জনমত-কৃষিতে সাফল্য কেন আড়ালে থেকে যাচ্ছে by মাহবুব হোসেন
আসন্ন বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র চালাতে ডিজেলের মূল্য তাদের জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে চলেছে। আমাদের তা আমদানি করে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। কিন্তু সরকার নিয়মিত মূল্য সমন্বয় না করে কয়েক বছর পর তা করতে গিয়ে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হওয়ায় ক্ষোভের মাত্রাও প্রবল হয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখছি।
বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতাজনিত সব সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে আমরা তার চাপ কিছুটা হলেও সহনশীল রাখতে পারি বৈকি
মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে সমকালসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে জরিপ দেখেছি। এতে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে জনমত তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে সরকারের সাফল্য হিসেবে শিক্ষা ও বিদ্যুতের কথা বলা হয়েছে বিশেষভাবে। কিন্তু সে তুলনায় কৃষি রয়েছে 'পিছিয়ে'। অথচ আমরা জানি, পরপর কয়েকটি মৌসুমে ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। অন্যান্য ফসলও বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। বাজারে খাদ্যশস্যের দাম এখন তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে, শীতকালীন সবজি বেশ সস্তা। কৃষি খাত ভালো করার পরও কেন আমজনতার মূল্যায়নে সাফল্যের শীর্ষে নেই, এ প্রশ্নে বলা যায়_ কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাজারে ধানের দাম এখন অস্বাভাবিক কম। উৎপাদকদের প্রত্যাশা ছিল প্রতি ৪০ কেজি আমন ধান ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি করা যাবে। কিন্তু দাম মিলছে ৫০০ টাকার আশপাশে। উৎপাদন ব্যয় এবং বাজারজাত করার খরচও অনেকের উঠছে না। এ অবস্থায় চাষিরা হতাশ। তাদের এ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন জরিপে।
এটা অবশ্য বলা যাবে না যে ধান চাষ করে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। আজকাল বিচালি বেচে ভালো দাম পাওয়া যায়। আবহাওয়া ভালো থাকায় ধানের ফলন যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি তা শুকানোর মতো পর্যাপ্ত রোদও ছিল। এ ধরনের আবহাওয়ার কারণে বিচালির মানও ভালো ছিল।
ধানের দাম পড়ে যাওয়ার একটি কারণ সরকারের অসময়োচিত খাদ্য আমদানি। এটা অবশ্য করা হয়েছিল 'আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা' বিবেচনায় রেখে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য জনগণের পহেলা নম্বরের উদ্বেগ। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ শঙ্কা থেকে চাল আমদানি করেছে এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই করেছে। এই চাল মূলত এসেছে মে-জুন মাসে বোরো ধান-চাল বাজারে ওঠার সময়ে। আমনের মতোই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। প্রকৃতিও সে সময় সদয় ছিল। সরকার যে চাল আমদানি করেছে তা যদি বোরো ধান ওঠার যথেষ্ট আগে দেশে পেঁৗছাত এবং বাজারে ছাড়া হতো, তাহলে খাদ্যশস্যের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত এবং কৃষকের ক্ষতি হতো না। কিন্তু 'অসময়ে' তা আমদানি হয়েছে। এ কারণে বাম্পার ফলন কৃষকের জন্য কষ্টের কারণ হয়েছে। তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয় করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারত। কিন্তু চালের ক্রেতাদের সমস্যা বিবেচনায় রেখে তারা প্রথমদিকে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। আরও একটি কারণ ছিল_ গুদামে স্থানাভাব। পরে অবশ্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কিছু চাল সংগ্রহ করে। তবে আরও ভালো দাম পাওয়ার আশায় সচ্ছল চাষিরা ধান-চাল ধরে রাখেন। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমন মৌসুমেও ভালো ফলন মিলবে_ এ পূর্বাভাস থাকায় বাজার স্বাভাবিক থাকে। নতুন ফসল উঠলে তা কোথায় রাখা হবে, এ চিন্তা থেকে কৃষক গোলা খালি করা শুরু করে। এ কারণে বাজারে চালের দাম আরও পড়ে যায়। এভাবে কৃষকরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে। তবে একই সঙ্গে বলতে হবে, খাদ্যের বাজারের বিপুল সংখ্যক ক্রেতার জন্য পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ছিল সন্তোষজনক, যা এখনও রয়েছে। সামনে রয়েছে বোরো মৌসুম। এক সময়ে আমন মৌসুম থেকেই জোগান আসত খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ। এখন আসে বোরো মৌসুম থেকে। কিন্তু বোরো ধান উৎপাদনের জন্য কৃষককে সেচ, সার, কীটনাশকের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ কৃষকের বিনিয়োগ বেশি পড়ে। চালের বাজার 'স্বাভাবিক' থাকায় কৃষক কিন্তু এখনই চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
