সেলিম আল দীন :একাল ভাবীকালে by লুৎফর রহমান
জীবিত সেলিম আল দীন এবং মৃত সেলিম আল দীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দ্বৈরথে মৃত সেলিম আল দীন বিপুল বিক্রমে বিজয়ী হন মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই। আবেগসর্বস্ব বাঙালির চিত্ত মথিত উচ্ছ্বাস সেদিন এই বঙ্গ-বদ্বীপ পরিব্যাপ্ত করে নিমেষেই। আজ আবেগ কতকটা অবসিত। থিতানো উচ্ছ্বাস বিচারিক বিবেচনাকে উত্তোলিত করেছে হয়তো। মৃত্যু-পরবর্তী প্রথম জন্ম ও প্রয়াণ দিবসের বর্ণিল ঔজ্জ্বল্য দ্বিতীয় প্রয়াণ দিবস এবং জন্ম-জয়ন্তীতে অক্ষুণ্ন ছিল সে ওই উন্মথিত আবেগগত কারণেই।
তৃতীয় প্রয়াণ দিবস এবং জন্মজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে নিষ্প্রভতা ছিল লক্ষণীয় মাত্রায়। এবং বোঝা যাচ্ছিল আবেগের স্থায়িত্বকাল যতটা হওয়া উচিত স্বাভাবিকভাবে এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে এবং তা মোটেই মন খারাপ করার মতো নয়। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অতি স্বল্প সময়ই পশ্চিম দিগন্তে তার আলোর তেজ অন্তরের রঙে রূপান্তরিত হয়ে জগৎচিত্ত অধিকার করে থাকে। তারপর দীর্ঘ রাতের অন্ধকারের ভিতরমুখো যাত্রা নিরন্তর। তার আলোক প্রভায় উদ্ভাসিত চাঁদ যদি থাকে, যদি সে রাহুগ্রস্ত না হয়, তবে দীর্ঘ রাতেও সূর্যের রূপান্তরিত সি্নগ্ধ প্রসন্ন আলোয় মনের পাখা মেলা যায়।
যুগস্রষ্টা শিল্পীর মৃত্যু_ বর্ণিত সূর্যাস্ত প্রসঙ্গের সঙ্গে তুলনীয়। শিল্পীর প্রদীপ্ত উপস্থিতির জন্য তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতেই পারেন_ পেতেই পারেন খ্যাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্মান, সম্মাননা এমনকি অর্থ-প্রতিপত্তিও। কিন্তু যদি তার চেতনার আলোয় কোনো পান্না সবুজ এবং চুনি রাঙা হয়ে না ওঠে তবে খাঁখাঁ অন্ধকার জীবিতকালে অর্জিত সব খ্যাতি-প্রতিপত্তি, সম্মানকে ম্লান করে দেয় অত্যল্পকালের মধ্যেই। সেলিম আল দীনের চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে প্রাণের দায় এবং কর্তব্যের মধ্যে একটা তীব্র দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উৎসবের রাজকীয় জৌলুসে পরিলক্ষিত হচ্ছে অনাড়ম্বরতার প্রগাঢ় ছাপ। নিরুপায়ের করুণ অভিব্যক্তি আবেগ ব্যাকুল ভক্তের চোখেমুখে। আপৎকালীন মানুষের বিপন্নতাও কারও কারও মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত। প্রশ্ন উঠেছে সেলিম আল দীন কতদিন আমাদের দিগদর্শন যন্ত্রস্বরূপ ইতিহাসের পাতায় অঙ্গুলিনির্দেশ-ভঙ্গিসমেত উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে। আমাদের প্রত্যক্ষ বর্তমান, দূর ভবিষ্যতের শিল্প-সাহিত্যের এবং সামাজিক জীবন সংগ্রামের জন্য সেলিম আল দীন কতটা প্রাসঙ্গিক, অপরিহার্য তা বিচার করতে বসা লোকের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।
এসব প্রশ্ন, বিচার-বিবেচনা অকুণ্ঠ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। নিশ্চয়ই সেলিম আল দীন পাঠের প্রত্যক্ষ ফল এসব। বাঙালির ইতিহাসের ভয়ংকর পাঠবিমুখতার এই কালে দু-দশ জন পাঠক সেলিম আল দীন পাঠ করছেন, এ সংবাদ অবশ্যই আনন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে সেলিম আল দীনের উজ্জ্বল উপস্থিতির খবরটিও আপ্লুত করে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সংবাদ সেলিম আল দীনের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের ওপর গবেষণা করতে আগ্রহী তরুণ গবেষকদের সংখ্যাবৃদ্ধি। মঞ্চে দৃশ্যকাব্যের শিখর ছোঁয়া প্রযোজনা উপস্থাপন সম্ভব না হলেও সেলিম আল দীনের নাটক প্রযোজনায় গভীরভাবে