাহিত্যিক মহিউদ্দিন আহমদ (আহমদ মীর), সর্বশেষ গোলাম পাঞ্জাতন। মাঝখানে পেয়েছিলাম এক কর্মবীর, হেমায়েত উদ্দিন আহমদ। তার মতো দক্ষ ও সাহসী প্রশাসক প্রায় বিরল। আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নের মৃত্যুও দেখি। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ডিএফপি’র ভেতর-বাইরে আমূল পরিবর্তন আনেন।
প্রসঙ্গত কালাম মাহমুদ। মুচকি হাসির ঝলক মানেই কালাম মাহমুদ। মুচকি হাসি দিয়ে মুহুর্তে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দিতেন। যথাসময়ে তিনি অবসরে গেলেন। দৈনিক যুগান্তরে শিল্প উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ‘নগরবায়স’ নামে যায়যায়দিন পত্রিকায় সরস ভাষায় সাবলীল গদ্যে কলাম লিখতে শুরু করেন। ভ্রমণের নেশা বুঝি পেয়ে বসল। এক ধনাঢ্য বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেলেন নেপাল। সিকিম থেকে দেশে ফেরার পথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হঠাত্ হার্টস্ট্রোক এবং সেখানেই তার আকস্মিক মৃত্যু। মৃত্যু এতই ঠুনকো, অনাড়ম্বর, প্রস্তুতিহীন! তারিখ ১ নভেম্বর, সাল ২০০০। অবিশ্বাস্য সেই খবরে স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে! এমন লোকের জন্যই যেন চোখের জলের সৃষ্টি!
আসলে মানুষের ডাকনাম জীবন, পোশাকি নাম মরণ।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও এদের কারও কারও সঙ্গে আমার আন্তরিক প্রীতি সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অধ্যাপক মুহম্মদ মনসূর উদ্দীন কেন জানি আমাকে দেখলেই ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। শ্রদ্ধেয় আ ন ম বজলুর রশীদ আমার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য একদা তার স্ত্রীকে চেম্বারে নিয়ে আসেন। মনিরউদ্দীন ইউসুফ আমাকে একটি দুর্লভ হোমিও গ্রন্থ উপহার দেন, যার প্রথম পৃষ্ঠায় জ্বলজ্বলে তার হাতের লেখা—‘হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সার সাধক কবি কে. জি. মোস্তফা সাহেবকে প্রীতি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে—মনিরউদ্দীন ইউসুফ, ২৮/১২/৮২’ আমাকে উদ্বেলিত করে তোলে।
বিশিষ্ট কথাশিল্পী রাবেয়া খাতুন, শামস্ রাশীদ ও রাজিয়া মজিদের আন্তরিক আতিথেয়তা ‘ভুলি কেমনে আজও যে মনে’।
সহকর্মীদের মধ্যে বেশ ক’জন খ্যাতিমান সাহিত্যিক ছিলেন। স্বল্প সময়ের জন্য পেয়েছি কবি তালিম হোসেন ও কথাশিল্পী আহমদ মীরকে। এছাড়া সুসাহিত্যিক আতোয়ার রহমান, কবি আবদুস সাত্তার, গল্পকার হুমায়ুন কাদির, কবি খালেদা এদিব চৌধুরী, শিশুসাহিত্যিক মনওয়ার হোসেন, অনুবাদক জাফর আলম এবং খ্যতিমান তরুণ কবি গাজী রফিক।
সৃজনশীল আরও দু’জনের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। একজন প্রখ্যাত চরিত্রাভিনেতা সিরাজুল ইসলাম, অপরজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী কালাম মাহমুদ, আপাদমস্তক পরিপাটি অমায়িক এক মানুষ। প্রথমে উপ-পরিচালক, পরে পরিচালক, সর্বশেষ মহাপরিচালক ছিলেন। সম্পাদক হিসেবে আমার যতটুকু কৃতিত্ব বা সুনাম অর্জন, আড়ালে ছিল কালাম মাহমুদের বীজমন্ত্র তথা আন্তরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা।
১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬। দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরিজীবনে ১২ জন বিভাগীয় প্রধানকে পেয়েছিলাম। প্রথমজন সুসাহিত্যিক মহিউদ্দিন আহমদ (আহমদ মীর), সর্বশেষ গোলাম পাঞ্জাতন। মাঝখানে পেয়েছিলাম এক কর্মবীর, হেমায়েত উদ্দিন আহমদ। তার মতো দক্ষ ও সাহসী প্রশাসক প্রায় বিরল। আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্নের মৃত্যুও দেখি। কিন্তু স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ডিএফপি’র ভেতর-বাইরে আমূল পরিবর্তন আনেন।
প্রসঙ্গত কালাম মাহমুদ। মুচকি হাসির ঝলক মানেই কালাম মাহমুদ। মুচকি হাসি দিয়ে মুহুর্তে যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে দিতেন। যথাসময়ে তিনি অবসরে গেলেন। দৈনিক যুগান্তরে শিল্প উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দেন। ‘নগরবায়স’ নামে যায়যায়দিন পত্রিকায় সরস ভাষায় সাবলীল গদ্যে কলাম লিখতে শুরু করেন। ভ্রমণের নেশা বুঝি পেয়ে বসল। এক ধনাঢ্য বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেলেন নেপাল। সিকিম থেকে দেশে ফেরার পথে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হঠাত্ হার্টস্ট্রোক এবং সেখানেই তার আকস্মিক মৃত্যু। মৃত্যু এতই ঠুনকো, অনাড়ম্বর, প্রস্তুতিহীন! তারিখ ১ নভেম্বর, সাল ২০০০। অবিশ্বাস্য সেই খবরে স্বজন-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে! এমন লোকের জন্যই যেন চোখের জলের সৃষ্টি!
আসলে মানুষের ডাকনাম জীবন, পোশাকি নাম মরণ।
লেখক : কবি, গীতিকার ও সাংবাদিক
No comments