এ বছর কৃষকরা পাটের দামও অনেক কম পেয়েছে। এর মূল দায় অবশ্য বিশ্ববাজারের। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলতে থাকায় কয়েকটি উন্নত দেশ পাটের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে কিংবা দাম কম দিতে চাইছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারে। আর এটা এমন সময়ে ঘটেছে যখন পরপর দুটি বছর কাঁচা পাটের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা উৎপাদন বাড়ানোর দিকে ঝুঁকেছিল। ধান-পাটের পাশাপাশি শীতকালীন সবজিতেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলুতেও লোকসান গেছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত ফসল ফলায় যে কৃষক, তারা খুশি নেই। তারা বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছিল। কিন্তু এখন তাদের চলছে হতাশার সময়।
কৃষক ফসলের ভালো দাম পেলে সার্বিক অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়ে। তারা শিল্পপণ্য কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। এতে গ্রামে বাজার প্রসারিত হয়। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এমন অনুকূল পরিস্থিতিই কাম্য।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল খাদ্যশস্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা। একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখা এবং আরও সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়। এ বাবদ সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কেবল গত বছরেই এ ভর্তুকির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
আমাদের দেশে অন্তত ৩০ শতাংশ লোক রয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত এবং কখনও কখনও কাজ জুটিয়ে নিতেও সমস্যা হয়। আবার আমন ও বোরো মৌসুমের চিত্র থাকে ভিন্ন। এ সময়ে তাদের সবার জন্যই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং মজুরি মেলে মোটামুটি সন্তোষজনক হারে। খাদ্যের বাজারেও থাকে অপেক্ষাকৃত স্বস্তিকর অবস্থা। অর্থাৎ পকেটে অর্থ থাকে এবং খাদ্যের বাজারেও তেমন আগুন থাকে না। খাদ্য বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে সরকারকে মৌসুমি পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখার জন্য অনুরোধ করব। ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। সে দেশের সরকার দরিদ্রদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য থেকে বাজারে অংশ নিয়ে থাকে। বাজারে যখন চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি থাকে এবং দাম থাকে অপেক্ষাকৃত কম, তখন সরকারের মজুদ গড়ে তোলার জন্য বাজার থেকে খাদ্য ক্রয় করে। আবার বাজারে যখন দাম বাড়তে থাকে তখন তারা এ মজুদ থেকে বাজারে ছাড়ে এবং দামও নির্ধারণ করা হয় বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সরকারের হিসাব সোজা_ দাম কম থাকার সময় কিনতে হয় এবং বাড়ার সময় বেচতে হয়। এর ফলে বাজার যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তেমনি সরকারের কিছু লাভও থাকে। এই লাভের অর্থ দিয়েই সরকারের খাদ্য-কর্মসূচির আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে থাকে গুদামজাত করা ও পরিবহন ব্যয় এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ। এ ধরনের বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্যের জন্য সরকারের ভর্তুকি পরিমাণও সীমিত রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে এখন চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। কিন্তু একই সঙ্গে সরকার ২৪ টাকা কেজি দরে 'ওপেন মার্কেট সেল' চালু রেখেছে। যেসব ট্রাকে এ চাল বিক্রি