উৎসাহী তরুণ পরিচালকের সংখ্যা বাড়ছে। সেলিম আল দীন প্রতিষ্ঠিত নাট্যরীতি অনুসারী কিছুসংখ্যক তরুণ নাট্যকার ইতিমধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন_ একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসের দিগন্তকে করেছেন সম্প্রসারিত। আবহমান বাংলা নাটকের উপস্থাপনারীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সেলিম আল দীনের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি দেশের সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। উপর্যুক্ত এসবই যখন চাক্ষুষ দেখেছি তখন সেলিম আল দীনের বর্তমান অবস্থান এবং তাঁর ভবিষ্যৎ পরিণাম বিষয়ে নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তাই জাগে মনে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম অর্জন সেলিম আল দীন। বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস বিচিত্র পথগামী এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণের অবকাশ নেই কোনো। বর্ণোজ্জ্বল সেই বিচিত্র পথের একটির রেখাচিত্র থেকে শোভাযাত্রার উপযোগী শোভিত রূপের স্রষ্টার একক দাবিদার সেলিম আল দীন। ওই বিবেচনায় আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাসের রচয়িতা সারণিভুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া সে পথের অভিযাত্রী অন্য কোনো নাম নির্বাচন করতে পারবেন এমন বোধ হয় না। পূর্বোক্ত বক্তব্য এ উদ্দেশ্যেই উচ্চারিত যে, ঔপনিবেশিক নাট্য আঙ্গিক অনুসৃতির প্রচল প্রবাহ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় নতুন বাঁকে চলতে থাকেন এবং এই বাঁক পরিবর্তন সেলিম আল দীনের জীবনে মোটেও আকস্মিক নয়। নিরীক্ষা প্রবণতা সেলিম আল দীনের শিল্পী-প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্য_ এ সত্য তাঁর প্রতিটি রচনায় অনুসন্ধেয়। এবং নিবিষ্ট পাঠক, গবেষক নিশ্চয়ই এতদ্বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করবেন না। এবং এই নিরীক্ষাকর্মের ফলশ্রুতি তাঁর নাটকগুলো যে কালজয়ী হওয়ার সব যোগ্যতা বহন করে, সে বিষয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ রচয়িতার মনে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। আর নিম্নোক্ত আলোচনা সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পরিচালিত।
বাংলাদেশের মঞ্চের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক 'মুনতাসীর' [১৯৭৪-৭৫] তখনও চলছে। 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন' [১৯৭২] থেকে মুনতাসীর অবধি প্রযোজিত, প্রদর্শিত নাটক সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় নাট্যরসিক সমালোচকদের প্রশস্য সমালোচনা প্রকাশিত হচ্ছে। তন্মধ্যে দেশবরেণ্য পণ্ডিতদের রচনাও রয়েছে। এমন নয় যে, সৃজন-ঋতুতে প্রচণ্ড খরায় বিশুষ্ক শিল্পভূমির বন্ধ্যত্ব দূরীকরণার্থে নতুন বাঁকে চলতে বাধ্য হন। অর্থাৎ সেলিম আল দীন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে স্বতন্ত্র নাট্যরীতির অন্বেষণায় ব্যাপৃত হননি। তবে তো দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা বলাই যায়, ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য ছিল তাঁর আঙ্গিক নিরীক্ষার! সে ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত অন্য সব বাঙালির মতোই তিনি ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ খুঁড়ে স্বর্ণগর্ভা-ঐতিহ্য আহরণ করেন। বস্তুত সেলিম আল দীনের আশ্রয় ছিল মধ্যযুগের নাট্যমূলক উপস্থাপননির্ভর আখ্যান কাব্য। অবশ্য তিনি একা নন, বাংলা সাহিত্যের সিংহভাগের স্রষ্টা সার্বভৌম শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎপূর্বেই পেঁৗছে গিয়েছিলেন সেই সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের সিংহদরজায়। তাঁর প্রদর্শিত পথেই সেলিম আল দীন ভিন্ন এক চেতনায় নবীভূত হয়ে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে ব্রতী হন। নিজস্ব নাট্যরীতির যৌক্তিকতা, উপযোগিতা, বৈচিত্র্য এবং অভিনবত্বের জন্যই তিনি একালের ও ভাবীকালের বাঙালির ইতিহাসের নক্ষত্রপথে ঔজ্জ্বল্য ছড়াবেন।
রবীন্দ্র-নাট্যসাহিত্যে, কি কাব্যনাট্য, কি গদ্যনাটক সর্বত্রই ইউরোপীয় ঘটনা ও দ্বন্দ্বের প্রাধান্য অস্বীকৃত। চূড়ান্ত বিচারে রবীন্দ্র-নাটক ইউরোপীয় নাট্য আঙ্গিকবৃত্তের বাইরে ভিন্ন এক শিল্পনিরীক্ষার ফলশ্রুতি। আখ্যানের প্রাধান্য, ব্যক্তিচরিত্রের পরিবর্তে সমষ্টিকে একটি আদর্শের প্রতিভূরূপে চিত্রণ, নৃত্য-গীত, শিল্পিত সংলাপ, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কিত রসজ্ঞ বর্ণনা এবং আখ্যানে গল্পকথন রীতির উপস্থিতি রবীন্দ্র-নাটককে ইউরোপীয় নাট্যরীতি থেকে স্বতন্ত্রতা দান করে। সেলিম আল দীন সর্বাংশে রবীন্দ্র-ভাবনা বলয়ের স্রষ্টা। জীবন-জগৎ সম্পর্কিত উপলব্ধির সাযুজ্য এবং স্বীয় রচনাকে কেবল মঞ্চের সামগ্রী না করে উৎকৃষ্ট পাঠযোগ্য শিল্পের স্তরে উন্নীতকরণ প্রয়াসে উভয়ের চিন্তা ও সৃজন প্রয়াসের ঐক্য বিদ্যমান। উলি্লখিত বিবেচনায় সেলিম আল দীনের নাটকের নিম্নলিখিত বিশেষত্ব শনাক্ত করা যেতে পারে_
প্রথমত, ভারতবর্ষীয় প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল আনুগত্য। দ্বিতীয়ত, সমাজ বাস্তবতার অভ্যন্তরে চিরায়ত মানবতার অন্বেষা। তৃতীয়ত, নিজস্ব সৃষ্টিকে চিরায়ত শিল্পের সমকক্ষতাদানের অঙ্গীকার। চতুর্থত, ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির আগ্রাসনের বিপরীতে বাঙালির নিজস্ব নাট্যরীতির ও অভিনয়রীতির প্রতিষ্ঠা প্রয়াস। পঞ্চমত, প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্রচল বাংলা নাট্যরীতিকে যুগোপযোগী অবয়বদান ও এ কালের মানুষের শিল্পরুচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা। ষষ্ঠত, নাটককে নৃত্য-গীত-বাদ্য-বর্ণনা-সংলাপ এই পঞ্চ উপাদানের ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। সপ্তমত, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সৃষ্ট পাঁচালি, কথানাট্য, প্রচল আখ্যানকাঠামোর বাঁধা ছকটি ভেঙে নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশলের আশ্রয়ে তদস্থলে আখ্যানহীন, আখ্যান উপস্থাপন কৌশল প্রতিষ্ঠা [নিমজ্জন ২০০৬]। রবীন্দ্র-শিল্প পাঠের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ সেলিম আল দীন উপরোক্ত অভিপ্রায় থেকেই শিল্প সৃষ্টি অব্যাহত রাখেন আমৃত্যু। এক জীবনে বাংলা নাট্যসাহিত্যের ভাণ্ডারে তাঁর সঞ্চয় অবশ্য ঈর্ষণীয়।
উপর্যুক্ত তথ্যসূত্র মতে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা অসংগত নয় যে, অন্তর্লীন এক সৃজন বেদনা সর্বক্ষণ বয়ে বেড়িয়েছেন সেলিম আল দীন_ অধ্যয়ন করেছেন মানুষ, মানবসভ্যতার ইতিহাসের নানা কালের মানবসৃষ্ট সাহিত্য-শিল্প, আহরণ করেন সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঞ্চিত জ্ঞান। এবং আহরিত জ্ঞানের সবটুকু নির্যাস বিষয় ও চরিত্রের স্নায়ুরেখায় ন্যাস করেন শিল্পসৃজন দক্ষতায়। জাতীয়তাবাদ থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদে রবীন্দ্র চিন্তার বিবর্তন মূলত শিল্প-অভিজ্ঞতার সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশমান প্রবাহ। ইউরোপীয় সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা প্রতিপন্ন করেছেন 'সভ্যতার সঙ্কট' শীর্ষক প্রবন্ধে [রবীন্দ্র প্রবন্ধ সংগ্রহ, সময় প্রকাশন]। ওই রচনায় রবীন্দ্রনাথের ঔপনিবেশিকতাবিরোধী মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। 