হয়, সেখানে স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতাদের ভিড় নেই। তারপরও সরকার অপেক্ষাকৃত চড়া দামে আমদানি কিংবা দেশ থেকে সংগ্রহ করা চাল বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। সরকার কেন এভাবে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, সে প্রশ্ন অর্থনীতিবিদরা করছেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার বছরজুড়ে যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার তুলনায় দরিদ্রদের জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু রাখার ভর্তুকি কেন বেশি, এ প্রশ্নের উত্তরও সহজ নয়। তবে সরকার কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য চাহিদা বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। একটা সময় ছিল যখন আমন ধানের ওপর নির্ভরতা ছিল ব্যাপক। এ ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নষ্ট হলে তার প্রভাব দৈনন্দিন বাজারে পড়ত, সার্বিক অর্থনীতিতেও পড়ত। এখন সে অবস্থা নেই। আমন উঠতে না উঠতেই গম কাটা শুরু হয়। বোরো ধানের চাষের প্রস্তুতিও চলতে থাকে। বাজারে ধানের দাম বাড়লে কৃষক পরবর্তী মৌসুমে ফলন বাড়াতে উদ্যোগী হয়। এ অবস্থ্থায় সরকারকে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে হবে। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমলাতন্ত্রের কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রায়শই দীর্ঘায়িত হয়, কখনও কখনও থাকে জটিলতা। বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সময়েই খাদ্য আমদানি এর একটি উদাহরণ। বেসরকারি খাত এ তুলনায় অনেক নমনীয়তা দেখাতে পারে এবং সরকারকে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখন সময় এসেছে, খাদ্যের বাজারে হস্তক্ষেপে গোটা বছরের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকারি বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ অপচয় হয়, এ অভিজ্ঞতা নতুন নয়। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ করা খাদ্য সাহায্যের সবটা তাদের উপকারে লাগে না, এ তথ্য সরকারের হাতে অবশ্যই থাকার কথা। আমন বা বোরো চাল বাজারে আসার সময় যখন খাদ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম থাকে এবং দিনমজুরদের কাজের সুযোগ বেশি থাকে, তখন বিপুল ভর্তুকি দিয়ে ওপেন মার্কেট সেল চালু রাখার যুক্তিই-বা কোথায়? সরকার যদি দক্ষতা বাড়াতে পারে, কম দামে কিনে বাজার একটু চড়া হলে তা বিক্রি করে তাহলেও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
সরকারের জন্য ভর্তুকি এক বড় সমস্যা। সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ_ ভর্তুকির অনেক খাত। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে জ্বালানি খাতে অস্বাভাবিক অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে ভর্তুকি বাবদ। এ জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে, যা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য অর্থের জোগান প্রদানে ব্যাঘাত ঘটায়। এতে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়। একই সঙ্গে তা মূল্যস্ফীতির কারণ হয়। জনতুষ্টির জন্য ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য বিক্রি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতিজনিত দুর্ভোগ ডেকে আনা কতটা সঙ্গত? সরকারকে বুঝতে হবে যে, তারা যেভাবে চলছে তাতে ম্যাক্রো অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতাও নষ্ট হচ্ছে।
মতিয়া চৌধুুরী দ্বিতীয় দফায় কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কৃষি উপকরণের সরবরাহ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে চলেছেন। সারসহ কোনো কোনো উপকরণে ভর্তুকি কমানো হলেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ পেতে কৃষককে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু আসন্ন বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র চালাতে ডিজেলের মূল্য তাদের জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে চলেছে। আমাদের তা আমদানি করে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। কিন্তু সরকার নিয়মিত মূল্য সমন্বয় না করে কয়েক বছর পর তা করতে গিয়ে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হওয়ায় ক্ষোভের মাত্রাও প্রবল হয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখছি। বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতাজনিত সব সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে আমরা তার চাপ কিছুটা হলেও সহনশীল রাখতে পারি বৈকি।