'রক্তকরবী '[১৯১২] নাটকে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর পীড়ন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কবির শাণিত বক্তব্য এবং সুদৃঢ় অবস্থান অভিব্যক্ত। 'মুক্তধারায়' [১৯২২] রবীন্দ্র-ভাবনা ভিন্নমাত্রা পায়_ সেখানে পরিলক্ষিত হয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির অমানবিক আচরণ কীভাবে উত্তরকুট, শিবতরাইয়ের জনগণের মধ্যকার নিপীড়নমূলক সম্পর্কের উদগাতায় পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শক্তির অমানবিক হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতার অভ্যন্তরে। মোদ্দাকথা রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নিজের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করেন নানা রচনার মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পাদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পী সেলিম আল দীন ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্যশীল। এতদ্বিষয়ে তিনি অগ্রজ শিল্পীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। ভারতবর্ষীয় পুরাণ [শকুন্তলা, প্রাচ্য ইত্যাদি] আত্মস্থ করার পর সেলিম আল দীন গ্রিক, ল্যাটিন পুরাণ [কীত্তনখোলা] খ্রিস্টীয় পুরাণ, মুসলিম পুরাণ [কীত্তনখোলা, হাত হদাই ইত্যাদি] এবং অতঃপর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর পুরাণ যেমন_ মারমা পুরাণ [একটি মারমা রূপকথা], গারো পুরাণ [কেরামতমঙ্গল, ধাবমান, ঊষা উৎসব ও স্বপ্ন রমণীগণ ইত্যাদি], সাঁওতাল পুরাণ [চাক], মান্দাই পুরাণ [বনপাংশুল] আত্মস্থ ও প্রয়োগ করেন স্বীয় সৃষ্টিকর্মের উৎকর্ষ সাধনে। তা ছাড়া বিভিন্ন লোকপুরাণ [কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই] ব্যবহারে সেলিম আল দীনের কৌতূহল অনন্যতায় উজ্জ্বল। পুরাণকে সমাজবাস্তবতার উপস্থাপনায় ব্যবহারের যে কৌশল বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সেলিম আল দীন সার্থকভাবে তার প্রয়োগ করেছেন। লোকসমাজে পুরাণ প্রাতঃস্মরণীয়_ তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন-সংগ্রামকে উপজীব্য করে রচিত তাঁর নাটকে সর্বত্রই পুরাণ অনুষঙ্গরূপে সমগুরুত্বে উপস্থাপিত।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ এবং এর অবক্ষয়িত আর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবয়ব নানাবিধ বিশ্বাস- সংস্কার, অশিক্ষা-অন্যায়, পীড়ন-নিপীড়ন, প্রতারণা-প্রণয়-বিচ্ছেদ, কাম-ক্রোধ-জিঘাংসা, প্রতিশোধ প্রবণতা-প্রতিহিংসা, বাৎসল্য, মানবিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাকার জীবনচর্যার জঙ্গমচিত্র সেলিম আল দীনের নাটকের মৌল শক্তি। শৈল্পিক বাস্তবতা সৃজনে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। পেশাজীবী নানা শ্রেণীর মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয় ক্ষরিত রক্তস্রোত তাঁর নাট্য-চরিত্রের ধমনী পথে দর্শক-পাঠকের চেতনায় পেঁৗছে। আগামী দিনের সমাজের তারাই নায়ক_ সেলিম আল দীন তাদেরই জীবনবাণীর কথক।