ড. মাহবুব হোসেন : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্র্যাক
মহাজোট সরকারের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে সমকালসহ কয়েকটি সংবাদপত্রে জরিপ দেখেছি। এতে সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা সম্পর্কে জনমত তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে সরকারের সাফল্য হিসেবে শিক্ষা ও বিদ্যুতের কথা বলা হয়েছে বিশেষভাবে। কিন্তু সে তুলনায় কৃষি রয়েছে 'পিছিয়ে'। অথচ আমরা জানি, পরপর কয়েকটি মৌসুমে ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে। অন্যান্য ফসলও বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারছে। বাজারে খাদ্যশস্যের দাম এখন তুলনামূলক নিয়ন্ত্রণে, শীতকালীন সবজি বেশ সস্তা। কৃষি খাত ভালো করার পরও কেন আমজনতার মূল্যায়নে সাফল্যের শীর্ষে নেই, এ প্রশ্নে বলা যায়_ কৃষকের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাজারে ধানের দাম এখন অস্বাভাবিক কম। উৎপাদকদের প্রত্যাশা ছিল প্রতি ৪০ কেজি আমন ধান ৮০০-৯০০ টাকায় বিক্রি করা যাবে। কিন্তু দাম মিলছে ৫০০ টাকার আশপাশে। উৎপাদন ব্যয় এবং বাজারজাত করার খরচও অনেকের উঠছে না। এ অবস্থায় চাষিরা হতাশ। তাদের এ মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বিভিন্ন জরিপে।
এটা অবশ্য বলা যাবে না যে ধান চাষ করে কৃষকের লোকসান হচ্ছে। আজকাল বিচালি বেচে ভালো দাম পাওয়া যায়। আবহাওয়া ভালো থাকায় ধানের ফলন যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি তা শুকানোর মতো পর্যাপ্ত রোদও ছিল। এ ধরনের আবহাওয়ার কারণে বিচালির মানও ভালো ছিল।
ধানের দাম পড়ে যাওয়ার একটি কারণ সরকারের অসময়োচিত খাদ্য আমদানি। এটা অবশ্য করা হয়েছিল 'আশ্বিন-কার্তিকের মঙ্গা' বিবেচনায় রেখে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের বাজারে অস্থিরতা রয়েছে। বাংলাদেশেও দ্রব্যমূল্য জনগণের পহেলা নম্বরের উদ্বেগ। খাদ্য মন্ত্রণালয় এ শঙ্কা থেকে চাল আমদানি করেছে এবং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই করেছে। এই চাল মূলত এসেছে মে-জুন মাসে বোরো ধান-চাল বাজারে ওঠার সময়ে। আমনের মতোই বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছিল। প্রকৃতিও সে সময় সদয় ছিল। সরকার যে চাল আমদানি করেছে তা যদি বোরো ধান ওঠার যথেষ্ট আগে দেশে পেঁৗছাত এবং বাজারে ছাড়া হতো, তাহলে খাদ্যশস্যের বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ত এবং কৃষকের ক্ষতি হতো না। কিন্তু 'অসময়ে' তা আমদানি হয়েছে। এ কারণে বাম্পার ফলন কৃষকের জন্য কষ্টের কারণ হয়েছে। তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকার কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল ক্রয় করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারত। কিন্তু চালের ক্রেতাদের সমস্যা বিবেচনায় রেখে তারা প্রথমদিকে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। আরও একটি কারণ ছিল_ গুদামে স্থানাভাব। পরে অবশ্য খাদ্য মন্ত্রণালয় কিছু চাল সংগ্রহ করে। তবে আরও ভালো দাম পাওয়ার আশায় সচ্ছল চাষিরা ধান-চাল ধরে রাখেন। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। আমন মৌসুমেও ভালো ফলন মিলবে_ এ পূর্বাভাস থাকায় বাজার স্বাভাবিক থাকে। নতুন ফসল উঠলে তা কোথায় রাখা হবে, এ চিন্তা থেকে কৃষক গোলা খালি করা শুরু করে। এ কারণে বাজারে চালের দাম আরও পড়ে যায়। এভাবে কৃষকরা নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত মনে করে। তবে একই সঙ্গে বলতে হবে, খাদ্যের বাজারের বিপুল সংখ্যক ক্রেতার জন্য পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ছিল সন্তোষজনক, যা এখনও রয়েছে। সামনে রয়েছে বোরো মৌসুম। এক সময়ে আমন মৌসুম থেকেই জোগান আসত খাদ্য চাহিদার সিংহভাগ। এখন আসে বোরো মৌসুম থেকে। কিন্তু বোরো ধান উৎপাদনের জন্য কৃষককে সেচ, সার, কীটনাশকের জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। অর্থাৎ কৃষকের বিনিয়োগ বেশি পড়ে। চালের বাজার 'স্বাভাবিক' থাকায় কৃষক কিন্তু এখনই চিন্তিত হয়ে পড়েছে।