শিল্পকাণ্ডজ্ঞান, নিজস্ব ভাবনাকে ব্যাকরণসম্মত শিল্পে উন্নীত করার মুহূর্তে নতুন শিল্প-ব্যাকরণের তাদিগবোধ এবং তার স্রষ্টা হিসেবে সেলিম আল দীন বর্তমানে যতটা প্রাসঙ্গিক, ভাবীকালের মানুষের শিল্পী হিসেবে ততোধিক গ্রাহ্য হবেন এ সত্য অবশ্যমান্য। বিদ্যমান সমাজ-রাজনৈতিক-অবস্থায় সেলিম আল দীন এবং তাঁর নাটক জাতীয় সম্পদ। একাল সেকালে যতদিন আর্থ-সামাজিক অবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন না হবে ততদিন তাঁর নাটকের আবেদন অক্ষুণ্ন থাকবে। সেলিম আল দীন সৃষ্ট নাট্যভাষা বাংলা নাটকের ভাবীকালের নাট্যকারের ভাষায় পরিণত হবে এ উচ্চারণ কষ্টকল্প নয়। মোটকথা স্বল্প পরিসরের বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের অন্তিমে অবশ্য উচ্চার্য যে, নাট্য আঙ্গিক, নাট্যাভিনয়রীতি, রচনারীতি এবং সমাজবাস্তবতাকে শিল্প করার কৌশল এবং মঞ্চ ও পাঠ্য উভয় মাধ্যমে সমান উপযোগী টেক্সট রচনার মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। ভাবীকালের মঞ্চের পক্ষে তাঁকে অস্বীকার করা দুঃসাধ্য_ মঞ্চের পক্ষে তাঁকে ত্যাগ করা সম্ভব হলেও পাঠক সেলিম আল দীনকে আবিষ্কার করবে প্রতিদিন নতুন করে নতুন জীবনের প্রয়োজনে। তাই তিনি একালের এবং ভাবীকালেরও স্রষ্টা। হ
যুগস্রষ্টা শিল্পীর মৃত্যু_ বর্ণিত সূর্যাস্ত প্রসঙ্গের সঙ্গে তুলনীয়। শিল্পীর প্রদীপ্ত উপস্থিতির জন্য তিনি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠতেই পারেন_ পেতেই পারেন খ্যাতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সম্মান, সম্মাননা এমনকি অর্থ-প্রতিপত্তিও। কিন্তু যদি তার চেতনার আলোয় কোনো পান্না সবুজ এবং চুনি রাঙা হয়ে না ওঠে তবে খাঁখাঁ অন্ধকার জীবিতকালে অর্জিত সব খ্যাতি-প্রতিপত্তি, সম্মানকে ম্লান করে দেয় অত্যল্পকালের মধ্যেই। সেলিম আল দীনের চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে প্রাণের দায় এবং কর্তব্যের মধ্যে একটা তীব্র দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হচ্ছে। উৎসবের রাজকীয় জৌলুসে পরিলক্ষিত হচ্ছে অনাড়ম্বরতার প্রগাঢ় ছাপ। নিরুপায়ের করুণ অভিব্যক্তি আবেগ ব্যাকুল ভক্তের চোখেমুখে। আপৎকালীন মানুষের বিপন্নতাও কারও কারও মুখমণ্ডলে প্রদীপ্ত। প্রশ্ন উঠেছে সেলিম আল দীন কতদিন আমাদের দিগদর্শন যন্ত্রস্বরূপ ইতিহাসের পাতায় অঙ্গুলিনির্দেশ-ভঙ্গিসমেত উপস্থিত থাকবেন তা নিয়ে। আমাদের প্রত্যক্ষ বর্তমান, দূর ভবিষ্যতের শিল্প-সাহিত্যের এবং সামাজিক জীবন সংগ্রামের জন্য সেলিম আল দীন কতটা প্রাসঙ্গিক, অপরিহার্য তা বিচার করতে বসা লোকের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন।
এসব প্রশ্ন, বিচার-বিবেচনা অকুণ্ঠ অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। নিশ্চয়ই সেলিম আল দীন পাঠের প্রত্যক্ষ ফল এসব। বাঙালির ইতিহাসের ভয়ংকর পাঠবিমুখতার এই কালে দু-দশ জন পাঠক সেলিম আল দীন পাঠ করছেন, এ সংবাদ অবশ্যই আনন্দের। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে সেলিম আল দীনের উজ্জ্বল উপস্থিতির খবরটিও আপ্লুত করে। কিন্তু তার চেয়েও বড় সংবাদ সেলিম আল দীনের জীবন ও সৃষ্টিকর্মের ওপর গবেষণা করতে আগ্রহী তরুণ গবেষকদের সংখ্যাবৃদ্ধি। মঞ্চে দৃশ্যকাব্যের শিখর ছোঁয়া প্রযোজনা উপস্থাপন সম্ভব না হলেও সেলিম আল দীনের নাটক প্রযোজনায় গভীরভাবে উৎসাহী তরুণ পরিচালকের সংখ্যা বাড়ছে। সেলিম আল দীন প্রতিষ্ঠিত নাট্যরীতি অনুসারী কিছুসংখ্যক তরুণ নাট্যকার ইতিমধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন_ একই সঙ্গে বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসের দিগন্তকে করেছেন সম্প্রসারিত। আবহমান বাংলা নাটকের উপস্থাপনারীতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সেলিম আল দীনের বর্ণনাত্মক অভিনয়রীতি দেশের সর্বত্র অনুসৃত হচ্ছে। উপর্যুক্ত এসবই যখন চাক্ষুষ দেখেছি তখন