এ বছর কৃষকরা পাটের দামও অনেক কম পেয়েছে। এর মূল দায় অবশ্য বিশ্ববাজারের। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা চলতে থাকায় কয়েকটি উন্নত দেশ পাটের আমদানি কমিয়ে দিয়েছে কিংবা দাম কম দিতে চাইছে। এর প্রভাব পড়ছে দেশের বাজারে। আর এটা এমন সময়ে ঘটেছে যখন পরপর দুটি বছর কাঁচা পাটের ভালো দাম পাওয়ায় কৃষকরা উৎপাদন বাড়ানোর দিকে ঝুঁকেছিল। ধান-পাটের পাশাপাশি শীতকালীন সবজিতেও কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলুতেও লোকসান গেছে। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বৃত্ত ফসল ফলায় যে কৃষক, তারা খুশি নেই। তারা বিনিয়োগ করে লাভবান হচ্ছিল। কিন্তু এখন তাদের চলছে হতাশার সময়।
কৃষক ফসলের ভালো দাম পেলে সার্বিক অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়ে। তারা শিল্পপণ্য কেনার জন্য অর্থ ব্যয় করতে পারে। এতে গ্রামে বাজার প্রসারিত হয়। অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এমন অনুকূল পরিস্থিতিই কাম্য।
মহাজোট সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকারের মধ্যে ছিল খাদ্যশস্যের বাজার স্থিতিশীল রাখা। একই সঙ্গে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান কর্মসূচিগুলো অব্যাহত রাখা এবং আরও সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়। এ বাবদ সরকারকে প্রচুর ভর্তুকি দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা বাজেটের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কেবল গত বছরেই এ ভর্তুকির পরিমাণ ছিল সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা।
আমাদের দেশে অন্তত ৩০ শতাংশ লোক রয়েছে, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত এবং কখনও কখনও কাজ জুটিয়ে নিতেও সমস্যা হয়। আবার আমন ও বোরো মৌসুমের চিত্র থাকে ভিন্ন। এ সময়ে তাদের সবার জন্যই কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং মজুরি মেলে মোটামুটি সন্তোষজনক হারে। খাদ্যের বাজারেও থাকে অপেক্ষাকৃত স্বস্তিকর অবস্থা। অর্থাৎ পকেটে অর্থ থাকে এবং খাদ্যের বাজারেও তেমন আগুন থাকে না। খাদ্য বাজেট প্রণয়ন করতে গিয়ে সরকারকে মৌসুমি পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখার জন্য অনুরোধ করব। ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। সে দেশের সরকার দরিদ্রদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্য থেকে বাজারে অংশ নিয়ে থাকে। বাজারে যখন চাহিদার তুলনায় জোগান বেশি থাকে এবং দাম থাকে অপেক্ষাকৃত কম, তখন সরকারের মজুদ গড়ে তোলার জন্য বাজার থেকে খাদ্য ক্রয় করে। আবার বাজারে যখন দাম বাড়তে থাকে তখন তারা এ মজুদ থেকে বাজারে ছাড়ে এবং দামও নির্ধারণ করা হয় বাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। সরকারের হিসাব সোজা_ দাম কম থাকার সময় কিনতে হয় এবং বাড়ার সময় বেচতে হয়। এর ফলে বাজার যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তেমনি সরকারের কিছু লাভও থাকে। এই লাভের অর্থ দিয়েই সরকারের খাদ্য-কর্মসূচির আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে থাকে গুদামজাত করা ও পরিবহন ব্যয় এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধ। এ ধরনের বাজার ব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্যের জন্য সরকারের ভর্তুকি পরিমাণও সীমিত রাখা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশে এখন চালের বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল। কিন্তু একই সঙ্গে সরকার ২৪ টাকা কেজি দরে 'ওপেন মার্কেট সেল' চালু রেখেছে। যেসব ট্রাকে এ চাল বিক্রি হয়, সেখানে স্বাভাবিক কারণেই ক্রেতাদের ভিড় নেই। তারপরও সরকার অপেক্ষাকৃত চড়া দামে আমদানি কিংবা দেশ থেকে সংগ্রহ করা চাল বিক্রি অব্যাহত রেখেছে। সরকার কেন এভাবে ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে, সে প্রশ্ন অর্থনীতিবিদরা করছেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সরকার বছরজুড়ে যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার তুলনায় দরিদ্রদের জন্য খাদ্য কর্মসূচি চালু রাখার ভর্তুকি কেন বেশি, এ প্রশ্নের উত্তরও সহজ নয়। তবে