সেলিম আল দীনের বর্তমান অবস্থান এবং তাঁর ভবিষ্যৎ পরিণাম বিষয়ে নিশ্চিন্ত নিশ্চয়তাই জাগে মনে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম অর্জন সেলিম আল দীন। বাংলাদেশের নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস বিচিত্র পথগামী এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণের অবকাশ নেই কোনো। বর্ণোজ্জ্বল সেই বিচিত্র পথের একটির রেখাচিত্র থেকে শোভাযাত্রার উপযোগী শোভিত রূপের স্রষ্টার একক দাবিদার সেলিম আল দীন। ওই বিবেচনায় আধুনিক বাংলা নাট্যসাহিত্যের বস্তুতান্ত্রিক ইতিহাসের রচয়িতা সারণিভুক্ত করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া সে পথের অভিযাত্রী অন্য কোনো নাম নির্বাচন করতে পারবেন এমন বোধ হয় না। পূর্বোক্ত বক্তব্য এ উদ্দেশ্যেই উচ্চারিত যে, ঔপনিবেশিক নাট্য আঙ্গিক অনুসৃতির প্রচল প্রবাহ থেকে তিনি স্বেচ্ছায় নতুন বাঁকে চলতে থাকেন এবং এই বাঁক পরিবর্তন সেলিম আল দীনের জীবনে মোটেও আকস্মিক নয়। নিরীক্ষা প্রবণতা সেলিম আল দীনের শিল্পী-প্রতিভার প্রধান বৈশিষ্ট্য_ এ সত্য তাঁর প্রতিটি রচনায় অনুসন্ধেয়। এবং নিবিষ্ট পাঠক, গবেষক নিশ্চয়ই এতদ্বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করবেন না। এবং এই নিরীক্ষাকর্মের ফলশ্রুতি তাঁর নাটকগুলো যে কালজয়ী হওয়ার সব যোগ্যতা বহন করে, সে বিষয়ে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধ রচয়িতার মনে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। আর নিম্নোক্ত আলোচনা সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই পরিচালিত।
বাংলাদেশের মঞ্চের অন্যতম জনপ্রিয় নাটক 'মুনতাসীর' [১৯৭৪-৭৫] তখনও চলছে। 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন' [১৯৭২] থেকে মুনতাসীর অবধি প্রযোজিত, প্রদর্শিত নাটক সম্পর্কে পত্র-পত্রিকায় নাট্যরসিক সমালোচকদের প্রশস্য সমালোচনা প্রকাশিত হচ্ছে। তন্মধ্যে দেশবরেণ্য পণ্ডিতদের রচনাও রয়েছে। এমন নয় যে, সৃজন-ঋতুতে প্রচণ্ড খরায় বিশুষ্ক শিল্পভূমির বন্ধ্যত্ব দূরীকরণার্থে নতুন বাঁকে চলতে বাধ্য হন। অর্থাৎ সেলিম আল দীন অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ থেকে স্বতন্ত্র নাট্যরীতির অন্বেষণায় ব্যাপৃত হননি। তবে তো দ্বিধাহীন চিত্তে এ কথা বলাই যায়, ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য ছিল তাঁর আঙ্গিক নিরীক্ষার! সে ক্ষেত্রে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত অন্য সব বাঙালির মতোই তিনি ইতিহাসের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ খুঁড়ে স্বর্ণগর্ভা-ঐতিহ্য আহরণ করেন। বস্তুত সেলিম আল দীনের আশ্রয় ছিল মধ্যযুগের নাট্যমূলক উপস্থাপননির্ভর আখ্যান কাব্য। অবশ্য তিনি একা নন, বাংলা সাহিত্যের সিংহভাগের স্রষ্টা সার্বভৌম শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তৎপূর্বেই পেঁৗছে গিয়েছিলেন সেই সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের সিংহদরজায়। তাঁর প্রদর্শিত পথেই সেলিম আল দীন ভিন্ন এক চেতনায় নবীভূত হয়ে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে ব্রতী হন। নিজস্ব নাট্যরীতির যৌক্তিকতা, উপযোগিতা, বৈচিত্র্য এবং অভিনবত্বের জন্যই তিনি একালের ও ভাবীকালের বাঙালির ইতিহাসের নক্ষত্রপথে ঔজ্জ্বল্য ছড়াবেন।