সরকার কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য চাহিদা বিবেচনায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। একটা সময় ছিল যখন আমন ধানের ওপর নির্ভরতা ছিল ব্যাপক। এ ফসল প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নষ্ট হলে তার প্রভাব দৈনন্দিন বাজারে পড়ত, সার্বিক অর্থনীতিতেও পড়ত। এখন সে অবস্থা নেই। আমন উঠতে না উঠতেই গম কাটা শুরু হয়। বোরো ধানের চাষের প্রস্তুতিও চলতে থাকে। বাজারে ধানের দাম বাড়লে কৃষক পরবর্তী মৌসুমে ফলন বাড়াতে উদ্যোগী হয়। এ অবস্থ্থায় সরকারকে বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী চলতে হবে। আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, আমলাতন্ত্রের কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া প্রায়শই দীর্ঘায়িত হয়, কখনও কখনও থাকে জটিলতা। বোরো ধানের বাম্পার ফলনের সময়েই খাদ্য আমদানি এর একটি উদাহরণ। বেসরকারি খাত এ তুলনায় অনেক নমনীয়তা দেখাতে পারে এবং সরকারকে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। এখন সময় এসেছে, খাদ্যের বাজারে হস্তক্ষেপে গোটা বছরের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নের পরিবর্তে স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সরকারি বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ অপচয় হয়, এ অভিজ্ঞতা নতুন নয়। দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ করা খাদ্য সাহায্যের সবটা তাদের উপকারে লাগে না, এ তথ্য সরকারের হাতে অবশ্যই থাকার কথা। আমন বা বোরো চাল বাজারে আসার সময় যখন খাদ্যের দাম অপেক্ষাকৃত কম থাকে এবং দিনমজুরদের কাজের সুযোগ বেশি থাকে, তখন বিপুল ভর্তুকি দিয়ে ওপেন মার্কেট সেল চালু রাখার যুক্তিই-বা কোথায়? সরকার যদি দক্ষতা বাড়াতে পারে, কম দামে কিনে বাজার একটু চড়া হলে তা বিক্রি করে তাহলেও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
সরকারের জন্য ভর্তুকি এক বড় সমস্যা। সার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ_ ভর্তুকির অনেক খাত। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে জ্বালানি খাতে অস্বাভাবিক অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ চলে যাচ্ছে ভর্তুকি বাবদ। এ জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ করতে হচ্ছে, যা বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের জন্য অর্থের জোগান প্রদানে ব্যাঘাত ঘটায়। এতে উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হয়। একই সঙ্গে তা মূল্যস্ফীতির কারণ হয়। জনতুষ্টির জন্য ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য বিক্রি করতে গিয়ে মূল্যস্ফীতিজনিত দুর্ভোগ ডেকে আনা কতটা সঙ্গত? সরকারকে বুঝতে হবে যে, তারা যেভাবে চলছে তাতে ম্যাক্রো অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতাও নষ্ট হচ্ছে।
মতিয়া চৌধুুরী দ্বিতীয় দফায় কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর কৃষি উপকরণের সরবরাহ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করে চলেছেন। সারসহ কোনো কোনো উপকরণে ভর্তুকি কমানো হলেও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ পেতে কৃষককে কোনো সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না। কিন্তু আসন্ন বোরো মৌসুমে সেচযন্ত্র চালাতে ডিজেলের মূল্য তাদের জন্য বাড়তি উদ্বেগের কারণ হতে পারে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে চলেছে। আমাদের তা আমদানি করে প্রতিদিনের চাহিদা পূরণ করতে হয়। কিন্তু সরকার নিয়মিত মূল্য সমন্বয় না করে কয়েক বছর পর তা করতে গিয়ে ভোক্তাদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। হঠাৎ করে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হওয়ায় ক্ষোভের মাত্রাও প্রবল হয়। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি দেখছি। বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতাজনিত সব সমস্যার সমাধান আমাদের হাতে নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা উন্নত করার মাধ্যমে আমরা তার চাপ কিছুটা হলেও সহনশীল রাখতে পারি বৈকি।
ড. মাহবুব হোসেন : কৃষি অর্থনীতিবিদ ও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা, ব্র্যাক
No comments