রবীন্দ্র-নাট্যসাহিত্যে, কি কাব্যনাট্য, কি গদ্যনাটক সর্বত্রই ইউরোপীয় ঘটনা ও দ্বন্দ্বের প্রাধান্য অস্বীকৃত। চূড়ান্ত বিচারে রবীন্দ্র-নাটক ইউরোপীয় নাট্য আঙ্গিকবৃত্তের বাইরে ভিন্ন এক শিল্পনিরীক্ষার ফলশ্রুতি। আখ্যানের প্রাধান্য, ব্যক্তিচরিত্রের পরিবর্তে সমষ্টিকে একটি আদর্শের প্রতিভূরূপে চিত্রণ, নৃত্য-গীত, শিল্পিত সংলাপ, পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কিত রসজ্ঞ বর্ণনা এবং আখ্যানে গল্পকথন রীতির উপস্থিতি রবীন্দ্র-নাটককে ইউরোপীয় নাট্যরীতি থেকে স্বতন্ত্রতা দান করে। সেলিম আল দীন সর্বাংশে রবীন্দ্র-ভাবনা বলয়ের স্রষ্টা। জীবন-জগৎ সম্পর্কিত উপলব্ধির সাযুজ্য এবং স্বীয় রচনাকে কেবল মঞ্চের সামগ্রী না করে উৎকৃষ্ট পাঠযোগ্য শিল্পের স্তরে উন্নীতকরণ প্রয়াসে উভয়ের চিন্তা ও সৃজন প্রয়াসের ঐক্য বিদ্যমান। উলি্লখিত বিবেচনায় সেলিম আল দীনের নাটকের নিম্নলিখিত বিশেষত্ব শনাক্ত করা যেতে পারে_
প্রথমত, ভারতবর্ষীয় প্রাচীন, মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যের প্রতি প্রবল আনুগত্য। দ্বিতীয়ত, সমাজ বাস্তবতার অভ্যন্তরে চিরায়ত মানবতার অন্বেষা। তৃতীয়ত, নিজস্ব সৃষ্টিকে চিরায়ত শিল্পের সমকক্ষতাদানের অঙ্গীকার। চতুর্থত, ঔপনিবেশিক শিল্পরীতির আগ্রাসনের বিপরীতে বাঙালির নিজস্ব নাট্যরীতির ও অভিনয়রীতির প্রতিষ্ঠা প্রয়াস। পঞ্চমত, প্রাচীন ও মধ্যযুগে প্রচল বাংলা নাট্যরীতিকে যুগোপযোগী অবয়বদান ও এ কালের মানুষের শিল্পরুচির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করা। ষষ্ঠত, নাটককে নৃত্য-গীত-বাদ্য-বর্ণনা-সংলাপ এই পঞ্চ উপাদানের ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো। সপ্তমত, বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সৃষ্ট পাঁচালি, কথানাট্য, প্রচল আখ্যানকাঠামোর বাঁধা ছকটি ভেঙে নিজস্ব উদ্ভাবনী কৌশলের আশ্রয়ে তদস্থলে আখ্যানহীন, আখ্যান উপস্থাপন কৌশল প্রতিষ্ঠা [নিমজ্জন ২০০৬]। রবীন্দ্র-শিল্প পাঠের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ সেলিম আল দীন উপরোক্ত অভিপ্রায় থেকেই শিল্প সৃষ্টি অব্যাহত রাখেন আমৃত্যু। এক জীবনে বাংলা নাট্যসাহিত্যের ভাণ্ডারে তাঁর সঞ্চয় অবশ্য ঈর্ষণীয়।
উপর্যুক্ত তথ্যসূত্র মতে নিঃসন্দেহে এ কথা বলা অসংগত নয় যে, অন্তর্লীন এক সৃজন বেদনা সর্বক্ষণ বয়ে বেড়িয়েছেন সেলিম আল দীন_ অধ্যয়ন করেছেন মানুষ, মানবসভ্যতার ইতিহাসের নানা কালের মানবসৃষ্ট সাহিত্য-শিল্প, আহরণ করেন সমাজ-রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সঞ্চিত জ্ঞান। এবং আহরিত জ্ঞানের সবটুকু নির্যাস বিষয় ও চরিত্রের স্নায়ুরেখায় ন্যাস করেন শিল্পসৃজন দক্ষতায়। জাতীয়তাবাদ থেকে আন্তর্জাতিকতাবাদে রবীন্দ্র চিন্তার বিবর্তন মূলত শিল্প-অভিজ্ঞতার সঙ্গে রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশমান প্রবাহ। ইউরোপীয় সভ্যতার অন্তঃসারশূন্যতা প্রতিপন্ন করেছেন 'সভ্যতার সঙ্কট' শীর্ষক প্রবন্ধে [রবীন্দ্র প্রবন্ধ সংগ্রহ, সময় প্রকাশন]। ওই রচনায় রবীন্দ্রনাথের ঔপনিবেশিকতাবিরোধী মনোভাব অত্যন্ত স্পষ্ট। 'রক্তকরবী '[১৯১২] নাটকে সাম্রাজ্যবাদী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর পীড়ন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে কবির শাণিত বক্তব্য এবং সুদৃঢ় অবস্থান অভিব্যক্ত। 'মুক্তধারায়' [১৯২২] রবীন্দ্র-ভাবনা ভিন্নমাত্রা পায়_ সেখানে পরিলক্ষিত হয় ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রশক্তির অমানবিক আচরণ কীভাবে উত্তরকুট, শিবতরাইয়ের জনগণের মধ্যকার নিপীড়নমূলক সম্পর্কের উদগাতায় পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক শক্তির অমানবিক হিংস্রতা প্রত্যক্ষ করেন জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পৈশাচিকতার অভ্যন্তরে। মোদ্দাকথা রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে নিজের সুদৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করেন নানা রচনার মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিল্পাদর্শে অনুপ্রাণিত শিল্পী সেলিম আল দীন ঐতিহ্যের প্রতি প্রগাঢ় আনুগত্যশীল। এতদ্বিষয়ে তিনি অগ্রজ শিল্পীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। ভারতবর্ষীয় পুরাণ [শকুন্তলা, প্রাচ্য ইত্যাদি] আত্মস্থ করার পর সেলিম আল দীন গ্রিক, ল্যাটিন পুরাণ [কীত্তনখোলা] খ্রিস্টীয় পুরাণ, মুসলিম পুরাণ [কীত্তনখোলা, হাত হদাই ইত্যাদি] এবং অতঃপর বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর পুরাণ যেমন_ মারমা পুরাণ [একটি মারমা রূপকথা], গারো পুরাণ [কেরামতমঙ্গল, ধাবমান, ঊষা উৎসব ও স্বপ্ন রমণীগণ ইত্যাদি], সাঁওতাল পুরাণ [চাক], মান্দাই পুরাণ [বনপাংশুল] আত্মস্থ ও প্রয়োগ করেন স্বীয় সৃষ্টিকর্মের উৎকর্ষ সাধনে। তা ছাড়া বিভিন্ন লোকপুরাণ [কীত্তনখোলা, কেরামতমঙ্গল, হাত হদাই] ব্যবহারে সেলিম আল দীনের কৌতূহল অনন্যতায় উজ্জ্বল। পুরাণকে সমাজবাস্তবতার উপস্থাপনায় ব্যবহারের যে কৌশল বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত, সেলিম আল দীন সার্থকভাবে তার প্রয়োগ করেছেন। লোকসমাজে পুরাণ প্রাতঃস্মরণীয়_ তাই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাত্যহিক জীবন-সংগ্রামকে উপজীব্য করে রচিত তাঁর নাটকে সর্বত্রই পুরাণ অনুষঙ্গরূপে সমগুরুত্বে উপস্থাপিত।
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ এবং এর অবক্ষয়িত আর্থনৈতিক-সাংস্কৃতিক অবয়ব নানাবিধ বিশ্বাস- সংস্কার, অশিক্ষা-অন্যায়, পীড়ন-নিপীড়ন, প্রতারণা-প্রণয়-বিচ্ছেদ, কাম-ক্রোধ-জিঘাংসা, প্রতিশোধ প্রবণতা-প্রতিহিংসা, বাৎসল্য, মানবিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাকার জীবনচর্যার জঙ্গমচিত্র সেলিম আল দীনের নাটকের মৌল শক্তি। শৈল্পিক বাস্তবতা সৃজনে তাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। পেশাজীবী নানা শ্রেণীর মানুষের যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয় ক্ষরিত রক্তস্রোত তাঁর নাট্য-চরিত্রের ধমনী পথে দর্শক-পাঠকের চেতনায় পেঁৗছে। আগামী দিনের সমাজের তারাই নায়ক_ সেলিম আল দীন তাদেরই জীবনবাণীর কথক।
শিল্পকাণ্ডজ্ঞান, নিজস্ব ভাবনাকে ব্যাকরণসম্মত শিল্পে উন্নীত করার মুহূর্তে নতুন শিল্প-ব্যাকরণের তাদিগবোধ এবং তার স্রষ্টা হিসেবে সেলিম আল দীন বর্তমানে যতটা প্রাসঙ্গিক, ভাবীকালের মানুষের শিল্পী হিসেবে ততোধিক গ্রাহ্য হবেন এ সত্য অবশ্যমান্য। বিদ্যমান সমাজ-রাজনৈতিক-অবস্থায় সেলিম আল দীন এবং তাঁর নাটক জাতীয় সম্পদ। একাল সেকালে যতদিন আর্থ-সামাজিক অবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন না হবে ততদিন তাঁর নাটকের আবেদন অক্ষুণ্ন থাকবে। সেলিম আল দীন সৃষ্ট নাট্যভাষা বাংলা নাটকের ভাবীকালের নাট্যকারের ভাষায় পরিণত হবে এ উচ্চারণ কষ্টকল্প নয়। মোটকথা স্বল্প পরিসরের বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের অন্তিমে অবশ্য উচ্চার্য যে, নাট্য আঙ্গিক, নাট্যাভিনয়রীতি, রচনারীতি এবং সমাজবাস্তবতাকে শিল্প করার কৌশল এবং মঞ্চ ও পাঠ্য উভয় মাধ্যমে সমান উপযোগী টেক্সট রচনার মধ্য দিয়ে সেলিম আল দীন স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে এড়িয়ে যাওয়া চলে না। ভাবীকালের মঞ্চের পক্ষে তাঁকে অস্বীকার করা দুঃসাধ্য_ মঞ্চের পক্ষে তাঁকে ত্যাগ করা সম্ভব হলেও পাঠক সেলিম আল দীনকে আবিষ্কার করবে প্রতিদিন নতুন করে নতুন জীবনের প্রয়োজনে। তাই তিনি একালের এবং ভাবীকালেরও স্রষ্টা। হ
No comments